Published : 10 Feb 2021, 01:21 PM
করোনাভাইরাস নামক অদৃশ্য শত্রুটি ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯ চীনের উহান প্রদেশে প্রথম শনাক্ত হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ২১ লক্ষেরও বেশি মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে, সংক্রামিত মানুষের সংখ্যা গিয়ে পৌঁছেছে ১০ কোটিতে। আমেরিকা ও ইউরোপ মহাদেশে এখনও চলছে মৃত্যুর মিছিল। প্রতিদিনই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা। করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় পর্যায়ের ঢেউ চলছে বিশ্বজুড়ে। এখনও পর্যন্ত স্থবির হয়ে আছে গোটা পৃথিবী। মানুষের সাথে মানুষের শারীরিক যোগাযোগ বিছিন্ন। মানুষ প্রতিষেধক টিকার জন্য হন্যে হয়ে আছে। বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির উৎকর্ষতার কারণে খুব তাড়াতাড়িই আবিষ্কৃত হয়েছে টিকা। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি উন্নত দেশ তাদের নিজ দেশের জনগণের মাঝে টিকা প্রয়োগ শুরু করে দিয়েছে।
জাতিসংঘের ৭৫ তম সাধারণ সন্মেলনে ভার্চুয়াল বক্তব্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা বিশ্ব নেতৃবৃন্দদেরকে আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, 'আমাদের সকলের ভাগ্য একই সূত্রে গাঁথা। যতক্ষণ পর্যন্ত না সকলের সুরক্ষা নিশ্চিত করা যাচ্ছে, আমরা কেউই সুরক্ষিত নই। কাজেই সকল দেশ যাতে এই ভ্যাকসিন সময়মতো ও একই সময় পায় তা নিশ্চিত করতে হবে'। কিন্তু দেখা যাচ্ছে প্রভাবশালী দেশগুলো শুধু নিজেদের জনগণের টিকার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। সেক্ষেত্রে উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর টিকাপ্রাপ্তি অনেক দূরহ হয়ে পড়বে। তবে এক্ষেত্রে ব্যতিক্রমধর্মী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদি। গত ১৭ ডিসেম্বর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার সাথে দ্বিপাক্ষিক ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, তার সরকার 'প্রতিবেশীর অগ্রাধিকার' নীতিতে পরিচালিত হচ্ছে এবং সেই নীতির 'এক নম্বর স্তম্ভ' হচ্ছে বাংলাদেশ। চলমান এই বছরটি মহামারীর জন্য অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং, তবে এর মধ্যেও ভারত বাংলাদেশের মধ্যে ভাল সহযোগিতা ছিল এবং ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রেও দুই দেশের সহযোগিতা থাকবে বলে ঘোষণা দেন। তারপরই দুই প্রধানমন্ত্রীর আলোচনার ভিত্তিতে বাংলাদেশের বেক্সিমকো ফার্মার সাথে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের মধ্যে টিকা বিনিময়ের চুক্তি স্বাক্ষর হয়। সে অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার টিকার অনুমোদন দেওয়ার এক মাসের মধ্যে সেরাম ইনস্টিটিউট বাংলাদেশকে টিকা দেবে বলে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়। প্রথমে পর্যায়েই ৫০ লাখ টিকা দেয় তারা। যেটা ২৫ জানুয়ারি বাংলাদেশে পৌঁছেছে। পরবর্তীতে প্রতিমাসে ৫০ লাখ করে মোট ৩ কোটি ডোজ টিকা সরবরাহ করবে তারা। কিন্তু তার আগেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী ২০ লাখ ডোজ টিকা উপহার হিসেবে পাঠিয়ে একটি বন্ধুত্বের দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন।
কোভিড-১৯ সংক্রমণ শুরু হওয়ার পরপরই ভারত সরকার করোনাভাইরাস প্রতিরোধ সামগ্রী দিয়ে বাংলাদেশের জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছিল। তখন দুইটি চালানের মাধ্যমে করোনাভাইরাস প্রতিরোধ সামগ্রী বাংলাদেশে পাঠানো হয়। প্রথম চালান ২৫ মার্চ ৩০ হাজার সার্জিক্যাল মাস্ক ১৫ হাজার হেড কভার এবং দ্বিতীয় চালানে এক লাখ হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন ট্যাবলেট ও পঞ্চাশ হাজার জীবানুমুক্ত স্যার্জিক্যাল ল্যাটেক্স গ্লাভস আসে।
ভারত থেকে বাংলাদেশ টিকা আমদানি করবে আর এক শ্রেণির লোক মুখ বুজে বসে থাকবে সেটা তো হতে পারে না। সেইসব দুষ্ট লোকেরা বিভিন্ন ধরনের গুজব, অপপ্রচার, বিভ্রান্তমূলক বক্তব্য দিয়ে মাঠ গরম করতে শুরু করল। এরই মধ্যে হঠাৎ করে গত ৩ জানুয়ারি সেরাম ইনস্টিটিউটের প্রধান নির্বাহী আদর পুনাওয়ালা সংবাদ মাধ্যমকে জানায়, সেরাম ইনস্টিটিউট কোন ভ্যাকসিন রপ্তানি করবে না। খবরটি বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত ছড়িয়ে পড়ে পুরো বাংলাদেশে। গণমাধ্যম, সোশ্যাল মিড়িয়ার মাধ্যমে খবরটি জনগণের মাঝেও ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। যারা সবসময় ভারত বিরোধীতায় মগ্ন থাকে, তারা তো সরকারের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করতে থাকে। তবে বাংলাদেশ নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার শ্রী বিক্রম দোরাইস্বামী ও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দ্রুততম সময়ের মধ্যেই জানিয়ে দেয়া হয় যে, এই সিন্ধান্ত বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। দিল্লির টিকা বাংলাদেশ পাবেই। মুহূর্তেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যায়।
