Published : 20 Jul 2020, 07:47 PM
পাপুল, সাহেদ, পাপিয়া, সাবরিনা অথবা আরিফ এরা কারা? এরা কি ভীনগ্রহের প্রাণী? না, এরা আমাদের চারপাশের মানুষ। এদের সংখ্যাই এখন বেশি। এদের চেনার সুবিধার্থে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার তিনটি ঘটনা উল্লেখ করছি।
ঘটনা-১
বছর দুয়েক আগে, লন্ডনে ছবি বাণিজ্য করে এক প্রতারক একজন বয়স্ক ভদ্রলোকের পুরো দুই কোটি টাকা হজম করে ফেলে। এই প্রতারক ও তার স্ত্রী ব্রিটেনে সফরকালে প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতিসহ এমপি-মন্ত্রীদের সাথে ছবি তুলে সাহেদের মতোই ফেসবুকে শেয়ার দিত। কোথাও কোথাও প্রধানমন্ত্রীর অফিসের বিশেষ কর্মকর্তা বলে নিজের পরিচয় দিত। কোথাও র্যাবের কর্মকর্তা, কোথাও প্রপার্টি বিজনেস, কোথাও ট্রাভেল, মানি ট্রান্সফার ব্যবসায়ী হিসাবে পরিচয় দিয়ে প্রতারণা করত।
তার বিরুদ্ধে চেক প্রতারণা ও বাড়ি দখলের অভিযোগে বাংলাদেশ পুলিশ তাকে গ্রেফতারও করেছিল। প্রতারণা ও দুর্নীতি এবং গ্রেফতার নিয়ে সংবাদ করায়, জেল থেকে বের হয়ে সে ভূয়া চেক তৈরি করে আমার বাংলাদেশে আমার কর্মস্থলে জমা দেয় এবং অভিযোগ জানায় যে, আমি টাকার বিনিময়ে তার বিরুদ্ধে সংবাদ করেছি। যদিও তার প্রতারণার বিষয়টি কর্তৃপক্ষ ধরতে পারেন।
এই প্রতারক বহাল তবিয়তে এখনো ঢাকায় বসে তার প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছে বলেই জানি। এবং আওয়ামী লীগের নাম ভাঙিয়েই করছে এসব। ইদানীং অনলাইন পত্রিকায় লেখালেখিও করে। করোনাভাইরাস নিয়ে জাতিকে জ্ঞানদান করে ভিডিও বার্তা দেয়। কিন্তু যাদের পৃষ্টপোষকতায় মন্ত্রী-আমলা থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত পৌঁছাল, তাদের কেউ কিন্তু এই প্রতারকের বিরুদ্ধে আজ পর্যন্ত প্রতিবাদ করেননি। এবং যদি আরো বড় কোনো প্রতারণার দায়ে ফেঁসে যায়, সে কিন্তু আওয়ামী লীগ হিসাবেই ফাঁসবে।
ঘটনা-২
প্রায় এক দশক ধরেই লন্ডনে তাকে জানি, চিনি। কখনো আওয়ামী লীগের কিছুতেই দেখিনি। আওয়ামী লীগের দুঃসময় কিংবা যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি নিয়ে প্রবাসীরাও যখন একাত্ম, বিএনপি-জামায়াতের আগুন, বোমা সন্ত্রাস নিয়ে উৎকণ্ঠিত। যেকোনো আড্ডা বা আলোচনায় ঘুরেফিরে বাংলাদেশের প্রসঙ্গই আসত। শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে এই দুর্যোগ থেকে উত্তরণ কিভাবে হবে। এই সব আলাপ শুনলেই তিনি বিরক্ত হতেন। বরং বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনার নামের আগে বাজে বিশেষণ লাগাতেন। তো বছর চারেক আগে হঠাৎ করে তার বাসায় ছাত্রলীগের নেতাদের দাওয়াত খাওয়ানোর ছবির হিড়িক পরে গেল। কিছুদিন পর দেখলাম আওয়ামী লীগের নেতারাও সেইখানে ভীড় জমিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী ইউরোপ সফরে আসছেন, যুক্তরাজ্যের সিনিয়র নেতাদের সাথে এই লোক স্বস্ত্রীক সেখানে উপস্থিত!
