Published : 31 Aug 2020, 12:40 PM
১.
'সীমিত পরিসর' শব্দটার মধ্যে কেমন শ্লেষ্মা জড়ানো বিদ্রুপ লুকিয়ে আছে। এই পর্যবেক্ষণ বিগত মাসগুলোর। সবাই কথা-বার্তা, আচার-আচরণে, মন্তব্য-হাস্যরসে, আলোচনা-বিদ্রুপে 'সীমিত পরিসর' শব্দ দুটি নিয়ে টিপ্পনী কেটে যাচ্ছে। অথচ এই শব্দ দুটি ভালো অর্থেই ব্যবহৃত হত। অন্তত করোনাভাইরাস আসার আগ পর্যন্ত।
করোনাভাইরাস আসার পর বাঙালির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের নতুন রূপের দেখা মিলল। বাঙালির চরিত্রের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো নিয়ম ভাঙ্গা এবং নিয়ম না মানা। করোনাভাইরাসে যখন ৬৬ দিনের লকডাউন কার্যকর ছিল তখনই নিয়ম মানাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। বরং নিয়ম ভাঙ্গাটাই সবার কাছে একটা গর্বের বিষয় ছিল। কাঁচাবাজার: পুলিশ আড়াল হলেই দূরত্ব কমে যায় ক্রেতাদের। পুলিশ যখন সব জায়গায় টহল দিত তখন সবাই লুকিয়ে পড়ত। পুলিশ চলে যাওয়ার পর আবার যথারীতি আগের অবস্থানে ফিরে যেত। পুলিশের সাথে নিয়মিত লুকোচুরি চলত। (বাংলা ট্রিবিউন, ১৯.৪.২০২০)
৬৬ দিনের লকডাউন শেষে যখন সীমিত পরিসরে যোগাযোগব্যবস্থা চালু করা হলো তখনকার প্রেক্ষাপটও অপরিবর্তনীয় থাকল। ৩১ মে পটুয়াখালী-ঢাকা নৌপথে লঞ্চে যাত্রীদের শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত না করায় একটি লঞ্চকে জরিমানা করে ভ্রাম্যমাণ আদালত। জরিমানা করায় পটুয়াখালী লঞ্চঘাটে থাকা লঞ্চগুলো ঢাকামুখী যাত্রা বন্ধ করে দেয়। যাত্রীরা পড়ে চরম দুর্ভোগে। (প্রথম আলো, ৩১.৫.২০২০)
লকডাউন পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী দুই ধরনের অভিজ্ঞতা জানার এবং দেখার পর আমরা বর্তমানে উন্মুক্ত অবস্থানে আছি। এখন সীমিত পরিসরের সাথে সাথে স্বাস্থ্যবিধিও উধাও। যেসব এলাকায় স্বাস্থ্যবিধি মানার জন্য লকডাউন দেয়া হয়েছিল সেইসব এলাকাবাসীদের নিয়ম মানাতে হিমশিম খেতে হয়েছিল স্বেচ্ছাসেবীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের।
অত্যধিক জনসংখ্যার দেশে শারীরিক দূরত্ব মেনে চলাচল যে অসম্ভব ছিল তা করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে প্রমাণিত হয়েছে। তারচেয়ে বড় কথা হলো, শারীরিক দূরত্ব, হাত ধোঁয়া, মাস্ক পড়া, লকডাউন এইসব কথা কিছু মানুষ শুনলেও বেশির ভাগই শুনতে চাইত না।
তারা কোনোকিছু না ভেবেই যেকোনো ধরনের চ্যালেঞ্জ নিয়ে ফেলত। ২৫ মার্চ-৫ এপ্রিল, ১৭ এপ্রিল-২৪ এপ্রিল ও ৩০ জুলাই-৭ অগাস্ট মানুষ যেভাবে ঢাকা ছেড়েছে এবং ঢাকায় প্রবেশ করেছে তাতে প্রমাণিত তারা কিছুই শোনেনি। কি লকডাউনের আগে, কি লকডাউনের পরে। তারা নিজেদের তৈরি জীবন ব্যবস্থার মধ্যে চোখ বন্ধ করে হেঁটেছে। হাঁটতে গিয়ে বাঁধার সম্মুখীন হলেই তারা চোখ খুলছে। ক্ষেত্রবিশেষে চোখও খুলছে না। সেইভাবেই বাঁধা ডিঙ্গিয়ে পার হচ্ছে। যা খুবই ভয়ানক।
২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তৈরি বহু নির্দেশক গুচ্ছ জরিপ (মিকস) প্রকাশিত হয়। জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় বিবিএস এই জরিপ পরিচালনা করে। জরিপের তথ্যানুযায়ী, দেশের ২৫ শতাংশের বেশি মানুষ ঠিকমতো হাত ধোয় না। ৬৪ হাজার ৪০০ নমুনা নিয়ে গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে। তা থেকে এই তথ্য উঠে আসে।
এই একটি জরিপ থেকে বোঝা যায়, বর্তমান অবস্থা। জরিপের তথ্যানুযায়ী, দেশে দরিদ্র ও চরম দরিদ্র মানুষের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৩ শতাংশ। তাদের হাতে যখন অর্থ আসে তখন সবার আগে তারা খাবারের চিন্তা করে। বেশিরভাগ শ্রমজীবী মানুষ যে অবস্থায় কাজ করে সেই অবস্থায় খাবার খাওয়া শুরু করে। এতে করে তাদের হাত ধোয়া হচ্ছে না। মিকস'র জরিপ শুধু দরিদ্র ও চরম দরিদ্র মানুষের ওপর করেছে তা কিন্তু নয়। সকল শ্রেণিপেশার মানুষের উপর এই জরিপ পরিচালিত হয়।
হাত ধোঁয়া নিয়ে বাংলাদেশে প্রচার-প্রচারণা চলছে অনেক বছর ধরে। ছেলেবেলায় মীনা কার্টুন এবং বিটিভি'র মাধ্যমে হাত ধোঁয়ার প্রক্রিয়া এবং উপকারিতা দেখেছিলাম, যা এখনো মনে আছে। তিন যুগের বেশি সময় অতিবাহিত হয়েছে। এরপরও বৃহৎ অংশে সচেতনতা তৈরি হয়নি। করোনাকালীন অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা এবং জানা যায়, সচেতন হওয়ার খুব একটা ইচ্ছা আসলে আমাদের নেই।
২.
২০২০ সালের ২৭ মে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (ইসিডিসি) এবং বিভিন্ন গণস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে 'ইএএসএ' উচ্চঝুঁকিতে থাকা বিমানবন্দরগুলোর একটি তালিকা প্রকাশ করে। তাদের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশের সবগুলো বিমানবন্দরই উচ্চঝুঁকিপূর্ণ।
এই তথ্য জানার পরও ১ জুন থেকে দেশের অভ্যন্তরীণ রুটে বিমান চলাচল শুরু করেছিল। এই তথ্য যে সরকারের কাছে ছিল না তা কিন্তু নয়। তারা সবই জানত কিন্তু এরপরও তাদের ছিল ঢিলেঢালা পরিকল্পনা। যে কারণে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীরা ইতালি পৌঁছেছে এবং বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ধ্বংস করে দিয়েছে।
করোনাভাইরাস: বাংলাদেশ থেকে ইতালির সকল ফ্লাইট নিষিদ্ধ। ইতালির স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বাংলাদেশের ফ্লাইটকে 'ভাইরাল বোমা'র সাথে তুলনা করেছে। (বিবিসি,৭.৭.২০২০)
শুধু কি ফ্লাইট? গণপরিবহনের অবস্থা ছিল আরো ভয়াবহ। ভাড়া বাড়িয়েও ভর্তুকি চান বাস মালিকরা (বণিক বার্তা, ২৯.৬.২০২০) স্যানিটাইজারের নামে রঙিন পানি, নামমাত্র ডেটল, স্যাভলন, গুঁড়া সাবান মিশিয়ে জীবাণুনাশক স্প্রে করা হচ্ছে। (কালের কণ্ঠ, ২৮.৬.২০২০) ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে গণপরিবহনে মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধি (ইউএনবি, ৩.৭.২০২০) স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না গণপরিবহনে (বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম, ১৩.৮.২০২০)
লকডাউনের পর গণপরিবনের মালিকরা ৬০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধি করে সব ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সেই প্রতিশ্রুতির কি হাল হয়েছে আমরা দেখেছি। এখন আবার ৬০ শতাংশ ভাড়া কমিয়ে আগের ভাড়ায় ফিরে গিয়ে সব ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রতিশ্রুতি দেয়া হচ্ছে। এই প্রতিশ্রুতিও যে তারা রক্ষা করবে না তাও আমরা জানি। আসলে গণপরিবহনের খাতের মালিকরা প্রতিশ্রুতি মানবে না তা জেনেই তাদের প্রতিশ্রুতি মানতে বলা হয়। যাতে করে বোকা জনগণকে খানিক সময়ের জন্য থামিয়ে রাখা যায়।
৩.
