মা দিবসে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের মায়ের কথা কি আমরা ভুলে যাব?
Published : 12 May 2024, 05:27 PM
প্রতি বছর মে মাসের দ্বিতীয় রোববার ‘মা দিবস’ পালিত হয়। এই দিনটি উন্নত বিশ্বের দেশগুলোয় যেমন ঘটা করে পালন হয়, তেমনি আমাদের দেশেও এখন ‘মা দিবস’ বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে।
মা দিবস আসার আগে থেকেই মায়ের জন্য কত আয়োজন করি আমরা! সেদিন মায়ের প্রিয় খাবারটিই রান্না হবে, সেরা উপহারটিই কেনা হবে মাকে মুগ্ধ করার জন্য।
মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে আর যা যা করার সবই করার পরিকল্পনা থাকে আমাদের। কিন্তু আলোর ঠিক নিচেই অন্ধকারের বাস, এই অমোঘ সত্য কখনও আমরা ভুলে যাই, আর কখনও এড়িয়ে যাই। না, আমি এই দিনটি পালনের পরিপন্থি আলাপে যাচ্ছি না। শুধু কিছু বিষয় আজকের প্রজন্মের ও সমাজের দৃষ্টির মধ্যে আনার চেষ্টা করছি।
গল্পের আগের গল্পটি
রাজধানীতে কড়াইল বস্তির ভেতর একটি ডে কেয়ার তথা রেসপাইট কেয়ার রয়েছে। ‘প্যালিয়েটিভ কেয়ার সোসাইটি অব বাংলাদেশ’ (পিসিএসবি) পরিচালিত এই রেসপাইট কেয়ারটির নাম ‘আনন্দ ডে কেয়ার’। পিসিএসবি সমাজ কল্যাণ অধিদপ্তরের অধীনে নিবন্ধিত দাতব্য প্রতিষ্ঠান। জনমানুষের কল্যাণে নিয়োজিত এই সংগঠন বার্ষিক অডিটের মাধ্যমে নিয়মিত নিরীক্ষিত। এর পরিচালনা পর্ষদ সম্পূর্ণ অবৈতনিক। অত্যন্ত ছোট পরিসরে শুরু করা এই ‘আনন্দ ডে কেয়ার’ সেসব শিশুদের জন্য উৎসর্গিত যারা নিরাময়-অযোগ্য ও জীবন-সীমিত রোগে ভুগছে।
প্রায় ২৬ জন শিশুকে আগলে রাখার চেষ্টা করছে এই ডে কেয়ার সেন্টারটি। এসব শিশুর বাবা-মা প্রত্যেকেই কড়াইল বস্তির বাসিন্দা। বাবারা হয়ত ছোটখাটো দোকানে বা স্বল্প মজুরির কাজ করেন, অন্যদিকে মায়েরা কাজ করেন বাসাবাড়িতে। নিরাময়-অযোগ্য এসব শিশু যেন এই বাবা-মায়ের জীবনে ‘অভিশাপ’। নিজের অজান্তেই তারা একসময় চাইতেন উটকো ঝামেলা হয়ে জীবনে আসা এসব শিশু তালাবদ্ধ ঘরে দম আটকে মরে যাক। অথচ একটু দূরে প্রাচীরের বাইরেই ঝকঝকে দালান ও সর্বোচ্চ সুবিধাপ্রাপ্ত উন্নত নগরী।
অবহেলিত ও শারীরিকভাবে ভারাক্রান্ত এই শিশুগুলো যেন সপ্তাহে অন্তত একটি দিন আনন্দ পায়, যত্ন পায় ও ভালো খাবার খেতে পারে সে আশা থেকেই এই আনন্দ ডে কেয়ারের দরজা খোলা হয়। নিরাময়-অযোগ্য ও জীবন-সীমিত রোগাক্রান্ত নিবন্ধিত কড়াইল বস্তিবাসী শিশুরা প্রতি শনিবার সকালে এখানে আসে, নাস্তা করে, প্রয়োজনীয় ফিজিওথেরাপি নেয়, খেলাধুলা করে, ভাতঘুম দিয়ে বিকেলে মায়ের হাত ধরে বাড়ি ফেরে।
অধিকাংশ শিশুই বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন, নিজে নিজে বসতে পারে না, মনের ভাব সহজে প্রকাশ করতে পারে না। তাই ডে কেয়ারের স্বেচ্ছাসেবকদের সহায়তা প্রয়োজন হয়। সপ্তাহের এই একটি দিন যেন তাদের ও তাদের অভিভাবকের কাছে ছোট হলেও একটি স্বস্তির নিঃশ্বাস।
শ্রেণির তফাত, তবে দুই মায়ের একই গালিচা
