আমাদের দেশের মানুষ কেন অবৈধভাবে পাড়ি দিতে গিয়ে ভিনদেশের সাগরে ডুবে মরবে? সেকি কেবলই প্রলোভন? টাকা বানানোর নেশা? উন্নত জীবনের স্বপ্ন? নাকি দেশে কোনো কিছু করতে না পেরে ভিনদেশে কিছু একটা করার তাড়নায়?
Published : 12 Feb 2025, 06:41 PM
আমাদের দেশে বারবার আন্দোলন হয়, সংগ্রাম হয়, এমনকি অভ্যুত্থানও হয়। পরিবর্তন আসে রাজনীতিতে, পাল্টে যায় বিধি-সংবিধান। কিন্তু বদলায় না কেবল দেশের সাধারণ মানুষের ভাগ্য। অধিক উপার্জনের আশায়, উন্নত জীবনের স্বপ্নে বিভোর মানুষ আগে যেমন কাজের সন্ধানে বিদেশে পাড়ি দিত, এখনও তেমনই দিচ্ছে। সময় বদলেছে, কিন্তু দালালদের প্রতারণা, অসহায় মানুষের সর্বস্বান্ত হওয়া কিংবা লাশ হয়ে ফিরে আসার করুণ চিত্র আজও রয়ে গেছে একই রকম।
অবৈধভাবে সমুদ্রপথে ও বিভিন্ন দেশের ঝুঁকিপূর্ণ সীমানা পাড়ি দিয়ে ইউরোপযাত্রার সময় অসংখ্য মানুষ জীবন হারাচ্ছেন, নিখোঁজও হচ্ছেন। সম্প্রতি তেমনি এক মর্মান্তিক ঘটনার শিকার হয়েছেন হতভাগ্য বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি যুবক। লিবিয়া থেকে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার পথে নৌকাডুবিতে প্রাণ হারিয়েছেন তারা। ভূমধ্যসাগরের উপকূল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে তাদের নিথর দেহ।
কঠোর আইন, জীবনের ঝুঁকি, অনিশ্চয়তা এসব বিপত্তি জেনেও অনেক বাংলাদেশি তরুণ অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে ইউরোপ ও আমেরিকার পথে পা বাড়াচ্ছেন। অবৈধভাবে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে ঢোকার অন্যতম একটি পথ লিবিয়া। এ পথে ইউরোপে যাওয়ার জন্য মূলত ব্যবহার করা হয় ছোট ছোট নৌকা। এসব নৌকায় ধারণক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত যাত্রী তোলা হয়। প্রতিবছর এ পথে যাত্রা করতে গিয়ে প্রাণ হারান অনেক অভিবাসনপ্রত্যাশী। এ জন্য এ কাজে দালালেরা চালু করেছেন ‘বডি কন্ট্রাক্ট’ চুক্তি। এই চুক্তির আওতায় যত দিন লাগুক, অভিবাসনপ্রত্যাশীকে ইতালি জীবিত পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে টাকা নেয় দালালচক্র। কিন্তু অনেকেই শেষ পর্যন্ত গন্তব্যে পৌঁছতে পারে না। তার আগেই ডুবে মরে। আবার অনেকে সর্বস্বান্ত হয়ে দেশে ফিরে আসে।
প্রশ্ন হলো, আমাদের দেশের মানুষ সব সরকারের আমলে কেন অবৈধভাবে পাড়ি দিতে গিয়ে ভিনদেশের সাগরে ডুবে মরবে? সেকি কেবলই প্রলোভন? টাকা বানানোর নেশা? উন্নত জীবনের স্বপ্ন? নাকি দেশে কোনো কিছু করতে না পেরে ভিনদেশে কিছু একটা করার তাড়নায়? এ প্রশ্নগুলোর জবাব খোঁজা দরকার।
বাংলাদেশের শত শত তরুণ টাকা উপার্জনের স্বপ্নে বিভোর হয়ে অবৈধভাবে কেন ইউরোপ-আমেরিকা পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করছে? ইউরোপ-আমেরিকা তো নয়, এ যেন এক ভয়ংকর মৃত্যুপথযাত্রা! গহিন অরণ্য, গভীর সমুদ্র, তপ্ত মরুভূমি পাড়ি দিয়ে ভয়ংকর স্বপ্নযাত্রায় পা রাখছে অনেক বেকার যুবক। ভয়ংকর এই স্বপ্নযাত্রায় সর্বস্ব বিক্রি করে দালালদের হাতে তুলে দিচ্ছে টাকা-পয়সাসহ পরিবারের শেষ সম্বল।
