Published : 22 Sep 2011, 03:32 PM
১৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার কেন্দ্রস্থল কাকরাইলসহ সারাদেশের অনেকগুলো স্থানে জামায়াত-শিবিরের হিংসাত্মক তাণ্ডব আপাত নিস্তরঙ্গ রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন আলোচনার সুযোগ করে দিয়েছে। এই চক্রটি কতটুকু সংহত ও সাংগঠনিকভাবে শক্তিসম্পন্ন তা নতুন করে প্রমানিত হয়েছে এদিনের ঘটনায়। জামায়াত-শিবিরের এই সহিংস বিক্ষোভের পরে মনে হয়েছে আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় এ বিষয়ে আগে থেকে তেমন কিছুই জানতো না। সংবাদ মাধ্যমে দেওয়া বক্তব্যে পুলিশের ঊর্ধতন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, হঠাৎ করে জামায়াত-শিবির বিক্ষোভে প্রচুর লোক সমাগম ঘটায়। ফুটপাত দিয়ে সাধারণ মানুষের মতো হাটতে থাকা জামায়াত-শিবির কর্মীরা হুট করেই রাস্তায় নেমে বিক্ষোভে অংশ নেয়। তাঁদের জনশক্তি দেখে পুলিশ হতভম্ব হয়ে পড়ে প্রাথমিক পর্যায়ে। পুলিশের কর্তারা গণমাধ্যমে স্বীকার করেছেন যে প্রথমে তাঁরা নিজেদের নিরাপত্তার জন্য আশেপাশের ভবনে আশ্রয় নেন এবং পরে ফোর্স আনিয়ে জামায়াত-শিবিরকে মোকাবেলা করেন। এর মাঝেই প্রায় দুই ডজন গাড়ি ভষ্মীভূত হয়ে গেছে ঢাকার রাস্তায়। পুলিশকে অন্তত এই ধন্যবাদটুকু দিতে হয় যে আতংকিত হয়ে তাঁরা গোলাগুলি শুরু করেন নি, নয়তো রাজপথে হয়তো প্রাণনাশের ঘটনা ঘটত এদিন।
সন্ধ্যায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন যে সংঘর্ষে জামায়াত-শিবির গ্যাস গ্রেনেড ব্যবহার করেছে। গ্যাস গ্রেনেড শব্দটি দেশে প্রচলিত নয়, এই অস্ত্রটি কতটুকু মারাত্মক তা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীই ভালো বলতে পারবেন, কিন্তু এটা বোঝা গেল যে জামায়াত যতই নীরব থাকুক, তারা ইতিমধ্যেই তাদের অস্ত্রশস্ত্রকে আধুনিক করে তুলছে। যারা আজকে গ্যাস গ্রেনেড যোগাড় করতে পারে, কালকে যে তাঁরা জীবনধ্বংসী গ্যাস নিয়ে হামলা করবে না, সেটা জোর দিয়ে বলা যায় না। গোটা ঘটনা থেকে একটা জিনিস পরিস্কার। সরকার জামায়াতকে এখনও ছোট করে দেখছে, অথবা জামায়াতকে ইচ্ছা করে লালন করছে নিজেদের রাজাকার বিরোধী রাজনীতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য।
জামায়াত ফুটপাতে তাদের হাজার হাজার মানুষকে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে দাঁড় করিয়ে রাখলেও সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এত বড় তৎপরতা সম্পর্কে কোনো খোঁজই পায়নি আগে। আর রাস্তায় গ্যাস গ্রেনেড ছোঁড়ার আগ পর্যন্ত তাঁরা টের পায়নি যে এই নতুন ধরণের অস্ত্র জামায়াত-শিবিরের সংগ্রহশালায় যোগ হয়েছে।
