Published : 11 Sep 2015, 11:55 AM
আমি বারবার বলি, এই দেশে শিক্ষা অধিকার, কিন্তু উচ্চশিক্ষা নয়; সেটি সুযোগের ব্যাপার। খুব করে চাইতাম যেন আমি যেটা বলছি সেটা ভুল বা মিথ্যে হয়। কিন্তু চলমান বাস্তবতা সেটা সঠিক প্রমাণের জন্য যথেষ্ট। আমাদের সংবিধানের ২য় ভাগে রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি দেওয়া আছে। ২য় ভাগের ১৫ অনুচ্ছেদে বলা আছে যে, রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হবে জনগণের জীবনযাত্রার বস্তুগত উন্নতি সাধন কল্পে শিক্ষার মতো অন্যান্য মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা করা। অর্থাৎ আমাদের সংবিধান বলছে, শিক্ষা আমাদের মৌলিক অধিকার এবং সে অধিকার নিশ্চিত করা এই রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব।
প্রতি বছরই সরকার বাজেট করে। আর প্রতি বারের বাজেট আগের বছরের বাজেট ছাড়িয়ে যায়। এবারের বাজেট প্রায় ২৯৫ হাজার কোটি টাকার (২৯৫,১০০ কোটি টাকা)। এর মাঝে শিক্ষা ও প্রযুক্তির জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে প্রায় ৩৪ হাজার ৩৭৭ কোটি টাকা (৩৪,৩৭৭ কোটি টাকা)। অর্থাৎ ২০১৫-১৬ সালের বাজেটে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ করা হয়েছে সম্পূর্ণ বাজেটের প্রায় ১১.৬ শতাংশ।
কিন্তু শুধু শিক্ষার জন্য বরাদ্দ হিসাবে নিলে দেখা যাবে, সে অংক আসলে ৩১ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা (৩১,৬১৪ কোটি টাকা)। অর্থাৎ, ২০১৫-১৬ সালের বাজেটে শিক্ষার জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে মোট বাজেটের ১০.৭১ শতাংশ। এই অংক ২০১৪-১৫ সালের বাজেটে যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল তার তুলনায় বেশি। কিন্তু মোট বাজেটের শতকরা হিসাবে তা কম (২০১৪-১৫ সালের বাজেটে শিক্ষার জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল মোট বাজেটের ১১.৭ শতাংশ)। অর্থাৎ বাজেট যে হারে বড় হয়েছে, শিক্ষা খাতে সে হারে বরাদ্দ না বেড়ে বরং কিছুটা কমে গিয়েছে!
গত পাঁচ বছরে বাজেটে শিক্ষায় বরাদ্দের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৩-১৪ অর্থবছর ছাড়া প্রতি বারই মোট বাজেটের অনুপাতে শিক্ষায় বরাদ্দ আগের বছরের তুলনায় কমেছে। ২০১১-১২ অর্থবছরে শিক্ষায় মোট বরাদ্দ ছিল জাতীয় বাজেটের ১২.১১ শতাংশ। যা গত অর্থবছর ছিল ১১.৭ শতাংশ। বাজেটে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে প্রথম বারের মতো ১০ শতাংশ ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রস্তাবে এ ভ্যাট ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ ধরে বাজেট পাস হয়। উল্লেখ্য, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে আগে থেকেই ভ্যাট চালু আছে।
সরকার জাতীয় আয়ের ১.৮৪ শতাংশ শিক্ষায় দিচ্ছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী ভারত যদিও বিশাল, তারপরও দেশটি কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে আমাদের চেয়ে খুব একটা শক্ত অবস্থানে নেই। উন্নয়ন সূচকের প্রায় সবগুলোতেই আমরা ভারতের সমান। সেখানে জাতীয় আয়ের ৩.৮ শতাংশ শিক্ষায় বরাদ্দ। আমরা ওই অংক বরাদ্দ দিতে না পারলেও এর চেয়ে এক ভাগ কম দেওয়ার সামর্থ্য আমাদের আছে। মালয়েশিয়ায় শিক্ষায় বরাদ্দ জাতীয় আয়ের ৬ থেকে ৭ শতাংশ; মালদ্বীপে ৮ শতাংশ। আর আমাদের থেকে অনেক পিছিয়ে থাকা রাষ্ট্র নেপালেও শিক্ষায় বরাদ্দ জাতীয় আয়ের ৩ শতাংশ।
যে দেশে খাদ্যের বিনিময়ে শিক্ষা-কার্যক্রম চালু হয়েছিল, সে দেশে এখন শিক্ষা গ্রহণ করতে হলে শর্ত মেনে ভ্যাট দিতে হবে। আমাদের সবার গোচরেই শিক্ষা পণ্য বানানোর সব আয়োজন করা হয়ে গেছে। শিক্ষা ব্যবসায় সরকার বৈধতার লাইসেন্স দিতে যাচ্ছে। এ বছর উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৭ লাখ ৩৮ হাজার ৮৭২ জন। জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪২ হাজার ৮৯৪ জন। কিন্তু আমাদের সরকারি ৩৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার। যদি ধরে নিই যে, প্রায় ৪০ হাজার জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে, তাহলে বাকি ৭ লক্ষ কোথায় পড়বে?
