আমারো খুব ভালভাবে বাঁচতে ইচ্ছে করে। উদীয়মান আর অস্তমিত চাঁদ দেখতে ইচ্ছে করে, সদ্য ফোটা ফুলের কলি আর ঝরে যাওয়া ফুলের ঘ্রাণ নিতে বড্ড ইচ্ছে করে।
Published : 10 Feb 2024, 05:21 PM
গল্পটা শুরু করছি। নিজের গল্প। কোথায় যেন শুনেছিলাম সুখ ছড়িয়ে দিতে হয় আর দুঃখ নিজের মাঝে লুকিয়ে রাখতে হয়। দুঃখের কথা শুনে মানুষ সহানুভূতি জানাবে, একসময় বিরক্ত হবে, তারপর একদিন আপনাকে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া শুরু করবে। আমি তাই নিজের কষ্টগুলো ঝিনুকের ভেতর বালির মতোই লুকিয়ে রাখি। হয়ত একদিন এই বালি থেকে মুক্তো ফলবে। সুখে থাকার অভিনয় করতে হয়। চারপাশে সবাইকে সুখে রাখতে হয়। আমি তো চাই আমার চারপাশ সুখে থাকুক।
কি বলতে কি বলে ফেলছি জানি না। আজ আমি নিজের গল্প বলব। এটা সংগ্রাম কিনা জানি না। তবে অনেকের মহাসংগ্রামের কাছে আমারটা হয়ত তুলোর চেয়েও হালকা।আমার কয়েকজন ডাক্তার বন্ধু আছেন। পরিবার নিয়ে সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। কারো বাবা মুদি দোকানদার, কারো বাবা অটো ড্রাইভার। ছেলেকে ডাক্তারি পড়িয়েছেন বুক অবধি দেনা করে। বন্ধুগুলো আমার দিনরাত ২৪ ঘণ্টা ক্লিনিক ডিউটি করে বাবার দেনা শোধ করছেন, সংসার সামলাচ্ছেন। ৩৯ নামের এক বিসিএস তাদের জীবনে এসেছিল।ভেবেছিল এবার হয়ত অমানবিক ক্লিনিক ডিউটি নামক কামলা-খাটা থেকে রেহাই পাবে। কিন্তু বিধি বাম। সব নন ক্যাডার। ওরা এখনো সংগ্রাম করে যায়। এদেশে ডাক্তার হওয়া আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ তার মানে খুঁজে বেড়ায়। ওদের মতো হাজার হাজার ডাক্তারের সংগ্রামের কাছে আমার কষ্টটা কিছুই না।
তারপরও আজ খুব বলতে ইচ্ছে করছে। এমবিবিএস পাশের পর আমার অর্জন বলতে কিছুই নেই। ইন্টার্নির প্রথম বেতনের পর আম্মাকে একটা শাড়ি কিনে দিতে চেয়েছিলাম। আমার মা নেননি। আমি যখন স্থায়ী চাকুরি পাব তখন নিবেন। ডাক্তার হওয়ার পর পরিবারে আমি কিছুই দেইনি। মধ্যবিত্ত পরিবার। অতটা উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই।আমাকে অবাধ সুযোগ দিয়েছেন পোস্ট গ্রাজুয়েশন করার। আমি পোস্ট গ্রাজুয়েশনের পাহাড় বেয়ে উঠার চেষ্টা করছি। ৩৯ বিসিএস আবার পোস্ট গ্রাজুয়েশন। দু দিকে সামাল দেওয়ার চেষ্টায় আছি। বিসিএসের রিটেন খুব ভাল হলো। আশায় বুক বাঁধলাম।ভাইভা এভারেজ হলো। এমডি এক্সাম আর বিসিএস ভাইভা। ৫ দিনের গ্যাপ। এমডি হলো না। বিসিএসের জন্য আশায় ছিলাম। তখন আব্বার অবসরের সময় ঘনিয়ে আসল। বাড়ি থেকে আর টাকা নেওয়া যাবে না। এবার আমিও ক্লিনিক ডিউটির পাশাপশি পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছি। খুব ইচ্ছা এবার ফ্যামিলির হাল ধরব। এ পর্যন্ত সকল বাংলাদেশী নবীন ডাক্তারদের একটি সাধারণ ঘটনা।
