ক্ষতিপূরণের দাবি জোরালো ও যৌক্তিকভাবে তুলে ধরলেও আশাপ্রদ ফল অর্জিত হয়নি, তাই অন্যান্য সময়ের মতো এবারও হতাশ বাংলাদেশ। একইসঙ্গে হতাশ বিশ্বের অনেক গরিব ও মধ্যবিত্ত দেশ। কারণ তারাও অনেকটাই বাংলাদেশের মতো পন্থা অনুসরণ করেছে কিংবা করে আসছে।
Published : 22 Dec 2024, 04:09 PM
বন্যার ভয়াবহতা বাড়ছে, হঠাৎ বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে। শীত কখনো বাড়ছে আবার কখনোবা কমছে, পরিচিত ঋতুগুলোকে চেনা এখন অনেকটাই কঠিন। ডেঙ্গুসহ অনেক রোগের প্রকোপ বাড়ছে, নতুন নতুন এলাকা খরার কবলে আক্রান্ত হচ্ছে। কৃষি-প্রাণিকুল ও সার্বিকভাবে জীববৈচিত্র্য বিনষ্ট হচ্ছে। এছাড়াও তাপপ্রবাহ ও বায়ু দূষণের কারণে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হওয়াসহ নানামুখী চাপে ভারাক্রান্ত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ তালিকার সপ্তম অবস্থানের দেশ বাংলাদেশ। ওয়ার্ল্ড ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স-এর সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ীও, পৃথিবীর যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি জলবায়ু ঝুঁকিতে রয়েছে, তার মাঝে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষ দশে।
প্রসঙ্গত, বৈশ্বিক বিভিন্ন জলবায়ু সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সাল ছিল বিশ্বের মানব ইতিহাসের সবচেয়ে উষ্ণ বছর। ২০২৪ সালে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যেমন টানা ও দীর্ঘ তাপপ্রবাহ ও খরা পরিলক্ষিত হয়েছে, তেমনি নানা দেশে হয়েছে বিধ্বংসী ও ব্যাপক বন্যা। এর বাইরে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতার অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি, বিস্তীর্ণ এলাকা ডুবে যাওয়া, উৎপাদন কম হওয়ায় খাদ্য ঘাটতি, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, ভয়াবহ ভূমিকম্প, তাপমাত্রা বৃদ্ধিসহ ভয়ানক সব অশনিসংকেত বাংলাদেশের জনগণের সামনে অপেক্ষা করছে। বৈশ্বিক গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনে বাংলাদেশের অবদান মাত্র ০.৪ শতাংশ হলেও দেশটি চরম ক্ষতির শিকার। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় ক্ষতিপূরণের দাবিতে সোচ্চার।
কিন্তু ক্ষতিপূরণের দাবিই কি একমাত্র ও যথেষ্ট? বাংলাদেশ কি শুধু ক্ষতিপূরণ আদায় করার দাবি জানানোরই সক্ষমতা রাখে? জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার ক্ষেত্রে গুরুত্ব ও কাজের আঙ্গিক বিচারে কৌশলগত কি কোনো পরিবর্তন আনার প্রয়োজন আছে? আমরা আগে নিজেরা বাঁচব, নাকি একইসঙ্গে বিশ্বকেও বাঁচাব? গণতন্ত্র, রাজনীতি ও সুশাসনসহ বাংলাদেশের সামনে এখন মৌলিক অনেক ইস্যু— এর মধ্যে জলবায়ু ইস্যু কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ, কতটা গুরুত্ব দেওয়া উচিত আসলেও? এই প্রশ্নগুলো এখন বাংলাদেশের সামনে! একই ধরনের প্রশ্ন বিশ্বের বিশেষভাবে গরিব ও মধ্যবিত্তের অন্যান্য দেশগুলোও নিজেরা নিজেদেরকে করতে পারে কিংবা তাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে।
সম্প্রতি জাতিসংঘের জলবায়ু বিষয়ক সম্মেলন (কপ-২৯) অনুষ্ঠিত হলো আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে। সেখানে অংশগ্রহণ করার সৌভাগ্য হয়েছিল আমারও। এই সম্মেলনে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে তিনশ বিলিয়ন ডলার দেয়ার অঙ্গীকার করেছে ধনী দেশগুলো। জলবায়ু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রস্তুতি ও প্রতিরোধে সহায়তার জন্য এ তহবিল দেওয়া হবে। আজারবাইজানে অনুষ্ঠিত ওই সম্মেলনে সমঝোতার জন্য অতিরিক্ত ৩৩ ঘণ্টা সময় লেগেছে। বিগত সময়ের মতো সেখানে ক্ষতিপূরণের দাবি জোরালো ও যৌক্তিকভাবে তুলে ধরলেও আশাপ্রদ ফল অর্জিত হয়নি, তাই অন্যান্য সময়ের মতো এবারও হতাশ বাংলাদেশ। একইসঙ্গে হতাশ বিশ্বের অনেক গরিব ও মধ্যবিত্ত দেশ। কারণ তারাও অনেকটাই বাংলাদেশের মতোই পন্থা অনুসরণ করেছে কিংবা করে আসছে। ফলে এবার এই প্রশ্নটাও জোরালোভাবে উঠে এসেছে, এভাবে কপ আয়োজনের প্রয়োজনীয়তা আসলেও কতটুকু!
