Published : 17 Sep 2014, 07:47 PM
আমরা যখন সিডনিতে কাজে যাবার জন্য তৈরি হতে থাকি বাংলাদেশ তখন গভীর ঘুমে। আজ সকালে কাজে যাবার আগে দেয়াল লিখন লিখতে গিয়ে মনে হল ফাঁসি তো আসলে হবার কথা নয়। যারা আমাকে চেনেন বা আমার লেখায় চোখ বুলাতে ভালোবাসেন তাঁদের জন্য সত্যটা বলে রাখাই ভালো।
অবশ্য এই সত্য আমার অভিজ্ঞতা ও চিন্তাপ্রসূত। কিছুদিন আগে ইউটিউবে বিএনপির 'চুদুরবুদুর' খ্যাত সাংসদ চুমকির একটা বক্তৃতা শোনা ও দেখার সুযোগ ঘটেছিল। অমন চোটপাট আর জামায়াত-বিরোধিতা দেখে মনে হচ্ছিল, সম্পর্ক ভাঙার বেদনা কত মারাত্মক হতে পারে! দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়া গুজব, সমঝোতার রাজনীতি. জামায়াতের নিস্ক্রিয় মনোভাব আর সরকারের ষ্ট্যান্ড পয়েন্ট থেকে এটা প্রায় নিশ্চিত ছিল যে, এই মুহূর্তে সাঁকো নাড়ার কোনো কারণ নেই। আর সে মূহূর্তে সাঈদীর আপিলের রায় বা ফলাফল কী হতে যাচ্ছে সেটা অনুমান করা কঠিন ছিল না।
আদালতের রায়, আপিল বা বিচার, এ জাতীয় বিষয়গুলো স্পর্শকাতর। আইনি বিষয়ে ব্যক্তিগত মন্তব্যও ঠিক নয়। তারপরও এ জাতীয় একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও সুদূরপ্রসারী বিষয়ে চুপ থাকা যায় না। বিশেষত যখন তা রাজনীতি-নিয়ন্ত্রিত। একজন মানুষ নিরপরাধী বা দোষী দুটোর যে কোনো একটা হতেই পারেন। কিন্তু আজ আমরা যে অপরাধ ও কৃতকর্মের কথা বলছি তার ধরন বা চেহারা ভিন্ন। তাছাড়া ফাঁসির আদেশ হয়ে যাবার পর আপিলে শাস্তি লঘু হয়ে গেলে আগের রায় নিয়ে সংশয় থেকে যায়।
প্রশ্ন জাগে, কোনটি আসলে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত? এর সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশ মিলিয়ে দেখলেই অংক মিলে যাবে।
ধারণা করি, ভারতে সাম্প্রতিক পরিবর্তন, সারা বিশ্বে জামায়াতের নেটওয়ার্ক, লবিং ও অর্থের কাছে পরাভূত হয়েছে জাতির বিবেক। সঙ্গে সন্ধির নতুন রাজনীতি দিয়েছে নতুন ইন্ধন। এই বিচারপর্বের ধারাবাহিকতায় গণজাগরণ মঞ্চের আবির্ভাব ও তার বিরুদ্ধে ক্রমাগত কঠোর সরকারি অবস্থানেই বোঝা যাচ্ছিল, জামায়াতের সঙ্গে সংঘাত ও আপোষের বেলায় একটা রফা হচ্ছে। আদালতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই জানতে ইচ্ছে করে, প্রথমবার যে সাঈদীকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হল এ জন্যে কি মার্জনা চাওয়া উচিত নয়?
