Published : 03 Jul 2020, 10:39 PM
সম্প্রতি শতাধিক শিল্পী 'শিল্পের সম্মানে শিল্পীদের বাঁচান' স্লোগানে ঘোষণা দিয়েছেন তারা পারিশ্রমিক ছাড়া আর গাইবেন না। সংক্ষেপে, করোনাভাইরাসের কারণে সংগীতশিল্পীদের আয়ের প্রধান উৎস স্টেজ শো কয়েক মাস ধরে বন্ধ। কবে তারা স্টেজে ফিরতে পারবেন তারও ঠিক নেই। এই ঘরবন্দি সময়ে ফেইসবুক লাইভ, ইউটিউব, ওয়েব বা টিভিতে বিনামূল্যে শো করার প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে তাদের, কেউ কেউ তা মেনে নিয়েছেনও। কিন্তু এখন থেকে তা আর হবে না কারণ এতে তাদের জীবন চালানো কঠিন হবে।- একুশে টিভি অনলাইন, ২৮ জুন ২০২০।
এই নিয়ে বচসা শুরু হয়েছে। আমার সামগ্রীর মূল্য বা অমূল্য আমিই ধরব আর কেউ নয়, এই সুস্পষ্ট বিষয় নিয়ে অনাবশ্যক বচসা কেন তৈরি হলো? কে বা কারা তৈরি করলো? এর বিরুদ্ধে চমৎকার বলেছেন সৈয়দ আব্দুল হাদী ভাই, "কণ্ঠশিল্পীরা যদি পারিশ্রমিক ছাড়া গান না করার সিদ্ধান্ত নেন, তাতে অপরাধ কোথায়? পেশাদার শিল্পীর জন্য সেটাই তো স্বাভাবিক। বিশেষ করে বর্তমান দুঃসময়ে যাঁরা এর ওপরেই নির্ভর করেন, তারা যথোচিত সম্মানী পেলে অনেকটাই উপকৃত হবেন। আমি বিনা পারিশ্রমিকেও গান করি, সেটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার হতে পারে। কিন্তু একজন পেশাদার শিল্পী সম্মানী দাবি করলে তার মধ্যে তো কোনো অপরাধ দেখি না।" -প্রথম আলো ৩০ জুন ২০২০।
চলুন আমরা বিষয়টা একটু 'খতিয়ে' দেখি। শিল্পীরা কি আকাশ থেকে হঠাৎ করে পড়েন? না, পড়েন না। তারা বহু বছরের ক্রমাগত পরিশ্রমে তিল তিল উত্তমের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা তিলোত্তমা। আমরা যখন তাস খেলি, আড্ডা দেই, সিনেমা দেখি, তারা তখন নিজ ভুবনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা একাগ্র সাধনা করেন। অর্থাৎ তাদের কয়েক মিনিটের পারফরমেন্স দাঁড়িয়ে থাকে হাজারো ঘণ্টার নিভৃত পরিশ্রমের ওপর। ঠিক যেমন:
"শত বর্ষ ধরে,
একটি পুষ্পের কলি ফুটাবার তরে
চলে তব ধীর আয়োজন" (প্রতীক্ষা, কবিগুরু)
যতদূর মনে পড়ে শিল্পীদেরকে আর্থিকভাবে শক্তিশালী করার কথাটা প্রথম শুনেছিলাম নবী ভাইয়ের কণ্ঠে মধ্য ষাট দশকে (প্রয়াত শিল্পী মাহমুদুন্নবী)। পাকিস্তান সরকার যখন ঢাকা রেডিওতে হেমন্ত, মানবেন্দ্র, সন্ধ্যা মুখার্জীসহ পশ্চিম বাংলার শিল্পীদের গান প্রচার নিষিদ্ধ করল (নিষিদ্ধ রবীন্দ্রসঙ্গীত অন্য বিষয়) তখন তার বিরুদ্ধে শিল্পী ও সুশীল সমাজে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। তাদের যুক্তি, বাঙালি সংস্কৃতিকে বিভক্ত করা হচ্ছে। সবাইকে অবাক করে সেই স্রোতের বিরুদ্ধে গায়কদের মধ্যে সর্বপ্রথম সেই সরকারি সিদ্ধান্তকে শক্তিশালী সমর্থন জানান নবী ভাই। তার বক্তব্য, যদি আমাদের কাছ থেকে হেমন্ত, মানবেন্দ্র, সন্ধ্যাকে ছিনিয়েই নেওয়া হতো তবে তার বিরুদ্ধে তিনিই সর্বপ্রথম দাঁড়াতেন। কিন্তু যেখানে আকাশবাণী কলকাতা খুললেই ওখানকার শিল্পীদের গান