Published : 09 Jun 2016, 04:16 PM
বর্তমানে বাংলাদেশে জামায়াতের রাজনীতি একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে, যা ১৯৪৮ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে তাদের কার্যকলাপ শুরু করবার পর থেকে কখনও মোকাবেলা করতে হয়নি। যুদ্ধপরাধের দায়ে দলের আমীরসহ শীর্ষ নেতৃত্বের ফাঁসি হয়ে যাবার পর দলটি শুধু যে নেতৃত্বের সঙ্কটে পড়েছে তা নয়, যে দ্বিতীয় ও তৃতীয় সারির নেতৃত্ব দলকে ধরে রাখবার চেষ্টা করছেন তাদেরকে হয় জেল, নয়তো আত্মগোপনের জীবন যাপন করতে হচ্ছে।
তদুপরি, নিজস্ব প্রতীকে, দলীয় ব্যানারে নির্বাচন করবার অধিকার হারাবার পর আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের নিষিদ্ধ করা হবে কি না, দলটিকে এখন এ প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। সার্বিকভাবে আগামী দিনগুলিতে জামায়াত পরিচয়ে বৈধভাবে আর রাজনীতি করা যাবে কি না, সামনে চলে এসেছে এ প্রশ্নও।
জামায়াত একটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল যার শাখা বাংলাদেশ ছাড়াও পাকিস্তানে ও ভারতে রয়েছে। তত্ত্বগতভাবে সবগুলি শাখা স্বাধীন হলেও, বিভিন্ন দেশে দলটির নেতাকর্মীরা লাহোরকে তাদের কেন্দ্র মনে করে থাকে, যা গোলাম আযমসহ অন্যান্য জামায়াত নেতার বিভিন্ন সময়ের বক্তব্যেও উঠে এসেছে। ভারতে জামায়াত সরাসরি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের চেয়ে সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ডে বেশি জোর দিয়ে থাকে।
অন্যদিকে, পাকিস্তানের রাজনীতিতে জামায়াত শুধু যে অত্যন্ত সক্রিয় তাই নয়, বিভিন্ন সময় দলটি সেখানকার সরকার এবং সেনাবাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে এসেছে, যা দলটিকে রাজনীতিতে সব সময় বাড়তি সুবিধা দিয়েছে।
বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামী ১৯৭১ সালে সংঘটিত গণহত্যার মতো ঘৃণ্য মানবতাবিরোধী অপরাধ করা সত্বেও, ১৯৭৫পরবর্তী সামরিক শাসকবৃন্দ এবং তাদের তৈরি দলসমূহ অসাম্প্রদায়িক ধারার রাজনৈতিক দলগুলোকে মোকাবেলা করবার হাতিয়ার হিসেবে তাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করে এসেছে। যার ফলে জামায়াত মধ্যপ্রাচ্যের পেট্রোডলারের সহায়তায় ধীরে ধীরে তার সাংগঠনিক প্রভাব বলয় বিস্তার করতে এবং অপেক্ষাকৃত দুর্বল, কিন্তু জামায়াত-ধারার একটি সমান্তরাল সিভিল সমাজ গড়ে তুলতে সমর্থ হয়। যুদ্ধপরাধের বিচার শুরু হলে আমরা সিভিল সমাজের এ ধারাকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিচারের বিরুদ্ধে সক্রিয় অবস্থান নিতে দেখি।
গত শতাব্দীতে কমিউনিজমের জুজুর ভয় দ্বারা পাশ্চাত্যের দেশগুলি প্রবলভাবে আক্রান্ত হবার ফলে তারা কমিউনিজম ঠেকাবার নীতি হিসেবে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীসমূহকে মদদদানের নীতি গ্রহণ করে। যা জামায়াতকে দেশীয় রাজনীতিতে বাড়তি সুবিধা প্রদান করে। এ নীতির ফলে, পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে সে সময়টায় ব্যাপক হারে জামায়াতের নেতা-কর্মীদের ভ্রমণ ও মাইগ্রেশন পরিলক্ষিত হয়।
