Published : 06 Sep 2020, 10:44 PM
আমার কর্মস্থল থেকে বাড়ি ফেরার পথে প্রায়ই রাত হয়। বড় রাস্তার মোড়ে রিকশা ছেড়ে দিয়ে পাড়ার মুদি দোকান আর শাকসবজি-র ভ্যানগাড়ি থেকে টুকিটাকি কেনাকাটা করতে করতে আমি বাসা পর্যন্ত যাই। বড় রাস্তার মোড় থেকে যে গলিটা বাসার দিকে গেছে তার মুখেই একটা জনপ্রিয় ফ্রায়েড চিকেন এর আউটলেট। দিনরাত সেখানে লোকের ভিড় লেগেই থাকে। 'বুড়ি' আর 'বুড়ু' সেই রেস্তোরার দরজার মুখে দাঁড়িয়ে থাকে উচ্ছিষ্ট খাবারের আশায়, সেখানকার কর্মচারীদের বদৌলতে মাঝেমাঝে মিলেও যায়।
একবেলা একটু পেটে পড়লেই সারাদিনের জন্য নিশ্চিন্ত। কিন্ত আমাকে দেখলেই ক্ষুধা ভুলে, খাবারের টান ভুলে হইহই করতে করতে ওরা আমার দিকে ছুটে আসে। ব্যক্তিগত প্রহরীর মতো আমার পেছন পেছন চলতে থাকে। আমি যে যে দোকানে যাই আমার পাশে ধৈর্য ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। কোন অপরিচিত লোক দেখলে তাদের আমার কাছে ঘেঁষতে দেয়না, মৃদুশব্দে সতর্ক করে দেয়। কোন কোন দিন আমি হয়তো কিছু একটা কিনে খেতে দিই, কোন কোন দিন দিইনা। তবু তাদের প্রতি আমার মায়াটুকু মনে রেখে তারা প্রসন্ন মুখে আমার সাথে সাথে বাড়ির দোরগোড়া পর্যন্ত চলে, আমি লিফটে পা রাখা পর্যন্ত গেটের গ্রিলের ফাঁক গলে আমার দিকে উজ্জ্বল চোখে তাকিয়েই থাকে। বোবা না হলে হয়তো "আবার দেখা হবে, ভালো থেকো" এই জাতীয় কিছু বলে বিদায় নিতো; নির্বাক বলে আমার সামান্য স্নেহের প্রতিদানে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে নিরবেই। বুড়ি আর বুড়ু, আমার পাড়ার দুই পথকুকুর; যারা রাস্তায় থাকে বলে রাতে বাড়ি ফিরে আমি মা-কে অভয় দিয়ে বলি; "বুড়ি আর বুড়ু সারাক্ষণ আমার পিছু পিছু থাকে, দুশ্চিন্তার কিছু নেই!"
অথচ বছর পাঁচেক আগেও আমি এমন ছিলাম না। পরিচিত সকলেই আমার প্রচণ্ড কুকুর ভীতি সম্পর্কে জানতো। ছোটবেলা থেকেই গ্রামের বাড়ির পোষা কুকুর 'ডন' ছাড়া পৃথিবীর তাবৎ কুকুরকে আমি ভয় পেতাম। রাস্তায় হেঁটে যাবার পথে অপরিচিত কুকুর দেখলেই আমি সভয়ে অন্য পাশে সরে যেতাম। সেই ভীতি আচমকা কেটে গেল বছর দুয়েক আগে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখে। আমাদের এলাকাতেই চারটি কুকুর ছানা গাড়ি চাপা পড়ে মারা গেল। মা কুকুরটি একবার বাচ্চাদের কাছে যাচ্ছিল, জিভ দিয়ে চেটে রক্ত মুছে দিচ্ছিল; আর সেই সাথে পথ চলতি প্রতিটা মানুষের পায়ের কাছে গিয়ে করুণ স্বরে আর্তনাদ করছিল। সেই দৃশ্য দেখে সেদিন আমি রাস্তার কুকুরের মাঝে এক অসহায় মাতৃরূপ আবিষ্কার করলাম; সন্তান হারিয়ে যার মানুষের মতোই যন্ত্রণা হয়, ক্ষুধা-তেষ্টায়-নিরাশ্রয়ে সকল প্রাণীর মতোই কষ্ট পায়, কিন্ত নির্বাক প্রাণী বলে সেই বোবা আর্তনাদ আর মিনতি প্রকাশ করতে পারেনা। সেদিনের পর থেকে আস্তে আস্তে ভয় কাটিয়ে পৃথিবীতে মানুষের সবচেয়ে