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কমবেশি বিশ্বের সকল দেশই আক্রান্ত, কিন্তু ক্ষতিগ্রস্থ কিংবা ঝুঁকির দিক থেকে অনেক তারতম্য রয়েছে। উল্লেখযোগ্য যে, বাংলাদেশের জলবায়ু ঝুঁকির তালিকায় শীর্ষস্থানে থাকার অন্যতম কারণ হলো ঘূর্ণিঝড় ও বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ব্যাপকতা। ২০২২ সালে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং এবং ২০২৩ সালের সিলেটের অস্বাভাবিক বন্যা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
জীবনের মতোই বিশ্বও চলছে তার নিজস্ব গতিতে, এই গতিকে থামানো এখন অনেক কঠিন, উচিতও হয়তো না! আর এই গতির সঙ্গেই যুক্ত হয়েছে সকল প্রাণের বেঁচে থাকা, গতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মানুষ তার জীবনধারা এমনভাবে গড়ে তুলেছে, যার অনেকটাই পরিবর্তন করার মতো, যার আশু ইতিবাচক পরিবর্তনও প্রয়োজন— কারণ বিশ্বের মানুষের আচরণের কারণেই এখন জলবায়ুর প্রভাব আশঙ্কাজনকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই আচরণে ইতিবাচক ও পরিবেশবান্ধব পরিবর্তন দেশ, জাতি, গোষ্ঠী, ধর্ম, বর্ণ, বয়সভেদে সবাইকেই আনতে হবে। এই পরিবর্তন আনতে হবে পরিবারে, প্রতিষ্ঠানে, সমাজে ও রাষ্ট্রে— এর অন্য কোনো বিকল্প নেই। তা না হলে গরিব থেকে ধনী, উন্নত থেকে অনুন্নত প্রতিটি দেশই সার্বিকভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে আরও বাড়িয়ে দেবে।
প্রতিটি দেশের প্রতিটি শিশু, দেশের প্রতিটি নাগরিক, আপামর জনসাধারণ, প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্র সকলকেই এখন লাগাম টেনে ধরাটা শিখতে হবে। লাগাম টেনে ধরতে হবে কার্বন নিঃসরণের ক্ষেত্রে, যা কখনো শূন্যে নামিয়ে আনা সম্ভব নয়, কিন্তু একে নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে নিয়ে আসা বা রাখা সম্ভব— আর ওই চেষ্টাই আমাদেরকে করতে হবে। একে অন্যকে কিংবা এক প্রজন্ম আরেক প্রজন্মকে দোষারোপ করার চর্চার সংস্কৃতির বাইরে এসে পুরো পৃথিবীতেই এখন পরিবেশবান্ধব চর্চা শুরু করতে হবে। পৃথিবীর গতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নতুন পরিবেশবান্ধব জীবনধারা, সরঞ্জাম, ব্যবস্থা ও ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। বেঁচে থাকার তাগিদে পরিবেশবান্ধব কৃষি পদ্ধতি যেমন শূন্য-চাষ পদ্ধতি এবং খরা-সহনশীল ধান উদ্ভাবনের উদ্যোগসহ এই ধরনের উদ্ভাবনী উদ্যোগ গ্রহণে আরও তৎপর হতে হবে। এছাড়া জীবাশ্ম জ্বালানির মতো ইস্যুসমূহে দাবি ও চাপ অব্যাহত রাখার বিকল্প নেই। ফলে ওই সকল দাবি ও চাপ অব্যাহতভাবেই চালিয়ে যেতে হবে। বলাবাহুল্য, প্রতিশ্রুতি থাকলেও সাম্প্রতিক কপ সম্মেলনে এ সম্পর্কিত কোনো চুক্তি করা সম্ভব হয়নি।