জামায়াত তখন লন্ডনসহ ইউরোপের বিভিন্ন শহরে স্বনামে এবং ক্ষেত্রবিশেষে ইসলামি চ্যরিটির নামে নানা সংগঠন গড়ে তোলে যারা পরবর্তীতে যুদ্ধপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের পাশাপাশি, সরকার, মিডিয়া ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে প্রভাবিত করবার জন্য ব্যাপক প্রয়াস চালায়।
জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা আবুল আলা-মওদুদী নিউইয়র্কের বাফেলোতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৯৭৯ সালে মৃত্যুবরণ করেন, যেখানে তার মেজ ছেলে চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বর্তমান বিশ্বে ধর্মকে ব্যবহার করে যে রাজনৈতিক সন্ত্রাস চলছে, সে রাজনৈতিক সন্ত্রাসীদের একটি বড় অংশের উপরই মওদুদীর চিন্তাধারার ব্যাপক প্রভাব রয়েছে।
গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে সুন্নি ইসলাম ব্যবহার করে যে রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংগঠন গড়ে উঠেছে– যাকে অনেক বিশ্লেষক 'রাজনৈতিক ইসলাম' বা ইসলামিজম বলে অভিহিত করে থাকেন– সে ইসলাম মূলত তিনজনের চিন্তাধারার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এ তিনজনের একজন হলেন আবুল আলা-মওদুদী। বাকি দুজন হাসাল আল-বান্না ও সাইয়্যেদ কুতব।
এরা সবাই সে সময় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে কমিউনিস্ট আন্দোলনের যে উপস্থিতি ছিল, তার নানা কলা-কৌশল এবং রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলবার প্রক্রিয়া তাদের নিজস্ব ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংগঠন গড়ে তোলার কাজে লাগান।
এ সমস্ত প্রক্রিয়ার প্রতি পাশ্চাত্যের দেশসমূহ এক ধরনের প্রশ্রয়দানমূলক নমনীয় আচরণ বা প্রছন্ন সমর্থন প্রদান করেছিল এ উদ্দেশ্যে যে, এ ধরনের ইসলামভিত্তিক রাজনৈতিক সংগঠনসমূহ মুসলিমপ্রধান দেশগুলোতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রভাব প্রতিহত করতে ভূমিকা পালন করবে।
আন্তর্জাতিক ইসলামি আন্দোলন হিসেবে জামায়াত নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেও উপমহাদেশের বাইরে তাদের রাজনীতির কোনো আবেদন তৈরি করতে পারেনি; যদিও মিসরের ইখওয়ানুল মুসলিমিন বা মুসলিম ব্রাদারহুড এবং এর প্রতিষ্ঠাতা হাসান আল-বান্না এবং সাইয়্যেদ কুতবের চিন্তাধারার সঙ্গে মওদুদীর চিন্তাধারার সাযুজ্য পরিলক্ষিত হয়। ফলে জামায়াত এবং বাংলাদেশের জামায়াতের সঙ্গে মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুডের এক ধরনের ভাতৃত্ববোধক সম্পর্ক পরিলক্ষিত হয়, যার ফলশ্রুতি হল মুসলিম ব্রাদারহুডের যুদ্ধপরাধের বিচারের বিরুদ্ধে সক্রিয় অবস্থান নেওয়া।