মোদ্দা কথায় রাজনীতিতে ব্যক্তিগত হিংসা, শোধ, প্রতিশোধ আর ইমিডিয়েট শত্রুই মূল কথা। সাঈদী তো শীর্ষস্থানীয় কারও পিতা, মাতা, ভাই, বোন বা আত্মীয়স্বজনকে হত্যা করেননি। সাধারণ মানুষ বিশেষত হিন্দুদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া, তাদের ধর্মান্তরিতকরণ কিংবা প্রগতিশীল মুসলমানের জীবন হরণে দেশের রাজনীতির কী আসে যায়! সে সব অতীত তো গদি টলমল বা গদি আঁকড়ে থাকার হাতিয়ার মাত্র।
আওয়ামী লীগের বদলে যাওয়া রাজনীতি কাদের মোল্লাকে দোষী মনে করে ফাঁসিতে ঝুলাবে কিন্তু গোলাম আজমকে রাখবে জামাই আদরে। কারণ তারা জানে প্রগতিবাদীরা মিছিল-মিটিং বা সমাবেশ করবে, কাঁদবে, মোমবাতি জ্বালাবে– ভাঙচুর করবে না– সারাদেশে অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করবে না। সুতরাং এদের সামাল দেওয়া সহজ। কিন্তু গদিনসীনরা ভুলে যায় একেই বলে 'সাইলেন্ট মেজরিটি'। এরাই নিয়ামক ও নিয়ন্ত্রক।
যতদূর বুঝি, বিএনপিকেই টার্গেট ভাবছে আওয়ামী রাজনীতি। সেটা যে কোনো ভাষণ, বক্তৃতা বা আচরণেই স্পষ্ট। একাত্তর, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সব কিছুতে জিয়ার মতো দুশমন নেই। এমনকি খন্দকার মুশতাকের চাইতেও জিয়াই বেশি ঘৃণ্য!
অন্যদিকে গদির চ্যালেঞ্জার বিএনপি দমনে জামায়াতও বন্ধু। এটা যদি আসলেই সত্য হয়, আওয়ামী লীগের কপালে দুঃখ আছে। আজকের আপিলের রায়ের পর এদেশের এবং বিদেশের বাংলাদেশিদের এক বিরাট অংশ পুরো ব্যাপারটার ওপরই বীতশ্রদ্ধ হবেন বা আস্থাহীনতায় ভুগবেন। যার মানে, প্রকারান্তরে জামায়াতের অভিযোগ মেনে নেওয়া। তারা এখন বলবে, আমাদের আন্দোলন ও বিদেশি চাপের ভয়ে সরকার ও আইন নিজের মতো পরিবর্তনে বাধ্য হয়েছে এবং সেটা কিঞ্চিৎ সত্যও বটে।
সবচেয়ে বড় কথা, যে সমর্থন ও সাহসের পায়ে ভর করে এই পথচলা বা বিচারের শুরু, সেটািএখন প্রায় অস্তমিত। কথিত সুশীল টকশোওয়ালা, মিডিয়ার চাপের মুখে অবিরল বুক চিতিয়ে থাকা চেতনাপ্রবণ মানুষগুলোর বুকের ভেতর দুঃখের ঢেউ জেগেছে আজ। সবাই জানে সবাই বোঝে কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারছে না। এভাবে আর যাই হোক, ইতিহাসের শুদ্ধতা বা বিজয় ধরে রাখা যায় না। বিচারের রায় যদি ক্লাইমেক্স আর নাটকীয়তায় ভরপুর হয় তাতে মিডিয়ার বাণিজ্য হলেও আখেরে আমাদের সর্বনাশ।
আজ মনে হচ্ছে সব কিছু রঙ বদলায়। একসময় যে সিংহ, দীর্ঘকাল বাঁদর বা ইঁদুরের সঙ্গে সহবাসে সেও আর সিংহ থাকে না। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গৌরব হয়তো অম্লান কিন্তু আমরা যে এখন তার ভার বহনে খুব একটা পারঙ্গম সেটা ভাবতে পারছি না। আবারও বলি, যে কোনো কারণেই হোক, প্রশ্ন রেখে যাওয়া সাঈদীর আপিলের রায় আকাশে সিদুঁরে মেঘের ঈঙ্গিত। সবার আগে যাদের ঘরে আগুন লাগবে তারাই যখন এতে তৃপ্ত, আমাদের কী বলার আছে?
লালন ফকির কি সাধে বলেছিলেন, চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে আমরা ভেবে করব কী! চাঁদের আমনুষকে মর্ত্যে ফাঁসি দেয় এমন সাধ্য কার?
অজয় দাশগুপ্ত: লেখক।