Published : 01 Mar 2021, 06:54 PM
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অন্তরে যে শিশুটি চিরকাল আপন মহিমায় বিরাজিত ছিল সেটা আমাদের শিশু মনস্তত্ব ও শিশু শিক্ষার জন্যে খুবই জরুরি ছিল। রবীন্দ্রনাথের শৈশবের স্মৃতিচারণ বিষয়ক লেখার মধ্যে তার অন্তঃস্থিত শিশুটির যে স্বতস্ফূর্ত প্রকাশ ঘটেছে তার মর্মকথা ধারণ করতে পারলে আমাদের শিশু শিক্ষার বিস্তারে ব্যাপক প্রভাব রাখবে। শিশু শিক্ষা বিষয়ক রবীন্দ্রপাঠ থেকে জানা যায়, কলকাতা শহরের বক্ষ তখনো পাথরে বাঁধানো হয়নি, অনেকখানি কাঁচা ছিল। তেল-কলের ধোঁয়ায় আকাশের মুখে তখনো কালি পড়েনি। ইমারত-অরণ্যের ফাঁকায় ফাঁকায় পুকুরের জলের ওপর সূর্যের আলো ঝিকিয়ে যেত, বিকেলবেলায় অশ্বথের ছায়া দীর্ঘতর হয়ে পড়ত, হাওয়ায় দুলত নারকেল গাছে পত্র-ঝালর, বাঁধা নালা বেয়ে গঙ্গার জল ঝরণার মতো ঝরে পড়ত জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ির দক্ষিণ-বাগানের পুকুরে, মাঝে মাঝে গলি থেকে পালকি বেহারার হাঁই-হুঁই শব্দ আসত কানে, আর বড় রাস্তা থেকে সহিসের হেইও হাঁক। সন্ধ্যাবেলায় জ্বলত তেলের প্রদীপ তারই ক্ষীণ আলোয় মাদুর পেতে বুড়ি দাসীর কাছে শুনতুম রূপকথা। এই নিস্তব্ধ প্রায় জগতের মধ্যে শিশু রবীন্দ্রনাথ ছিলেন এক কোণের মানুষ। লাজুক, নীরব, নিশ্চঞ্চল। আরও একটা কারণ তাকে খাপছাড়া করেছিল। "আমি ইস্কুল-পালানো ছেলে, পরীক্ষা দিইনি, পাস করিনি, মাস্টার আমার ভাবীকালের সম্বন্ধে হতাশ। ইস্কুল ঘরের বাইরে যে অবকাশটা বাধাহীন সেইখানে আমার মন হাঘরেদের মতো বেরিয়ে পড়েছিল।…" [অবতরণিকা রবীন্দ্ররচনাবলী প্রথম খণ্ড (কবিতা) পঃ বঃ সরকার]। শিশুচিত্তে নির্মল আনন্দ দান যে শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য স্বাস্থ্যানুশীলনের পক্ষে অবশ্য-প্রয়োজন, একথার গুরুত্ব সেই বিদ্যাসাগরোত্তর যুগে স্বীকৃত পেয়েছিল। ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে যোগীন্দ্রনাথ সরকার মহাশয়ের রচিত 'হাসি ও খেলা' নামক গ্রন্থখানি প্রকাশের মধ্য দিয়েই 'শিশু-সাহিত্য'র এই যুগটির সূচনা বলা যায়। ১৩০১ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন সংখ্যার 'সাধনা' পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যোগীন্দ্রনাথ সরকার রচিত 'হাসি ও খেলা' গ্রন্থটির সম্বন্ধে যা লিখেছিলেন তার কিছুটা অংশ উদ্বৃত করছি। আমরা শিশুদের উপযোগী বই প্রকাশ করতে পারছি কিনা? শিশুদের মানসিক বিকাশে শিক্ষকরা কাজ করছেন কিনা? এগুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। যোগীন্দ্রনাথ সরকারের 'হাসি ও খেলা' বইটা কেন গুরুত্বপূর্ণ।
"…বইখানি ছোট ছেলেদের পড়বার জন্য। বাঙ্গালা ভাষায় এরূপ গ্রন্থের বিশেষ অভাব ছিল। ছেলেদের জন্য যে সকল বই আছে তাহা স্কুলে পড়িবার বই; তাহাতে স্নেহের বা সৌন্দর্য্যের লেশমাত্র নাই, তাহাতে যে পরিমাণে উৎপীড়ন হয় সে পরিমাণে উপকার হয় না।…আপাততঃ ছেলেদের ইচ্ছাপূর্ব্বক ঘরে পড়িবার বই রচনা করা অত্যন্ত আবশ্যক হইয়াছে; নতুবা বাঙ্গালীর ছেলের মানসিক আনন্দ ও স্বাস্থ্যনুশীলনের এবং বুদ্ধি বৃত্তির সহজ পুষ্টি সাধনের অন্য উপায় দেখা যায় না।"