মুসলিম ব্রাদারহুডে ছাড়াও তুরস্কের ক্ষমতাসীন এ কে পার্টির (দ্য জাস্টিস অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট পার্টি) সঙ্গেও জামায়াতের আদর্শগত সাযুজ্য পরিলক্ষিত হয়, যার ফলে তুরস্ককে সব সময় যুদ্ধপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে দেখা গেছে। উল্লেখ্য যে, এ কে পার্টির নেতৃবৃন্দ নিজেদেরকে কৌশলগত কারণে ইসলামিস্ট পার্টি হিসেবে পরিচয় দিতে চান না। কারণ তারা মনে করেন, এর ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হতে তুরস্কের সমস্যা হতে পারে। বাস্তবে, বাংলাদেশে জামায়াতসহ মধ্যপ্রাচের দলসমূহ, যারা ইসলামকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে চায়, তাদের সঙ্গে এ কে পার্টির রাজনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। পাশাপাশি, সিরিয়ায় ধর্মকে ব্যবহারকারী বিভিন্ন উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলির অন্যতম প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে আমরা তুরস্ককে দেখি।
এর বাইরে মওদুদীর চিন্তাধারার সঙ্গে সৌদি আরবে রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত ওয়াহাবি/সালাফি মতবাদের মিল পরিলক্ষিত হওয়ায় সৌদি রাজতন্ত্র জামায়াতের সঙ্গে সব সময় একটা সখ্যতার সম্পর্ক বজায় রেখে এসেছে।
১৯৭৯ সালে ইরানে শিয়াপন্থী ইসলামি বিপ্লব হবার পর জামায়াত-কর্মীদের মাঝে একটা প্রাথমিক উচ্ছ্বাস পরিলক্ষিত হয় এবং ইরানের সঙ্গে এক ধরনের সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা চলে। কিন্তু এ বিপ্লব শিয়া ইসলামি হবার কারণে এবং সৌদি আরবের সঙ্গে ইরানের সম্পর্কে দ্বান্দ্বিকতা বৃদ্ধি পেলে, জামায়াতের প্রাথমিক উচ্ছ্বাস কেটে যায় এবং ইরানের সঙ্গে তাদের সম্পর্কে ভাটা পড়ে।
তবে ইরানের বিপ্লব শিয়া বিপ্লব হলেও যারা সুন্নি ইসলামপন্থী রাজনীতি করতেন, এ বিপ্লবের পর তাদের মাঝেও এক ধরনের আত্মবিশ্বাসের মনোভাব জন্ম নেয়। ইসলামি রাষ্ট্রের চিন্তা– যেটি এক সময় ছিল শুধুমাত্র তাত্ত্বিক ধারণা– আধুনিক বিশ্বে এর যে একটি মূর্ত রূপ দেওয়া সম্ভব ইরানের বিপ্লবের পর সেটি পরিস্কার হয়ে যায়। সারা বিশ্বে সুন্নি ইসলামপন্থী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা ব্যাপকভাবে উজ্জীবিত হন। ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পালে জোর হাওয়া লাগে। জামায়াতের নেতা-কর্মীরাও এ উদ্দীপনার বাইরে ছিলেন না।
এর কিছুদিন পর আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনীর উপস্থিতিতে মুসলিম বিশ্বে ব্যাপক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ইসলামপন্থী দলগুলো 'নাস্তিক' কমিউনিস্টদের হাত থেকে আফগানিস্তানকে রক্ষা করা তাদের জেহাদি দায়িত্বের অংশ বলে মনে করে। বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশ থেকে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের কর্মীরা এ সময় সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে 'জেহাদ' করবার জন্য পাকিস্তানে সমবেত হতে থাকে। পাকিস্তান তখন এ অঞ্চলে ইসলামভিত্তিক দলসমূহের সশস্ত্র কর্মীদের কাজে লাগিয়ে তাদের প্রভাব-বলয় বিস্তারের মোক্ষম সুযোগ বলেই একে মনে করে।
এ সময় পাকিস্তান তার নিরাপত্তা ডকট্রিন এ ধারণার উপর গড়ে তোলে যে, পাকিস্তান তার জাতীয় নিরাপত্তা তখনই নিশ্চিত করতে পারবে যদি সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড দ্বারা প্রতিবেশি রাষ্ট্রসমূহকে ব্যতিব্যস্ত রাখা যায়। তাদের এ ডকট্রিনের ফলশ্রুতি হল, উপমহাদেশের বিভিন্ন জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীগুলোকে মদদ দেওয়া, যা এখনও অব্যাহত রয়েছে।
অপরদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনীর উপস্থিতিকে ভিয়েতনাম যুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ নেবার একটি মোক্ষম সুযোগ হিসেবে দেখতে থাকে। যার ফলশ্রুতি হল সোভিয়েতবিরোধী মুজাহিদ বাহিনীকে সামরিক ও আর্থিকসহ নানা সুবিধা প্রদান। পশ্চিম ইউরোপও সোভিয়েত ইউনিয়নকে চাপে রাখবার একটা মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে আফগানিস্তানের মুজাহিদ বাহিনীকে ব্যবহার করে। মূলত, এ সময়েই মধ্যপ্রাচ্যের পেট্রোডলারের সহযোগিতায় এবং পশ্চিমা বিশ্বের নানাবিধ সাহায্য ও সমর্থন নিয়ে ইসলামপন্থী রাজনীতির নিয়মতান্ত্রিক ও সন্ত্রাসবাদী ধারা দুটো বিকাশ লাভ করে।
বাংলাদেশেও জামায়াত এবং তার ছাত্র সংগঠন শিবির এ সময়টায় দ্রূত বিকাশ পায়– একদিকে নিয়মতান্ত্রিক সংগঠন এবং অপরদিকে ধর্মনিরপেক্ষ ও বাম সংগঠনসমূহের মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের উপর সন্ত্রাসী আক্রমণ পরিচালনা করে। একই সঙ্গে নিয়মতান্ত্রিকতা ও সন্ত্রাসবাদ এ দুধারার উপর নির্ভর করে দল বিকাশের কৌশলটি তারা 'প্যারেন্ট অরগ্যানাইজেশন' পাকিস্তানের জামায়াতের কাছ থেকে শিখে নেয়। পাকিস্তানের জামায়াতের ছাত্র সংগঠন, ইসলামী জামিয়াত-ই-তালাবাকে আমরা পাকিস্তানের বিভিন্ন ক্যাম্পাসে এবং এর বাইরে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের উপর সে সময়ে ব্যাপক সন্ত্রাসী হামলা চালাতে দেখি।
আন্তর্জাতিকভাবে পাশ্চাত্যের কাছে জামায়াত এবং অনান্য ইসলামপন্থী দলগুলোর গুরুত্ব হ্রাস পেতে থাকে সোভিয়েত ইউনিয়নসহ পূর্ব ইউরোপে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা নামে পরিচিত ব্যবস্থার অবসানের কারণে। কমিউনিজমের এ পতনের বিষয়কে জামায়াতসহ ইসলামপন্থী দলসমূহ তাদের মতাদর্শিক বিজয় হিসেবে দেখে। বিশ্বব্যাপী সুন্নি ও শিয়া ইসলামপন্থী দলসমূহ তাদের মূল আদর্শিক শত্রু হিসেবে বামপন্থীদের মনে করত। যে ধারা এখনও অব্যাহত– সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পতনের দীর্ঘ সময় পরও। ৯/১১এর সন্ত্রাসবাদী হামলার পর সুন্নি ইসলামপন্থী দলসমূহের সঙ্গে পাশ্চাত্যের দ্বান্দ্বিকতার সম্পর্ক তৈরি হয়। শিয়া ইসলামপন্থীদের সঙ্গে এটা তৈরি হয়েছিল ইরানের ইসলামি বিপ্লবের পর।
ইসলামপন্থীদের সঙ্গে দীর্ঘ সখ্যতার ফলে এখনও পাশ্চাত্যের অনেক নীতিনির্ধারক মনে করেন যে, ধর্মভিত্তিক দল ও গোষ্ঠীসমূহের সঙ্গে সম্পর্ক পুরোপুরি ছেদ করা ঠিক হবে না। কিন্তু ৯/১১ এবং এর পরবর্তীতে ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইসলামকে ব্যবহার করে উপর্যুপরি সন্ত্রাসী হামলার পর, যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে ইসলামপন্থী দলের বিষয়ে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে।