কিন্তু আমার জীবনটা একটু ব্যতিক্রম হয়ে গেল। হুটহাট করে জানতে পারলাম আমার রেক্টাল ক্যান্সার হতে পারে। চিরায়ত চলমান জীবনে আমি একটু একটু করে ব্রেক কষা শুরু করছি। তখন আমার জীবনে একটাই চাওয়া আমার টিউমারটা যেন বিনাইন হয়।তখন আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য হলো একজন মানুষ সুস্থভাবে বেঁচে আছে। ঢাকা শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে তৃষ্ণার্ত কাকের মত দৌড়াচ্ছি।কোন এক ডাক্তার যেন আমাকে আশার বাণী শোনায়। ডায়াগনোসিস কনফার্ম করা যাচ্ছে না। বিএসএমএমইউ-এর স্যাররা আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন আমার জন্য। অবশেষে ডায়াগনোসিস কনফার্ম হলো। সেদিন ছিল ছিল ৩৯ বিসিএস-এর রেজাল্ট আর আমার ইনসিশনাল বায়োপসির হিস্টোপ্যাথলজিক্যাল রিপোর্ট পাবার দিন। রিপোর্ট আসল মিউসিনাস কারসিনোমা। মানে এবার শিওর। অ্যাগ্রেসিভ একটি ক্যান্সারে আমি আক্রান্ত।কয়েক মিনিট বাদে মোবাইলে ৩৯ বিসিএস-এর রেজাল্ট আসল। অভিনন্দন আপনি নন ক্যাডার। এ অভিনন্দন শুধু অভিনন্দনেই সীমাবদ্ধ। আমার মতো ৮ হাজার ৩৬০ জন ডাক্তার এমন অভিনন্দন পেয়েছেন। যাদের জন্য এটা অভিনন্দন নয় শুধু, বিষফোঁড়াও বটে। এরমানে আমরা বিসিএস-এ উত্তীর্ণ। কিন্তু সারাদেশে নাকি পদ ফাঁকা নেই। তাই চাকুরি পাব না! দুই রেজাল্ট হাতে নিয়ে আমি ভাবছি, জীবনে কোন কষ্টটা বড়? তারপর ভাবলাম হেসে উড়িয়ে দেই সব। এই দুই রেজাল্ট পেয়ে আমি প্রাণ খুলে হেসেছি। জীবনে এমন সময়ও আসে, যখন এরকম হাসিটাও মধুর লাগে।
এরপরের দিন আমার আব্বার অবসর হয়ে গেল। আমার জীবন এক গোলক ধাঁধাঁয় বাধা পড়ল। হসপিটাল, ডায়াগনোস্টিক সেন্টার, হসপিটাল। জুতার তলা ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে, পকেট খালি হয়ে যাচ্ছে। আর আমি আছি অন্য জগতে। যে জগতে হাসি কান্না সব এক। বন্ধুরা সব এগিয়ে এল। আমার জন্য সবাই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিল।আমার চিকিৎসা শুরু হয়ে গেল। আমি ভুলে যাচ্ছি জীবনের না পাওয়াগুলো।
কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি এসব নিয়েই ব্যস্ত হয়ে গেলাম। নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত।বাইরের পৃথিবীতে কি হচ্ছে তা ভুলে গেলাম। কয়েকদিন আগে আমার অপারেশন হয়েছে। পেটের উপর স্টোমা ব্যাগ নিয়ে ঘুরতে হয়। আগামী ৬ মাস এভাবেই থাকতে হবে। এ এক নতুন অভিজ্ঞতা বটে। আমার ২১ সেপ্টেম্বর থেকে আবার ৬ সাইকেল কেমো শুরু হবে। সেই কষ্টের দিন। কেমোর সময় মনে হয় আমার শরীরে আগুন দিল কে? সেই আগুনের দিনগুলো শুরু হতে যাচ্ছে। এরপর আবার একটি অপারেশন। ileostomy reversal.