এই রেসপাইট কেয়ারের একজন স্বেচ্ছাসেবী সদস্য শিল্পী আক্তার (ছদ্মনাম)। তার কন্যা সুষমা (ছদ্মনাম) বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন কিশোরী। নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া সুষমা মায়ের সঙ্গে নিয়মিতই এই ডে কেয়ারে আসে। সুষমা জানে তার মা, বাবা, দাদা, নানা প্রত্যেকেই উচ্চশিক্ষিত। তার নিজেরও ইচ্ছে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হবে। কিন্তু সে যে স্কুলে পড়ে সেখান থেকে জানানো হয়, সুষমা মাধ্যমিক দিতে পারবে না, দিলেও পাশ করার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
একথা মেনে নিতে নারাজ সুষমা। সুষমার মায়ের অবস্থা কী সেখানে? মেয়েটি এত ভালো ছবি আঁকে, একই কথা বারবার পুনরাবৃত্তি করলেও মানবিক ভাবনা মেয়েটির মন ও মগজে খেলা করে। এমন একটি মেয়ে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হতে চেয়েও পারবে না? তাছাড়া ওর ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাচ্ছে, এভাবে কতদিন তাকে আগলে রাখা যাবে? তার নিজের জীবনের হাল কি সে কখনও ধরতে পারবে? এই ভাবনাগুলো সুষমার মাকে প্রতিনিয়তই তাড়া করে।
মুদ্রার ওপরপিঠের গল্পটা এবার বলি। রেসপাইট কেয়ারে কড়াইল বস্তিবাসী রিতা (ছদ্মনাম) এক কিশোরী নিয়মিতই আসে। তার মা গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করেন। রিতার মা একবার পিসিএসবি’র একজন চিকিৎসককে প্রশ্ন করেছিলেন, সদ্য বয়ঃসন্ধিতে প্রবেশ করা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মেয়েটিকে জন্মনিরোধক ইনজেকশন দেওয়া যায় কিনা? কারণ মা কাজে গেলে রিতা একা থাকে। কে কেমন মানুষ সেটা তো বোঝা যায় না। মেয়েটিও বোঝে না বলে, যে কারো মাধ্যমেই তো যৌন হয়রানির শিকার হতে পারে।
সহজ ভাষায় এই মা’ও সমাজের সচ্ছ্ল শ্রেণির মা শিল্পী আক্তারের মতোই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। দুজন মায়েরই ভাবনা, তাদের সন্তানের ভবিষ্যৎ কোথায় আসলে? মা দিবসে এই মায়েদের কথা কি আমরা ভুলে যাব? এই মায়েদের মনের শান্তি ও নিশ্চিন্ত জীবনের জন্য আমরা কী করতে পারি? সুবিধাপ্রাপ্ত হোক বা সুবিধাবঞ্চিত; বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর জন্ম তো আগামীতেও হবে। তাদের সুন্দরভাবে বেঁচে থাকা, শিক্ষা, চিকিৎসা, নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য আমরা ও আমাদের সমাজ আসলে কতটুকু প্রস্তুত?
আমরা কি সুষমা ও রিতাদের মতো কিশোরী বা শিশুদের কথা একবারও ভেবেছি? যারা ছবি আঁকতে ভালোবাসে, পড়তে চায় ও লাল জামাটা বুকে আগলে রাখে কোনো এক শনিবার মজার খাবার খেতে যাবে বলে? যাদের আনন্দ তাকে মায়ের বুকে আনন্দের ঢেউ তুলে দেয়, যাদের নিরাপত্তা দেওয়ার কথা ভাবলে মায়ের বুক কেঁপে ওঠে প্রতিক্ষণে? মা দিবস আনন্দ নিয়ে আসুক সব মায়ের ঘরে। শুভেচ্ছা।
লেখক: চিকিৎসক, কাউন্সেলর, সাইকোথেরাপি প্র্যাকটিশনার, ফিনিক্স ওয়েলনেস সেন্টার।