কেউ কেউ অবৈধ পথে স্বপ্নের ঠিকানায় পৌঁছাতে পারলেও অধিকাংশই হয় ভাগ্যাহত। অনেকের জায়গা হয় কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। বাকিদের কারও কারও সলিল সমাধি হয় নৌকাডুবিতে। কেউ প্রাণ হারায় অনাহারে অর্ধাহারে, নানা রোগ-শোকে। তারপরও জীবনবাজি রেখে মৃত্যুকে হাতে নিয়ে এক মরীচিকার পেছনে ছুটছে হাজার হাজার বাংলাদেশি তরুণ। তারা যেতে চায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন উন্নত দেশে। তবে যে উন্নত জীবনের টানে তারা ধাবিত হয় ওইসব দেশ সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই বিদেশ-মোহে পেয়ে বসা এই তরুণদের। তারা যা শোনে তা সবই লোকমুখে এবং দালালদের কাছ থেকে।
এভাবে বিদেশ সম্পর্কে নানা গালগল্প শুনে আর দালালদের খপ্পরে পড়ে প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে বিদেশ পাড়ি দিচ্ছে ৭ থেকে ৮ লাখ মানুষ। কেউ যাচ্ছে বৈধ পথে, কেউবা অবৈধ উপায়ে। অবৈধ উপায়ে দালাল ধরে যারা বিদেশে যাচ্ছে তাদের অধিকাংশই সমুদ্র পাড়ি দিয়ে যায়। রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) তথ্য মতে, গত ১০ বছরে সমুদ্রপথে বিদেশ যেতে নিহত বা নিখোঁজ হয়েছে ১০ হাজার বাংলাদেশি। পাচার হয়েছে ২ লাখ ৬৫ হাজার মানুষ। আর বিদেশি কারাগারে বাংলাদেশি বন্দি রয়েছে ১৫ হাজারেরও বেশি। তবুও বিদেশ যাত্রা ‘নাহি মানে পরাভব!’
টাকা রোজগার করতে গিয়ে বিদেশে ভয়াবহ সব অভিজ্ঞতার পরও কেন বাংলাদেশিরা এভাবে জীবনকে হাতের মুঠোয় নিয়ে ইউরোপ পাড়ি দিতে চাচ্ছে? এর জন্য দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও কম দায়ী নয়। দেশে কাজ নেই। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না। মানুষের জীবিকা নির্বাহের ন্যূনতম সুযোগের প্রসার ঘটছে না। জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে, চাহিদা বাড়ছে, ভোগবাদিতা বাড়ছে। শুধু তাই নয়, দেশে শ্রমের মর্যাদা নেই। প্রচলিত ধারার বাইরে গিয়ে কিছু করলেই আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে পাড়াপ্রতিবেশীরা নাক সিটকায়। বন্ধুরা টিটকারি দেয়। বিদেশে ওই জটিলতা নেই। সেখানে ময়লা সাফ কিংবা টয়লেট পরিষ্কার করলেও দেখার কেউ নেই। সমালোচনারও কেউ নেই। তা ছাড়া দেশে এখন স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি নেই। সম্মান নিয়ে সৎপথে থেকে মাথা উঁচু করে বাঁচার নিশ্চয়তাও নেই। ফলে যেকোনো মূল্যে তরুণরা বিদেশ যেতে চায়। কাজ ও উপার্জনের আশায় করুণ অপমৃত্যুতে জীবনের শেষ অধ্যায় লেখা হলেও তারা বিদেশকেই কাঙ্ক্ষিত মনে করে।
এর আগে থাইল্যান্ডের এক জঙ্গলে অবৈধভাবে যাওয়া বাংলাদেশি শ্রমিকদের গণকবর পাওয়া গিয়েছিল। মালিকরা দাসের মতো ব্যবহার করে একসময় তাদের গণকবর দিয়ে রেখেছিল। বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষ কাজের আশায় বেঁচে থাকার তাগিয়ে বাংলাদেশের চেয়ে আরও দরিদ্র, আরও অবক্ষয়গ্রস্ত দেশে পর্যন্ত যাচ্ছে। কতটা বিপন্ন হলে যুদ্ধবিধস্ত সিরিয়ার মানুষের সঙ্গে এক হয়ে একজন মানুষ কাজের সন্ধানে পাড়ি জমানোর ইচ্ছা পোষণ করে?