এ অবস্থায় নীতিনির্ধারকরা 'মডারেট ইসলামিস্ট দল' নামের ক্যটাগরিতে ভূষিত করে কোনো কোনো ইসলামপন্থী দলসমূহকে সমর্থন দেওয়ার চেষ্টা করলেও, পাশ্চাত্যের সিভিল সমাজ ও গণমানসে এদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা থাকবার কারণে নীতিনির্ধারকদের জন্য ইসলামিস্ট দলসমূহের পক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে যুদ্ধপরাধের বিচার ঠেকাবার জন্য জামায়াত মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ করলেও, কিছু মানবাধিকার সংস্থার কাছ থেকে বিবৃতি যোগাড় করা ছাড়া তেমন ফলপ্রসূ সাড়া পায়নি।
এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দরপতন এবং এর ফলে দুর্বল হয়ে যাওয়া সৌদি অর্থনীতি জামায়াতের আর্থিক খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করার সম্ভাবনা তৈরি করেছে। এর পাশাপাশি জামায়াতের প্রধান পৃষ্ঠপোষক পাকিস্তান নিজেই আজ নিজের সৃষ্ট সন্ত্রাসবাদ দ্বারা আক্রান্ত। বহির্বিশ্বে পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদের মদদদাতা রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত। ফলে আন্তর্জাতিক মহলে জামায়াতের পক্ষে জোরালো ভূমিকা পালন করা পাকিস্তানের পক্ষেও দুস্কর হয়ে পড়েছে।
জামায়াতের রাজনীতির সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হল, জাতীয় স্বার্থের চেয়ে আন্তর্জাতিক বিষয়ে বেশি গুরত্ব দেওয়া, যেটিকে তারা তাদের ভাষায় ইসলামিক উম্মাহর স্বার্থ বলে মনে করে। শুরু থেকেই বাংলাদেশে জামায়াতের রাজনীতি জাতীয় স্বার্থের চেয়ে অন্যান্য মুসলিমপ্রধান দেশের স্বার্থ প্রাধান্য দিয়ে এসেছে। পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তান জামায়াত এ অঞ্চলের জনগণের স্বার্থ না দেখে পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থের প্রাধান্য দিয়েছে। কারণ তাঁরা মনে করেছে, এর মধ্য দিয়ে বৃহত্তর মুসলিম উম্মাহর স্বার্থ সংরক্ষিত হবে।
জামায়াত-নেতৃত্বের পাকিস্তানি রাজনীতির গতিপ্রকৃতি মূল্যায়ন করতে না পারা অর্থাৎ মুসলিম উমাহর নামে পশ্চিম পাকিস্তান যে পূর্ব পাকিস্তানে 'অভ্যন্তরীন উপনিবেশ' স্থাপন করে জাতিগত শোষণ চালাচ্ছে, সেটি বুঝতে না পারবার ব্যর্থতা তাদের এ অঞ্চলের জনগণ থেকে সম্পূর্ণ বিছিন্ন করে ফেলে। বাস্তবতাবিবর্জিত, কাল্পনিক উম্মাহর ধারণা তাদের এতটাই অন্ধ করে ফেলে যে, ধর্মের নামে পশ্চিম পাকিস্তান যখন পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা শুরু করে, জামায়াত সেটির বাস্তবায়নে প্রধান সহয়তাকারীর ভূমিকা পালন করে।
১৯৭১এর এ ভূমিকার কারণেই মধ্যপ্রাচ্যের পেট্রোডলারের বিপুল প্রবাহ এবং শীতল যুদ্ধের সময় আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অত্যন্ত সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবার পরেও কিছু পকেট অঞ্চল ব্যতীত কোথাও কোনো গণভিত্তি তারা গড়ে তুলতে পারেনি। সেটি না পারবার আরেকটি কারণ হল এই যে, তাদের ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্ব দাঁড় করাতে না পারা। উপমহাদেশসহ বিশ্বরাজনীতির অন্যতম মূল নিয়ামক হল ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্ব। এদেশে