শিশু শিক্ষা নিয়ে অনেক ভাবনা-চিন্তার প্রয়োজন আছে। উন্নত বিশ্বে শিশু শিক্ষা নিয়ে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া থাকে। আমি আর আমার স্ত্রী দু'জনেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মোটামুটি একই সময়ে পিএইচডি শেষ করেছিলাম; যখন পোস্টডক্টরেট করছি তখন আমাদের প্রথম পুত্র সন্তান জন্ম নেয় এবং আমার স্ত্রী কোনো চাকরি-বাকরি না করে ঘরে বসে আমাদের ছেলেটিকে দেখেশুনে রাখার সিদ্ধান্ত নিল। কয়েক মাসের একটা বাচ্চাকে নানাভাবে ব্যস্ত রাখার একটি প্রক্রিয়া হিসেবে সে আমাদের ছেলেটিকে বই পড়ে শোনাতে শুরু করল। প্রথম প্রথম সে বইটিকে টেনে নিয়ে সেটাকে দিয়ে কোনো এক ধরনের খেলা আবিষ্কারের চেষ্টা করলেও আট মাস বয়স হবার পর হঠাৎ করে সে বইয়ের দিকে নজর দিতে শুরু করল। আমরা মোটামুটি বিস্ময় নিয়ে আবিষ্কার করলাম দুরন্ত ছটফটে একটা শিশুকে খুব সহজেই বই পড়ে শুনিয়ে শান্ত করে ফেলা যায়। আমাদের ছেলের বয়স যখন আড়াই বছর তখন আমাদের মেয়ের জন্ম হয় এবং আমার স্ত্রী তার দুই ছেলেমেয়েকে দুই পাশে শুইয়ে বই পড়ে যেতে লাগল। দু'জন ছোট শিশু তাদের মায়ের দুই পাশে শুয়ে গম্ভীরভাবে বই পড়া শুনে যাচ্ছে দৃশ্যটি খুব মজার- আমি বেশ অবাক হয়ে সেটি উপভোগ করতাম।
ড. জাফর ইকবালের শিশু বিষয়ক একটা লেখা থেকে ক'টি লাইন থেকে এ পরিসরে উল্লেখ করা যেতে পারে। "আমার ছেলের বয়স যখন ঠিক চার বছরের কাছাকাছি তখন আমাদের একজন আমেরিকান প্রতিবেশী তার ছেলের জন্মদিনে আমাদের ছেলেকে দাওয়াত দিয়েছে। বিকেল বেলা গাড়ি করে বাসা থেকে তুলে নিয়ে কয়েকঘণ্টা পর ভদ্রমহিলা আমাদের ছেলেকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে যাওয়ার সময় আমার স্ত্রীকে বলল, 'তুমি তো আমাকে কখনো বলনি যে তোমার ছেলে সবকিছু পড়তে পারে'। আমার স্ত্রী আকাশ থেকে পড়ল, বলল, 'না। আমার ছেলে মোটেও পড়তে পারে না। তাকে আমরা একটা অক্ষরও পড়তে শেখাইনি।'…আমেরিকান ভদ্রমহিলা বলল, 'আমার কথা বিশ্বাস না হলে তুমি পরীক্ষা করে দেখ। জন্মদিনে আমার ছেলে অনেক গিফট পেয়েছে, গিফটগুলো জুড়ে দেওয়ার জন্য সাথে যে ইন্সট্রাকশন শিট ছিল তোমার ছেলে সেটা পড়ে পড়ে শুনিয়েছে অন্য সব বাচ্চা মিলে তখন সেগুলো জুড়ে দিয়েছে।' আমেরিকান ভদ্রমহিলা চলে যাওয়ার সাথে সাথে আমার হতবাক স্ত্রী একটা সিরিয়ালের বাক্স নামিয়ে আমার ছেলের হাতে দিয়ে বলল, 'এখানে কী আছে পড় দেখি।…আমার ছেলে গড়গড় করে সেটা পড়ে শোনাল। আমার স্ত্রী একটা শব্দ দেখিয়ে বলল, 'এটা বানান কর দেখি।'…আমার ছেলে ফ্যাল ফ্যাল করে আমার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে রইল, বানান? সেটা আবার কী? আমার স্ত্রী একটু পরেই আবিষ্কার করল সে একটা অক্ষরও চেনে না, কোনটা কোন অক্ষর জানে না, কিন্তু সবকিছু পড়তে পারে। আমি নিজের চোখে না দেখলে এটা বিশ্বাস করতাম না যে একজন মানুষ কোনো অক্ষর না জেনে পুরোপুরি পড়ে ফেলতে পারে। অনেক পরে সে যখন স্কুলে গিয়েছে তখন সে এ বি সি ডি শিখেছে!"
