Published : 02 Sep 2019, 02:56 PM
রাজধানীর পূর্বাচলে ১০ কাঠা প্লট চেয়ে গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রীবরাবর আবেদন করে ব্যাপক সমালোচনার মুখে সেই আবেদনপত্রটি প্রত্যাহার করেছেন বিএনপি থেকে সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা। 'দলীয় নেতাকর্মীদের অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে' তিনি ওই আবেদন প্রত্যাহার চাইছেন বলে উল্লেখ করেছেন চিঠিতে।
সরকারের কাছে রুমিন ফারহানার প্লটের জন্য আবেদনপত্রটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে ব্যাপক সমালোচিত হন। তিনি সব সময় এই সরকারকে 'অবৈধ সরকার' বলে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেন। নীতি নৈতিকতার বুলি আওড়ান। সেই তিনি যখন সামান্য ১০ কাঠা প্লটের জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানান, তখন নানা মহল থেকে সমালোচিত হন। প্রসঙ্গত, ঢাকায় রুমিন ফারহানার প্লট, ফ্ল্যাট নেই এমন মিথ্যা তথ্য দিয়ে তিনি আবেদন করেন। তার এই আবেদন প্রকাশিত হলে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। কেউ কেউ মন্তব্য করেন, 'গণতন্ত্রতের মা কারাগারে, আর সন্তান অট্টলিকা খোঁজে।' আবার কেউ বলেন, 'রুমিন হয়ত শিগগিরই বিয়ে-শাদি করবেন তাই প্লটের জন্য আবেদন করেছেন।'
রুমিনফারহানার বাবার রাজনৈতিক সহকর্মী ডেমোক্রেটিক লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইফুদ্দিন মনি গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, রুমিন ফারহানার লালমাটিয়ায় ৩ কাঠার প্লট আছে। একাদশ জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত মহিলা আসন নির্বাচনে দেওয়া হলফনামায় রুমিন ফারহানা নিজেই স্বীকার করেছেন, তার এলিফ্যান্ট রোডে১৮৫০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট আছে। ওই ফ্ল্যাট তিনি তার মায়েরকাছ থেকে পেয়েছেন। এছাড়া চট্টগ্রামেও তার প্লট রয়েছে। মিথ্যাচারেরমাধ্যমে সরকারের কাছে প্লটের আবেদন করে আসলে রাজনীতিবিদ হিসেবে রুমিন ফারহানানিজের 'জাত'কেই কেবল নতুন করে চিনিয়েছেন।
আসলে একটি১০ কাঠা প্লটের আর্থিক দিকটিখুবগুরুত্বপূর্ণবিষয়নয়,গুরুত্বপূর্ণহচ্ছেনৈতিকতারবিষয়টি।রুমিন ফারহানা কি এতটাই অস্বচ্ছল যে, তারএকটি ১০ কাঠার প্লট না হলে চলছিলই না? তাঁর রুটি-রুজিরকি এমনই করুণ দশা?
এটা অবশ্য শুধু রুমিন ফারহানার একার সমস্যা নয়, আমাদের দেশের নেতানেত্রীদের কমন সমস্যা। অনেকেই এমন সুযোগ গ্রহণ করেন, এমন সুযোগ বাগিয়ে নেওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকেন। এমনকি যাদের সঙ্গতি আছে, তারাও চান বাড়তি সুযোগ। এ ক্ষেত্রে তাদের বিবেকে একটুও আটকায় না। সম্প্রতি এমন একটি 'অনৈতিক সুযোগ' গ্রহণ করেছেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি এমপি না হয়েও শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির সুবিধা নিয়েছেন। সাবেক এই অর্থমন্ত্রীর আমদানি করা টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার জিপের শুল্ক কর আরোপ থেকে অব্যাহতি দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এনবিআর থেকে এ সংক্রান্ত একটি বিশেষ আদেশ জারি করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, আবুল মাল আবদুল মুহিত দশম জাতীয় সংসদের সংসদ সদস্য ও অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও ১১তম জাতীয় সংসদে আর নির্বাচন করেননি। সেজন্য তিনি শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির সুবিধা প্রাপ্ত না হলেও বাস্তবিক অবস্থার নিরিখে তাকে সংসদ সদস্যের মতোই শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির সুবিধা দেয়ার বিষয়টি যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছে। প্রশ্ন হলো, 'বাস্তবিক অবস্থা'টা কি? তিনিও কি এতটাই অস্বচ্ছল যে একটি গাড়ি কেনার সামর্থ্য পর্যন্ত নেই? সাধারণ মানুষের করের টাকায় 'বিশেষ সুযোগ' গ্রহণে এমন মহান ব্যক্তির বিবেকে কি একটুও বাধল না? আমাদের দেশে প্রবীণ নেতারাও যদি ত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে না পারেন, সামান্য সুযোগ-সুবিধা, লোভলালসার ঊর্ধ্বে উঠতে না পারেন, তাহলে আর সমাজে আমরা কাদের আদর্শ মানব? সমাজটা কি এভাবেই সুবিধাবাদিতায় ভরে যাবে?