বিশ্বস্ত সহচর প্রাণীদেরকে নতুন চোখে দেখার শুরু; স্রষ্টার সৃষ্টিদর্শনকে নতুনভাবে খানিকটা বুঝতে পারা। তবে আমার ব্যক্তিগত বোধোদয় আমি কখনো অন্যের কাছে প্রকাশে উদ্যোগী হতাম না যদি অত্যন্ত হতাশা ও গভীর উদ্বেগের সাথে "ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এর নগরবাসী বেওয়ারিশ কুকুর নিধন বা স্থানান্তর করবার অসহিষ্ণু দাবি নিয়ে মানববন্ধন করেছে" এই খবরটি চোখে না পড়তো। সেই সাথে আমার উৎকণ্ঠা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে যখন পত্রিকা মারফত জানতে পেরেছি, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন ৩০ হাজার বেওয়ারিশ কুকুর স্থানান্তরের মতো একটি 'নির্দয়' ও 'আত্মঘাতী' সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত তাদের হয়তো বোধোদয় হয়েছে। এখন বলছে, 'কুকুর সরানোয় সমাধান নেই'।
২.
২০১৯ সালের প্রাণী কল্যাণ আইন অনুসারে মালিকানাবিহীন কোন প্রাণী নিধন বা স্থানান্তর দন্ডণীয় অপরাধ। ২০১৪ সালে একটি প্রাণিপ্রেমী সংগঠনের রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে কুকুর নিধনে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে আদালতেরও। আইনি বিধান ছাড়াও পুরো বিষয়টি নিষ্ঠুর, নির্দয় এবং অমানবিক। কেননা, প্রাণিকুলের নিয়ম অনুযায়ী পথ কুকুরদের একটি নির্দিষ্ট এলাকা থাকে, তাদেরকে স্থানচ্যুত করলে ঐ এলাকার বাস্তুচক্র যেমন বিঘ্নিত হবে তেমনি নতুন এলাকায় এই স্থানান্তরিত কুকুররা খাদ্যের সংস্থান করতে পারবেনা, অন্য কুকুরদের আক্রমণের শিকার হবে এবং অচিরেই মারা যাবে। আবার অন্যদিকে যে এলাকায় কুকুর সরিয়ে নেওয়া হবে সেখানের পরিবেশের শৃঙ্খলাও বিঘ্নিত হবে। আজ যে স্থানান্তরের কথা এক এলাকার মানুষ বলছে কাল তা অন্য এলাকার মানুষ বলবে। তখন সিটি কর্পোরেশনকে নতুন কোন উপায় খুঁজতে হবে। অর্থাৎ পথ কুকুরদের স্থানান্তরিত করায় নাগরিকদের সমস্যার কোন স্থায়ী সমাধান হবে না, কুকুরের পাশাপাশি সমস্যা ও অভিযোগ গুলোও স্থানান্তরিত হবে কেবল।
শহরের পথপ্রাণীদের কীভাবে নিয়ন্ত্রণ ও রক্ষনাবেক্ষণ করা যায় সেই বিষয়ে পৃথিবীর বহুদেশ টেকসই সমাধান গ্রহণ করেছে। সেখানে নগর কর্তৃপক্ষ পথপ্রাণিদের নিয়মিত টিকা দেয় এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বন্ধ্যাকরণ বা নিবীর্যকরণ করে। ফলে নাগরিকরা কুকুরের আগ্রাসন ও কুকুরের কামড়ে রোগাক্রান্ত হবার ভয় থেকে মুক্ত থাকে ও শহরের পথ কুকুরদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে থাকে। তুরস্কের কথাই উদাহরণ হিসেবে নেওয়া যাক। এখানকার বিভিন্ন শহরের বিভিন্ন স্থানে পথ প্রাণীদের জন্য খাবার ও পানি রাখা থাকে। নগরের উপাসনালয়গুলোর দ্বার পথ কুকুরদের আশ্রয়স্থান হিসেবে খোলা থাকে। ফলে ক্ষুধার্ত নিরাশ্রয় প্রাণীর করুণ আর্তনাদ নগরীতে ভেসে বেড়ায় না।