যাই হোক, আমি বিশ্বাস করি, অপেক্ষাকৃত বেশি ভুক্তভোগী ও ক্ষতিগ্রস্থ দেশ হলেও বাংলাদেশ এবং বিশ্বের অনেক গরিব ও মধ্যবিত্তের দেশসমূহ অসাধারণ ও অমিত সম্ভাবনার সক্ষমতা রাখে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে উদ্ভাবনীমূলক উদাহরণ তৈরি করার। শুধু অ্যাডপটেশন নয় মিটিগেশনের ক্ষেত্রেও এ সকল দেশসমূহ অনন্য অবদান রাখতে সক্ষম। তারা এক্ষেত্রে প্রযুক্তিকেও সর্বোত্তমভাবে ব্যবহার করে তাক লাগিয়ে দেওয়ার সক্ষমতা রাখে বলেই আমি বিশ্বাস করি। বিগত সময়ে অনেকক্ষেত্রেই আমরা এর অনন্য নজির স্থাপন করেছি, করতে দেখেছি— তাই এই বিশ্বাস আমার মতো আরও অনেকের মধ্যেই নিশ্চয়ই জোরাল হওয়াটাই স্বাভাবিক।
ফলে হাত পেতে শুধু ক্ষতিপূরণ আদায় করার সংস্কৃতির বাইরে গিয়ে এখনই সময় আমাদেরকে নতুনভাবে চিন্তা করার। নিজেদের মেধা ও দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে টেকসই (সাসটেইনেবল) ও রেপ্লিকেবল মডেল তৈরি করার। যা এই সকল দেশসমূহ ভুক্তভোগী ও ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার পরও তাদের সক্ষমতাকে তুলে ধরবে, নিজেদের ভাবনায় ও বেঁচে থাকায় বিভোর হয়ে থাকার বাইরে গিয়ে তারা যে সারা বিশ্বের জন্যও ভাবছে তারও স্পষ্ট প্রকাশ ঘটাবে। একইসঙ্গে বহুকাঙ্ক্ষিত অর্থ কিংবা জলবায়ু তহবিল যেভাবেই বলা হোক না কেন— সেটা পরিপূর্ণভাবে পাওয়ার পথও সুপ্রশস্থ হবে সহজেই। কারণ এর মধ্য দিয়ে তখন ফলপ্রসূ গ্রিন ও টেকসই মডেলসমূহ আরও গুরুত্ব সহকারে সবার সামনে আসবে।
ফলে সংস্কৃতি পরিবর্তনের এই চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আসুন আমরা নিজ নিজ দেশের অবস্থান পরিবর্তন করি। ভবিষ্যতের কথা, ভবিষ্যত প্রজন্মের কথা বিবেচনায় রেখে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় জরুরিভিত্তিতে সকলকেই কাজ করতে হবে।
এবারের কপ২৯-এ একটি আবেদনে আমি নিজেও সাড়া দিয়েছিলাম। সেটি ছিল, আগামী কপ হোক শিশুদের জন্য। শিশুদের নরম কোমল মনের মতোই আগামী কপও হয়ে উঠুক সংস্কৃতি পরিবর্তনের অনন্য ও অন্যরকম— যেখানে শুধু দাবি না জানিয়ে এ সকল দেশের পক্ষ থেকে বেশি বেশি কাজ ও উদাহরণ তুলে ধরা হোক। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার মডেলসমূহ তুলে ধরা হোক, কাজের ফলাফল বিশ্লেষিত হোক, উদাহরণ সৃষ্টিকারী কাজসমূহ এক দেশ থেকে আরেক দেশে সম্প্রসারিত করার জন্য বেশি বেশি আলোচনা ও উদ্যোগ নেওয়া হোক। আর ওই গতিপ্রবাহ তৈরি করতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দিতে বিশ্বের ধনী রাষ্ট্রসমূহ কিংবা ধনী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানসমূহ কখনোই পিছপা হবে না বলেই আমি বিশ্বাস করি, কারণ সেখানে তাদেরও বেঁচে থাকার, ভালো কিছু করার, অবদান রাখার স্বার্থ এবং প্রশংসা পাওয়ার বিষয়ও ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত থাকবে। আর এ ধরনের বিনিয়োগের সন্ধানেই তারা আছে— যা সাম্প্রতিক ও বিগত সময়ের কপ থেকে আরও সুস্পষ্ট হয়েছে। তবে সেগুলো যেন ঋণের ফাঁদ না হয়, বহুজাতিক কোম্পানি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ যাতে সেগুলোর ফায়দা নিতে না পারে— সেদিকে সচেতন দৃষ্টি রাখাটা বিশেষভাবে জরুরি।