আমি আমার জীবন নিয়েই ব্যস্ত আছি। খুব খারাপ সময় যাচ্ছে। যদিও মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়িনি। তবে বাকি জীবনটার কথা মনে হলে কষ্ট হয়। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য খুঁটির দরকার হয়। কাজে ডুবে থাকতে হয়। আমার সে রকম এখনো কিছু হয়নি। এই বিসিএস হলে হয়ত একটা খুঁটি পেতাম। অসুস্থতার মাঝে বিএসএমএমইউ-এর মেডিকেল অফিসারের ভাইভা দিয়েছি। আমি জানি এই চাকুরিটার আশা করা আমার জন্য উচ্চাশা। এটার আশায় আমি নেই। তবুও একটা খুঁটির আশায় আছি। আম্মাকে শাড়িটা কিনে দেওয়া হয়নি, আমার পরিবারের হাল ধরা হচ্ছে না। আবার আমার ব্যস্ত ডাক্তার হয়ে বাঁচতেও ইচ্ছে করে। মাঝে মাঝে মনে হয় এসব ক্ষুদ্র চিন্তা ছেড়ে দেই।আমাকে মহৎ কিছু ভাবতে হবে। কিন্তু আমার সংকীর্ণ মন শুধু ক্ষুদ্র চিন্তা নিয়েই পড়ে আছে।
আমারো খুব ভালভাবে বাঁচতে ইচ্ছে করে। উদীয়মান আর অস্তমিত চাঁদ দেখতে ইচ্ছে করে, সদ্য ফোটা ফুলের কলি আর ঝরে যাওয়া ফুলের ঘ্রাণ নিতে বড্ড ইচ্ছে করে। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবি উপন্যাসের কবিয়ালের মতো আমারো বলতে ইচ্ছে করে—
"এ ভুবনে ডুবল যে চাঁদ সে ভুবনে উঠল কি তা?
হেথায় সাঁঝে ঝরল যে ফুল হোথায় প্রাতে ফুটল কি তা?
এ জীবনের কান্না যত— হয় কি হাসি সে ভুবনে?
হায়! জীবন এত ছোট কেনে?
এ ভুবনে?"
বিশেষ দ্রষ্টব্য: এখন সাল ২০২৩, আমি এখন ব্যস্ত ডাক্তার। হাসপাতালে দাপিয়ে বেড়াই। ২০১৯-এর ৩০ এপ্রিল আমার ক্যান্সার ধরা পড়ে এবং একই দিনে বিসিএস-এর রেজাল্টেও নন ক্যাডার আসে। এরপর এক বছর চড়াই উতরাই আর আগুনের দিনগুলো পাড় করে আমি চিকিৎসা নেই। আবারও ৩০ এপ্রিল। ২০২০ সাল। দেশে করোনার ভয়াবহ প্রকোপ। ডাক্তার সংকট। ৩০ এপ্রিল ২০২০ সালে একই বিসিএস-এ আমাকে ক্যাডারভুক্ত করা হয়। সৃষ্টিকর্তার কি সুন্দর খেলা। সদ্য চিকিৎসা থেকে উঠে আসা শরীর নিয়ে চাকুরিতে যোগদান করি। করোনার রোগীদের চিকিৎসা দেই। নিজের কষ্ট ভুলে মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর ব্যর্থ চেষ্টা করি। এখনো দাপিয়ে বেড়াচ্ছি মানুষকে আশা দেখাতে। জানি না কতটা পারছি।
লেখক: ইনডোর মেডিকেল অফিসার
(সেন্টার ফর ক্যান্সার কেয়ার ফাউন্ডেশনের ‘এখানে থেমো না’ বইয়ে লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে)