শারদীয় দুর্গাপূজার দুটি বিশেষ দিক রয়েছে, একটি হলো পূত-পবিত্র মন নিয়ে শাস্ত্রীয় বিধি অনুসরণ করে পূজা উদযাপন এবং আর একটি দিক হলো সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম।
Published : 18 Sep 2024, 06:43 PM
দুর্গাপূজাকে আমরা বলি শারদীয় উৎসব। উৎসবই বটে। প্রকৃতিতে যেমন, তেমনি মনে, পোশাকে, ঘরে, সমাজে– সর্বত্র আনন্দ আর আগমনী খুশি ছড়িয়ে পড়ত একসময়। দিন যায় সময় যায় । উৎসবের আমেজ বা রং ও বদলায় । ষাটের, সত্তরের বা আশির দশকের পূজা আর আজকের পূজা এক নয়। বিগত কয়েক বছরে বেশ কয়েকবার দুর্গোৎসবের সময় দেশে থাকার সুবাদে আমার অভিজ্ঞতা হয়েছে পূজা দেখার। এখন আর আগের সাত্ত্বিক নিয়ম বা নির্মল উদযাপন নেই। চাকচিক্য, মাইকিং, ঢাক-ঢোলের আওয়াজে চাপা পড়ে থাকা মূল বিষয় উঠিয়ে আনাই এখন দুঃসাধ্য। তবে এটা ঠিক গেল ক'বছরে যে জৌলুশ আর চাকচিক্য দেখেছি তা আগের যে কোনো সময়কে হার মানায় ।
কথা তা নিয়ে নয়। কথা হচ্ছে এখন যখনই দুর্গা পূজার সময় এগিয়ে আসে আমরা টের পাই ভিন্নভাবে। আসার কিছুদিন এমন কি মাসাধিক কাল আগেই প্রতিমা বানাতে হয়। মাটির প্রতিমায় প্রাণ সঞ্চার করা সহজ কিছু নয়। মূলত মৃৎশিল্পী নামে পরিচিতজনেরা এই কাজটি শুরু করেন আগে থেকে। এখন আমরা মিডিয়া বা সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাঙ্গা মূর্তির মুখ থুবড়ে পড়া শরীর থেকে হাত পা বা বিচ্ছিন্ন মাথা দেখে জানি যে পূজা আসছে। এই অনিয়ম বা অসঙ্গতি কিন্তু বিশেষ আমলের নয়, আওয়ামী আমলে ছিল। এর আগের বিএনপি আমলেও ছিল। আওয়ামী লীগ একটু বেশিই ছিল। দেশত্যাগী বা দেশ ছেড়ে পলাতক প্রধানমন্ত্রীকে এ বিষয়ে নালিশ জানালে তিনি বলতেন, আপনারা তো দু নৌকায় পা দিয়ে চলেন। দেশের হিন্দু সমাজের প্রতি এমন বিদ্বেষপ্রসূত মন্তব্য করা তিনি আজ কোথায় ? তিনি নিজেও আরেক নৌকায় বসে আছেন। মূল কথা হচ্ছে তখন এসব বিষয়কে তুচ্ছ বা কিছু হয়নি বলাটাই ছিল রেওয়াজ। একটা কথা বুঝতে হবে নিজে ভালো থাকার জন্য বা নিজেদের নিরাপদ ভাবার জন্য সংখ্যালঘুর একাংশকে ব্যবহার করা এক বিষয় আর সার্বিক মঙ্গল কামনা ভিন্ন বিষয় ।
আমাদের সমাজে রাষ্ট্রে বেশির ভাগ মানুষ ধার্মিক কিন্তু তারা সাম্প্রদায়িক নন। সাম্প্রদায়িক হলে কলকাতার চাইতে ধুমধামে পূজা করা সম্ভব হতো না । এমন কোন গ্রাম-উপগ্রাম নেই, যেখানে দুর্গা পূজা হয় না। আমাদের জীবনের সঙ্গে মিশে যাওয়া এই পূজা এবার যেন নির্বিঘ্নে হয় সে বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সুস্পষ্ট মনোভাব ভালো লেগেছে । তারা তাদের যথাসাধ্য করার কথা বলেছেন। সমস্যা অন্যত্র।
উস্কানি বিষয়টি বাংলাদেশীদের এখন মজ্জাগত। সঙ্গে জুটেছে সোশ্যাল মিডিয়া। এই সামাজিক মিডিয়া যে আসলে মিডিয়া না, এটা অনেকেই বোঝে না। যেখানে ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিত বিবেচনার আগেই কিছু লিখে দেওয়া যায় বা বলে মানুষকে উত্তেজিত করা যায় তা কি আসলে কোন মিডিয়া হতে পারে? সত্যিকারের মিডিয়া হচ্ছে সত্যভাষণ আর সঠিক প্রশ্ন তোলার কারিগর। সে জায়গাটা সামাজিক মিডিয়ায় নেই। যে কারণে উৎসব নামের এক যুবককে আমরা প্রায় মরতে মরতে বাঁচতে দেখলাম। সে এখন কোথায় আছে কেমন আছে জানি না। শুধু এটুকু বিশ্বাস করি সে ভালো আছে। নিরাপদ আছে।