ক'বছর আগে একটি পত্রিকায় বিশেষ প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল যা আমাদেরকে ভীষণভাবে আশাবাদী করে। শিরোনামটা ছিল এ রকম 'ওরা স্কুলে যায় না, স্কুলই আসে ওদের কাছে'। ২০১২ সালে অস্ট্রিয়ান সংস্থা হোপ'৮৭-এর বাংলাদেশ শাখা বন্দর নগরী চট্টগ্রামে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য একটি বিদ্যালয়ের পরিকল্পনা হাতে নেয়। ঘটনাচক্রে তারা জানতে পারে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি'র অনুদানে পরিচালিত একটি বিশেষ স্কুলের কথা। বিশেষ এই স্কুলটি ছিল একটি বাসের ভেতর। বন্দর নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে শিক্ষা উপকরণ বহন করে নিয়ে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পড়াত স্কুলটি। তবে কয়েক বছর পর বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ে এ মহৎ উদ্যোগ। সহায়তার অভাবে একসময় এর কার্যক্রম বন্ধের উপক্রম হয় ভ্রাম্যমাণ এ স্কুলটির। বিষয়টি জানার পর হোপ'৮৭, বাংলাদেশের কর্মকর্তারা ভাবনায় পরিবর্তন আনলেন। তারা সিদ্ধান্ত নিলেন ঘুরে ঘুরে শিক্ষা দেওয়ার এই ভিন্ন ধরনের শিক্ষালয়টিকেই পুনরায় সচল করে তুলবেন তারা। সেই ভাবনা থেকেই 'নুরুল ইসলাম বিএসসি (সাবেক মন্ত্রী) মোবাইল কোয়ালিটি স্কুলের' নতুন করে হাল ধরলেন তারা। আবার চালু হলো মোবাইল স্কুল। ২০১৮ সাল থেকে রাজধানীতে কার্যক্রম শুরু করে 'নুরুল ইসলাম বিএসসি-হোপ মোবাইল কোয়ালিটি স্কুল'। বর্তমানে ইস্কাটন, জুরাইন, মিরপুর, রায়েরবাজারসহ রাজধানীর বেশ কয়েকটি পয়েন্টে চালু রয়েছে তাদের কার্যক্রম। চট্টগ্রামেও চলছে যথারীতি। এ স্কুলে শিশু থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পায় শিশুরা প্রতিটি পয়েন্টে তিন ঘন্টা ধরে শিশুদের পড়াশোনা করানোর পর রওনা হয় অন্য একটি পয়েন্টের উদ্দেশ্যে। এক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল – "আমরা প্রথমে একটা নির্দিষ্ট এলাকায় জরিপ চালিয়ে সুবিধাবঞ্চিত কর্মজীবী শিশুদের খোঁজ করি। কোনো এলাকায় ৫০ জন এমন শিশু পাওয়া গেলেই আমরা সেখানে গাড়ি পাঠাই। ঢাকায় শিক্ষকরা বিনা বেতনেই স্বেচ্ছায় বাচ্চাদের পড়ান। শিক্ষকদের বেশিরভাগই তরুণ। দেখা গেল, কোথাও আগে থেকেই সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে একটি স্কুল ছিল। কিন্তু রোদ বৃষ্টিতে বাচ্চাদের সেখানে পড়ালেখায় অসুবিধা হতো। আবার শিক্ষা উপকরণগুলো রাখা নিয়েও সমস্যা ছিল। কিন্তু বাস সেই সমস্যার সমাধান করেছে।" গত বছর ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ সফরকালে এই স্কুলের কার্যক্রম পরিদর্শন করে শিশুদের সঙ্গে সময় কাটান অস্ট্রিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কেবিন নেইসল।
২.
