লুপ্তপেশা কাগজি: বিস্মৃত আড়িয়ল পেপার

এককালের সমৃদ্ধ জনপদ কীভাবে ইতিহাসের অংশ হয়ে আবার তা বিস্মৃতিপ্রবণ হয়ে উঠতে পারে তার দৃষ্টান্ত এই আড়িয়ল কাগজ আর কাগজিদের গ্রাম।

আমিন বাবুআমিন বাবু
Published : 8 Dec 2023, 07:57 AM
Updated : 8 Dec 2023, 07:57 AM

কিছুকাল আগে সরকারের একটি বিমানবন্দর নির্মাণ প্রকল্প ঘিরে আলোচনায় আসে আড়িয়ল বিল। গণমাধ্যমের কল্যাণে নামটি তখন থেকে মুখে মুখে ছড়িয়ে যায়। কিন্তু আড়িয়ল আরেকটি কারণে শত শত বছর আগে পরিচিতি পেয়েছিল যা আমাদের ইতিহাসে উপেক্ষিত।

কয়েক বছর আগে ব্রিটিশ সরকারের অফিসিয়াল কিছু নথি উন্মুক্তকরণের পর বিষয়টি নিয়ে জানাজানি হয়। খুবই সামান্য কিছু নোট পাওয়া যায় আড়িয়লের নামে। ঐতিহাসিক এসব নথি সাক্ষ্য দেয়, ইতিহাস আড়িয়লকে তার গর্ভে জায়গা দিয়েছিল কাগজ শিল্পে বিশেষ অবদানের কারণে। বস্তুত, হাতে বানানো কাগজের কারিগর বা কাগজিদের কারণে বাংলাদেশের এই স্থানটি একসময় বিশ্বজুড়ে পরিচিতি লাভ করেছিল। স্থানটি সম্পর্কে বর্ণনায় যাওয়ার আগে কাগজিদের সম্পর্কে কিছু বলা উচিত।

কাগজি (Kagji/Kaghzi/Kaghazi) বলা হতো এমন পেশাজীবীদের, যারা হাতে কাগজ প্রস্তুত ও বিপণনে কুশলী ছিল। কাগজিরা যেসব গ্রামে বসবাস করতো এবং কাগজ বানাতো সেই গ্রামগুলো কাগজি পাড়া, কাগতি পাড়া ইত্যাদি নামে পরিচিত ছিল। মধ্যযুগের কবি মুকুন্দ রাম চক্রবর্তীর লেখায় এই পেশার উল্লেখ আছে। তিনি লিখেছেন, “কাগজ কাটিয়া নাম ধরিল কাগতি”। এই কাগতি বা কাগতিয়ারাই লুপ্তজীবী- ‌‘কাগজি’। মুনতাসীর মামুন তাঁর ‘ঢাকা স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী’ বইতে সপ্তদশ শতকে কাগজিদের জীবনযাত্রা বর্ণনা দিতে গিয়ে দেলওয়ার হাসানের উদ্ধৃতিতে বলেছেন:

“আজ যেখানে বাংলাবাজার, পাটুয়াটুলী, ইসলামপুর, বাবুবাজার, চকবাজার ও নিউমার্কেট, সেখানে একসময় কাগজের বাজার ছিল। এর শুরুটা মোগল আমলে। মোগল সুবাদাররা এ অঞ্চলের হুকুমবরদার হয়ে আসার সময় তারা সাথে করে কাগজিদের নিয়ে এসেছিলেন দরবারের প্রয়োজনীয় কাগজ বানানোর জন্য। মোগল প্রশাসনের সঙ্গী হওয়া সেই কাগজিরাই কালে কালে রয়ে যায় এবং বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। শায়েস্তা খাঁ ১৬১৬ সালে ঢাকার আশপাশে কাগজিদের বসবাসের জন্য জমি দান করেন। যার অন্যতম ধামরাইয়ের কাগজিপাড়া। বুড়িগঙ্গার পাড়েও কাগজিদের আবাস ছিল। ঢাকায় বসবাসরতদের জন্য দান করা জায়গাটি পরিচিত কাগজিটোলা নামে। পুরান ঢাকার কলুটোলার পাশেই কাগজিটোলার অবস্থান। একসময় মোগল দরবার, দপ্তর, আদালতসহ বাণিজ্যিক নানা কাজে কাগজের এস্তেমাল ছিল সীমিত। ক্রমেই কাগজিরা হাতে তৈরি কাগজ তৈরি বাড়িয়ে দিতে থাকে। শুরুতে মেস্তা দিয়ে এরা কাগজ তৈরি করতো। পরে পাট, চট এবং আরও পরে বাঁশের মণ্ড দিয়ে কাগজ উৎপাদনে ঝুঁকে পড়ে তারা। ফরিদপুরের পাট ও বিক্রমপুর অঞ্চলে তৈরি চটের সহজলভ্যতার কারণে পরবর্তীকালে বিক্রমপুর অঞ্চলে কাগজ তৈরির কারিগররা বসতি গড়ে তোলে। সময়ের সাথে উৎপাদন ও বিক্রিতে জড়ায় কাগজিরা। এসব কাগজিদের তৈরি নানা রংয়ের কাগজ ঢাকার কাগজিটোলায় বেচাকেনা হতো। মুঘল সুবাহ’র দপ্তরে হাতে বানানো কাগজ কদর পেয়েছিল। পরে মুর্শিদ কুলী খাঁ রাজধানী রাজমহলে স্থানান্তর করলে কাগজিরা সংকটে পড়ে”। 1