আমরা সেইসব ছবি দেখে যাই। কিছুদিন পরেই দেখি উপকমিটির এক পদে চলে আসছেন তিনি! শুনেছি এখন দেশেই থাকেন বেশি সময়। এবং বিভিন্ন টেলিভিশনে জাতিকে জ্ঞান দান করেন।
ঘটনা-৩
আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ দীর্ঘদিন ব্রিটেনে ছিলেন, তার পরিবার লন্ডনেই থাকতেন। তিনিও পরিবারের সাথে সময় কাটাতে আসতেন প্রায়শ। কিন্ত রাজনৈতিক সভা সমাবেশ এড়িয়ে চলতেন। হাতেগোণা কয়েকজন শুভাকাঙ্ক্ষীর সাথে যোগাযোগ রাখতেন।
তবুও সভা সমাবেশে বার কয়েক তার সাথে দেখা হয়েছে। টেলিভিশন ও সংবাদপত্রে কাজের সুবাদে টুকটাক কথাবার্তাও হয়েছে। কিন্তু তার সাথে কথা বলার লোভ ছিল আমার, ক্ষমতার ক্ষেন্দ্রে থেকে এমন নির্লোভ যাপিত জীবন আমার কাছে অপার বিস্ময়। ঘোর লাগা শ্রদ্ধা এবং ভালবাসা দুটোই ছিল তার প্রতি।
সাহাব উদ্দীন চঞ্চল ভাই, যার সাথে মৃত্যুর পূর্বপর্যন্ত তার সার্বক্ষণিক সম্পর্ক ছিল। চঞ্চল ভাইয়ের মাধ্যমেই মূলত, সৈয়দ আশরাফ ও তার পরিবারের অন্যান্য ভাইদের সান্নিধ্য লাভ করা। সৈয়দ আশরাফ ভাইয়ের সাথে সাক্ষাতের একটি ছবি ফেসবুকে দেয়ার পর, মনে হল আমি বড় কোনো নেতা হয়ে গেছি! লোকজন ফোন করে, একবার বাসায় নিয়ে দেখা করিয়ে দিতে বলে। নানা কাজের অনুরোধ আসতে শুরু করে।
আমি কাউকে বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না যে, আমার ওনার সাথে কোনো সম্পর্ক নাই! আমি নিতান্তই অন্যের মাধ্যমে শুধু দেখা করতে গিয়েছিলাম। সেদিন বুঝলাম রাজনীতিতে এই ছবির ক্ষমতা! তেমনি প্রধানমন্ত্রী লন্ডন আসলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আওয়ামী লীগের নেতাদের ভীড়ে দেখি যুবদল করা নেতা পাশে দাঁড়িয়ে। সাবেক এই যুবদল নেতা হঠাৎ করে আওয়ামী লীগ হয়েই, একবারে শেখ হাসিনার পাশে চলে গেলেন!
এই উদাহরণগুলো টানার মূল কাহিনী হলো, এই যে প্রতারক, ছবি ব্যবসায়ীরা নিজেদের জাহির করার সুযোগ পায়। নিজেদের আওয়ামী লীগ হিসাবে দ্রুত প্রতিষ্ঠিত করে ফেলে। এর দায় কি আওয়ামী লীগ নেতারা এড়িয়ে যেতে পারেন? দুর্নীতির দায়ে ধরা পরলেই তাকে বহিরাগত, জামায়াত শিবিরের এজেন্ট, এসব বলে দায় এড়াতে চান।
সবচেয়ে ভয়ংকর হচ্ছে এই অনিয়মগুলো নিয়ে প্রশ্ন তোলা আরেক বিপদ। যারাই প্রশ্ন তুলেছেন হয় রাজনীতি থেকে তাদের বিদায় নিতে হয় অথবা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে জেলে খাটতে হয়। সর্বশেষ হবিগঞ্জের এক এমপির এমন একটি ছবি স্থানীয় সংবাদপত্রে প্রকাশ হওয়াতে স্থানীয় একটি পত্রিকার সম্পাদক এবং প্রকাশক সুশান্ত দাশগুপ্তকে এক মাস জেল খাটতে হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে হওয়া মামলায়। পত্রিকার অন্য তিন প্রধান ব্যক্তিকেও ১৫ দিন জেল খাটতে হয়েছে। এই ঝুঁকিও কেউ নিতে চায় না। বরং প্রকৃত আওয়ামী লীগ বা আওয়ামী লীগের শুভাকাঙ্খী অভিমানে চুপ করে ঘরে বসে থাকে। আজকেই ফেসবুকে দেখলাম ছাত্রলীগ, যুবলীগের তুখোড় নেতা শাহীন রেজা খান যিনি শরিয়তপুরের সাবেক এমপি আবিদুর রেজা খানের সন্তান গুরুতর অসুস্থ্য এই সংবাদটুকু তার প্রিয় নেত্রীকে জানানোর সুযোগ পাচ্ছেন না। অথচ সাহেদরা মাসে-মাসে চান্দে-চান্দে সুযোগ পায় প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাতের।