পথপ্রাণীদের ব্যবস্থাপনার আরেকটি টেকসই ও কার্যকর পদ্ধতি হলো "পারটিসিপেটরি কমিউনিটি ম্যানেজমেন্ট"। আগেকার দিনে গ্রামের বাড়িতে কয়েক ঘরের বাসিন্দা মিলে যেমন একটি বা দুইটি কুকুর এর খাবারের সংস্থান করতো, ঠিক তেমনি একটি নির্দিষ্ট এলাকার মানুষেরা সমন্বিতভাবে সেই এলাকার পথকুকুরদের খাবার, টিকা, বন্ধ্যাত্বকরণ (স্পে অ্যান্ড নিউটার) এর ব্যবস্থা করতে পারে। প্রতি ঘরের প্রতিদিনের খাবারের অবশিষ্টাংশ এবং প্রতি বাড়ি থেকে সংগৃহীত একটি সামান্য অংকের বাৎসরিক চাঁদাতেই সেটা করা সম্ভব। এর ফলে এলাকায় কুকুরের সংখ্যার সাম্যাবস্থা থাকবে, ক্ষুধার্ত কুকুর পথে পথে ঘুরবেনা, নিবীর্যীকরণের ফলে কুকুরের আকস্মিক আগ্রাসনও কমে যাবে এবং মানুষের সাথে পথকুকুরদের বন্ধুত্বসূচক বিশ্বস্ত সহাবস্থান বজায় থাকবে।
প্রাণীদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের চিন্তাটি অভিনব নয়। খোদ মানুষই পৃথিবীর সীমিত সম্পদের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে নানাবিধ কৌশল ও প্রক্রিয়ার আশ্রয় নেয়। কুকুরদের ক্ষেত্রেও সেরকম কৌশল ও প্রক্রিয়া গ্রহণ করেই বিদ্যমান সমস্যার সমাধান হতে পারে। কিন্ত প্রাণিহত্যা সেই কৌশলের অংশ হতে পারেনা কিছুতেই। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এর একটি চমৎকার উদ্যোগ হলো-রাস্তার কুকুরদের জন্য জলাতংক টিকা প্রদান। গত বছরেও তারা শহর জুড়ে পথকুকুরদের জলাতংক টিকা দিয়েছিল। টিকা দেওয়া হয়েছে কী না তা চিহ্নিত করতে ব্যবহার করেছিল গোলাপী রঙ ও কানে একটি ইয়ারমার্ক। নগর কর্তৃপক্ষের সেই উদ্যোগে নাগরিকরা জলাতংক ভীতি মুক্ত হয়েছিল। এবারেও নগর কর্তৃপক্ষ এমন কোনও ইতিবাচক প্রাণীকল্যাণমুলক উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে।
পথ কুকুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে প্রাণীবিদ ও পথপ্রাণিদের নিয়ে কাজ করে এজাতীয় সংগঠনগুলোর সাথে আলোচনা করে এমন একটি টেকসই কৌশল গ্রহণ করতে পারে যাতে সমস্যার সমূল সমাধান হয় এবং প্রতিটি প্রাণ সস্থানে সুরক্ষিত থাকে। সাস্টেইনেবল ডেভেলপমেন্ট এর এই সময়ে বাংলাদেশ সরকারের এজেন্ডা হলো সকল প্রতিষ্ঠানের মাঝে পারষ্পরিক যোগাযোগ ও সমন্বয় প্রতিষ্ঠা করে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা। এই উদ্দেশ্যে যে পরিকল্পনা কাঠামোটি নির্মাণ হয়েছে সেখানে সাস্টেইনেবল সিটি অর্থাৎ টেকসই নগরী গড়ে তোলার জন্য এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করতে বলা হয়েছে যাতে করে সকল প্রাণীর নিরাপদ সহাবস্থান নিশ্চিত হয়। সরকারের সকল প্রতিষ্ঠান যেখানে টেকসই উন্নয়ন এর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে নানান পন্থা গ্রহণ করছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন কেন তাতে সামিল হবে না?
৩.