এই বর্ণনা থেকে ঢাকার আশপাশের এলাকায় কাগজিদের বসবাস করা কিছু জায়গার কথা বলা হয়েছে। সঙ্গে কাগজ শিল্প এবং কাগজিদের জীবন সম্পর্কেও আলোকপাত করা হয়েছে। এখানে কিছু আবাসস্থলের নাম দেয়া হলেও কাগজিদের যে দলটি বিক্রমপুর অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিল তার পরিচয় মেলে না। সেটা যে আড়িয়ল গ্রামকে কেন্দ্র করে এমনটা আমাদের ইতিহাসবেত্তারা তাঁদের নথিতে উল্লেখ করার প্রয়োজন বোধ করেননি।

বাংলাদেশের ইতিহাস সংক্রান্ত সমস্ত নথি ব্রিটিশ সার্টিফাইড পেপারের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার পর ধারণা করি জায়গাটি এখনো খুঁজে পাওয়া সম্ভব। ধারণার ওপর ভর করে কিছুকাল অনুসন্ধানের পর গ্রামটি খুঁজে পাই ২০২২ সালে। উল্লেখ্য আড়িয়লের সেই জায়গা, কাগজিদের বংশধর বা তাদের ব্যবহৃত উপকরণ নিয়ে এর আগে দেশে কোনো গবেষণা বা অনুসন্ধান আমার জানা ছিল না। তাই গোড়া থেকেই ব্যাপারটা শুরু করতে হয়েছিল।

সূত্রপাতটা মোগল আমলে সেটা লেখার গোড়াতেই বলা হয়েছে। মোগল শাসন বিদায় নিলেও কাগজিরা এ অঞ্চলে রয়ে যায়। শত শত বছরের পরিক্রমায় তাদের উত্তরসূরিরা বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ঢাকার পুনর্জাগরণের (১৯০৫) পর বা ঢাকা দ্বিতীয় দফায় রাজধানী হওয়ার পরও কাগজিরা এই পরিযান প্রক্রিয়ার মধ্যেই ছিল। এর মধ্যে অন্যতম বড় আবাসস্থানের কথা জানা যায় ঢাকার অদূরে বিক্রমপুরে। ঘুরেফিরে ইতিহাসবিদরা বিক্রমপুর নামটাই শুধু ব্যবহার করেছেন কিন্তু যে নামে কাগজ আর কাগজিরা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল সেই ‘আড়িয়ল’ নামটি উপেক্ষিত রয়ে গেছে। কোথায় ছিল আড়িয়লের অবস্থান আর তার সীমানা সম্পর্কে বিস্তারিত বলা হয়নি শিল্প সংক্রান্ত প্রতিবেদন, বাংলাদেশের ইতিহাস বা ব্রিটিশ নথিতে। বস্তুত এলাকাটি প্রথম নজরে আসে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ ও বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় সাহেব আর নেটিভ কর্তাদের সমীক্ষার কল্যাণে। ১৮৮৩ সালে ঢাকার সিভিল সার্জন James Wise-এর লেখায় এই স্থানের কিছুটা উল্লেখ পাওয়া যায়। ওয়াইজসহ অন্যরা ব্রিটিশরাজের কাছে যুগের পর যুগ যেসব রিপোর্ট পাঠিয়েছেন, সেখানে অবস্থান হিসেবে শুধু ঢাকার অধীন একটি এলাকা হিসেবে আড়িয়লকে বর্ণনা করেছেন যদিও ব্যাপারটা তেমন নয়। ওয়াইজের লেখায় বিভিন্ন বিষয় উঠে আসত। এমনকি এ অঞ্চলের পেশাজীবীদের যে বর্ণনা আছে সেখানে কাগজিদের নাম ছিল না তেমনটা কিন্তু নয়। কাজেই ঢাকাবাসীর নাকের ডগায় এমন একটা ইতিহাস শত শত বছর কাটিয়ে দিলেও ইতিহাসের উপকরণ হিসেবে আমরা তাকে গুরুত্ব দিইনি।

