Published : 06 Aug 2013, 10:25 AM
খবরের কাগজে প্রকাশিত কোনো কোনো খবর নানাভাবে প্রভাব ফেলে দেশের আর্থ-সামাজিক তথা রাষ্ট্রিক জীবনে। তেমনি একটি খবর একটি কাগজে প্রকাশিত হয়েছে আগস্ট মাসের ১ তারিখে। খবরটির শিরোনাম 'স্বাচিপের কোন্দলে শিশু হাসপাতালের হাসফাঁস'।
খবরটিতে 'শিশু' 'হাসপাতাল' এমন জরুরি ও আবেগতাড়িত শব্দ আছে বলেই নয়, এটি আমাকে এবং বোধকরি আমার মতো অন্য অনেকেরই ভাবনার কারণ হয়েছে এই ভেবে যে, রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষকতা আর সমর্থনে এমন স্বেচ্ছাচার ও দুর্বৃত্তপনা আর কতদিন? যাহোক, লেখার প্রয়োজনেই খবরটির একটু বিস্তারিত না করলেই নয়।
"আওয়ামী লীগের সমর্থিত চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) অভ্যন্তরীন কোন্দলে ঢাকা শিশু হাসপাতালে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। চিকিৎসক ও কর্মকর্তারা সময়মতো আসা-যাওয়া করেন না। হাসপাতালে সেবার মানও পড়ে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা বোর্ডেও সভাপতির পদ পাঁচ মাস খালি। বোর্ডেও সভা নিয়মিত হচ্ছে না বলে দৈনন্দিন কাজ আটকে আছে। ওই পদে লোক বসানো নিয়ে স্বাচিপের দুই উপদল সক্রিয়। বর্তমান পরিচালককে রাখা না-রাখা নিয়েও এরা বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে। হাসপাতালের পরিচালক মনজুর হোসেন প্রায় এক মাস হাসপাতালে যান না। এই পরিস্থিতিতে নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতালের জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক বলেছেন, বিরোধ চলতে থাকলে শিশুদের চিকিৎসার সবচেয়ে বড় হাসপাতালটিতে সেবা বলে কিছু থাকবে না। সবচেয়ে বিপদে পড়বে দরিদ্র মানুষ।" (প্রথম আলো, ১ আগস্ট, ২০১৩)।
সরকারি চাকরি করেন এমনসব চিকিৎসকেরা এখন (কেউ স্বেচ্ছায়, কেউ বাধ্য হয়ে) স্পষ্টত তিন থেকে চারটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। কেউ আওয়ামী লীগ সমর্থিত সংগঠন স্বাচিপভূক্ত। কেউ বিএনপি সমর্থিত ড্যাবের সদস্য। আবার কেউ-বা স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতপন্থী।
তবে এর বাইরে চিকিৎসকদের একটি বড় অংশ এসবের মধ্যে নিজেদের জড়াতে চান না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, যখন যে দল রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে তখন সে দল সমর্থিতরাই সুবিধাভোগী হয়ে ওঠে। তাই যারা নৈতিকভাবে এর বাইরে থাকতে চান তারাও থাকতে পারেন না।
কারণ পেশাগত সকল নিয়মকানুন, পোস্টিং, বদলি, প্রমোশন ইত্যাদির মতো অনুষঙ্গগুলো 'পাইয়ে' দেওয়ার একমাত্র নিয়ন্তা হয়ে ওঠে সরকার সমর্থিত এই সংগঠন। এসবের বাইরে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সম্পর্কিত নানা অবকাঠামো উন্নয়নকাজেরও সুবিধাভোগী হয়ে ওঠেন এসব সংগঠনের নেতাকর্মীরা। তা সে স্বাচিপ কিংবা ড্যাব যা-ই হোক না কেন।
এমনিতেই বিপুল জনসংখ্যার এ দেশে রাষ্ট্রিক চিকিৎসা সুবিধা একেবারেই অপ্রতুল। যেখানে প্রতি বছর মোট জনসংখ্যার সঙ্গে যোগ হচ্ছে অন্তত ১৮ লাখ মানুষ। ২০১২ সালে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশের মানুষ নিজেদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় প্রতি জনে বছরে খরচ করে মাত্র ২৩ দশমিক ২৯ ডলার। এর মধ্যে প্রতিটি মানুষের স্বাস্থসেবা, পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম, পুষ্টিমান রক্ষা ও জরুরি স্বাস্থ্যসেবা থাকলেও নেই অতিজরুরি পানি ও স্যানিটেশন সেবার খরচ।
অন্য আরেক পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশের মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সরকারের কোষাগার থেকে খরচ হয় মাথাপিছু মাত্র পাঁচ ডলার। যা কি না স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ সবটা মিলিয়ে। অথচ স্বল্পন্নোত দেশগুলোর জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বেঁধে দেওয়া এই হার মাথাপিছু কমপক্ষে ৩৪ ডলার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, স্বাস্থ্যখাতে সরকারের বরাদ্দ জিডিপির পাঁচ ভাগ হওয়ার কথা থাকলেও বাংলাদেশে এই হার এক শতাংশের সামান্য বেশি।
এবারের বাজেটের কথাই যদি ধরি, সেখানে স্বাস্থ্যখাতে মোট বরাদ্দ মাত্র ৯ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা। যার মধ্যে এই খাতের উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩ হাজার ৬০২ কোটি টাকা। তাহলে ভাবুন, জনস্বাস্থ্যের জন্য বরাদ্দ আসলে কতটা?