এখন কথার থেকে কাজ বেশি প্রয়োজন, সচেতনতার থেকে শিক্ষা বেশি প্রয়োজন, দাবির থেকে দক্ষতা বেশি প্রয়োজন, অর্থের পাশাপাশি উদ্ভাবনী চিন্তাও প্রয়োজন— যা আমাদেরকেই খুঁজে বের করতে হবে। তাহলেই প্রতিটি দেশ ও বিশ্বে ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা হবে। সেশন থেকে শুধু জ্ঞানার্জন নয়— কপ হোক ওই ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনাকারী মাইলফলক রচনাকারী এক মহাসম্মেলন। আগামী কপ হয়ে উঠুক জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার সমাধানের সঙ্গে সংযোগ ও আর্থিক যোগসূত্র স্থাপনের সম্মেলন। জাতিসংঘের মতো প্রতিষ্ঠানের কাছে সেটাই সবার প্রত্যাশা থাকবে। ফলে কপ আয়োজনের ডিজাইন বা মূল পথনকশনা নিয়ে নতুন করে ভাবনার অবকাশ আছে এবং ভাবনার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম বলেই আমি মনে করি।
জলবায়ু ইস্যুকে উপেক্ষা করা মানে আমাদের বেঁচে থাকাকে আরও হুমকির মধ্যে ফেলে দেওয়া। ফলে প্রতিটি ক্ষেত্রে, প্রতিটি সেক্টরে, প্রতিটি বিষয়ের সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের সংযোগ খুঁজতে হবে এখন এবং যৌক্তিকভাবেই প্রতিটি জীবনের, প্রতিটি বিষয়ের সঙ্গেই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সংযোগ রয়েছে। এই সংযোগসমূহ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে খুঁজে বের করে প্রতিটি দেশকে ওই আলোকে রাষ্ট্র ও জীবন পরিচালনের গতিধারা মানসম্মতভাবে নির্দিষ্ট করাটা এখন জরুরি। এটি কঠিন কিছু নয়, বরং ভুক্তভোগী ও ক্ষতিগ্রস্থ দেশসমূহ এক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিতে পারে, কারণ তারা জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতাকে অনেক বেশি অনুভব করছে। ফলে তাদের সমাধান, তাদের চিন্তাধারা, এ নিয়ে কাজ করার জন্য তাদের পণ ও প্রতিজ্ঞাসমূহ অন্য অনেকের থেকেই আরও গভীর, ব্যাপক ও সমৃদ্ধ হতে বাধ্য।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, প্রতিটি দেশ তাদের অনেক সমস্যার ভিড়ে জলবায়ু পরিবর্তনকে সেভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে না কিংবা দিতে পারছে না; অনেকক্ষেত্রেই তারা এটাকে শুধুমাত্র নির্দিষ্ট মন্ত্রণালয়ের, পরিবেশ বিষয়ের শিক্ষার্থীদের ও সংস্থার কিংবা পরিবেশবাদীদের বিষয় হিসেবে ভাবছে। অন্যভাবে বলতে গেলে অনেকটা একেবারেই আলাদা বিশেষায়িত বিষয় বলেই হয়তো মনে করছে। ফলে বিনিয়োগের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র ও সুযোগ থেকেও গরিব ও মধ্যবিত্তের দেশসমূহের মতোই বাংলাদেশও অনেকটাই বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে।