James wise তাঁর লেখা- ‘Races, Castes and Trades of Eastern Bengal’ শিরোনামে যেসব নোট লিখেছিলেন সেখানে প্রথম কাগজিদের বাসস্থান লিখতে গিয়ে জায়গার নাম তিনি ‌‘Arial Khan’ লিখেছেন এবং সেটা একাধিকবার। ওয়াইজের পরে আবার অন্যরা শুধু আড়িয়ল নামটি ব্যবহার করেন। ধারণা করা যায়, ইংরেজদের এই ‘Arial Khan’ এবং ‘Areal/Arial’ নামবাচক শব্দ হিসেবে সমার্থক। নদীর নামে জনপদ এবং জনপদের নাম পরে সংক্ষিপ্ত হতে দেখেছি আমরা হামেশাই। এ বিষয়ে ঐতিহাসিকদের গবেষণাও এই যুক্তির পক্ষে রায় দিচ্ছে এবং একইসঙ্গে পূর্বাপর তথ্যেরও ধারাবাহিকতাও পাওয়া গেছে। এরমধ্যে অন্যতম কাগজিদের আর্থ সামাজিক অবস্থা, যা তুলে ধরতে গিয়ে ওয়াইজ নিজেই লিখেছেন:

“শোনা যায়, নবাবী আমলে পূর্ববঙ্গের কাগজ প্রস্তুতকারীদের আনা হয়েছিল উত্তর ভারত থেকে এখন তারা যেসব গ্রামে বসবাস করেন শুরুতে সেখানেই বসতি করা হয়েছিল তাদের। কাগজ প্রস্তুত গোড়া থেকে মুসলমানদের ব্যবসা। দেশের নিম্নাঞ্চল কাগজ প্রস্তুতের জন্য সুবিধাজনক। কেননা যে গাছ থেকে কাগজ বানানো হয় ওই অঞ্চলেই তা ছিল অধিক ও সহজলভ্য। বিক্রমপুরের উত্তর সীমানা বরাবর অসংখ্য কাগজির বাস। শুধু আড়িয়ল খাঁ গ্রামে বাস চার/পাঁচশ কাগজি পরিবারের”।2

মনে রাখা দরকার, ওয়াইজ এই রিপোর্ট যখন লিখছেন সেটা উনিশ শতকের শেষভাগ। তখনই প্রায় ৫শ কাগজি পরিবার যারা পরের শতক সমাপ্তির আগেই হারিয়ে যায় তারা সেখানে বসতি গেড়েছিল। এ বিষয়ে শ্রী অমিত ভট্টাচার্যের Bengal: Past and Present প্রবন্ধে বলা হয়েছে:

“আড়িয়ল অত্যন্ত পুরোনো কাগজ তৈরির স্থান এবং এখানকার সব কাগজি ফুলটাইম শ্রমিক। ৭টি পরিবার থেকে শুরু হয় এই কাগজি হওয়ার যাত্রা। এই শিল্পের সাথে কারিগর, শ্রমিক তাদের সন্তান ও স্ত্রীরাও কাজ করছে। এই খাতে কোন যন্ত্রপাতি নয় শুধু কাগজ তৈরির কাঁচামাল ও নিজেদের বানানো হস্ত উপকরণ এস্তেমাল হয়”।3

পেশাজীবীদের শুমারি অংশে বাংলার কুটির শিল্প গ্রন্থে কাগজিদের কাঁচামাল সম্পর্কে বলা হয়েছে:

স্থানীয় কাঁচামাল বলতে তখন এ অঞ্চলে সবচেয়ে জনপ্রিয় তখন- পাট। সবকিছুতেই তখন পাটের ব্যবহার ছিল উল্লেখযোগ্য। এক মণ পাট দিয়ে একবার মণ্ড প্রস্তুত করলে তা থেকে ৫/৬ রিম কাগজ তৈরি করা যেত। আর সেই রিমও ছিল ঢাউস সাইজের। এই পরিমাণ কাগজ বানাতে তিনজন কাগজির সময় লাগতো প্রায় ১০ দিন। ১৯৩৪ সালের এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, মানভেদে প্রতি রিম কাগজের বিক্রয়মূল্য ছিল ৫ থেকে ৬ টাকা।4