উৎসব একটি প্রতীক এখন। উৎসব করতে হলে উৎসবকে ভালো থাকতে হবে। আমরা যুগপৎ আনন্দিত ও গর্বিত হতেই পারি যে দুর্গাপূজার সূচনা ঘটেছিল আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের ভৌগোলিক অঞ্চলে। দুর্গাপূজা আজ সারা বিশ্বের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে প্রাণময় এবং একই সঙ্গে ভক্তিভরে উদযাপিত পূজা হয়ে ওঠেছে। বাংলাদেশে সূচিত দুর্গা পূজাই ইউনেস্কোর শিল্প ও ঐতিহ্যবাহী উৎসবের তালিকাভুক্ত হয়েছে। যদিও কলকাতার দুর্গা পূজাকে ইউনেস্কো ঐতিহ্যবাহী উৎসবের তালিকাভুক্ত করেছে তবে এ কথা মনে রাখা উচিত শারদীয় দুর্গাপূজার প্রচলন হয়েছিল এই সুবর্ণভূমিতেই। কলকাতার দুর্গাপূজা বিশ্বজনীন হলে সারা পৃথিবীর দুর্গাপূজাই বিশ্বজনীন হয়ে পড়ে। মা দুর্গা সারা বিশ্বের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে সমান ভক্তিসহকারে পূজিত হন। উৎসব, আনন্দ, পূজার প্রক্রিয়া সারা বিশ্বে একই রকম।
শারদীয় দুর্গাপূজার দুটি বিশেষ দিক রয়েছে, একটি হলো পূত-পবিত্র মন নিয়ে শাস্ত্রীয় বিধি অনুসরণ করে পূজা উদযাপন এবং আর একটি দিক হলো সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম। দুর্গাপূজার সামজিক ও সাংস্কৃতিক অনুসঙ্গগুলো কী? দুর্গাপূজা সাধারণত সমাজের সকল স্তরের মানুষের সম্মিলনে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। পূজা অনুষ্ঠানের জন্য ঢাকী, প্রতিমাশিল্পী, সঙ্গীতশিল্পী, লেখক, চিত্রশিল্পীসহ সমাজের সব শ্রেণী ও পেশার মানুষের এক অসাধারণ সামাজিক সংহতি তৈরি হয়। এই সামাজিক সংহতিই উৎসবকে প্রাণবন্ত করে তোলে । হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, এমন কি অবিশ্বাসীরও সমান অধিকার আছে উৎসবে অংশ নেওয়ার। এটাই সংহতি।
এখন মনে যে প্রশ্নটি আলোড়ন তোলে আমাদের সমাজে কি পূজা আসবে, না সঙ্গে উৎসবও? আজকের বাংলাদেশ ক্রান্তিকালের এক বাংলাদেশ। অভূতপূর্ব জাগরণ আর উল্লাসে যাবতীয় অনাচার ভেসে যাবে বলে যে জনআকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ঘটেছে, তার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন চায় সাধারণ মানুষ। আত্মম্ভরী একনায়কের একদর্শী চিন্তা থেকে মুক্তির আকুলতাই স্বাধীনতা। সে কাজটি এবার হয়েছে বলেই শুনছি। সে সমাজে তাহলে কেন হানাহানি আর আক্রমণ দানা বাঁধবে? মানুষ যা চায় তাই তো হয়েছে। তাহলে এখন বেছে বেছে শিকার করা বন্ধ হোক। সুসময়ের জন্য আকুল উৎসব পালনে ব্যাকুল মানুষের মনে শান্তি ফিরিয়ে দিন।
বহুকাল আগে কনফুসিয়াস একটি দামি কথা বলেছিলেন, সুশাসন বিষয়ে তার কথা ছিল, এই সুশাসন মূলত মৃদুমন্দ প্রবাহিত বাতাসের মতো। যখন সে বইয়ে যায় মানুষের মন শান্ত হয়। চিত্ত আমোদিত হয়। প্রকৃতিতে ঢেউ খেলে যায় , সে বাতাসে দুর্বিনীত গাছপালাও মাথা নুইয়ে তাকে স্বাগত জানায়। কী চমৎকার সে উদাহরণ।
উৎসব প্রিয় বাঙালির জীবনে দুর্গাপূজার আরেক নাম শারদীয় উৎসব। জেনে অবাক হবেন এই পূজার সূচনা ছিল চট্টগ্রামের পাহাড়ে এক আশ্রমে। পুরাণে লিখিত হয়েছে যে, পুরাকালে রাজ্যহারা রাজা সুরথ এবং স্বজনপ্রতারিত সমাধি বৈশ্য একদিন মেধস মুনির আশ্রমে যান। সেখানে মুনির পরামর্শে তারা দেবী দুর্গার পূজা করেন।
আমরা ঐতিহ্য আর গৌরবের অংশীদার বাংলাদেশী। আমাদের দেশে রাজনৈতিক ঘাত-প্রতিঘাত আছে, থাকবে। কিন্তু সবার ওপরে সমাজ আর মানুষ। দুর্গাপূজা যেন উৎসবের নিরাপত্তা দিয়ে উৎসব হয়েই আসে। তা না হলে প্রশ্ন থাকবে, পূজা এলে কি উৎসবও আসে সঙ্গে?