পথ কুকুর নিধন কিংবা স্থানান্তর করার সিদ্ধান্তটি কেন আমাদের জন্য আত্মঘাতী, এবার আসি সে আলাপে। সমগ্র পৃথিবীর প্রাণ-প্রকৃতি যে বাস্তুতান্ত্রিক নিয়ম মেনে চলে সেখানে প্রতিটি প্রাণির অস্তিত্বই একে অন্যের সাথে পরোক্ষভাবে সংযুক্ত এবং প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় প্রতিটি প্রাণীই গুরুত্বপূর্ণ। শহরের রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো যে কুকুরদের আমরা দেখি, আপাতদৃষ্টিতে যে রুগ্ন-ক্লিষ্ট কুকুরদের দেখে আমরা বিরক্ত হই; এই শহরের আমাদের নিরাপদে বেঁচে থাকার পেছনে তাদের ভূমিকা তুচ্ছ নয়। রাস্তাঘাটের এই ভাসমান কুকুররাই উচ্ছিষ্ট খাবার খেয়ে এই শহরকে আবর্জনা মুক্ত রাখে। ড্রেনের পানি খেয়ে কমিয়ে দেয় মশার লার্ভা। এরা না থাকলে ঢাকার মতো ছোট আয়তনের শহরে অধিক জনসংখ্যার চাপে বর্জ্যব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়া আরো নাজুক হয়ে পড়তো, আরো অবনতি হতো মশাবাহিত রোগ সংক্রমণের। ঢাকা শহরের কাক ও রাস্তার কুকুরেরা মিলে আবর্জনার বোঝা কমিয়ে শহরবাসীকে অনেক প্রকার অজানা জীবানুবাহী রোগ-ব্যাধি-মহামারী থেকে নিরাপদ রাখে। ম্যানহোল ও ড্রেনের ইঁদুর ও ছুঁচো জাতীয় প্রাণীর প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে থাকে রাস্তায় কুকুরের বিচরণ এর কারণে। এই রাস্তার কুকুরেরাই আপনার-আমার এলাকার অতন্ত্র প্রহরী, আমরা তাদের খেয়াল না করলেও তারা তাদের প্রবৃত্তি থেকেই আসা-যাওয়ার পথের আমাদেরকে মনে রাখে, তাই মাঝরাতে এলাকায় কোন আগন্তুক কিংবা অসময়ে আসা কোন গাড়ি দেখলে সজোর চিৎকারে সতর্কবার্তা পৌঁছে দেয়, বাড়ির গেটের সিকিউরিটি বক্সে ঝিমুতে থাকা দারোয়ান তাতে আড়মোরা ভেঙে সজাগ হয়, আর আমরা রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমাই।
সভ্যতার শুরু থেকে যখন মানুষ শিকার করে খাদ্য সংস্থান করতো তখন থেকেই কুকুর তার বিশ্বস্ত সঙ্গী। সেই প্রাচীন কালের মানুষ জানতো খাদ্য ও সহমর্মী আচরণ এর মাধ্যমে এই বন্য প্রাণীটিকে কী করে মানুষের বিশ্বস্ত অনুচরে রূপান্তরিত করা যায়, শিকার এবং পালিত পশুর পাহাড়ায় কাজে লাগানো যায়। বর্তমান কালের মানুষেরা যদিও শিকার করে জীবন নির্বাহ আর করেনা কিন্ত এই কালের কুকুরেরা এখনো মানুষের নিরাপত্তাপ্রহরীর কাজ করে যাচ্ছে। খেয়াল করলেই দেখা যাবে, মানুষের মতোই পথকুকুরদেরও দিন কাটে ক্ষুধা-তেষ্টা আর আশ্রয়ের সন্ধানে। রাস্তায় ঘুরে ঘুরে তারা খোঁজে একটু খাবার- যা উচ্ছিষ্ট আবর্জনা হলেও আপত্তি নেই, একটু পানি-যা ড্রেনের হলেও তারা বিনা প্রতিবাদে মুখ ডুবিয়ে তেষ্টা মিটিয়ে নেয় আর রোদঝড়বৃষ্টিতে এক চিলতে নিরুপদ্রব আশ্রয় চায়-যেখানে কেউ তাদের লাঠি দিয়ে মারবেনা, তাদের গায়ে গরম পানি ঢালবেনা। নানাবিধ অমানবিক অত্যাচারের অভিজ্ঞতার কারণে তারাও বরং মানুষকে ভয় পায়; কখনো কখনো 'ঘেউ' 'ঘেউ' ডাক সমেত তেড়ে যায় কেবলই কোন ভীতিকর ঘটনার আশংকা ও অভিজ্ঞতা থেকে, এটুকুই তাদের অস্তিত্ব রক্ষার একমাত্র বর্ম বলে। আর যদি বিপরীত অভিজ্ঞতা হয়, মানুষের কাছ থেকে সামান্য খাবার আর করুণা পায়; তবে আজীবন তারা সেই কৃতজ্ঞতা বহন করে চলে।
