Published : 31 Aug 2012, 04:05 PM
হুমায়ূন আহমেদের জীবনে বিশেষ দুই নারী– তাঁর স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন এবং সাবেক স্ত্রী গুলতেকিন খান। সম্প্রতি গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এই দুই নারীকে নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা এবং পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্ক। এ আলোচনায় স্পষ্টতই নারীর প্রতি আমাদের সমাজের পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গী প্রকাশ পাচ্ছে।
যে কোনো সমাজেই পুরুষতান্ত্রিক দর্শন, মানসিকতা, আচার-আচরণ নারীকে অবমাননা করে, নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য তৈরি করে, যা সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তন বাধাগ্রস্ত করে। গুলতেকিন-হুমায়ূন-শাওন পরিস্থিতিতে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার প্রত্যক্ষ শিকার শাওন ও গুলতেকিন; পরোক্ষভাবে হুমায়ূন আহমেদ।
পুরুষতন্ত্র শব্দটা এসেছে ইংরেজি Patriarchy থেকে। স্বল্প কথায়, Patriarchy বা পুরুষতন্ত্র হচ্ছে একটি সামাজিক তত্ত্ব বা মতবাদ যা অন্যায্য, বৈষম্যমূলক সমাজ ব্যবস্থার কথা বোঝায়; Patriarchal বা পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা নারীকে অন্যায় ও নিষ্ঠুর নিয়ম–কানুন দ্বারা দমিয়ে রাখে বা কর্তৃত্ব করে।
নারীবাদী তত্ত্ব অনুযায়ী পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রায় সকল সামাজিক নিয়ম-নীতি বা কার্যসাধন পদ্ধতিসমূহ অন্তর্ভুক্ত যা নারীর উপর সাধারণত পুরুষের কর্তৃত্ব প্রয়োগ করে বা করতে সচেষ্ট হয়। পুরুষ-নারী নির্বিশেষে এই পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার অধিকারী হতে পারে এবং আমাদের দেশে প্রায়ই সে রকম দেখা যায়। আবার জাতি-সমাজ-সংস্কৃতি ভেদে পুরুষও পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার শিকার হতে পারে।
হুমায়ূন আহমেদের লেখা 'সংসার' থেকে জানা যায়, গুলতেকিনের সঙ্গে বিয়ে বিচ্ছেদের আগে তিনি আলাদা, একাকী জীবন যাপন করতেন। সাধারণত যে কোনো বিচ্ছেদ নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট দুজনের সম্পর্কের গভীরতা এবং সক্রিয়তার উপর। আমার বিশ্বাস স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের পারদ সময় এবং পরিস্থিতির কারণে ওঠানামা করে। তাই অনেক কারণেই বিচ্ছেদ হতে পারে।
বিচ্ছেদের পর তিনি শাওনকে বিয়ে করেন। হুমায়ূন গুলতেকিনের সঙ্গে কাগজে-কলমে লোকদেখানো সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার পাশাপাশি শাওনকে ব্যবহার বা দ্বিতীয় স্ত্রী করার মতো অসততা করেননি। মনে হচ্ছে সেই অসৎ কাজটি করলেও তাঁর সমালোচকদের আপত্তি ছিল না– যতটা আপত্তি দেখা যায় শাওনকে যথাযথ স্ত্রীর মর্যাদা দেওয়ায়!