১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আইয়ুব খান জোর করেই দেশের ক্ষমতা দখল করে নেন। শেখ মুজিবসহ বহু নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে জেলে আটকে রাখেন। পাঁচ বছরের জন্য পুরো দেশে রাজনীতি বন্ধ করে দিলে গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্বমুহূর্তে শেখ মুজিবুর রহমান তরুণদের এক যুগান্তকারী নির্দেশ দিয়ে গেলেন। বললেন, "এই পাঁচ বছর তোমরা শিশু সংগঠন কচি-কাঁচার মেলার মাধ্যমে কাজ করো। নিজেদের সচল রাখো।" আমরা জানি দেশের ঐতিহ্যবাহী এই শিশু সংগঠনটি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশের মাত্র দুই বছর আগে অর্থাৎ ১৯৫৬ সালের ৫ অক্টোবর প্রতিষ্ঠিত হয়। এ জন্যই তিনি এমন নির্দেশ দিয়েছিলেন। কারণ বঙ্গবন্ধু জানতেন, কচি-কাঁচার মেলা প্রগতিশীল একটি শিশু সংগঠন। শিক্ষা, সংস্কৃতি চর্চা, খেলাধুলার মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক চেতনা, দেশ ও মানুষকে ভালোবাসার মানসিকতা বিকাশে শিশুরা সেখানে নিজেদের সুনাগরিক হিসেবে বেড়ে ওঠার প্রেরণা পাচ্ছে। শিশুরা দেশের যোগ্য নাগরিক হিসেবে নিজেদের গড়ে তোলার সুযোগ পাচ্ছে। ১৯৬৩ সালের কথা শেখ মুজিবুর রহমান তখনো বঙ্গবন্ধু উপাধি পাননি, জাতির পিতাও হননি। তবে আওয়ামী লীগের বড় নেতা। সেই সময়ই তিনি শিশুদের টানে ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাব চত্বরে কচি-কাঁচার মেলা আয়োজিত শিশু আনন্দমেলায় এসেছিলেন। শিশুদের প্রিয় মানুষ বঙ্গবন্ধু শিশুদের কল্যাণে ১৯৭৪ সালের ২২ জুন জাতীয় শিশু আইন (চিলড্রেন অ্যাক্ট) জারি করেন। এই আইনের মাধ্যমে শিশুদের নাম ও জাতীয়তার অধিকারের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। শিশুদের প্রতি সব ধরনের অবহেলা, শোষণ, নিষ্ঠুরতা, নির্যাতন, খারাপ কাজে লাগানো ইত্যাদি থেকে নিরাপত্তার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন-আজকের শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। ভবিষ্যতে দেশ গড়ার নেতৃত্ব দিতে হবে আজকের শিশুদেরই। তাই শিশুরা যেন সৃজনশীল, মননশীল এবং মুক্তমনের মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে-তিনি সব সময় সেটাই চাইতেন। অহিংসা দিয়ে, মানবপ্রেম দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে সমাজে যে আদর্শ বঙ্গবন্ধু নির্মাণ করে গেছেন তার মৃত্যু নেই, ক্ষয় নেই।
৩.
