Published : 16 May 2020, 06:22 PM
আনিসুজ্জামানের কন্যা তখন বেশ ছোট। নীলক্ষেতের বাড়িতে অসুস্থ আনিসুজ্জামানকে দেখতে এসেছেন বঙ্গবন্ধু, সঙ্গে তাজউদ্দীন। সকলের সামনে শিশুকন্যা তার বাবা আনিসুজ্জামানের কাছে জানতে চাইলেন, আসাদ আসেনি? কন্যা রুচি কী জিজ্ঞেস করছে তাকে, জানতে চাইলেন বঙ্গবন্ধু। আনিসুজ্জামানের কাছে উত্তর শুনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন; ওরা তো আমার কাছে কৈফিয়ত চাইতেই পারে।
উনসত্তরের শহীদ আসাদুজ্জামান আর বঙ্গবন্ধু কীভাবে একাত্ম হয়ে একটা জাতির শিরা উপশিরাতে প্রবাহিত হয়েছিল, সেটা বোঝাতে নিজের জীবনের এই অভিজ্ঞতার কথা খুব বলতেন আনিসুজ্জামান। বাঙালিকে আত্মমর্যাদার সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত করবার বিষয়টিকে একজন একাডেমিশিয়ান যখন নিজের জীবনবিদ হিসেবে ধরে নেন, তখন ইতিহাসের পরতে পরতে জমে থাকা ধুলোর আস্তরণগুলি কীভাবে আপনাআপনিই যেন এক জাদুমন্ত্র বলে খসে যায়, একটা পরিপূর্ণতাকে কীভাবে জাতি উপলব্ধিতে আনতে পারে- তার শিক্ষাই হল আনিসুজ্জামান। বোধকে অহঙ্কারে পরিণত করে, সেই অহঙ্কারকে ব্যক্তিজীবনের চৌহদ্দির ভেতরে না ঢুকতে দেওয়ার নামই হল আনিসুজ্জামান। আনিসুজ্জামান এমন একজন মানুষ, যার অভিধানে 'সঙ্কীর্ণতা' বলে শব্দটি কোনো দিন ছিল না। আবার এই সমুদ্রের মতো গভীর, পাহাড়ের মতো শুভ্র, আকাশের মতো দিগন্তপ্রসারী ব্যক্তিটি কিন্তু হৃদয়বত্তার ঔদার্যে 'সত্য' ঘিরে কখনো এতটুকু আপোষ করেননি।
আনিসুজ্জামানের পিতামহ শেখ আবদুর রহিম হলেন প্রথম বাঙালি যিনি হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)-এর জীবনী রচনা করেছিলেন। ১৮৮৮ সালে তার এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। লেখক-সাংবাদিক পিতামহের উত্তরাধিকার অত্যন্ত সফল ভাবেই বজায় রেখেছিলেন আনিসুজ্জামান। তার পিতা ডা. এ টি এম মোয়াজ্জেম ছিলেন একজন প্রতিথযশা চিকিৎসক। কলকাতার পার্ক সার্কাস অঞ্চলে এখনো বহু মানুষ আছেন, যাদের পরিবার একদা মোয়াজ্জম ডাক্তারের দ্বারা কোনো না কোনো ভাবে উপকৃত। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা ব্যবস্থার ভেতর দিয়ে অসহায় মানুষদের প্রতি পিতার সহমর্মিতার হাত প্রসারিত করবার বিষয়টি শিশু বয়সেই আনিসুজ্জামানকে খুব প্রভাবিত করেছে।
মোয়াজ্জেম ডাক্তার ঢাকাতে স্থিত হওয়ার অনেক আগে থেকেই এই পরিবারটির সঙ্গে কামালউদ্দিন খান, সুফিয়া কামালের পরিবারের একটা সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। ছেচল্লিশের দাঙ্গার সময়ে পার্ক সার্কাসে থাকতেন সুফিয়া কামালের পরিবার। সেই সময়ে দাঙ্গায় সর্বস্ব হারানো মেয়েদের জন্যে যে পুনর্বাসন কেন্দ্র তিনি তৈরি করেছিলেন, সেই কেন্দ্রের সাথে পটুয়া কামরুল হাসান, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের মতোই আনিসুজ্জামানের পিতারও একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। সেই সম্পর্ক ঢাকাতে এতটাই আন্তরিক হয় যে, সুফিয়া কামালের মেয়ে সুলতানা, সাঈদা আনিসুজ্জামানের পিতাকে ছোট থেকেই জানতেন, 'ডাক্তার মামা' হিসেবে। সুফিয়া কামাল তার মেয়েদের শিশুবয়সে শারীরিক কোনো সমস্যা হলেই নিয়ে যেতেন আনিসুজ্জামানের পিতার কাছে। আর এই আনিসুজ্জামানই মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে যুদ্ধরত সুলতানা, সাঈদার পরম পরম অভিভাবক ছিলেন।
