Published : 02 Mar 2020, 05:37 PM
'স্বামীর মার খান ২৫ শতাংশ নারী'। এমন তথ্য পেলে গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করাই স্বাভাবিক। দৈনিক প্রথম আলোও সম্প্রতি তাই করেছে। যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় ছেপেছে; দ্বিতীয় প্রধান শিরোনাম হিসেবে চার কলাম জুড়ে। খবরের তথ্যের উৎস বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর একটি জরিপ। খবরটি প্রকাশ হয় গত ২৫ ফেব্রুয়ারি।
সেদিন মোবাইলে ইপেপার খুলতেই খবরটি চোখে পড়েছিল। এর এক/দু'দিন পর পরিসংখ্যান ব্যুরোর ওয়েবসাইট দেখছিলাম। সেখানে চোখে পড়ল জরিপের সংক্ষিপ্ত প্রকাশনাটি। সেখানে দেখতে পেলাম জরিপের প্রশ্নটি, ইংরেজিতে : "Percentage of women age 15-49 years who state that a husband is justified in hitting orbeating his wife in at least one of the following circumstances: (1) she goes out without telling him, (2) she neglects the children, (3) she argues with him, (4) she refuses sex with him, (5) she burns the food" জরিপে এই প্রশ্নে 'যৌক্তিক'-এর পক্ষে উত্তর দিয়েছেন অংশগ্রহণকারীদের ২৫.২ শতাংশ। আর এই উত্তরকেই স্বামীর মার খাওয়া নারীর শতাংশ হিসেবে বিবেচনা করেছে প্রথম আলো।
বিবেচনাটি ভুল ছিল। এই ভুল নিয়ে পরদিন (২৬শে ফেব্রুয়ারি) পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় সংশোধনী ছাপে পত্রিকাটি। এতে বলা হয় : "'স্বামীর মার খান ২৫ শতাংশ নারী' শিরোনামে গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। প্রকৃত তথ্য হবে-পাঁচ কারণের অন্তত একটির জন্য স্বামীর হাতে মার খাওয়া যৌক্তিক মনে করেন বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সমীক্ষায় অংশ নেওয়া ২৫ দশমিক ৪ শতাংশ নারী। তথ্য উপস্থাপনার ত্রুটির জন্য আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত। বা. স."
সংশোধনীটি প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছে। তবে অবস্থান বিবেচনায় এটি খবরটির সমান বা কাছাকাছি গুরুত্ব পায়নি। 'স্বামীর মার খান ২৫ শতাংশ নারী'- চার কলাম খবরের ভুল নিয়ে সংশোধনীটি ছাপা হয় এক কলামে। চার কলাম শিরোনামের একটি ভুল খবর জোরালো ভাবে পাঠকের চোখে-মনে চেপে বসেছিল। এক কলামের সংশোধনী স্বাভাবিকভাবেই নীরবে চোখ এড়িয়ে যায়।
খবরে ভুল তো নানারকম হতে পারে। নারীর মার খাওয়া খবরের মতো বড় ধরনের ভুল হতে পারে। আবার কোনো বিষয়ের খবরের ভেতরে কোনো একটি তথ্য ভুল হতে পারে। আবার কখনো কখনো পুরো খবরটিই ভুল হতে পারে। এই সব ভুলের সংশোধনী কি এক কলামই হবে? সংবাদমাধ্যম তার ভুল কিভাবে সংশোধন করবে? ভুল খবর, ভুল করে হলেও, গুরুত্বসহ প্রকাশ হয়ে গেল। তার প্রভাব কমাতে সংবাদমাধ্যমের কি উচিত সংশোধনীটি সমান গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করা? যেকোনো ভাবে সংশোধনী প্রকাশেই তার দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়?
আকার-আকৃতির বিষয়টি বাদ দিয়েও সংশোধনীটি আগ্রহোদ্দীপক। ধরা যাক এমন একজন পাঠক এই সংশোধনীটি পড়ছেন যিনি প্রথম আলোর ২৫শে ফেব্রুয়ারির প্রতিবেদনটি পড়েননি। তাহলে এই সংশোধনীটি পড়ে তিনি কী বুঝবেন? তিনি বুঝবেন, পত্রিকাটিতে 'স্বামীর মার খান ২৫ শতাংশ নারী' শিরোনামে একটি খবর প্রকাশ হয়েছিল। কিন্তু এই শিরোনামটি যে সম্পূর্ণ ভুল ছিল তা কি ওই পাঠক বুঝতে পারবেন? পারবেন না। কারণ সংশোধনীর কোথাও বলা হয়নি যে এটি ভুল শিরোনাম ছিল। ভুল খবরের সূচনায় পাঁচটি কারণ উল্লেখ করে বলা হয়েছিল যে এসব কারণে নারীরা মার খান। এই সূচনা যে ভুল সেকথাও সংশোধনীতে উল্লেখ থাকতে পারত। এর ফলে আগের দিনের ভুল খবরটি পড়েননি এমন পাঠকরাও ভুলটি বুঝতে পারতেন।
প্রথম আলো অনলাইন সংস্করণেও খবরটি সংশোধিত হয়েছে। অনলাইনে খবরটির শিরোনাম করা হয়েছে :
'৫ কারণের যেকোনোটিতে স্বামীর মার যৌক্তিক ভাবেন ২৫% নারী'। মুদ্রিত সংস্করণের এক কলামের সংশোধনী অনলাইনে এসে জায়গা করে নেয় খবরের শেষে। যুক্ত হয়েছে এই সংশোধনী : "সংশোধনী : 'স্বামীর মার খান ২৫ শতাংশ নারী' শিরোনামে প্রথম আলোর ২৫ ফেব্রুয়ারির (২০২০) প্রিন্ট ও অনলাইনে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। প্রকৃত তথ্য হবে—পাঁচ কারণের অন্তত একটির জন্য স্বামীর হাতে মার খাওয়াকে যৌক্তিক মনে করেন সমীক্ষায় অংশ নেওয়া ২৫ দশমিক ৪ শতাংশ নারী। এখানে তথ্যটি সংশোধন করা হলো। এ জন্য আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত। বা. স."
অনলাইন মাধ্যমে সংশোধনীর ক্ষেত্রে প্রচলিত রীতি হলো শিরোনামে সংশোধন হলে শিরোনামের পাশে বন্ধনীতে সংশোধিত লিখে দেয়া। ছোটখাট তথ্যগত ভুল হলে তা সংশোধন করে খবরের শেষে নোটি আকারে লিখে দেয়া হয়। তবে অনলাইন সংশোধনের ক্ষেত্রে ওয়াশিংটন পোস্টের দুয়েকটি গাইডলাইনটি আমরা বিবেচনা করে দেখতে পারি : (১) খবরে সংশোধন করতে হবে এবং সংশোধনটি খবরের একেবারে ওপরেও উল্লেখ করতে হবে, (২) সংশোধনী ও ব্যাখ্যা স্পষ্ট, সংক্ষিপ্ত ও সরাসরি হতে হবে। এগুলো এমন হতে হবে যা সংশ্লিষ্ট খবরটি পড়েননি এমন ব্যক্তিরও বোধগম্য হবে। সংশোধনী পড়ে যেন যে কেউ বুঝতে পারেন ভুলটি কেন কিভাবে সংশোধন করা হয়েছে।
অনেক অনলাইন সংবাদমাধ্যম অনেক সময় ছোটোখাট ভুল 'নীরবে' সংশোধন করে ফেলে। বিশেষ করে চলমান ঘটনার (ডেভেলপিং স্টোরি) ক্ষেত্রে এমন হয়। তারা উল্লেখ না করলেও সেই সংশোধন পাঠকের ঠিক নজরে পারে। তখন এরকম 'নীরব' সংশোধনকে পাঠক অসাধুতা হিসেবে বিবেচনা করেন। তিনি বিভ্রান্ত হন। সংশোধনের আগেরটি ঠিক না পরেরটি তা তিনি নিশ্চিত হতে পারেন না। তাই তার মনে ওই সংবাদমাধ্যমের তকমা দাঁড়ায় এমন- 'ওরা ঠিক ছাপে না'। উল্টোদিকে সংশোধনের বিষয়টি উল্লেখ করে ভুল সংশোধন করলে তা হয় ইতিবাচক। পাঠক নিশ্চিত হতে পারেন যে আগেরটি নয় সংশোধিত রূপটিই ঠিক। তিনি মনে রাখেন যে এই সংবাদমাধ্যম 'ভুল করলেও সংশোধন করবেই'। যে সংবাদমাধ্যম পাঠকের মনে অন্তত দ্বিতীয় ধারণাটি দিতে পারে পাঠকে সেখানে নির্ভরতায় ফিরে আসেন।