গুলতেকিন সম্পর্কে খুব অল্পই জানা যায়। তিনি একজন মমতাময়ী সফল মা। গুলতেকিন এবং তাঁর ছেলেমেয়েদের প্রতি সবাই সহানুভূতিশীল। বিয়ে বিচ্ছেদ যে কোনো নারী বা পুরুষের জন্যই বেদনার। কিন্তু তাঁর অতিউৎসাহী ভক্তরা তাঁকে সহানুভূতির নামে সেই বেদনাদায়ক ঘটনা এবং হুমায়ূন আহমেদ নামক 'অতীত' ক্রমাগত স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে; তাঁকে করুণায় ভাসিয়ে দিচ্ছে। 'দুঃসহ একাকী বিচ্ছেদের জ্বালা সহ্য করছেন', 'তাঁর জীবন ধ্বংস হয়ে গেছে'-– ঘটনার দীর্ঘদিন পর সহানুভূতির নামে এসব আহাজারি একজন মানুষকে আত্মবিশ্বাসহীনই শুধু করে– তাঁর জীবনে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আনে না।
বিচ্ছেদ মানেই কষ্ট। কিন্তু এ কষ্ট কীভাবে দূর করা যায়, মাথা উঁচু করে, মর্যাদার সঙ্গে সামনের দিনগুলি সুন্দর করা যায়, সে ব্যাপারে এই ভক্তদের কিছু বলতে শোনা যায় না। কারণ এরা পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা বা আচরণে একজন তালাকপ্রাপ্ত বা বিধবা নারীকে করুণা করে যাতে তিনি আত্মবিশ্বাসহীন হন– তার উপর কর্তৃত্ব করতে পারে যাতে তিনি আত্মমর্যাদাহীন হন।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা একজন নারীকে যেভাবে দেখতে চায় আপাতদৃষ্টিতে তার সব গুণাবলী গুলতেকিনের ভক্তরা তাঁর মাঝে দেখতে পাচ্ছে। বলা হচ্ছে, হুমায়ূনের প্রতি গুলতেকিনের ভালোবাসা এখনও অটুট (!)। তিনি ত্যাগী, সহনশীল, আপোষকামী ইত্যাদি। এসব গুণাবলী আসলে পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধ টিকিয়ে রাখার কূটকৌশল। এসব তাঁকে মহিমান্বিত করার নামে প্ররোচিত করা, যাতে তিনি এভাবেই সঙ্গীহীন থেকে, হুমায়ূন আহমেদকে (অতীত) মনে করে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বাকি জীবন পার করেন।
পাশাপাশি এতে অন্য নারীদের জন্য এই বার্তাই দেওয়া হচ্ছে যে, স্বামী তাকে ত্যাগ করলেও তাকেই ভালোবাসতে, সব কিছু নীরবে সহ্য করতে হবে। তাকে আনুষ্ঠানিক জীবন (Public life) থেকে নিজেকে গুটিয়ে রেখে সন্তান মানুষ করতে হবে। যাপন করতে হবে সঙ্গীহীন জীবন যাপন এবং হতে হবে (তথাকথিত) ত্যাগী নারী!
এসব গুণ নারী সম্পর্কে গৎবাঁধা ধারণা (Stereotype) আরও পোক্ত করে। যেমন, একসময় হিন্দু নারীদের নানা উপমায় ও গুণে মহিমান্বিত করে, স্বর্গের মূলা দেখিয়ে মৃত স্বামীর সঙ্গে পুড়িয়ে মারা হত। আর এখন অধিকাংশ বিধবা বা স্বামীবিচ্ছিন্ন নারীকে পুরুষতান্ত্রিক নিষ্ঠুর কূটকৌশলে ধীরে ধীরে নিঃশেষ করার ব্যবস্থা করা হয়।
আমাদের দেশে সাধারণত বিয়ে বিচ্ছেদকে নারীর জন্য অবমাননাকর মনে করা হয়। তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে গুলতেকিনের মতো নারীরা সন্তান লালন-পালন করেন; সঙ্গীহীন, বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করেন। কারণ তাদের সেটাই করতে বলা হয় বা বাধ্য করা হয়। বিয়ে বিচ্ছেদের পর গুলতেকিনকে জনসমক্ষে কোনো কমর্কাণ্ডে দেখা যায়নি। আনুষ্ঠানিক জীবন (Public life) থেকে তাঁর বিচ্ছিন্নতা মহিমান্বিত করছে তাঁর ভক্তরা।
আমরা জানি না গুলতেকিনের এই নিভৃত জীবনযাপন স্ব-ইচ্ছায় নাকি তিনি তাঁর চারপাশের পুরুষতান্ত্রিক রীতি-নীতি, কর্তৃত্বে বাধ্য হয়েছিলেন। এখন তাঁকে হুমায়ূন-কেন্দ্রিক আনুষ্ঠানিকতায় দেখা যাচ্ছে। আর এতে তাঁর ভক্তরা হুমায়ূনের প্রতি তাঁর অটুট ভালোবাসার গভীরতা দেখতে পাচ্ছে! আমরা জানি না জনসমক্ষে তাঁর এই অংশগ্রহণ স্বেচ্ছায় নাকি তাঁকে দিয়ে এটা করানো হচ্ছে।
বিচ্ছেদের পর গুলতেকিন যদি বিয়ে করে নতুন জীবন শুরু করতেন, সেই স্বামীকে নিয়ে হুমায়ূন-কেন্দ্রিক আনুষ্ঠানিকতায় উপস্থিত হতেন (সেটা হয়তো তাঁকে করতেই দেওয়া হত না), তাহলে আজকে যারা তাঁকে মহিমান্বিত করার নামে করুণা করছে, এরাই হয়তো তাঁকে নিয়ে নেতিবাচক সমালোচনায় মুখর হত।
বিচ্ছেদপ্রাপ্ত বা বিধবা হয়ে একজন নারী বাকি জীবন একাকী, সঙ্গীহীন কাটাবেন, সমাজ এটা প্রত্যাশা করে কেন?