দেশভাগের আগে থেকেই মুসলমান সমাজকে একটা কুসংস্কারাচ্ছন্ন পরিমণ্ডলে আবদ্ধ মানুষ হিসেবে দেখবার প্রবণতা হিন্দু বাঙালিরা শুরু করেছিল। এই প্রবণতার বিরুদ্ধে তথ্যনিষ্ঠ গবেষণার মাধ্যমে দিয়ে প্রতিবাদ উচ্চারণের ভেতর দিয়েই মানবপ্রকৃতিবেত্তা হিসেবে আনিসুজ্জামান নিজেকে মেলে ধরতে শুরু করেন। কালানুক্রমিক পর্যায়ে বাঙালি মুসলমানের রচনার ভিতর দিয়ে তাদের কুসংস্কারের বেড়াজাল ছিন্ন করে আধুনিক, বিজ্ঞানমনষ্ক, প্রগতিশীল চিন্তার বিবর্তনের ধারাটি যেভাবে আনিসুজ্জামান তুলে ধরেছিলেন, তা বাঙালি মুসলমানকে মুসলিম জাতীয়তার সঙ্কীর্ণ, সাম্প্রদায়িক ঘূর্ণাবর্ত থেকে সহজে উত্তরীত হয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদে উপনীত হতে অনেকখানি সাহায্য করেছে।
বাঙালির উত্তরাধিকারের এই তথ্যনিষ্ঠ, বিজ্ঞাননির্ভর ধারাভাষ্য আনিসুজ্জামান যখন তৈরি করছেন তখন বাংলা ভাষার অনেক দিকপাল যেমন, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল ফজল, আবদুল হাই প্রমুখ জীবিত। এপার বাংলায় জীবিত সুনীতি কুমার, সুকুমার সেন। তাদের প্রজ্জ্বল উপস্থিতির ভেতরেই 'প্রগতিশীল সংস্কারের প্রতি' লেখক সমাজের কাকুতিকে সাক্ষ্য প্রমাণের মাধ্যমে তুলে ধরে আনিসুজ্জামান কেবল বাংলা ভাষা বা সাহিত্যের ক্ষেত্রেই একটা নতুন ভাবনার সংযোজন ঘটালেন না, এই ধারার ভেতর দিয়ে বাঙালিকে তিনি রাজনীতির ময়দানে লড়াইয়ের রসদ জোগালেন। কার্ল মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন যেমন মানব মুক্তির রসদ জুগিয়ে শোষণ মুক্তির লড়াইকে একটা আদর্শগত অবস্থানে স্থিত করেছিলেন, ঠিক তেমন ভাবেই অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি সমাজ, বাংলার ধর্মনিরপেক্ষ সামাজিক প্রেক্ষিতের সুলুক সন্ধান আনিসুজ্জামান দিয়েছিলেন। এই খোঁজ-তালাশের ভেতর দিয়ে একদিক থেকে সম্প্রদায়জনিত হীনমন্যতা তিনি দূর করেছেন, অপরদিক থেকে প্রতিবেশীর হৃদয়দুয়ারের অর্গল খুলতেও তিনি রসদ সরবরাহ করে গেছেন। এভাবে মহান মুক্তিযুদ্ধের তাত্ত্বিক ভিত্তি নির্মাণের ক্ষেত্রেও এক ঐতিহাসিক ভূমিকা তিনি গোটা জীবন ধরে পালন করে গেছেন। এই ভূমিকার ভেতর দিয়েই তিনি তার পূর্বসূরী অন্নদাশঙ্কর, কাজী আবদুল ওদুদ, সুফিয়া কামাল প্রমুখের মতো বা সতীর্থ কবীর চৌধুরীর মতো ধর্মনিরপেক্ষতার আইকন হিসেবে নিজের যোগ্যতায় স্বমহিমায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন।
অন্নদাশঙ্কর, গৌরী আইয়ুব, সুফিয়া কামাল, কবীর চৌধুরী, শামসুর রাহমান, নবনীতা দেবসেনহীন 'বিপুলা পৃথিবী'তে সম্প্রীতি আর ধর্মনিরপেক্ষতার বাতিস্তম্ভ ছিলেন আনিসুজ্জামান। ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে তার আপোসবিহীন শান্ত, স্থিতধি অথচ জলদগম্ভীর উচ্চারণ ছিল মানবতার, মানুষের এক পরম সম্পদ। শেখ হাসিনা তার প্রিয় ছাত্রী। বস্তুত সুফিয়া কামালের প্রয়াণের পর বাংলার এতিমকন্যা শেখ হাসিনার একমাত্র অভিভাবক ছিলেন আনিসুজ্জামান। এই মানুষটিই কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার একাধিক ধারা বিশেষ করে কওমি ধারা এবং তাদের ভাবধারাতে পরিচালিত মাদ্রাসাগুলি নিয়ে প্রকাশ্যে সরব হতে এতটুকু দ্বিধা করেননি। একজন প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ মানুষের পবিত্র কর্তব্য যেকোনো কিছুর পরোয়া না করে সংখ্যালঘুর পাশে দাঁড়ানো, এই মহতী মানবধর্ম পালনে আনিসুজ্জামান ছিলেন সুফিয়া কামাল, শামসুর রাহমান, কবীর চৌধুরীদেরই মতো পরম ধার্মিক। ধর্মনিরপেক্ষতার পূজারী হিসেবে কিন্তু তাই বলে তিনি একটিবারের জন্যেও তসলিমা নাসরিন বা দাউদ হায়দারের মতো পবিত্র ইসলাম, হযরত মহম্মদ (সঃ) সম্পর্কে একটি অমর্যাদাকর কথা বলেননি।
যতদিন শারীরিক শক্তি ছিল, উচ্চকন্ঠে আনিসুজ্জামান '৭২ এর সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্যে সোচ্চার থেকেছেন। সেই সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে দলীয় রাজনীতির নিরিখে, ক্ষমতার ভাগবাটোয়ারার নিরিখে তার ছাত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কোনো সমস্যা আছে, কী নেই – সেদিকে ফিরে তাকানোরও প্রয়োজন অনুভব করেননি আনিসুজ্জামান। মুক্তবুদ্ধির উপাসক তিনি, অথচ এই মাদ্রাসা প্রশ্নে মুসলিম সাহিত্য সমাজ 'শিখা' গোষ্ঠীর আবুল ফজলের পক্ষপাতিত্ব ঘিরে নিজের বিরক্তিকে একটিবারের জন্যেও গোপন করেননি। আমার অনুমান, কুদরত ই খুদা কমিশনের প্রতিবেদনের সার্বিক প্রয়োগ ঘিরে '৭৫-এর পূর্ববর্তী স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রশাসনের ভূমিকা ঘিরে যথেষ্ট ক্ষোভ, দুঃখ, অভিমান, যন্ত্রণা তার ছিল। একুশ শতকের বিজ্ঞান-প্রযুক্তির নিরিখে শিক্ষার আধুনিকতার অপ্রতুলতা, বিশেষ করে প্রযুক্তিগত শিক্ষার দৈন্য তাকে কষ্ট দিত। এই কষ্ট আরো অনেক অনেক বেশি প্রলম্বিত তার জীবনে হয়েছিল ধর্মভিত্তিক শিক্ষা এবং সেই ধর্মভিত্তিক শিক্ষা ঘিরে ধারা-উপধারা সম্পর্কে। এই ধারা-উপধারা ঘিরে আমজনতা যখন সবকিছু বুঝেও না বোঝার ভান করে থেকেছে, তখন কিন্তু চাতুর্যের আশ্রয় কখনো নেননি আনিসুজ্জামান। অব্যর্থ লক্ষ্যভেদের প্রত্যাশায় গান্ডীবে জ্যা রোপন করে জল মাপেননি একটি মুহূর্তের জন্যেও।
জামায়াতে ইসলামী কেবল মৌলবাদী বা সাম্প্রদায়িকই নয়, তারা মনেপ্রাণে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শক্তি। পাকিস্তানের সহায়ক শক্তি। তাই বলে তাদের মোকাবেলাতে কওমী পদ্ধতির সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করাটাকে টকের জ্বালায় দেশত্যাগ করে তেঁতুল তলায় বাস বলেই আনিসুজ্জামান মনে করতেন। আজকের বাংলাদেশে দুজন মানুষ ছিলেন, যারা পদ, সরকারি আনুকূল্য, বদান্যতা এসব কোনো কিছুরই পরোয়া না করে, পবিত্র ইসলামের প্রতি ও এতটুকু অসম্মান, অমর্যাদা না দেখিয়ে কওমীদের সম্পর্কে প্রকাশ্যে সোচ্চার হতে পারতেন। তাদেরই একজন চলে গেলেন- ড. আনিসুজ্জামান। তেমন বাঙালি আর একজনই বস্তুত রইলেন- সুলতানা কামাল। ক্ষমতার পেছনে নয়, ক্ষমতা এদের পায়ে লুটিয়ে পড়তে চেয়েছে। একটিবারের জন্যেও পায়ের নখাগ্র দিয়েও এরা স্পর্শ পর্যন্ত করেননি ক্ষমতাকে। ক্ষমতা নামক ময়দানবটি এরকম বাঙালির কাছে হার মানতে বাধ্য হয়েছে।