Published : 04 Jan 2020, 04:36 PM
আলোচনার চেয়েও সমালোচনার গ্লানি নিয়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ তাদের ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করছে। বাঙালি জাতির মুক্তির স্বপ্নদ্রষ্টা, সর্বকালের মহামানব, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে গড়া 'বাংলাদেশ ছাত্রলীগ' শিক্ষা, শান্তি ও প্রগতি'র স্লোগান আর পুঁথিগত বিদ্যা-শিক্ষার সাথে-সাথে দেশপ্রেম, মানুষ-মানবতা আর নৈতিক মূল্যবোধের জায়গাটি কতিপয় নেতাকর্মীর কারণে আজ ফিকে হয়ে আছে। ভাইলীগের নানান বিতর্কের কারণে সংগঠন 'বাংলাদেশ ছাত্রলীগ' আজ সংবাদ মাধ্যমে নেতিবাচক শীর্ষ শিরোনাম (!)- এটি যেমন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের জন্য অত্যন্ত লজ্জার বিষয়, অন্যদিকে ছাত্রলীগের গৌরব-ঐতিহ্যময় ইতিহাস আর আন্দোলন-সংগ্রামের পটভূমির সাথেও সাংঘর্ষিক।
সর্বশেষ বুয়েট ছাত্রলীগের কতিপয় নেতাকর্মীর হাতে নিমর্মভাবে খুন হওয়া আবরার বিষয়টি পুরো জাতিকে মর্মাহত করেছে। যদিও আবরার হত্যার সাথে যারা জড়িত ছিল, তাদের বেশিরভাগই অনুপ্রবেশকারী। একদা ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিল। তারও আগে এই ছাত্রলীগ তাদের গৌরবময় ইতিহাসকে পাশ কাটিয়ে স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকারের বংশধর ছাত্রশিবিরের ৯৭ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ২০১৮ সালে চুড়ান্ত পর্যায় নিয়ে যেতে সব রকমের চেষ্টা করেছে। বিনিময় মোটা অংকের টাকা ভাগ বাটোয়ারা করেছে। আর এর নেতৃত্বে কাজ করেছে ছাত্রলীগের ভিতর ছাত্রশিবিরের উইং।
তথাকথিত ভাইলীগ বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সর্বোচ্চ ক্ষতি করেছে। নিজস্ব রাজনীতি, নিজেস্ব গ্রুপ টিকিয়ে রাখার জন্য স্বাধীনতাবিরোধী রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত, এমন অনেককে নিজের লোক বানিয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত করে বঙ্গবন্ধুর ছাত্রলীগকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র করেছে। কতিপয় সাবেক নেতা এই ছাত্রলীগকে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যবহার করেছে। যেকোনো কমিটিতে নেতাকর্মীর আদর্শিক জায়গা বিবেচনার চাইতে কত টাকায় কমিটি অনুমোদন করা যায়, কে কার লোক, কাকে দিয়ে নিজেস্ব ফায়দা টিকিয়ে রাখা সম্ভব-এগুলোকে মূল্যায়ন করেছে। আর এগুলোর কারণে ছাত্রলীগ এমন এক অবস্থায় গিয়েছিল তখন বঙ্গবন্ধু কন্যা নিজেই কর্মী বাচাই করে ছাত্রলীগ কমিটি চূড়ান্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কিন্তু তাতেও পরিচ্ছন্ন রাজনীতি আর ছাত্রলীগ তাদের গৌরবময় ইতিহাসের পথে হাঁটতে ব্যর্থ হয়েছে।
বাংলাদেশের ইতিহাসের সাথে ছাত্রলীগের ইতিহাস এক কদম এগিয়ে। ছাত্রলীগের ইতিহাস ছাড়া স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের ইতিহাস অসম্পূর্ণ। এই ইতিহাস থেকে জানা যায়, টগবগে তরুণ শেখ মুজিব কলকাতায় নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন যার হাত ধরেই ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের জন্ম হয়েছিল। আর তখনকার পরিস্থিতিও ছিল একেবারে ভিন্ন। সময় আর বাস্তবতায় কলকাতার নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ মূলত সর্বভারতীয় মুসলিম লীগেরই আদর্শ লালন করত, ধারণ করত। তবে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের মূলত জন্মলাভ ছিল মুসলিম লীগের আদর্শের বাইরে।