মনে রাখতে হবে যে, মানুষ খুব একটা দায়ে না পড়লে নিজস্ব বাড়িঘর, পরিবেশ, আত্মীয়-স্বজন, ভাষা-সংস্কৃতি ছেড়ে বিদেশ যেতে চায় না। যারা যায়, নিতান্ত দায়ে পড়েই যায়। দেশে কাজ থাকলে কেউ কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে কিংবা মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে বিদেশে পাড়ি দেয় না। অভিবাসী কর্মজীবীদের অভিজ্ঞতা মোটেও সুখকর নয়। বিদেশে উপযুক্ত ও পছন্দনীয় চাকরি পাওয়া কঠিন; চাকরির নিরাপত্তা থাকে না; কর্মজীবন কষ্টদায়ক, অনেক ক্ষেত্রে অমর্যাদাকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। পাশাপাশি মানবিক অধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়; বৈষম্য, শোষণ ও নির্যাতনের শিকারও হতে হয়; বৈধ কাগজপত্রের অভাবে বিবেকহীন নিয়োগকারীরা সুযোগ নেয়; কম বেতনে প্রতিদিন দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করতে নিয়োগকারীরা জবরদস্তি করে এবং যেকোনো অজুহাতে কর্মচ্যুত হওয়ারও আশঙ্কা থাকে। এরপরও বেশি উপার্জনের আশায় মানুষ নিজ দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে।
সরকারের কর্তাব্যক্তিরা মুখে যা-ই বলুন না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে, দেশে কাজ নেই। আয়-রোজগারের ব্যবস্থা নেই। বাংলাদেশের চাকরির বাজার এখনও সংকীর্ণ। লাখ লাখ উচ্চশিক্ষিত বেকার কাজের আশায় পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনেকে দিশেহারা হয়ে নিজেদের শেষ সম্বলটুকু দালালের হাতে দিয়ে ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। জীবিকার সন্ধানে বিদেশ পাড়ি দিতে গিয়ে অনেকে সাগরে, মরুভূমিতে বা জঙ্গলে ধুঁকে ধুঁকে মরছে। আর যারা বেঁচে আছে তারা বিভিন্ন দেশে ফেরারি আসামি হয়ে দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছে। হয়ত এক জীবনে তাদের মা-বাবা বা প্রিয় মানুষের মুখটি আর দেখা হবে না। এছাড়াও বাংলাদেশের প্রচুর শিক্ষিত তরুণ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পেট্রল পাম্প, দোকান এবং বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে শত কষ্ট সহ্য করেও কাজ করে যাচ্ছে।
স্বাধীনতার এত বছর পরেও কি জাতি হিসেবে আমরা পশ্চাৎপদ রয়ে গেলাম? দেশের তরুণদের মুখে প্রায়ই শোনা যায়, বাংলাদেশে কোনো ভবিষ্যৎ নেই, সুযোগ পেলেই দেশের বাইরে চলে যাব। এখন সরকারের দায়িত্ব দেশে চাকরির বাজার সৃষ্টি করা এবং কর্মসংস্থান বাড়ানো। এ জন্য দরকার পরিকল্পিত উদ্যোগ। কিন্তু সরকার তা করতে পারছে বলে মনে হয় না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে প্রায় ছয় মাস হয়ে গেল। কিন্তু দেশের বেকারদের জন্য, তরুণদের জন্য আশাজাগানিয়া তেমন কোনো উদ্যোগ এখনও চোখে পড়েনি। অথচ অনেক আশা নিয়েই এই দেশের তরুণ প্রজন্ম সরকার পতনের আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল। তাদের জন্য কাজের ব্যবস্থা হবে, চাকরিতে বৈষম্য থাকবে না, ‘কসমেটিক উন্নয়ন’ নয়, প্রকৃতপক্ষে দেশের বেকার যুবাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। কিন্তু তরুণদের ওই স্বপ্ন ফিকে হতে শুরু করেছে। এত বড় রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরও তাদের জন্য তেমন কোনো স্বপ্নময় পথ রচনা করা যায়নি। এক ধরনের বিশৃঙ্খলা আর অরাজকতাই যেন বর্তমানে শেষ কথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ আমাদেরও কথা ছিল সিঙ্গাপুর হওয়ার। ভিয়েতনাম হওয়ার। সিঙ্গাপুর যদি ‘জেলেদের গ্রাম’ থেকে আজ সেরা মেগা-সিটি এবং পুঁজি বিনিয়োগের জন্য বিশ্বের সেরা দেশগুলোর একটি হতে পারে, বাংলাদেশ কেন পারবে না? এই প্রশ্নের উত্তর নেই।
আমাদের দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে গরিব মানুষকে বিদেশে মজুর খাটতে পাঠানো, আর নামমাত্র পারিশ্রমিকে মেয়েদের গার্মেন্টসে খাটানো। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, আমাদের দেশে এখন বেঁচে থাকাটাই বড় পাওয়া। ভালোভাবে বেঁচে থাকাটা বিলাসিতা। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? বালুতে মুখ গুঁজে আর মিথ্যে স্বপ্নের গল্প শুনিয়ে দেশের মানুষকে আর কতদিন ভুলিয়ে রাখা যাবে?