বিগত প্রায় চার বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে প্রভা অরোরার মতো সাসটেইনেবল গ্রিন এন্টারপ্রাইজ গড়ে উঠেছে। প্রভা অরোরা এর মধ্যে অনেকগুলো পাইওনিয়ারিং কাজের সূচনা ও ভিত্তি স্থাপন করেছে। এগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে ইউএন-এর গ্রীনিং এডুকেশন কার্যক্রম সফলভাবে শুরু, লাইফস্টাইল চেঞ্জিং প্রোডাক্টস নিয়ে কাজের জন্য ‘সবুজ সাথী’ প্রতিষ্ঠা, প্লাস্টিক পলিউশন কমিয়ে আনতে ইউএনইপির টাইড টার্নার্স প্লাস্টিক চ্যালেঞ্জ শুরু, জৈব বা পচনশীল আবর্জনা ব্যবস্থাপনার (অর্গানিক ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্টের) ক্ষেত্রে ফার্মিংয়ের মাধ্যমে জিরো ওয়েস্ট ও সার্কুলার ইকোনমির অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করা। পাশাপাশি শিল্পীদেরকে ও বিভিন্ন শিল্প মাধ্যমকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় কাজে লাগাতে ‘পরিবেশসন্ধ্যা’ আয়োজন, খাদ্যপণ্যের অভ্যাস পরিবর্তনে ‘ইকো-ভ্যান’ মডেল তৈরি ইত্যাদি অন্যতম।
প্রতিষ্ঠানটি ইতোমধ্যে সফলভাবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও অংশীদারিত্বের সম্পর্ক তৈরি করতেও সমর্থ হয়েছে, যা বাংলাদেশের জন্য নতুন ও ইতিবাচক ভবিষ্যতেরই ইঙ্গিত বহন করে। যেমন, তারা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ইউনেসকো ও ইউনেপ দ্বারা স্বীকৃত বিশ্বের সর্ববৃহৎ পরিবেশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ফাউন্ডেশন ফর এনভায়রনমেন্ট এডুকেশনের (FEE) বাংলাদেশের একমাত্র ন্যাশনাল অপারেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। প্রতিষ্ঠানটি গ্রিনিং এডুকেশন পার্টনারশিপস-এর গর্বিত পার্টনার, শিক্ষকদেরকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রদানের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি ইউনেসকোর অভ্যন্তরের গুরুত্বপূর্ণ দুটি প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজনের মধ্যে অন্যতম ‘অফিস ফর ক্লাইমেট এডুকেশন’-এর সঙ্গে বিশেষ পার্টনারশিপ স্থাপন করতে সমর্থ হয়েছে, এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি ইউএনইপির লিড পার্টনার হিসেবে টাইড টার্নার্স প্লাস্টিক চ্যালেঞ্জও বাস্তবায়ন করছে।
শুধু বাংলাদেশেই নয় অন্যান্য দেশেও এ ধরনের গ্রিন এন্টারপ্রাইজ, গ্রিন বিজনেস, সাসটেইনেবল এন্টারপ্রাইজ ও উদ্যোগ গড়ে উঠেছে এবং এর সংখ্যা ক্রমশই বাড়ছে। কিন্তু আমরা আদৌ কি এই প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রকৃতি বিচার করেছি, এ সকল প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমরা চিনি এবং জানি, এই উদ্যোগগুলোতে আদৌ কি আমরা মনোযোগ দিচ্ছি? প্রয়োজনীয় সহায়তা করছি?