কঠিন এক বাস্তবতায় মুসলিম ছাত্রলীগের রাজনীতি ছিল আরও কঠিন থেকে কঠিনতম। আর নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের নেতারাই পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের মূল দাবিদার হতে চাইল। অন্যদিকে চুয়াল্লিশের পরে বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের আর কোনও কাউন্সিল হয়নি। নতুন কমিটি গঠন করা হলে শাহ আজিজুর রহমান আবারও সাধারণ সম্পাদক পদে থাকতে চাইলে প্রতিবাদ করেন শেখ মুজিব। সাথে যোগ দিলেন মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, আবদুল হামিদ, আবদুল মতিন খান চৌধুরী, সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ আরও অনেক ছাত্রনেতা। তখন এদের নিয়েই টগবগে তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিব মিলিত হয়েছিলেন ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হল মিলনায়তনে। সভায় কনভেনর নিযুক্ত করেন রাজশাহীর নইমউদ্দিন আহমেদকে। আর সেসময় বিভিন্ন জেলা থেকে ১৫ জন সদস্য নেওয়া হয়েছিল। অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন শেখ মুজিব (জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান), আবদুর রহমান চৌধুরী (পরে বিচারপতি হন), অলি আহাদ (রাজনীতিবিদ), শেখ আবদুল আজিজ (রাজনীতিবিদ), আবদুল কুদ্দুস চৌধুরী (পরে বিচারপতি হন)। ওই সময় তরুণ শেখ মুজিব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগের ছাত্র ছিলেন। ১৯৫৩ সালে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে নামকরণ করা হয় 'পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ'।
পূর্ব বাংলায় ছাত্রলীগের আন্দোলন সংগ্রাম শুরু হয় ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। তারপর থেকে পূর্ব বাংলায় যত আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে, তার সবক'টির সাথেই সরাসরি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন।
সংগঠন ছাত্রলীগ যখন শিশুর বয়স পেরিয়ে কৈশরের মাঝ পথে পা দিয়েছে, তখনই ছাত্রলীগকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব বহন করতে হয়েছে। তরুণ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে ৫৪'র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে ছাত্রলীগ সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল আইয়ুব খান সরকারের শরিফ কমিশন শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা অপ্রতিরোধ্য গণআন্দোলনের ফলে স্বৈরাচার আইয়ুব খান নেতৃত্বাধীন সরকার ছাত্রদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে যা বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন নামে অভিহিত করা হয়।
তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৬ সালে বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা পেশ করেন শেখ মুজিবুর রহমান। তখন পাকিস্তান সরকার একে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে বলে নানানভাবে প্রচার করতে থাকে। কিন্তু বাঙালি জাতির ওই মুক্তির সনদের প্রতি অনড় থাকেন বঙ্গবন্ধু। দেশব্যাপী ছয়দফার প্রচার কতটুকু জরুরি-তখনই শেখ মুজিবুর রহমান অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। আর তাই ছাত্রলীগের ওপর আস্থ রেখে তিঁনি সংগঠনটির নেতাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, জেলায় জেলায় অবস্থান সুসংহত করে ছয় দফার পক্ষে ব্যাপক পচ্রারণা চালাতে। মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে ছয় দফার পক্ষে জনমত তৈরি করতে। বঙ্গবন্ধুর সেই নিদের্শ পালন করেছে ছাত্রলীগ। সারা বাংলার মানুষের কাছে ছয় দফার যৌক্তিকতা তুলে ধরেছে। মানুষকে তার অধিকারের ব্যাপারে সচেতন করেছে ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগ বঙ্গবন্ধুর আস্থাকে দায়িত্ব মনে করেছে।