গেল শতকের ত্রিশের দশকেও আড়িয়ল গ্রামে বেশ কিছুসংখ্যক কাগজি মোটা কাগজ তৈরি করেছিল বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। হাতে তৈরি এসব কাগজ জ্যোতিষী/রাশিফল গণক এবং স্থানীয় হিসাবরক্ষকদের কাছে কদর ছিল। আগাগোড়াই আড়িয়ল কাগজের প্রধান কাঁচামাল ছিল পাটের আঁশ।

উনিশ শতকের শেষভাগে এসে কাগজিদের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমতে থাকে। ডব্লিউ হান্টার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে সেসময় ঢাকা অঞ্চলে মাত্র ৯৭ ঘর কাগজির কথা জানা যায়, যা ওয়াইজের দেয়া হিসাবের এক পঞ্চমাংশ। একই প্রতিবেদন থেকে সমকালীন ঢাকায় ২৩ হাজারের বেশি জেলে এবং প্রায় সাড়ে ৬ হাজার গোয়ালার সংখ্যা জানা যায়।5

নাতিদীর্ঘ টিকা, মন্তব্য আর চিঠি থেকে আড়িয়ল গ্রামের নামটি নিশ্চিত হয়ে সন্ধানের পর জানা যায়, উল্লিখিত এলাকাটি আজকের মুন্সিগঞ্জ জেলার অন্তর্গত টঙ্গীবাড়ি উপজেলার একটি ইউনিয়ন। অতি প্রচীন এক জনপদ ও বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে এই জায়গায় সুনাম আছে। আড়িয়ল গ্রামের কারণেই গোটা ইউনিয়নের নামকরণ হয়েছে। সেখানে গিয়ে গ্রামটি আর লুপ্ত পেশাজীবীদের সন্ধান পাই। পুরোনো আড়িয়ল গ্রামের অবস্থান মূল সড়কের পশ্চিমে। কলেবর কিছুটা বৃদ্ধি পেয়ে তুলনামূলক নতুন আড়িয়ল গ্রামটি সড়কের পূর্ব দিক বরাবর গড়ে উঠেছে। গ্রামের মাঝখান দিয়ে এঁকে-বেঁকে বয়ে গেছে একটি খাল। গ্রামটি শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে অগ্রসর। কিছুদিন অনুসন্ধানের পর আঞ্চলিক ইতিহাসে দু-চারজন আগ্রহী পাওয়া গেল। পেশায় তাঁরা স্কুল শিক্ষক ও সরকারি কর্মচারি। আরও একজনকে আবিষ্কার করা গেল যিনি ইতিহাসে আগ্রহী নন কিন্তু ইতিহাসের জ্বলন্ত সাক্ষী। তিনি আজিজ তালুকদার। বংশ পরম্পরায় এই গ্রামেই বসবাস অশীতিপর আজিজ তালুকদারের। পুরনো পরিবারগুলোর একটি এই তালুকদাররা। আজিজ তালুকদার কাগজিদের বংশধর, কিন্তু কততম প্রজন্ম তার হিসেব জানা নেই। শুধু জানালেন, তার পরিবার কাগজ তৈরির ফর্মূলা পেয়েছে বংশ পরম্পরায়। তিনি একসময় কাগজ বানিয়েছেন নিজ হাতে। আড়িয়লের ঘরে ঘরে তৈরি হতে দেখেছেন হলদেটে মোটা কাগজ। হাতে বানানো কাগজের কারিগর আর প্রত্যক্ষদর্শী ২/৩ জনের বেশি জীবিত নেই। অর্থাৎ আড়িয়ল কাগজ বানানোর চাক্ষুষ সাক্ষী আর নির্মাতাদের শেষ প্রজন্মের মুখোমুখি আমরা।