উল্লেখ্য,সংসদ সদস্যদের জন্য শুল্কসহ যাবতীয় করমুক্ত গাড়ি আমদানির প্রথম সুযোগ করে দেন অসংখ্য অপকর্মের হোতা সাবেকরাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। কিন্তু এই ধারা এখনও চলছে। স্বৈরাচারপ্রবর্তিত 'রাষ্ট্রীয় উপঢৌকন' এখন 'আমের আচারে' পরিণত হয়েছে। আগে নিয়ম ছিল একজন সংসদসদস্য একবার শুধু শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির সুযোগ পাবেন। পরে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিতসরকারের আমলে নিয়ম পরিবর্তন করে এমপি-বান্ধব করা হয়। এখন সংশোধিত নিয়মে একজন সংসদ সদস্যযতবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবেন, প্রতিবারই একটি করে শুল্কমুক্ত জাড়ি আমদানি সুযোগপাবেন।
সাড়ে তিনশ এমপির শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানিরহাজার হাজার কোটি টাকা 'ভর্তুকি' দিতে হচ্ছে। অথচ এই নিয়ে আমাদের মহান মন্ত্রী-এমপিদেরকোনো বিকার নেই, নেই কোনো অনুশোচনা। আজ পর্যন্ত কোনো মন্ত্রী বা এমপি এই 'গণবিরোধী'নিয়মের প্রতিবাদ করেননি। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ,বিএনপি, জাতীয়পার্টি, জামায়াত-সবাইএকই রসুন। সবার ভূমিকা ও চরিত্রই এক!
আমাদের দেশের মন্ত্রী-এমপিরা যে শুধুশুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির সুযোগ পাচ্ছেন, তাই নয়, তারা এই গাড়ি বিক্রিও করে দিচ্ছেন।গত ১০টি সংসদের সংসদ সদস্যদের নামে আনা গাড়িগুলোর ৮০ শতাংশই বিক্রিকরে দেওয়া হয়েছে। এমপিদের বিনাশুল্কে আনা গাড়ি দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা কিনেনেন। চার বছর গাড়ির কাগজপত্র এমপির নামেই থাকে। পরে সেটা নতুন মালিকের নামে হয়ে যায়।বেশিরভাগ এমপিইচড়েন তুলনামূলক কম দামের গাড়িতে।কিন্তু আমদানি করেন দামি গাড়ি!এমপিদের শুল্কমুক্তগাড়ির প্রতি সবসময় চোখ থাকে বড় বড় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতির। গাড়িরডিলাররাও তক্কে তক্কে থাকেন। কেউ নতুন এমপি হলেই ছুটে যান তার কাছে। শুরু হয় প্রতিযোগিতা, কার আগে কে অফার দেবেন,কে কত টাকা বাড়তিদেবেন এ নিয়ে চলেদরকষাকষি। এটা এমপিবাহাদুরদেরবিনা পুঁজির বিশাল এক ব্যবসা!
পৃথিবীতে এমন একটি দেশও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে কোটি মানুষ অনাহারে থাকে, দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে আর সেই দেশের জনপ্রতিনিধিরা কোটি টাকার গাড়ি হাঁকায়। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতেও এমন বিধান নেই। ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, সুইডেন, ইতালি, জার্মান, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ভারত প্রভৃতি দেশে এমপিদের জন্য যাতায়াত ভাতা দেওয়া হয় সেই দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করে। নিজ নিজ সামর্থ্য বিবেচনায়। অথচ বাংলাদেশ যেখানে হাজার হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক ঋণের বোঝায় জর্জরিত, সেখানকার এমপিদের এই বিলাসিতা কেন? এমন বিলাসী জীবনযাপন করে, 'বিশেষ' সুবিধা গ্রহণ করতে তাদের লজ্জা করে না?