শোনা যাচ্ছে তাই বাঙালি সংস্কৃতিকে বিভক্তির প্রশ্নই ওঠে না। বরং ওদের প্রতিটি গান প্রচারে আমাদের রেডিও থেকে ওদেরকে টাকা দিতে হয়, এই টাকাটা আমাদের শিল্পীদের অধিকার ও প্রয়োজন। তাছাড়া আমাদের রেডিওর সময় খেয়ে নিচ্ছে উনাদের গান, বঞ্চিত হচ্ছেন আমাদের শিল্পীরা কারণ তাদের কণ্ঠ জনগণের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। নবী ভাইয়ের একথা আমি বন্ধুদের মধ্যে ছড়িয়েছিলাম।
রাজা, বাদশা, জমিদারদের অর্থানুকূল্য না পেলে কি সুবিশাল ভারতবর্ষের সুবিশাল সংগীত সম্ভার গড়ে উঠত? মোটেই নয়। আদিতে সেটা ছিল বলেই মিয়া তানসেন, আমির খসরু থেকে শুরু করে পরবর্তীতে আমরা পেয়েছি ওস্তাদ আলাউদ্দীন খান, ফৈয়াজ খান, রবিশঙ্কর, আমজাদ আলী খান, বিসমিল্লা খান, বড়ে ও ছোটে গোলাম আলী, আমির খান, ওঙ্কারনাথ ঠাকুর, এ কানন, মালবিকা কানন থেকে শুরু করে আমাদের পণ্ডিত বারীণ মজুমদার, নিলুফার ইয়াসমিন, ওস্তাদ মুন্সী রইসউদ্দীন, ওস্তাদ ইয়াসিন খান প্রমুখ।
ফুল বাঁচাতে ফুলগাছ বাঁচানোর দরকার, শিল্প বাঁচাতে শিল্পী বাঁচানোর দরকার। সংগীতে শিল্পমূল্যের পাশাপাশি অর্থমূল্যও আছে। সংগীত দিয়ে হাজারো সংসার চলে, সন্তানেরা প্রতিপালিত হয়। জীবন চালাতে টাকা লাগে, পেশাজীবীরা তা উপার্জন করেন। সংগীত যাদের পেশা তাদের ব্যতিক্রম হবার অবকাশ নেই। আমাদের বেশির ভাগ শিল্পীরা কখনোই বড়লোক ছিলেন না। আবদুল আলীমের মতো শিল্পী দুস্থ জীবন কাটিয়েছেন, খন্দকার ফারুক আহমেদ ভাইয়ের ছোট্ট ফিয়াট ৫০০ গাড়ি কেনাটা ছিল হৈহৈ রৈরৈ ব্যাপার। মুদ্রার অন্যদিকে, আজীবন দরিদ্র কিন্তু হিমালয়সম সঙ্গীতগুরু ছিলেন নজরুল। কলকাতার বিখ্যাত নজরুল বিশেষজ্ঞ আবদুল আজীজ আল-আমান লিখেছেন, "সংগীত উন্মত্তের মতো তার দাসত্ব করেছে"। কিন্তু এটা ব্যতিক্রম মাত্র।
"শিল্পের সম্মানে শিল্পীদের বাঁচান" শ্লোগানের দরকার আছে, অন্যকে উৎসাহ দিতে অন্যদের সমর্থন পেতে সেটা ঘোষণারও দরকার আছে। যেটা দরকার নেই তা হল শিল্পীদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের বিচারক বনে গিয়ে স্পর্ধিত বিপরীত রায় প্রদান করা। "সুরের খাদ্যে জানো তো মা বাণী, নরের মেটে না ক্ষুধা" – 'পুরস্কার' কবিতায় স্বয়ং সংগীতদেবী সরস্বতীর প্রতি কবিগুরুর এই উদ্যত তর্জনী আমাদের কেউ কেউ খেয়াল করছেন না কেন?
আরো একটা অনেক বড় প্রয়োজন আছে আর্থিকসহ সবদিক দিয়ে আমাদের শিল্পীদেরকে শক্তিশালী করার। স্বদেশের ঘাতক স্বদেশের সংস্কৃতিকে হত্যা করতে কনসার্টের জনারণ্যে বোমা মেরে স্বদেশেরই শিল্পী-দর্শকদেরকে খুন করছে, এমন উৎকট ও বীভৎস সমস্যা দুনিয়ায় আর কোনো জাতির কখনো ছিল না আজও নেই (রমনা বটমূলে ও উদীচী'র অনুষ্ঠানে বোমা হামলা)। অর্থাৎ বাঙালী সংস্কৃতি ও সংস্কৃতিসেবীরা এক ভয়ংকর ঘাতক দানবের সামনে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছেন। কাজেই এ সংস্কৃতির সদাজাগ্রত প্রহরী আমাদের শিল্পীদেরকে সবদিক দিয়ে শক্তিশালী করার সমূহ দরকার আছে।