আজকাল কচ্ছপের বেগে ছুটে চলা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়েও যদি ৫ লাখ শিক্ষার্থী ভর্তি হয়, বাকি ২ লাখ শিক্ষার্থী অবশ্যই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে। অর্থাৎ, ২ লাখ নতুন ক্রেতা সৃষ্টি হচ্ছে। অনেকের ধারণা, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরা পড়াশুনা করে। বাস্তবতা হল, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সবাই উচ্চবিত্ত পরিবার থেকে আসে না, বরং এখন অধিকাংশ ছেলেমেয়ে মধ্যবিত্ত পরিবারের। এমন অনেকেই আছে যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েও হয়তো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পছন্দ করছে একটি মানসম্মত শিক্ষার পাশাপাশি দ্রুত পাশ করে বের হয়ে চাকরি বাজারে ঢুকে পরিবারে অবদান রাখার জন্য।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ২০১৪ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ৩০ লাখ। এদের সঙ্গে কেন বৈষম্য করা হবে? 'সরকারি শিক্ষা', 'বেসরকারি শিক্ষা' বলে তো আর কিছু নেই, তাই না? এক দেশ কি দুই নীতি হতে পারে!
কোথায় যেন পড়েছিলাম, 'একটি জাতিকে দুর্বল করতে হলে সে জাতিকে অশিক্ষিত করে রাখ, না হয় তাদের মধ্যে যুদ্ধ লাগিয়ে দাও'। আজকে সরকার শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তাদের নির্বিচারে মারছে। আন্দোলন দমাতে এখন শটগান ব্যবহার করা হচ্ছে। গুলি করা হচ্ছে। এমনভাবে আচরণ করা হচ্ছে যেন শিক্ষার্থীরা পড়াশুনা করতে চেয়ে বিরাট একটা অপরাধ করে ফেলেছে। ২০১০ সালেও শিক্ষার উপর ৪.৫ শতাংশ ভ্যাট বসানোর এক রকম সিদ্ধান্ত নিলেও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে সেটিও উঠাতে বাধ্য হয় সরকার। তাই শিক্ষার্থীদের দমিয়ে রাখার সুযোগ নেই।
সমস্যা শুধু বেসরকারি খাতে নয়, ইউজিসির রূপকল্প অনুযায়ী রাষ্ট্র আর উচ্চ শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী নয়। ২০২৬ সাল নাগাদ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিজস্ব অর্থায়নে চলতে হবে, উচ্চ শিক্ষা গ্রহণেচ্ছুককেই তার ব্যয় বহন করতে হবে। অর্থাৎ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও আগামীতে 'সরকারি শিক্ষা বিক্রয় কেন্দ্র'তে রূপান্তরিত হতে যাচ্ছে।
আমাদের দেশে ছাত্রছাত্রীরা পড়াশুনা করতে চায়, ক্লাসরুমে ফিরতে চায়; রাজপথে তাদের মানায় না। আর এমন পরিবেশ সৃষ্টি করার মৌলিক দায়িত্ব রাষ্ট্রের। এই সরকারের সময় বিভিন্ন পরীক্ষায় পানির মতো প্রশ্নপত্র ফাঁস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের দ্বিতীয়বার ভর্তিপরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ বাতিল, কলেজে জিপিএএর ভিত্তিতে ভর্তির নামে তামাশা, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে জিপিএএর ভিত্তিতে ভর্তি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন-বৈষম্য ইত্যাদি সরকারের শিক্ষা ক্ষেত্রে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে। এমন অবস্থায় শিক্ষায় ভ্যাট আরোপ সরকারের জন্য আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হতে পারে।
এই সকল আন্দোলন যদি একীভূত হয়ে কোনো গণআন্দোলনে রূপ নেয় সেটি নিশ্চয়ই সরকারের জন্য বিব্রতকর হবে। কাজেই সরকারের উচিত এমন অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে অচিরেই শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিয়ে শিক্ষায় সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করা।