আজিজ তালুকদারের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল তখন সেখানে ভিড় করেছে উ‌ৎসুক গ্রামবাসী। তালুকদারের পরিবার ও তিনি নিজে যে কাগজি তার প্রমাণ খুঁজছিলাম। ভদ্রলোক আমার এক প্রশ্নের জবাবে, কীভাবে কাগজ বানাতে হয় তা গড়গড় করে বলে চললেন, তারপর উঠানে পড়ে থাকা একটি পাথর দেখিয়ে বললেন, এটি ‘হ্যান্ডমেড পেপার’ প্রক্রিয়ার সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকার একমাত্র দৃশ্যমান প্রমাণ। গ্রামবাসীর দাবি, এই পাথর ব্যবহার হতো ঢেঁকির নিচে বা তল হিসেবে। আড়িয়ল কাগজের প্রধান উপকরণ যেহেতু পাট তাই এই পাথরের ওপর রেখে পাটগুলোকে ঢেঁকির সাহায্যে চূর্ণ করার পর তা থেকে মণ্ড বানানো হতো। তারা দেখালেন, সেজন্যই পাথরের মাঝখানটায় কিছুটা গর্ত হয়ে আছে। কোথা থেকে কীভাবে পাথরটা এলো তা জানেন না আজিজ তালুকদার। পাথর ছাড়া সেই ঢেঁকি বা উপকরণের কিছুই অবশিষ্ট নেই এখন। যন্ত্রপাতি সব হাতছাড়া হয়েছে তবে মূঢ় সাক্ষীটি খোলা আকাশের নিচে আছে অর্ধযুগেরও বেশি। বর্তমানে আড়িয়লে এই পাথরটা পূর্বপূরুষের স্মৃতি আর গ্রামের শিশুদের খেলার সঙ্গী।

কাগজ বানানোর এই প্রক্রিয়া শুধু যে আড়িয়ল জানত তা নয়। আশপাশের গ্রামেও কাগজিদের বসতি ছিল। খুঁজলে এমন স্মৃতিকথা আর প্রমাণ আরও মিলতে পারে। নাগেরপাড়, ডুলিহাটা, ধাইরপাড়া, আলগাকান্দি, দিঘিরপাড় ও ধাকুরপাড় গ্রামের মানুষ কমবেশি এ পেশায় জড়িত ছিল। কয়েক গ্রাম মিলে তৈরি হলেও আড়িয়লের নামে পরিচিত হয়েছে এখানকার কাগজ। ধারণা করা হয়, যেহেতু আড়িয়ল কাগজ নামটি ব্র্যান্ড হয়ে গিয়েছিল এবং গুণে-মানে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিল, তাই এ অঞ্চলে প্রস্তুত সব কাগজই পরে এই গ্রামের নামে সুপরিচিত হয়ে ওঠে। ব্যাপারটা অনেকটা ইংল্যান্ডের কেন্ট পেপারের ইতিহাসের সাথে মিলে যায়।

গ্রামের ঘরে ঘরে প্রস্তুত হওয়া আড়িয়ল কাগজ বিক্রির জন্য চলে যেত নারায়ণগঞ্জ আর ঢাকায়। এ অঞ্চলের পুরনো ম্যাপ থেকে ভৌগলিক অবস্থান ও যোগাযোগের একটা চিত্র পাওয়া গেছে। সেখান থেকে বোঝা যায়, আড়িয়লের পণ্য কাছের বা দূরের বাণিজ্য কেন্দ্র পর্যন্ত নিয়ে যেতে নৌ-নির্ভর যোগাযোগ ছিল প্রধান ব্যবস্থা। টঙ্গীবাড়ি থেকে চলাচলের জন্য অতীতে চারটি নৌ-রুট ছিল। তিন দিকে চলে যাওয়া এই রুটগুলো একসময় বড় নদীতে গিয়ে যুক্ত হতো। এগুলো হলো:

পূর্বদিকে: আড়িয়ল-ডুলিহাটা-মটকপুর-টঙ্গীবাড়ি-সোনারং আবদুল্লাহপুর-কমলাঘাট বা রিকাবীবাজার-ধলেশ্বরী নদী।