৬৯'র গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রলীগের অবস্থান ছিল রাজপথে। যার ফলে স্বৈরাচার আইয়ুব খানকে স্বৈরশাসন ছাড়তে হয়। ৭০'র নির্বাচন, আগড়তলা মামলাবিরোধী আন্দোলনেও ছাত্রলীগের ভুমিকা ছিল অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য।
ছাত্রলীগের একটি নতুন সোনালি ইতিহাস শুরু হয় ৬৯'র গণআন্দোলন থেকে। ১৯৬৮ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন ও রাজবন্দিদের মুক্তির দাবিতে রাজপথে ছাত্রলীগ। যদিও আন্দোলনটির সূত্রপাত করেছিলেন তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের ছাত্ররা। এর পরপরই তা পূর্ব বঙ্গের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে তোফায়েল আহমদ সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন নাজিম কামরান চৌধুরী। ওই আন্দোলন চলাকালে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন কারাগারে। পাকিস্তান সরকার ওই আন্দোলন দমন করতে ব্যর্থ। বিশ্লেষকদের মতে, আইয়ুব খানের বিদায় ঘণ্টা তখন সময়ের ব্যাপার ছিল। কারণ, এই ছাত্রলীগ অপ্রতিরোধ্য আন্দোলন তৎকালীন গড়ে তুলেছিল।
আমার এই ছোট্ট লেখায় বা অল্প কথায় ছাত্রলীগের গৌরবময় ইতিহাস লিখে শেষ করা যাবে না। ছাত্রলীগের ইতিহাস তৈরি হয়েছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের রক্ত দিয়ে। নিজের সর্বস্ব ত্যাগ আর জাতির মুক্তির সংগ্রামে এই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা নিজের জীবন দিতেও সংকোচ করেনি। আমিও এই সংগঠনের কর্মী ছিলাম। কিন্তু মাঝে মাঝে দুঃখ হয়, আজকের ছাত্রলীগ কেন এতোটা সমালোচিত? কেন নেতিবাচক শিরোনামে ছাত্রলীগের নাম?
তথাকথিত 'ভাইলীগ' এর কারণে এই ছাত্রলীগ ভুলে যায় তাঁদের ১৭ হাজার নেতাকর্মী মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়ে লাল-সবুজের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছে। এই ছাত্রলীগের ইতিহাস, বাংলাদেশের ইতিহাস। স্বাধীন বাংলাদেশের আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস। ছাত্রলীগ তাদের ইতিহাসের জায়গা থেকে মুল্যায়ন করতে হবে। কারণ, তাদের আছে এক অসাধারণ নেতৃত্ব। যিনি শুধু বাংলাদেশই নয়, বিশ্বের প্রতিটি দেশেই যার প্রশংসা বিদ্যমান। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার প্রতিটি রাজনৈতিক বক্তব্য, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, রাজনৈতিক মিশন-ভিশন ছাত্রলীগের জন্য পাঠ্য বিষয়। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী প্রতিটি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীর জন্য গবেষণার বিষয় হতে পারে।
তথাকথিত ভাইলীগ পরিহার করে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের উচিত হবে- বঙ্গবন্ধুর আদর্শ নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানো। শেখ হাসিনার নেতৃত্বকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানে ছাত্রলীগ তাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রতি ন্যায় বিচার করা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার পরিবেশ, শিক্ষার্থীদের মৌলিক বিষয়গুলো পূরণে আন্তরিকতার সাথে কাজ করা। শেখ হাসিনার উন্নয়নের দর্শন, অসাম্প্রদায়িক-উদার গণতন্ত্রের বাংলাদেশের আজকের পটভূমি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে দেওয়া। যেখানেই গুজব, অপপ্রচার সেখানেই ছাত্রলীগ সঠিক তথ্য-উপাত্ত নিয়ে মানুষকে বিভ্রান্তির হাত থেকে রক্ষা করাও গৌরবময় ইতিহাস-ঐতিহ্যের ছাত্রলীগের নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য।