এরকম অবস্থায় সারাদেশের যে তরুণরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের অপেক্ষায় উন্মুখ হয়ে আছে, তাঁদের পক্ষ থেকে আমি জানতে চাই, 'হোয়াট দ্যা হেল ইয়্যূ আর ডুয়িং দেন?' মাননীয় সরকার, আপনারা তাহলে কী করছেন? আমাদের করের টাকায় আপনারা নিজেরা এবং আপনাদের গোয়েন্দারা যে বেতন নিচ্ছেন, সেটা হালাল হচ্ছে কি না এই প্রশ্ন করতে চাই। আপনাদের নাকের ডগায় যদি হাজার হাজার মানুষের মাঝে একটি গোপন কর্মসূচি আপনাদেরকে ঘুমন্ত রেখেই ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তাহলে আপনাদের হাতে জনগনের জানমালের নিরাপত্তা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠি।
ইদানীং একশ্রেনীর বুদ্ধিজীবিরা বলতে শুরু করেছেন যে জামায়াত কোনো নিষিদ্ধ সংগঠন নয়, সুতরাং তাঁদেরকে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি চালানোর সুযোগ করে দেওয়া উচিত সরকারের। এই গণতন্ত্রের দোহাইয়ে একটু সমস্যা আছে। আর এই সমস্যাটা তৈরি করে দিয়েছে সরকার।
তাঁরা যুদ্ধাপরাধীদেরকে শুধুমাত্র ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করছে। তাঁরা কৌশলে এড়িয়ে যাচ্ছে যে সংগঠন হিসেবেও জামায়াত একটি যুদ্ধাপরাধী সংগঠন। সরকার এর আগে অনেকগুলো জঙ্গী সংগঠনকে নিষিদ্ধ করেছে। বাংলাভাইয়ের জেএমবির সব সদস্য কি বোমা মেরেছে বাংলাদেশে? কিংবা হুজির সবাই কি শেখ হাসিনা হত্যাচেষ্টার সঙ্গে জড়িত ছিল? তা নয়। কিন্তু সংগঠন হিসেবে জেএমবি কিংবা হুজি এই ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড চালানোর জন্যই তৈরি হয়েছিল, সুতরাং তাঁদের সবগুলো কাজের দায় সংগঠন হিসেবে নিয়েই এই জঙ্গি সংগঠনগুলোকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে জামায়াতকে ছাড় দিচ্ছে কেন সরকার? গোলাম আযম, নিজামী, মুজাহিদরা শুধু কিন্তু ব্যক্তিগত উদ্যোগেই যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল না, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম, মুসলিম লীগ এই সংগঠনগুলো সাংগঠনিক ভাবেও আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় ও সশস্ত্র বিরোধিতা করেছে। স্বাধীন দেশে এই নামের সংগঠনগুলো তাই অবশ্যই নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়া উচিত। দেশে কোনো জঙ্গি হামলার সঙ্গে হিজবুত তাহরীরের সরাসরি যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগেই যদি হিজবুত তাহরীর নিষিদ্ধ হতে পারে, তাহলে যুদ্ধাপরাধের সাংগঠনিক দায় কাঁধে নিয়েও এই দেশে কীভাবে জামায়াত রাজনীতি করার অধিকার পায়?