সঠিক শিশু শিক্ষাই শিশুর ভবিষ্যতের শিক্ষাক্ষেত্রের পরিধি নির্মাণ করে। সুতরাং শিশু পাঠদানের পর্ব পৃথিবীর সব শিক্ষিত সমাজে একটি অপরিহার্য কর্ম বলে গণ্য হয়। এই বাংলাও তার ব্যতিক্রম নয়, তবে বলে রাখা উচিত অভিভাবকগণ যতটা না শিশুর ভবিষ্যতের কথা ভাবে বা তার ভিত তৈরি করার কথা ভাবে তার চেয়ে বেশি ভাবে একটি নির্দিষ্ট সময় শিশুকে দূরে রেখে নিজেদের প্রয়োজনীয় কাজ করার কথা। বর্তমানে দিনে পরিবার ছোট হতে হতে ফ্ল্যাট সংস্কৃতিতে অধরা। আর সময়ের সাথে সাথে যুক্ত হয়েছে শিশু শিক্ষাপাঠের অবনির্মাণ, যা পুরানো ঐতিহ্যকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে চলেছে।
এত কিছু থাকা সত্ত্বেও আজও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'সহজ পাঠ' প্রাসঙ্গিক, এখানে শিশুদের খাবার, প্রকৃতি, গ্রাম বাংলার মাঝে নিয়ে যাওয়ার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে সহজ পাঠ। যখন আমরা সহজ পাঠ পড়ি তখন এটি আমাদের কাছে খুবই সাধারণ, কিন্তু তার গভীরে প্রবেশ করলে মনে হবে এটি কোনো উপন্যাসের থেকে কম নয়। ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় আমাদেরকে বর্ণের পরিচয় দিলেও, পরবর্তীকালে রবি ঠাকুর সেই বর্ণগুলিকে দিয়েছেন সুরের ছন্দ, দিয়েছেন শব্দের জাদু। সহজ পাঠ-এর পাতায় ধরা পড়ে পশুপাখির প্রতি ভালোবাসা, পশুপাখি ভালোবাসতে শেখা মানবিকতার একটি অবশ্যিক অঙ্গ। যারা পশুপাখির কষ্ট বোঝে না, তাদের বিনা কারণে কষ্ট দেয়, তারা মানুষকে অন্তর থেকে ভালোবাসবে, এমন হতে পারে না। সহজ পাঠ-এর প্রথম ও দ্বিতীয় পাঠে এই মানবিক শিক্ষার প্রসঙ্গ বারবার এসেছে, যেমন বলা যায় প্রথম ভাগের চতুর্থ পাঠে একটি কথা যেখানে বলা হয়েছে, "পাখি ওড়ে না, ওর পায়ে বেড়ি। ও আগে ছিল বনে, বনে নদী ছিল, ও নিজে গিয়ে জল খেত, দীনু এই পাখি পোষে। "রবীন্দ্রনাথ এ প্রসঙ্গে আর কিছু বলেননি, তবে তিনি শিশু মনে যে চিত্র স্থাপন করলেন তাতে এ কথা বলাই যায় যে শিশুটি সারাজীবন কখনও পাখিদের কষ্ট দেবে না। বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের একটি কথা উল্লেখ করা যেতে পারে, তিনি এক জায়গায় বলেছিলেন, "স্কুল, কলেজে শেখা অঙ্ক, ইতিহাস, ভূগোল ইত্যাদি সমস্ত ভুলে যাওযার পর, যা বাকি থাকে তা হলো শিক্ষা।" আর এখানেই সহজ পাঠ কৃতিত্ব রাখে। ছেলেবেলায় পড়া সব কিছু ভুলে গেলেও, সহজ পাঠের সেই শিক্ষা ভোলা যায় না। আমাদের এখন দেখা দরকার আমরা শিশু শিক্ষার জন্যে কতটা গুরুত্ব দিচ্ছি। শিশুদের জন্য কতটা শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে পারছি সেটা ভাববার সময় এসেছে। আগেকার দিনে ছিল শিক্ষার্থী, মাঝের সময়ে আসলো নম্বরার্থী, এবারের সময়টায় জিপিএর্থী। এই প্রক্রিয়ায় কোনভাবেই শিশুর মানসিক বিকাশ সম্ভব নয়।