কোনো নারী যদি সাহস করে পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধ চ্যালেঞ্জ করেন তাহলে তাকে সইতে হয় নোংরা, অসম্মানজনক সমালোচনা। এই সব তথাকথিত মূল্যবোধের সঙ্গে প্রচলিত আইন বা ধর্মীয় নীতির সম্পর্ক নেই। শাওন পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার প্রত্যক্ষ আক্রমণের শিকার হয়েছেন; কারণ তিনি সাহস ও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে হুমায়ূনের ভালোবাসায় সাড়া দিয়েছেন।
সে সময় শাওন এবং হুমায়ূনের মধ্যে সামাজিক অবস্থান ও ক্ষমতার বিশাল ব্যবধান ছিল। তাই হুমায়ূন যদি শাওনকে তাঁর জীবনে আমন্ত্রণ না জানাতেন বা প্রবেশাধিকার না দিতেন, শাওনের পক্ষে কখনও গুণে, যশে, খ্যাতিতে, সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত হুমায়ূনের একান্ত সীমানায় প্রবেশ সম্ভব হত না। শাওনের সে রকম গুণাবলী ও যোগ্যতা আছে বলেই হুমায়ূন তাঁকে জীবনসঙ্গী করেছেন।
শাওন একজন কর্মক্ষেত্রে সক্রিয় নারী, এক মমতাময়ী মা এবং সে সঙ্গে দায়িত্বশীল স্ত্রীও বটে। নিজ অধিকার আদায়ে তিনি দৃঢ়, আত্মবিশ্বাসী ও আত্মমর্যাদাশীল (Assertive)। যা পুরুষতান্ত্রিক রীতি-নীতি চ্যালেঞ্জ করে। যার ফলে তাঁর বিরুদ্ধে চলছে নেতিবাচক সমালোচনা ও কুৎসা রটানো।
আমাদের সমাজে একজন মেয়ে Assertive হলে তাকে বলা হয় উদ্ধত বা Aggressive– আর একজন ছেলে Assertive হলে তাকে বলা হয় আত্মমর্যাদাশীল! জীবিতকালে হুমায়ূন আহমেদকেও এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার রোষানল সহ্য করতে হয়েছে। মনে হয় তিনি তাঁর পরিবার থেকেই প্রথম আঘাতটি পেয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর শাওনের প্রতি তাদের অবস্থান, আচরণে সেটাই স্পষ্ট হচ্ছে।
একজন নারী কারও মেয়ে, হয়তো কারও বউ বা কারও মা, কিন্তু সবার আগে তার পরিচিতি তিনি একজন মানুষ। নারী-পুরুষ প্রত্যেকেরই একান্ত নিজস্ব জীবন আছে, সে জীবন ঘিরে ভালোলাগা-ভালোবাসা আছে। নারীর সেই জীবন অস্বীকার করা, তার নতুন জীবনে প্রবেশে নিরুৎসাহিত করা বা কৌশলে বাধা দেওয়া নিষ্ঠুর আচরণ।
একইভাবে তথাকথিত সহানুভূতির নামে নারীকে শোষণ, নারীর উপর কর্তৃত্ব করা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কুৎসিত বহিঃপ্রকাশ। স্বেচ্ছায়, ব্যক্তিগত পছন্দমতো জীবন সুন্দর করার অধিকার সবারই আছে। থাকা উচিৎ।
শাওন, গুলতেকিনসহ সকল একাকী নারীর জন্য শুভকামনা।