ঢাকাবাসীদের একাংশ মনে করছে যে, রাস্তার কুকুরদের সংখ্যা ও দৌরাত্ম্য বেড়েছে যা তাদেরকে নানাবিধ অসুবিধায় ফেলেছে। তাই এদেরকে সরিয়ে ফেলতে হবে শহরের পথঘাট অলিগলি থেকে। এদের অভিযোগ মূলত কুকুরের কামড়, মাঝরাতে কুকুরের তাড়া খেয়ে এক্সিডেন্ট, কুকুরের চিৎকারে ঘুমের ব্যাঘাত ইত্যাদি বিষয়ে। প্রথমত, নিজেকে বিপন্ন বোধ না করলে শুধু কুকুর নয় এমনকী কোন সরিসৃপ প্রাণীও অন্যকে আক্রমণ করেনা। মানুষের কাছ থেকে পাওয়া নৃশংস আচরণ পথকুকুরদেরকে মানুষের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দিহান করে তোলে। অর্থাৎ, আমরা যদি তাদের আঘাত না করি, তাদের মতো করে বাঁচতে দিই তাহলে তারাও আমাদের পথ আগলে দাঁড়াবেনা। দ্বিতীয়ত, কুকুর চিৎকার করে ক্ষুধায়, কিংবা কিছু দেখে ভয় পেলে অথবা কোন অস্বাভাবিক কিছু দেখে সন্দেহ হলে। প্রতি এলাকার বাসিন্দারা যদি তাদের রান্নাঘরের উদ্বৃত্ত-উচ্ছিষ্ট খাবারটুকুও এই কুকুরদের জন্য বরাদ্দ রাখেন তবে এই ক্ষুধার্থ আর্তনাদ থেমে যাবে। হাতের কাছের উদাহরণ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের কথাই ধরুন, এই ক্যাম্পাসে প্রায় দেড়-দুইশ কুকুর আছে, হল ক্যান্টিনের উচ্ছিষ্ট খাবার আর শিক্ষার্থীদের সহানুভূতিতে এরা বেঁচে থাকে। এই কুকুরেরা কখনো কাউকে কামড়ে বিক্ষত করেছে এমন অভিযোগ কিন্তু আসেনি।
তৃতীয়ত, কুকুর বাইক বা গাড়ি দেখলে তাড়া করে মূলত দুই কারণে- এক, গাড়ি বা বাইক চাপা পড়ে কুকুর মারা যাবার-আহত হবার অতীত ট্রমার কারণে; দুই। অসময়ে এলাকায় বাইক বা গাড়ি এলে সে প্রবৃত্তিগত ভাবেই আশেপাশের সবাইকে সতর্ক করে। কুকুরের যেহেতু ভাষা নেই, এই চিৎকারই তার যোগাযোগের মাধ্যম, আমাদের নিরাপত্তা ও কল্যাণার্থেই তাদের বার্তা।
আজ যদি আমরা শুধুমাত্র নিজেদের আতংক কিংবা বিরক্তির কারণে কুকুরদেরকে এলাকা থেকে সরিয়ে ফেলি, তবে প্রকৃতিতে বিদ্যমান বাস্তুতন্ত্রের শৃংখল ভেঙে যাবে। যে কুকুরের ডাকে ঘুমের ব্যাঘাতের অভিযোগ করছি, সেই কুকুরের অনুপস্থিতির কারণেই হয়তো আমাদেরকে রাত জেগে বাড়ি পাহারা দিতে হবে। জনবলের অভাবে বর্জ্যব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়বে। কুকুর যা খেয়ে নেয় বলে আমাদের চোখে যা পড়েনা, সেইসব ময়লার স্তুপ জমবে অলিতে-গলিতে। নানা রকম অসুখ ছড়াবে, হানা দিতে পারে নানারকম জীবাণু, মশা ও ইঁদুরবাহিত মহামারী। কে জানে, হয়তো কুকুর নিধন বা অপসারণের আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের খেসারত হিসেবে পরবর্তীতে আমাদেরকেও ডেকে আনতে হবে কোন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা।