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) ও আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) যৌথ জরিপের প্রাথমিক ফলাফলে ২০২০ সালের ১০ অগাস্ট বলা হয়, রাজধানীর আনুমানিক ৯ শতাংশ মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত।
বিশ্বব্যাংকের হিসাবে ২০১৭ সালে ঢাকা মহানগরের জনসংখ্যা ১ কোটি ৮০ লাখ। সে হিসাবে রাজধানীতে করোনাভাইরাস আক্রান্তের সংখ্যা ১৬ লাখ ২০ হাজার। (প্রথম আলো, ২৫.৮.২০২০) দেশে নভেল করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে এ পর্যন্ত যত মানুষ মারা গেছে তাদের ৭৬ শতাংশেরই বয়স ৫০ বছরের বেশি। (বণিক বার্তা, ১৬.৮.২০২০)
জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যানুযায়ী, আক্রান্তের সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে ১৫তম। মৃত্যুর সংখ্যার দিক থেকে ২৯তম।
প্রশ্ন হলো, এত বিশাল সংখ্যক মানুষ কি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হতো? হতো না। সীমিত পরিসরে ঝুঁকি নিতে নিতে আজ আমাদের এই অবস্থান। প্রথম ৬৬ দিনের লকডাউন মানাতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। এর ফলাফল এখনো আমরা ভোগ করছি। মার্চ মাসে মৃতের সংখ্যা ছিল ৫ জন। এপ্রিলে ১৬৩ জন, মে মাসে ৪৮২ জন, জুনে ১ হাজার ১৯৭ জন, জুলাইয়ে ১ হাজার ২৬৪ জন।
জুলাই মাসে মৃত ১ হাজার ২৬৪ জনকে নথিভুক্ত করা হয়েছে। যাদের করা হয়নি তাদের সংখ্যা কি আমরা জানি? বেডের অভাবে যেসব রোগী হাসপাতালে যাচ্ছেন না, করোনাভাইরাস আক্রান্ত হয়ে বাসায় মারা যাচ্ছেন বা বেসরকারি হাসপাতালের মৃত করোনাভাইরাস রোগীর সংখ্যা কি সঠিক সময়ে পাওয়া যাচ্ছে? নিশ্চয় নয়। এই বিষয়ে নিশ্চিতভাবে বলতে পারছি ইউনিসেফের রিপোর্ট দেখে।
ইউনিসেফ ২০১৮ সাল একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। তাদের তথ্যানুযায়ী, ২০১৪ সালে বাংলাদেশে ৯০ শতাংশ মৃত্যুই রেকর্ড করা হয়নি।
২০১৪ সালে যেখানে ৯০ শতাংশ মৃত্যুর রেকর্ড হয়নি সেই জায়গায় ২০২০ সালে ১০ শতাংশ করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর রেকর্ড যদি করা না হয়, তাহলে তা অনেক বড় সংখ্যা। এ থেকেই বোঝা যায়, করোনা আক্রান্ত মৃত মানুষের সংখ্যা আসলে অনেক। আমরা জানছি শুধু নথিভুক্তগুলো।
নথিভুক্ত হোক আর না হোক, এখন আর কেউই মৃত মানুষের সংখ্যা নিয়ে ভাবছে না। অর্থনীতি সচল করতে করোনাভাইরাস, স্বাস্থ্যবিধি, হাত ধোয়া, লকডাউন মেনে চলা, সীমিত পরিসর, মাস্ক পরা সবকিছু জোর করে দূরে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে। মজার বিষয় হলো, এখন অর্থনীতি সচল করাটা সময়ের দাবি। এখন করোনাভাইরাস পরিস্থিতির নিয়ম-বিধি পূর্ণাঙ্গভাবে মানা হলে অর্থনৈতিক ধস থেকে উদ্ধার পাওয়া সম্ভব হবে না। অর্থনীতি সচল করার খাতিরে এইসব নিয়ম-বিধি শিথিল হচ্ছে কিন্তু যখন অর্থনীতি সচল করার বিষয়টি প্রাধান্য পায়নি তখন কি আমরা নিয়ম-বিধি মেনেছি? তখন কি স্বাস্থ্যবিধি মেনে, লকডাউন মেনে, সীমিত পরিসরে যাতায়াত করেছি? করিনি। যখন নিয়ম-বিধি মানাটা জরুরি ছিল তখন সরকার থেকে শুরু করে জনগণের অবহেলা ছিল নথিভুক্ত করে রাখার মতো আর এখন তো আরও প্রশ্ন আসে না।
শুরু করেছিলাম 'সীমিত পরিসর' শব্দের মধ্যে শ্লেষ্মা জড়ানো বিদ্রুপ লুকানো দিয়ে। এখনকার পরিস্থিতিতে বলা যায় 'সীমিত পরিসর' শব্দটার মধ্যে আসলেই শ্লেষ্মা জড়ানো বিদ্রুপ লুকিয়ে আছে। করোনাকালীন সময়ে এই শ্লেষ্মা জড়ানো বিদ্রুপ দিয়ে সীমিত পরিসরের সমাপ্তি ঘটবে এইটাই স্বাভাবিক।