সরকার সভা-সমাবেশে যতোই হম্বিতম্বি করুক, জামায়াতের ব্যাপারে তাঁদের কাজকর্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাগ্রত দেশবাসীর মনে কতটুকু স্বস্থি দিচ্ছে সেটা ভেবে দেখার ব্যাপার। দেশের সবচাইতে বড় যুদ্ধাপরাধী হচ্ছে গোলাম আযম। জামায়াত পরিচালিত হয় এই লোকের বুদ্ধি ও দিক নির্দেশনায়। ৭১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত এই গোলাম আযমই জামায়াতের মূল নীতি নির্ধারক। বিএনপিতে যেমন খালেদা জিয়ার কথাই শেষ কথা, আওয়ামী লীগ যেমন শেখ হাসিনার দল, জামায়াতও আসলে গোলাম আযমের দল। কিন্তু গত আড়াই বছরে এই লোকটাকে গ্রেপ্তারের কোনো উদ্যোগ নেয়নি সরকার। নিজামী-মুজাহিদ-কামারুজ্জামান-সাঈদীকে গ্রেপ্তার করে জামায়াতের অপতৎপরতা রোধ করা যাবে না। কারণ মূল বুদ্ধিদাতা এখনও বহাল তবিয়তেই বাইরে আছেন।
গোলাম আযমকে বাইরে রাখা কি আওয়ামী লীগের কোনো এস্কেপ রুট? পর্দার আড়ালে অন্য কোনো রাজনীতি নেই তো? স্মরণ রাখা দরকার যে ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগ সমর্থিত রাষ্ট্রপতি প্রার্থী বিচারপতি বদরুল হায়দার গোলাম আযমের কাছে গিয়ে সমর্থন কামনা করছেন, এমন ছবি দেখে আমরা শিউরে উঠেছিলাম।
এই সরকারের সময়েই কিন্তু গোলাম আযমের পাসপোর্ট নবায়ন করেছে সরকার। গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে যে কঠোর গোপনীয়তায় গোলাম আযমের জন্য ইংল্যান্ডের ভিসা যোগাড় করার চেষ্টা হয়েছে। শেষ মুহূর্তে লন্ডনে গোলাম আযমের ঘনিষ্ট একটি সূত্র থেকে খবর ফাঁস হওয়ার আগ পর্যন্ত সরকার এ বিষয়ে কিছুই জানতো না! ইংল্যান্ডের কথাই যখন উঠল, তখন একথা স্মরণ করতে হয় যে ১৪ ডিসেম্বরের বুদ্ধিজীবি হত্যার সবচাইতে বড় পান্ডা চৌধুরী মঈনউদ্দিন এখনও ইংল্যান্ডে থেকে জামায়াতের সব তহবিলের দেখাশোনা ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ রক্ষা করে বলে অভিযোগ আছে। মঈনউদ্দিনের ব্যাপারে সরকারের অবস্থান কী? এই ঘাতককে দেশে ফিরিয়ে আনার কোনো উদ্যোগ কেন নেওয়া হচ্ছে না?
মানবতা বিরোধী অপরাধের জন্য যে ট্রাইবুনাল গঠন করা হয়েছে, সেটি কি লোক দেখানো নাকি সরকারের আন্তরিকতা আছে, এটাও একটা বড় প্রশ্ন। প্রথমেই এই ট্রাইবুনালের দায়িত্বে দেওয়া হলো ছাত্রশিবিরের পিতৃ সংগঠন ছাত্র সংঘের এক নেতাকে। এই হচ্ছে সরকারের দক্ষতা আর আন্তরিকতার নমুনা! সেই যন্ত্রনা থেকে রক্ষা পাওয়া গেলেও, মানবতাবিরোধী ট্রাইবুনাল এখনও ধুঁকছে লজিস্টিক দুর্বলতায়। ট্রাইবুনালে যথেষ্ঠ পরিমান লোকবল নিযুক্ত হয় নি। তদন্ত কাজে তাই গতি নেই, এখন পর্যন্ত মাত্র একজনের ব্যাপারে তদন্ত শেষ করে আনতে পেরেছে ট্রাইবুনাল। আড়াই বছরে একজন হলে, গ্রেপ্তার হওয়া বাকিদের তদন্ত এই গতিতে চললে তাদের জীবদ্দশায় শেষ হবে কি না সেটা সরকারই ভালো বলতে পারবে।
চ্যানেল ওয়ান কিংবা দৈনিক আমারদেশ-এর মতো বিএনপি সমর্থিত মিডিয়াগুলোকে বন্ধ করার ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া হলেও জামায়াতের পত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেল কোনো ধরণের বাধা ছাড়াই চলছে। সরকার অন্য চ্যানেলগুলোর টকশো নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুরু কুঁচকালেও দিগন্ত টেলিভিশনের টকশোগুলো মনিটর করেন বলে মনে হয় না। সেখানে কৌশলে যে কথাবার্তা বলা হয়, সেগুলো বুঝার ক্ষমতা সরকারের লোকজনের থাকা উচিত।