বাম রাজনৈতিক দলগুলোর জনগণের মাঝে আবেদন তৈরি না হবার মূল কারণ হল, তাদের সে ধরনের নেতৃত্ব গড়ে তুলতে না পারা। জামায়াতের ব্যানারে ক্যারিশম্যাটিক নেতা তৈরি করা যাবে না বুঝতে পেরে, তাদের নেতা যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসে্ইন সাঈদীর 'ওয়াজ' করবার দক্ষতা কাজে লাগিয়ে একটা 'অরাজনৈতিক', 'সামাজিক' নেতৃত্ব গড়ে তোলার প্রয়াস চালায় জামায়াত।
এ প্রয়াসে তারা আংশিক সফল হলেও, এর সুবিধা দল হিসেবে পায়নি জামায়াত, বরং ব্যক্তি হিসেবে সাঈদী লাভবান হয়েছেন। ফলে সাঈদীর রায় নিয়ে জামায়াতের নেতৃত্বে কিছু পকেট এলাকায় বিক্ষোভ সংগঠিত করা গেলেও তার পুরোটার সুবিধাপ্রাপ্ত হন ব্যক্তি সাঈদী, তার দল জামায়াত নয়।
এ সমস্ত পকেট এলাকায় কিছু মানুষ ব্যক্তি সাঈদীর প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন ছিলেন, কিন্তু দল হিসেবে জামায়াতের প্রতি অতটা সহানুভূতিসম্পন্ন ছিলেন না। যার ফলে দলের আমীর এবং সাধারণ সম্পাদকের ফাঁসি হলেও এ সমস্ত এলাকায় প্রতিবাদ বিক্ষোভ সংগঠিত হয়নি।
বাংলাদেশে জামায়াতের রাজনীতি মূলত গড়ে উঠেছে সামরিক শাসক এবং তাদের সৃষ্ট দলসমূহের পৃষ্ঠপোষকতা, মধ্যপ্রাচ্যের পেট্রোডলার এবং পাশ্চাত্যের দেশসমূহ দ্বারা বাম রাজনৈতিক শক্তির বিরুদ্ধে ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হবার সুবিধাজনক অবস্থান দ্বারা। জামায়াত-নেতৃত্ব কমিউনিস্ট পার্টির অনুসরণে ক্যাডারভিত্তিক (পড়ুন কর্মচারী-নির্ভর) দল গড়ে তোলে। ক্যাডার-নির্ভর দল জামায়াত এদের সহায়তায় অত্যন্ত সফলভাবে বিভিন্ন ব্যবসায়, এনজিও এবং সেবা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে সক্ষম হয়।
ক্যাডার-নির্ভর রাজনীতির সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হল, কর্মচারী দিয়ে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা বা সন্ত্রাস করা গেলেও তা দিয়ে গণআন্দোলন গঠন করা যায় না। ক্যাডার-ভিত্তিক বাম দলগুলো তাদের দলীয় ক্যাডারদের উপর নির্ভর করে পৃথিবীর কোথাও তা করতে পারেনি। তেমনি পূর্ব পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ইতিহাসে ক্যাডার-নির্ভর জামায়াত কখনও আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি বা গড়ে তোলবার চেষ্টাও তাদেরকে করতে হয়নি।
এরশাদবিরোধী আন্দোলনসহ বিভিন্ন সময়ে তারা যেটা করেছে সেটা হল, অন্যান্য দলগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক কৌশলগত কারণে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করবার ভান করা। আজকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতাবিহীন জামায়াত জাতীয়ভাবে নানা চাপের মুখে এবং আন্তর্জাতিকভাবে অনেকটাই একঘরে, বন্ধুহারা।
এ অবস্থায়, রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে অনভিজ্ঞ, বিলাসী নেতৃত্ব দ্বারা পরিচালিত, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ও এনজিওনির্ভর দলটির পক্ষে আগামী দিনগুলোতে নিজস্ব ব্যানারে দলীয় রাজনীতি টিকিয়ে রাখা সম্ভব না-ও হতে পারে।