এমপি-মন্ত্রী হলেই কি তার বাড়ি গাড়ি ফ্রি করে দেওয়া হবে? এই জন্যই কি রাজনীতি করেন? এই কি তাদের জনসেবার নমুনা? ফ্ল্যাট, প্লট, পারমিট, অফিস, ল্যাপটপ, গাড়ি, আসবাবপত্র, থোক বরাদ্দ, বেতন, ভাতা– এমপিরা কী না গ্রহণ করছেন?
অথচ সংবিধানে বর্ণিত হয়েছে, 'যিনি প্রজাতন্ত্রের কর্মে কোন লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত তিনি সাংসদ হওয়ার অযোগ্য।' অর্থাৎ এমপিরা জনতার স্বার্থে এমন চেতনামণ্ডিত থাকবেন এবং জনকল্যাণে এমন স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে নিয়োজিত থাকবেন যে, প্রজাতন্ত্রের বাধ্যগত কর্মচারীদের মতো মজুরি বা সুযোগসুবিধাগ্রহণের মানসিকতা তাদেরথাকবে না। তাদের ভূমিকা সত্যিই মহান। তারাজননেতা, জনসেবক, আইন প্রণেতা। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের মতো বেতন-ভাতা, সুযোগসুবিধা ইত্যাদি চাওয়ার মানসিকতা তাদের থাকা উচিত নয়। কিন্তু দুঃখজনকহলেও সত্য যে, আমাদের দেশে রাজনীতিবিদ হিসেবে, জনসেবকহিসেবে, এমপি হিসেবেসে আদর্শগত মৌলিক চেতনার শেষ বিন্দুরও যেন কবর রচনা হয়ে গেছে!
পুনশ্চ: পৃথিবীর অন্যতম উন্নত দেশসুইডেনের এমপিদের সুযোগ সুবিধা না পাওয়াটাই রীতি। ওখানে রাজনীতিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়, যা তাদের কাছে জনগণের প্রতিনিধি হিসাবে একটি চাকরির মতো।
সুইডেনেরসংসদ সদস্যরাপাবলিক পরিবহনেবিনামূল্যে যাতায়াতকরতে পারেন।কিন্তু নিজেরজন্য কোনগাড়ি বাচালক পাননা।
এমনকিসুইডেনের পার্লামেন্টেরমাত্র তিনটিভলভো এস-এইটটিআছে, যাকেবল সরকারি অনুষ্ঠানেরকাজে পার্লামেন্টেরপ্রেসিডেন্ট এবংতিনজন ভাইস-প্রেসিডেন্টব্যবহার করতেপারেন।
দেশটিতেশুধু একজন রাজনীতিবিদকেসরকারিভাবে গাড়িদেয়া হয়েছে,তিনি হচ্ছেনসুইডেনের প্রধানমন্ত্রী।
আরতাদের এমপিদেরথাকার জায়গাটির আকারমাত্র ১৬বর্গমিটার। সেখানেওয়াশিং মেশিন বাডিসওয়াশারের মতোআসবাবপত্রও থাকেনা। আসবাববলতে সেখানেশুধু একজনের থাকারমতো একটিসিঙ্গেল বেডরয়েছে। কারণজনগণের অর্থশুধু একজন সংসদসদস্যের খরচেরজন্য।
সুইডেনেরএমপিদের মনমানসিকতাও আলাদা। কিছু দিন আগে সোশ্যালডেমোক্র্যাটিক পার্টিরসংসদ সদস্য প্রি-অর্নেহাকানসন বিবিসিরসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, "সংসদসদস্যের জন্যঅতিরিক্ত সুবিধাপাবার বিষয়টিকোনভাবেই যুক্তিসঙ্গতনয়, কারণআমাদের কাজহচ্ছে জনগণেরপ্রতিনিধিত্ব করা,তারা যেঅবস্থায় বাযেভাবে বসবাসকরছেন, সেটাকেইতুলে ধরা।"হায়, আমাদের দেশের মন্ত্রী-এমপিদের মুখে এমন কথাআমরা কবে শুনবো?