এসবের কারণে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে সরকারের অগ্রাধিকার প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছে। এর পাশাপাশি জামায়াত-শিবির তাদের প্রচার প্রপাগান্ডা অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। তারা দেশে বিদেশে বিভিন্ন ফোরামে কৌশলে এই বিচার বানচালের প্রচার জোরদার করছে। বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও পেশাজীবি সংগঠনের সদস্যদের তালিকা সংগ্রহ করে সেখানে তাদের প্রচারপুস্তিকা পাঠানো হচ্ছে, ইন্টারনেটে তথ্যচিত্র সম্প্রচার করা হচ্ছে। আর গুজব রটেছে জেলখানায় বন্দি সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে আপাতত কোনো নতুন মামলা দেওয়া হচ্ছে না, কারণ তাকে দিয়ে বিএনপি ভাঙ্গার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম নিয়ে জনমনের হতাশা ও অসিহষ্ণুতাকে ধরতে পারছে না, তারা আরো জরুরি অজরুরি বিষয়কে নিয়ে যেভাবে এগুচ্ছে, তাতে বিচার কার্যক্রমকে সেই একই গুরুত্ব দিচ্ছে না।
সরকারের মেয়াদ দ্রুত ফুরিয়ে আসছে, এই সময়ের মাঝে যদি বিচার কাজে দৃশ্যমান কোনো বড় অগ্রগতি না হয়, তাহলে আগামী নির্বাচনে তরুণ ভোটারদের কাছে এ নিয়ে আওয়ামী লীগকে ভালোই জবাবদিহি করতে হবে। আওয়ামী লীগের প্রজ্ঞাবান রাজনীতিবিদরা নিশ্চয়ই একথা বুঝতে ভুল করবেন না, যে জামায়াত সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাকে ফাঁকি দিয়ে রাজপথে হাজার হাজার মানুষকে কৌশলে সমবেত করে গ্যাস গ্রেনেড দিয়ে তাণ্ডব চালাতে পারে, সময় যতোই গড়াবে, ততোই তারা আরো অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ড দিয়ে সরকারকে বিপাকে ফেলতে চেষ্টা করবে।
এই সময়ে তাই জামায়াতকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করার জন্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রমকে সরকারের অগ্রাধিকারভিত্তিক এজেন্ডা হিসেবে বিবেচনা করা প্রয়োজন। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে এমনভাবে সক্রিয় করতে হবে যাতে করে গ্রামে গঞ্জে জামায়াতের প্রচার প্রপাগান্ডাকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করা যায়। জামায়াতের প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য সংগঠনগুলোর ব্যাপারে খোঁজ খবর নেওয়া দরকার। গ্যাস গ্রেনেড সংগ্রহের তহবিল দেশি বিদেশী কোন উৎস থেকে আসছে এটি খতিয়ে দেখা দরকার।
তবে জামায়াতের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড থেকে আওয়ামী লীগের একটি বড় রাজনৈতিক লাভ ঘটেছে। ঘটনার পরে সামাজিক সাইটগুলোতে সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া দেখে যা বুঝতে পারলাম, তা হলো মানুষ আবারও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের গুরুত্ব বুঝতে পারছে। তারা বুঝতে পারছে যে গ্যাস গ্রেনেড নিয়ে এগিয়ে আসা জামায়াত-শিবিরকে রাজনৈতিকভাবে প্রতিরোধ করার বিষয়টি ভুললে চলবে না। এই অনুভবের ফসল আওয়ামী লীগের ঘরে স্থায়ীভাবে উঠতে পারে শুধুমাত্র বিচার কার্যক্রমকে জোরদার করার মাধ্যমে।
আর বিএনপি যে এখনও পেছনের দিকে হাঁটছে তার প্রমান, জামায়াত-পুলিশ সংগ্রহের পরেই বিএনপির তড়িঘড়ি করে প্রতিক্রিয়া জানানো আর হরতালের ডাক দেওয়া। যে দল দেশের সাধারণ মানুষের মনোভাব গণ্য না করে যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে তাদের গাঁটছড়াকে ত্যাগ করছে না, আগামী দিনের রাজনীতিতে তাঁদের অগ্রগতি কতটুকু হবে সেটা দেখার বিষয়।