এই ধরনের একটি স্বাস্থ্যখাত সামাল দিতে যেখানে রাষ্ট্র তো বটেই, হাজার হাজার সাধারণ চিকিৎসক হিমশিম খাচ্ছেন সেখানে সরকার সমর্থিত এইসব সংগঠনের নিয়মবহির্ভূত 'পাওয়া' আর 'পাইয়ে' দেওয়ার সংস্কৃতির মাসুলটা তো টানতে হচ্ছে অধম জনগণকেই। জনগণের করের অর্থে রাষ্ট্র যেটুকুর সংস্থান করছেন তারও অনেকটাই চলে যাচ্ছে এসব 'উপরিপাইয়ে' চিকিৎসক নামের রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের পকেটে।
স্বাচিপ ধরনের এমনিতর সরকার সমর্থিত রাজনৈতিক দলের সহযোগী সংগঠনের স্বেচ্ছাচার ও কায়েমি স্বার্থ হাসিলের তৎপরতায় শুধু শিশু হাসপাতাল কেন, গোটা দেশের মানুষেরই হাঁসফাঁস অবস্থা। তবে এই ধারা যে নতুন তা নয়।
এর আগে চারদলীয় জোট সরকারের সময়েও বিএনপি সমর্থিত চিকিৎসকদের সংগঠন ডক্টরস এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, ড্যাবের নেতাকর্মীরা এমনটাই জারি রেখেছিলেন।
শুধু চিকিৎসকেরাই নন, অন্য পেশাজীবীরাও নিজ দল ক্ষমতায় এলে সাংগাঠনিক ব্যানারে মেতে ওঠেন নানাবিধ উপায়ে কায়েমি স্বার্থ হাসিলের কর্মকাণ্ডে।
তার ওপর মূল রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়ার দৌড়ে আরও একধাপ এগিয়ে থাকা ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, যুবলীগ, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক দল, শ্রমিক লীগ, শ্রমিক দলের মতো সহযোগী সংগঠনগুলোর তৎপরতা তো আরও বেপরোয়া। এসব সংগঠনের নেতাকর্মীরা অভিভাবক দল রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকলে নানা ধরনের বাজিগরিতে জানান দেয় তাদের দুর্বিনীত চরিত্রের। আর দল ক্ষমতায় না থাকার সময়টাতেও সমঝে থাকতে পারে না এরা। তখন নিজেদের দলাদলি আর কোন্দলে অস্থির করে রাখে সমাজকে।
এখন যারা এসব (?)করছেন তারা হয়তো বলবেন, 'ওরা' করেছে তাই আমরা করলে দোষের কী? এমনটা হলে বিষয়টা কী দাঁড়াল। সব শেয়ালের এক রা। নয় কি?
কিন্তু না। এমনটা মানতে পারে না দেশের বেশিরভাগ মানুষ। যে দলটি মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিল, যে দলটি পাকিস্তান নামের ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের জন্মের শুরু থেকেই অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তা-চেতনা ধারণ করে সকল আন্দোলন-সংগ্রামে একাত্ম থেকে জন্ম দিয়েছিল একটি একাত্তরের, যে দলটির নেতৃত্ব দেশের মানুষের কাছে অঙ্গীকার করেন 'ভোট ও ভাতের অধিকার' প্রতিষ্ঠার, অন্তত সে দলটির কাছ থেকে দেশের মানুষ এমনটা আশা করতে চায় না।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, এই রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের কুফল বাংলাদেশের মানুষকে স্বাধীনতার পর থেকেই বইতে হচ্ছে। যে দুর্বৃত্তায়ন শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে ও করছে মূলত রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর মাধ্যমেই। যারা সব ধরনের আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়ে থাকে রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছ থেকেই।
আজ হয়তো আমাদের মতো কিছুটা এগিয়ে থাকা মানুষদের কলম ধরতে হচ্ছে স্বাচিপ নিয়ে। লিখতে হচ্ছে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগসহ অন্য অনেক পেশার সরকার সমর্থিত সংগঠনের দুর্বৃত্তায়ন নিয়ে। আগামীতে বিএনপি ক্ষমতায় এলে কিংবা ফের যদি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে তাহলেই এমন লেখা লিখতে হবে না সে নিশ্চয়তা কোথায়?
তাই রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে আমার মতো অন্য অনেকেরই প্রশ্ন– ভোটের রাজনীতিতে মূল দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন কতটা দরকার?
দরকার হয়তো ছিল এক সময়ে যখন আমরা লড়েছি পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসক শক্তির বিরুদ্ধে। লড়েছি স্বাধীনতার জন্য। অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য। এমনকি এরশাদ স্বৈরাচারের নয় বছরের জগদ্দল শাসনের বিরুদ্ধে লড়েছি। যখন রাজনৈতিক দল ও দেশের মানুষের স্বার্থ একাকার হয়ে গিয়েছিল। একটাই ইস্যু স্বৈরাচার হটাতে হবে।
পাকিস্তানের শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার আন্দোলনে এমনিতর শ্রেণি-পেশার মানুষের সমর্থন যে ছিল না তা নয়। বরং তা ছিল সক্রিয় এবং তাতে ছিল না কোনো কায়েমি স্বার্থবাদিতা। দীর্ঘ চব্বিশ বছরের পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনে একমাত্র ছাত্ররা ছাড়া আর সবাই নিজ নিজ পেশায় থেকে স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য শক্তি জুগিয়েছে মূল রাজনৈতিক দলকে।
তবে সবদিক থেকে এগিয়ে থাকা একটি গোষ্ঠী হিসেবে ছাত্ররা থেকেছে মূল রাজনৈতিক স্রোতধারায়। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকের স্বার্থপরতার যে কোনো নিয়ম-নীতির বিরুদ্ধে প্রথম যে প্রতিবাদ আসত তা ছাত্রদের দিক থেকেই। তার সঙ্গে নানাভাবে যোগ দিতেন শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, চিকিৎসক ও শ্রমিক-কর্মচারিসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।
তখনও যে এসব পেশাজীবীদের দাবি আদায় ও কল্যাণের জন্য কোনো সংগঠন ছিল না তা নয়। তবে তাদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা ছিল অনেকটাই পরোক্ষ। যা কখনও-ই হয়ে ওঠেনি রাজনৈতিক দলগুলোর লেজুড়বৃত্তি বা কায়েমি স্বার্থ হাসিলের সংগঠন।
কিন্তু স্বাধীনতা-পরবর্তিতে বাঙালি শাসকশ্রেণির প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলগুলোর আজ্ঞাবহ ও লেজুড় হয়ে ওঠে এসব শ্রেণি-পেশার মানুষদের সংগঠনগুলো। বাদ যায়নি ছাত্র ও যুব সংগঠনগুলোও। বলা যায় প্রতিটি সরকারের সময়ে– তা সে আওয়ামী লীগ হোক আর বিএনপিই হোক– এসব সহযোগী ও সমর্থিত সংগঠনের নেতাকর্মীরা পেয়ে থাকে অন্যায় পৃষ্ঠপোষকতা আর আশ্রয় প্রশ্রয়।
এমনিতর আশ্রয়-প্রশ্রয়ে কায়েমি স্বার্থে ঋদ্ধ হওয়ার মধ্য দিয়ে এরা আজ অনেকটাই 'ফ্রাঙ্কেনস্টাইন'। যাদের কাজকর্মে অনেক সময়েই বিব্রত হতে হচ্ছে মূল রাজনৈতিক দলকে। অন্তত গেল বছর বিশেকের ইতিহাস তাই বলে।
কিন্তু এখন বিশ্ববাস্তবতায় বাংলাদেশ শুধু একক একটি দেশ নয়, বরং অন্য প্রতিটি রাষ্ট্রের মতোই এই দেশটিও বিশ্ব নামের পরিপূর্ণ একটি সত্তারই অংশ– যে বিশ্বসত্তার স্বার্থের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের স্বার্থ। জাতীয়ভাবেও দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটি অতিক্রম করছে গণতান্ত্রিক এক ধারাবাহিকতা, এ দেশের মানুষ নিজের শক্তিতে হয়ে উঠছে বলিয়ান।
ব্যক্তিগত নানা পর্যায়ের আর্থ-সামাজিক সাফল্যের হাত ধরে দেশের মানুষ এখন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে অনেকটাই স্বাধীন।
এমনি বাস্তবতায় রাজনৈতিক দলের শক্তি বাড়াতে নজর দিতে হবে জনগণের দিকে, তাদেরই কল্যাণে। তাই সহযোগী বা সমর্থিত সংগঠন, (যাদের একমাত্র কাজ রাজনৈতিক নেতৃত্বকে ব্যবহার করে নিজেদের আখের গোছানো ছাড়া আর কিছুই নয়) কতটা অপরিহার্য তা এখন রাজনৈতিক ভাবনার জায়গায় খুবই জরুরি একটি বিষয়।
সেলিম খান : সংবাদকর্মী।