৪
করোনাকালের লকডাউন চলাকালে আমরা যখন কেবলই নিজেদের কথা ভেবে নানান সামগ্রী মজুদ করে গৃহবন্দি হয়েছিলাম, তখন আমার পরিচিত অনেকেই সব ভয় তুচ্ছ করে নিজ উদ্যোগে বিগত ছয় মাস ধরে বিভিন্ন এলাকার পথ কুকুরদের নিয়মিত খাবার খাইয়ে প্রাণ রক্ষা করেছে, আহত-অসুস্থ কুকুরদের চিকিৎসা করেছে। আবার এদের মাঝে অনেকেই দরিদ্র মানুষের জন্য ফান্ড তুলে সাহায্য পৌঁছে দিয়েছে। যদি প্রশ্ন করেন, এর বিনিময়ে ওরা কী পেয়েছে; তবে উত্তরে তারা বলবে; নির্বাক নিষ্পাপ প্রাণিদের ক্ষুধার অবসান করে পেয়েছে অনির্বচনীয় শান্তি; পেয়েছে মানুষজন্ম সার্থক করে পরের তরে বেঁচে থাকার স্বর্গীয় অনুভূতি। কেননা সকল প্রাণের প্রতি নিঃস্বার্থ মানবিকতার কোন সীমানা হয় না।
পথ কুকুরদের নির্মূল করার দাবিরতরা একটি শব্দ ব্যবহার করছে- বেওয়ারিশ; অর্থাৎ যার মানব মালিক নেই। কিন্ত মানুষ হবার দম্ভে আমরা সম্ভবত ভুলে গেছি যে এই প্রাণীরা আমাদের মতোই প্রকৃতির উত্তরাধিকার বহন করে। আমাদের মতোই এরা স্রষ্টার সৃষ্টি। পৃথিবীর আলো হাওয়া জলে এদের সমান দাবি আছে, বেঁচে থাকার অধিকার আছে। এই পৃথিবীতে প্রত্যেকটি প্রাণই অমূল্য। চোখে পড়েনা এমন আকারের একসারি পিঁপড়া কিংবা ছোট্ট এক বিন্দু ঘাসফুল; প্রকৃতির সন্তান হিসেবে মূল্যহীন নয় এরা কেউই। বরং সৃষ্টির শ্রেষ্ঠত্ব দাবী করে বলে অন্য প্রাণীদের সুরক্ষায় মানুষের দায়িত্ব অনেক বেশি। অথচ মানুষের লোভ আর দায়িত্বহীনতায় পৃথিবীজুড়ে কত প্রাণী চিরতরে হারিয়ে গেছে, কত কত প্রাণীর নাম উঠেছে বিপন্ন বা অতি বিপন্নের তালিকায়। হারিয়ে ফেলে আমরা আজ তাদের গুরুত্ব বুঝেছি, পৃথিবীজুড়ে বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীদের সংরক্ষণ করতে ব্যস্ত হয়েছি।
করোনাভাইরাসের প্রকোপে মানুষের পদচারণা থেমে যাবার পর আবার সজীব হয়ে ওঠা বনভূমি, সমুদ্রসৈকত, নদীতট; সর্বত্র প্রাণীকুলের স্বচ্ছন্দ নির্ভয় ফিরে আসা বুঝিয়েছে মানুষের স্বার্থপর ধ্বংসযজ্ঞের কারণে সমগ্র প্রাণীকুল কতটা বিপদসংকুল পরিস্থিতিতে থাকে। মানুষের অস্তিত্ব যে অন্য সকল প্রাণের অস্তিত্বের সাথে যুক্ত তা আমরা অনুধাবন করেছি বড় দেরীতে। ঢাকা শহরের বেলায় যেন আমাদের সেই ভুল আবার না হয়। সভ্যতার সবচেয়ে বিশ্বস্ত প্রাণীটি এই শহরের মানুষের সহমর্মিতা পেয়ে বাঁচুক। তাদের প্রতি একটু দয়া, করুণা করে ছুঁড়ে দেওয়া একটু খাবার, নাগরিক সহাবস্থানের জন্য নেওয়া কতিপয় কৌশল আর মানবক সহিষ্ণুতা আমাদের মানুষ জন্মকে মহিমা দান করুক। আমাদের প্রাণের শহরে মানুষের সহানুভূতি পেয়ে একে অন্যের আশ্রয় হয়ে বেঁচে থাকুক সকল প্রাণী।