মিডিয়ার আলোচনার বিষয় অথবা হয়তো পরিকল্পিতভাবে গণমাধ্যমগুলো ব্যস্ত সাহেদ, সাবরিনা, আরিফের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে হাস্যরস করছে। সাহেদ কিভাবে অ্যারেস্ট হল, পিস্তল পেল কই, আসল না নকল? এইসব নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে গভীর রাত পর্যন্ত। যত জন ভিআইপির সাথে সাহেদের ছবি এসেছে এই ব্যাপারে বরং সাহেদকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হউক, এই দাবিটা কেউ তুলছেন না কেন? আমলা, নেতা, মন্ত্রী মহোদয়গণও তাদের অবস্থান পরিষ্কার করুন। কারণ সাহেদের ছবিগুলো সব কিন্তু জনসমাগমস্থলের ছবি নয়। নিতান্তই ঘরোয়া ছবিও আছে অনেক। চাইলেই অস্বীকার করার সুযোগ নেই। যে কেউ চাইলেই কোনো মন্ত্রীর বাসায়, প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তি কিংবা বড় রাজনৈতিক ব্যক্তির বাসায় প্রবেশ কিংবা তার সাথে ঘনিষ্ঠ ছবি তোলা সম্ভব নয়। পুঁথিগত বিদ্যা ছাড়াও একটা মানুষ জ্ঞান অর্জন করতে পারেন। দেশ জাতিকে বুদ্ধি পরামর্শ দিতে পারেন এতে কোনো সমস্যা দেখি না, কিন্তু যার বিরুদ্ধে এতসব মামলা, এত অভিযোগ তেমন একটা মানুষ রাতের পর রাত টেলিভিশনে গিয়ে দেশ জাতি উদ্ধার করেন, কোনো সাংবাদিক বা প্রশাসনের কেউ সেটা জানেন না কিংবা দেখেন নাই, এই বিষয়টা কি কোনোভাবে বিশ্বাসযোগ্য? সেইসব কেউ বলছেন না। কথা বলছেন, গ্রেফতারকালীন তার গোঁফ ছোট না বড়, তার কোমরে ঝুলানো পিস্তল আসল না নকল, সাহেদের বোরকায় কাদা লাগানো পুলিশের ড্রেসে নাই কেন? এসব নাটক না সিনেমা এই আলোচনা নিয়ে ব্যস্ত সবাই। কর্পোরেট সুন্দরীর সংজ্ঞায় সাবরিনা সুন্দরী, সুন্দরী হওয়াটা তার অপরাধ না। সাবরিনা কিভাবে ছবি তুলেছেন সেগুলো নিয়ে আদিরসাত্মক আলোচনা করছেন তাতে তার অপরাধকেই বরং হালকা করে দিচ্ছেন। সাবরিনাকে বিনোদনের উপাদান বানিয়ে নিচ্ছেন, গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিকে কৌতুক অভিনেতা তৈরি করে ফেলছেন।
সাহেদ, সাবরিনা গ্রেফতার হয়েছে, এই তো বড় স্বস্তির খবর। বাকী সব আপনারা যারা আলোচনা করেন তারা যেমন বুঝেন বা আমাদের বুঝান, সাধারণ মানুষ আমরাও সেসব বুঝি।
পাপুলের মত একজন মানব পাচারকারী শুধু টাকা দিয়ে মহান জাতীয় সংসদে চলে গেল! সেখানেই থেমে থাকল না সে। নিজে এমপি হয়ে নিজের স্ত্রীকেও সংরক্ষিত আসনে এমপি বানিয়ে নিয়ে আসল! যারা পাপুলের হয়ে দলের পক্ষ থেকে চিঠি লিখে তার নির্বাচনে কাজ করতে, তাকে ভোট দিতে নির্দেশনা দিয়েছিলেন তাদেরকে কি জবাবদিহিতার আওতায় আনা যাবে? জানি সেটা সম্ভব নয়।
করোনাকালীন সময়ে স্বাস্থ্যখাত নিয়ে নানা সমালোচনা আলোচনা, কিংবা করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সফলতা সব নিয়েই আলোচনা হচ্ছে। কিন্ত বারবার যে মানুষটার দিকে আঙুল উঠছে সেই ব্যক্তি স্বাস্থ্য বিভাগের ডিজি। কিন্তু তার টিকিটিও কেউ ছুঁতে পারছেন না। মন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করছেন। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় শুধু স্বাস্থ্যমন্ত্রী নয় প্রধানমন্ত্রীর চেয়েও শক্তিশালী এই ভদ্রলোক। যার পরিবারের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার অভিযোগ আছে, স্বাস্থ্যখাতের প্রতিটা অনিয়মে তার সম্পৃক্ততা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে৷ তবুও কিছুই হচ্ছে না!
স্বাস্থ্যখাত লুটেপুটে খাওয়া আরিফ, সাহেদ, মিঠুর গডফাদার কারা, তাদের গলায় ঘন্টা বাঁধুন। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণকারী ঘরে বসে যারা এইসব ফাইল, চুক্তি স্বাক্ষর করেন, বিল পাশ করেন। অন্ধকার নামলে, এই ক্লান্তি দূর করতে যারা পাপিয়াদের দরজায় কড়া নাড়েন। তাদের পরিচয় কি আদৌ জানা যাবে? তা না হলে পাপিয়া, আরিফ মিঠু, সাহেদরা ধরা পড়বে আবার নতুন চরিত্র জন্ম নেবে। এই ইঁদুর-বেড়াল খেলা চলবেই। আমরা অপরাধগুলোকে কৌতুক হিসাবে নিয়া হাসি তামশা করব শুধু।