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এইসব প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমরা গতানুগতিকতার মাপকাঠির বিচারে বিচার, বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করছি। ফলে এইসব প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার ক্ষেত্রে যে সকল সম্ভাবনা তৈরি করা এবং সম্ভাবনাসমূহকে বাস্তবে রূপদান করা সম্ভবপর ছিল কিংবা সম্ভব হতো— তা পুরোপুরিভাবেই বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। একইসঙ্গে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে গ্রিন ফাইন্যান্স, সাসটেইনেবল ফাইন্যান্স ও সাসটেইনেবিলিটি নিয়ে সামগ্রিক ইকোসিস্টেম তৈরির প্রক্রিয়াও।
বলাবাহুল্য যে, প্রভা অরোরার মতো এই সকল প্রতিষ্ঠানের জন্য আলাদা বিবেচনা, আলাদা কাঠামো, ব্যবস্থা ও ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন। এসব উদ্যোগের মধ্য দিয়ে গ্রিন ফাইন্যান্স, জলবায়ু তহবিল আমরা পরিপূর্ণভাবে একটি দেশে নিয়ে আসতে সমর্থ হবো বলেই বিশ্বাস করি। ফলে এই ধরনের প্রতিষ্ঠানসমূহ চিহ্নিত করে সে সকল প্রতিষ্ঠানগুলোর চিন্তার পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য এখন প্রয়োজনীয় সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতা করাটা অত্যন্ত জরুরি হবে। যাতে এ সকল প্রতিষ্ঠানসমূহ পরবর্তী সময়ের কপ এ গিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে মডেলসমূহ, কাজের ফলাফল ও বিশ্লেষণ বিস্তারিতভাবে তুলে ধরতে পারে।
মনে রাখতে হবে গ্রিন ও সাসটেইনেবল এ সকল উদ্যোগসমূহ অবশ্যই বিনিয়োগ নির্ভর হতে হবে, যাতে তা দীর্ঘমেয়াদে স্থায়িত্বশীলতা পায়। বিনিয়োগ সবসময় ঋণে জর্জরিত করে না, এর সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করার মতো পরিবেশ তৈরি করা জরুরি। একইসঙ্গে উপযুক্ত পরিমাণে বিনিয়োগ করাটাও জরুরি, পাশাপাশি এসকল প্রতিষ্ঠানসমূহের জন্য সহজ শর্তে বিনিয়োগ নিয়ে আসার পথও সুপ্রশস্ত করতে হবে। এক্ষেত্রে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের ওপর জোর দিয়ে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে।
তবে নারী ও তরুণ সমাজ, নিজস্ব সম্পদ, নিজস্ব ঐতিহ্য, নিজস্ব পণ্য বা প্রোডাক্ট ও সংস্কৃতিসমূহ মডেল তৈরির ক্ষেত্রে অন্যতম চালিকাশক্তি হবে। তাই সুনিপুণভাবে সেগুলো খুঁজে বের করাটা জরুরি, এজন্য ক্ষুদ্র উদ্যোগ কিংবা উদ্যোক্তাদের বিকাশের পথ তৈরি করে দেওয়াটাই অন্যতম ও গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হবে। বয়স অনুসারে পাঠ্যপুস্তকের সঙ্গে এ সকল বিষয়ের সংযোগ স্থাপন আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি পদক্ষেপ হবে।
পরিশেষে, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে গতানুগতিক চিন্তা-ভাবনার বাইরে গিয়ে উদ্ভাবনীমূলক চিন্তা করাটা এ মুহূর্তে জরুরি। এই লক্ষ্যে আমাদের সংস্কৃতি ও চিন্তার গতানুগতিক ধারায় পরিবর্তন ঘটাতে হবে। তবে ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে দেশ হিসেবে আমাদের এবং আমাদের মতো গরিব ও মধ্যবিত্তের দেশসমূহের অনেক সমৃদ্ধ সম্পদ, মেধা ও সক্ষমতা রয়েছে— সেগুলোকে উপযুক্তভাবে কাজে লাগিয়ে আমাদের টেকসই বা স্থায়িত্বশীল অর্থাৎ সাসটেইনেবল ও গ্রিন ইকোসিস্টেম এবং গ্রিন অ্যাকশন প্ল্যান আমাদেরকেই তৈরি করতে হবে, তবে সেখানে বেঁচে থাকার অগ্রাধিকার শুধু নিজ দেশের মানুষরা পাবে না— বরং সারা বিশ্বের প্রাণী, পরিবেশ ও প্রতিবেশ জগতও এর সুফল লাভ করবে। আর তাহলেই বাংলাদেশ কিংবা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্থ ও ঝুঁকিপূর্ণ দেশসমূহ যে ক্ষতির শিকার ওই ক্ষতির ক্ষত সারাবিশ্বের সবার চোখে পড়ার বাইরে গিয়ে, দেশগুলো যে ইতিবাচক পরিবর্তনেরও সূচনাকারী ও আলোকবর্তিকা সেটাও বিশেষভাবে প্রস্ফুটিত হবে।