পশ্চিম দিকে: আড়িয়ল-আপড়কাঠি-বালিগাঁও-তালতলা-ধলেশ্বরী নদী।

দক্ষিণ দিকে: আড়িয়ল-বালিগাঁও-ডহরী-পদ্মা নদী।

এছাড়া দক্ষিণ বরাবর আরেকটি রুট হয়ে যাতায়াত ছিলো নৌযানগুলোর। সেটি আড়িয়ল-মটুকপুর-হাসাইল হয়ে পদ্মার মূল শাখা নদী পর্যন্ত। প্রবাহগুলো আজ মরা খালে পরিণত হয়েছে, তারপরও আড়িয়ল গ্রামে গেলে সেই যোগাযোগ ব্যবস্থার একটা ধারণা পাওয়া যায়। বর্ষা তো বটেই এমনকি শুকনো মৌসুমেও পানি থাকত এসব খালে। তাই যোগাযোগ ও পণ্য পরিবহনে খালের ওপরই ভরসা করত স্থানীয়রা। এতবছর পর সংরক্ষণের অভাবে পলি পড়ে খালের মুখগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। কিছু দখল দূষণের শিকার। প্রায় পানিশূন্য হয়ে পড়েছে এগুলো। দেখে বোঝার উপায় নেই, এককালে এই খাল ধরেই নৌকা ভর্তি মোটা কাগজ পৌঁছে যেত গঞ্জে। কাঁচামাল আনা নেয়া আর হাতে বানানো পণ্য বাজারে নিয়ে যেতে একটা ভালো ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল পদ্মা পাড়ের এই জনপদে।

যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে তখন ঢাকার সিংহভাগই জঙ্গল। জিম করবেট বা কেনেথ অ্যান্ডারসনের লেখা থেকে হুটহাট উঁকি দিচ্ছে ম্যান ইটার। জঙ্গল কেটে জনপদ বিস্তৃত হচ্ছে বুড়িগঙ্গার অদূরে। হিকি বা টেলরের স্মৃতিকথায় এসব জ্বলজ্বলে অতীত আর চার্লস ডয়েলির ড্রয়িংয়ে তা রীতিমতো বাস্তব। এসব বাস্তবতার সাক্ষী আড়িয়ল গ্রাম।

গ্রামের পেশাজীবীদের নিয়ে কথা হচ্ছিল আজিজ তালুকদারসহ পুরনো মানুষগুলোর সঙ্গে। তারা দেখেছেন, হাতে কাগজ বানানো তাঁদের পূর্বপুরুষের কাছে অনেকটা ভাত-তরকারি রান্নার মতোই দৈনন্দিন স্বাভাবিক ঘটনা ছিল। ঘুম থেকে উঠে সূর্যাস্ত পর্যন্ত গ্রামগুলো কর্মমুখর থাকত এই কাজে। ব্যাপারটা তাদের কাছে এতই সাধারণ যে, উত্তরসূরিরা কখনো ভাবতেই পারেননি যে, কাগজ হাতে তৈরির কোনো ফর্মূলা বা রেসিপি সংরক্ষণ হয় আর এ নিয়ে কোনোদিন তাদের প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া লাগতে পারে। তাই এই অধ্যায় সবসময়ই তাদের কাছে অবহেলার পাত্র। অথচ এখান থেকেই একসময় উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল কাগজিরা। এমনকি উনিশ শতকে মাড়োয়ারিদের সহায়তায় নৌ-নির্ভর কাগজের সুশৃঙ্খল বাণিজ্য ব্যবস্থার অংশ ছিল এই আড়িয়ল। উত্তরে রাজশাহী থেকে দক্ষিণে চট্টগ্রামের পটিয়া পর্যন্ত হাতে বানানো এই কাগজের বাণিজ্যিক মানচিত্র বিস্তৃত ছিল। এই হ্যান্ডমেড পেপার সেসময় ভারতবর্ষের আনাচেকানাচে বিক্রি হয়েছে।6

এককালের সমৃদ্ধ জনপদ কীভাবে ইতিহাসের অংশ হয়ে আবার তা বিস্মৃতিপ্রবন হয়ে উঠতে পারে তার দৃষ্টান্ত এই আড়িয়ল কাগজ আর কাগজিদের গ্রাম। অথচ পূর্ব বাংলার কাগজ একসময় প্রদর্শনীর জন্য বিলেত নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ইতিহাসের সে আলাপ অন্য কোনোদিনের জন্য তোলা রইল।

তথ্যসূত্রঃ

1. ঢাকা: স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী, মুনতাসির মামুন, অখণ্ড সংস্করণ, পৃষ্ঠা ৯৫

2. Races, Castes and Trades of Eastern Bengal, James Wise, Harrison and Sons. London, 1883. p.94

3. Bengal: Past and Present, Vol-107, Issue no. 204-205, p.85

4. Banglar Kutir Shilpa in Banik, Bhadra 1341, p.147-52

5. A Statistical Account of Bengal, Vol.(V)- Districts of Dacca, Bakerganj, Faridpur and Maimansinh. W.W Hunter, London, 1875. p.37

6. Monograph on paper making and paper Mache in the province of Eastern Bengal and Assam, General Deptt. (Misc.Br.) FN 6M/5, Prgs. J. N Gupta, May 1909. p. 215-217