সরকার কিন্তু টিকা কেনার ক্ষেত্রে শুধু সেরাম ইনস্টিটিউটই নয়, একাধিক বিকল্প ব্যবস্থা করে রেখেছে। কোভাক্সের কাছ থেকে টিকা পেতে ইতোমধ্যেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তহবিলে টাকা জমা দিয়েছে। সে টিকাও নিশ্চিতভাবে পাওয়া যাবে, হয়তো কিছুটা সময় লাগবে। এছাড়া বিভিন্ন দেশের আরো টিকা প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলোর সাথে দ্রুত টিকা প্রাপ্তির জন্য যোগাযোগ অব্যাহত রেখে চলছে।
এক শ্রেণির তথাকথিত পণ্ডিতরা প্রশ্ন তুলছে, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রোজেনকার তৈরি টিকা কেন তাদের কাছ থেকে না কিনে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে কেনা হচ্ছে? এখানে কি ভারতের ব্যবসায়িক স্বার্থকেই বড় করে দেখা হচ্ছে? বাস্তবতা মোটেও সেটা নয়। এ অঞ্চলে সেরাম ইনস্টিটিউটই অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রোজেনকার একমাত্র ডিস্ট্রিবিউটর। বর্তমানে বিশ্বে বিভিন্ন দেশে উৎপাদিত যেসব টিকার প্রয়োগ চলছে তারমধ্যে সেরাম ইনস্টিটিউটের টিকাই বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সবচেয়ে উপযোগী। এটি মাইনাস ২ থেকে মাইনাস ৮ ডিগ্রী সেলসিয়াসে সংরক্ষণ করতে হয়। অন্যদিকে ফাইজার বা মর্ডানার টিকা সংরক্ষণ করতে হয় মাইনাস ৭০ থেকে ৮০ ডিগ্রী সেলসিয়াসে। যার ব্যবস্থা আমাদের দেশে নেই।
করোনাভাইরাস প্রতিরোধে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এখন পর্যন্ত জরুরিভিত্তিতে তিনটি টিকাকে অনুমোদন দিয়েছে। এগুলো হলো যুক্তরাষ্ট্রের ফাইজার ও মর্ডানা এবং যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার যৌথ টিকা যেটা ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট উৎপাদনের দায়িত্ব পেয়েছে। বিশ্বের ধনী ও টিকা উৎপাদনকারী দেশগুলো তাদের নাগরিকদের দ্রুততার সাথে টিকা প্রয়োগ শুরু করে দিয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের দ্রুত টিকা পাওয়ার সম্ভাবনার অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছিল, সেসময়ই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্র ভারতেরর প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদী।
বাংলাদেশের একটি চক্র টিকা নিয়ে নানা মুখরোচক গল্প বাজারে ছড়াচ্ছে। তারা জেনে কিংবা না জেনেই মানুষকে বোকা বানাতে চাচ্ছে। দেশের ভিতরে সরকারবিরোধী একটি চক্র সুপরিকল্পিত ভাবে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবার চেষ্টা করে যাচ্ছে যে, ভারতকে সুবিধা দিতেই বেশি দামে টিকা কেনা হচ্ছে। এই প্রযুক্তির যুগে সত্যকে মিথ্যা দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করা যায় না। বাস্তব সত্যটা হলো অক্সফোর্ডের টিকা দেশ বা অঞ্চল ভেদে সর্বনিম্ন ২.৭০ ডলার থেকে সর্বোচ্চ ৩৭ ডলার পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও অক্সফোর্ডের টিকা ৪ ডলার করে প্রতি ডোজ কিনে নিচ্ছে। শুধু যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের দেশগুলোর ক্ষেত্রে দামটা একটু কম। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটও বাংলাদেশকে দেয়া প্রতি ডোজের দাম নিচ্ছে ৪ ডলার। এটা যদি অন্য কোন দেশ থেকে আনা হতো তাহলে পরিবহন ব্যয় দিয়ে এর দাম কম করে হলেও তিন গুণেরও বেশি হতো।
এখন কোভিড-১৯ থেকেও বেশি আলোচনা চলছে ভ্যাকসিন নিয়ে। মানুষ দ্রুতই বন্দীদশা থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার জন্য অস্থির হয়ে আছে। যেকোন মূল্যে মানুষ এখন ভ্যাকসিন চায়। ইতোমধ্যে ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু হয়ে গেছে। ধনী দেশগুলো তাদের নাগরিকদেরকে ভ্যাকসিন দিচ্ছে। তারা শুধু নিজেদের কথাই ভাবছে, অন্যদেশকে সাহায্য করা, কিংবা অতিমহামারীর বিরুদ্ধে একসাথে লড়াই করার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সেক্ষেত্রে ভারত সরকারই এতমাত্র ব্যতিক্রম মনোভাব দেখিয়েছে। ভারত বাংলাদেশ ছাড়াও নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ, শ্রীলংকা, মিয়ানমার ও মরিশাসকে ভ্যাকসিন উপহার হিসেবে দিচ্ছে।
২১ জানুয়ারি বাংলাদেশের কাছে একটি ঐতিহাসিক দিন হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এই দিন ২০ লক্ষ ডোজ ভ্যাকসিন বিনামূল্যে বাংলাদেশ সরকারকে উপহার হিসেবে হস্তান্তর করে ভারত সরকার। কথায় আছে সংকটেই প্রকুত বন্ধুত্বের পরিচয়। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে যেভাবে পাশে দাঁড়িয়েছিল, ঠিক এই সময়ের মহামারী যুদ্ধেও বাংলাদেশকে করোনার টিকা দিয়ে জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে সত্যিকারের বন্ধুর পরিচয় দিল ভারত।