রুচির ভিন্নতা এবং উত্তরপ্রজন্মের জন্য ভাবনা

শিশুরা নদী পাবে কোথায়? নদী তো দখল হয়ে যাচ্ছে। একটা প্রবাল দ্বীপ ছিল, তাও ভূমিদস্যুদের লোভে আজ ধ্বংসের পথে, একটা সুন্দরবন ছিল সেখানেও গাছ কেটে উজাড় করা হচ্ছে, একটা সমুদ্রের তীরে ঝাউবন ছিল, ওই ঝাউবন নেই হয়ে গেছে কংক্রিটের দালানে। তাহলে বাচ্চাদের নিয়ে অভিভাবকেরা যাবেন কোথায়?

জেবউননেছাজেবউননেছা
Published : 1 April 2023, 11:44 AM
Updated : 1 April 2023, 11:44 AM

কিছুদিন আগে গাজীপুরের কালিয়াকৈরের ঠাকুরপাড়ায় যাত্রা অনুষ্ঠান উপভোগ করার সুযোগ হয়েছিল। যাত্রা উপভোগের অভিজ্ঞতা এটাই প্রথম। মধ্যরাতে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ এবং নারী ও পুরুষের জন্য আলাদা দর্শক সারি আমাকে অভিভূত করেছে। বাইরে প্রাঙ্গনে চলছে গ্রামীণ মেলা। বাহারি পণ্যের দোকানের পাশাপাশি রয়েছে অনেক ধরনের খাবারের দোকানও। বিশেষ করে মুড়ি, মুড়কি, নিমকি, কদমার দোকানে তো রমরমা অবস্থা। তিন দিনব্যাপী এই মেলা এবং যাত্রা অনুষ্ঠানে শেষ রাত পর্যন্ত থাকে মানুষের আনাগোনা।

ওই অনুষ্ঠান থেকে বাসায় ফিরে শৈশবের নানান স্মৃতি ভর করতে থাকে আমার মাথায়। শৈশবে নারায়ণগঞ্জের আলী আহমেদ চুনকা পাঠাগারে মঞ্চনাটক উপভোগ করতাম। আমার বাবার লেখা নাটকও দেখেছি বেশ কয়েকবার। মঞ্চে কলাগাছ, ছনের ঘরসহ নানা প্রাকৃতিক দৃশ্যের উপস্থাপনা আমার মনে গেঁথে গিয়েছিল। অনেক সময় দেখতাম, নাটক শেষে শিল্পীরা বাবাকে ‘ওস্তাদ’ সম্বোধন করে পা ছুঁয়ে সালাম করছেন। এই পাঠাগারে নানা ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করেছি। নিজেও কবিতা আবৃত্তি এবং উপস্থাপনা করেছি। এখন সেই পুরনো পাঠাগার ভেঙে নির্মিত হয়েছে নতুন ভবন। আন্ডারগ্রাউন্ডে একটি সিনেমা হলও আছে। আগের মতোই নাটক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। কিন্তু আগের মতো ওস্তাদকে তার শিষ্যরা পা ছুঁয়ে সালাম করেন কিনা জানা নেই।

আমাদের বাড়ির কাছে একটি শিশু পার্ক ছিল। বিকেল হলেই বাবা নিয়ে যেতেন ওই পার্কে, কাছেই শীতলক্ষ্যা নদী। পার্কে বাবার লেখা ইতিহাসভিত্তিক বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হয়েছে, কালের বিবর্তনে শিশুপার্ক ভেঙে ফেলা হয়েছে, এখানে গড়ে উঠেছে গুদামঘর।

মেজ চাচা চলচ্চিত্রের সাথে জড়িত ছিলেন বলে কৈশোর থেকেই সিনেমা হলে গিয়ে অসংখ্য সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতা আমার আছে। আশির দশকে চাচাতো ভাই-বোনরা একসাথে সিনেমা দেখতে যেতাম আমরা। নারায়ণগঞ্জ শহরের কোনো সিনেমা হল বাকি নেই যেখানে সিনেমা দেখিনি। জীবনের প্রথম দেখা সিনেমার নাম ছিল, ‘নার্গিস’। গল্প এবং নায়ক নায়িকার নাম মনে নেই। কিন্ত পরিষ্কার মনে আছে ‘ইনসাফ’, ‘বিনি সুতার মালা’, ‘হাতি আমার সাথী’, ‘স্বাধীন’, ‘স্বাক্ষর’সহ আরও অনেক সিনেমার নাম। কালের বিবর্তনে এখন সিনেমা হলগুলোর আগের জৌলুস নেই। তবে বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠদের সাথে বসে দেখার মতো সিনেমাও তেমন হয় না।

শৈশবে বাংলাদেশ টেলিভিশনের শুরুটা হতো দেশের গান এবং গ্রামের দৃশ্য দিয়ে। শতভাগ শহরের মেয়ে হওয়াতে গ্রামের দৃশ্যগুলো আমার মন কেড়ে নিত। যা এখনো চোখে লেগে আছে। এরপর ছিল ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘বহুব্রীহি’, ‘অয়োময়’, ‘আজ রবিবার’সহ নানা ধরনের নাটক। শিশুদের জন্য ছিল ‘এসো গান শিখি’ ও ‘মীনা কার্টুন’। শুক্রবার বিকেলে হতো বাংলা ছায়াছবি, রাত দশটার পর ‘ছায়াছন্দ’– এগুলো পরিবারের সবাই মিলে উপভোগ করতাম। সময়ের বিবর্তনে এমনভাবে হয়তো কেউ আর টেলিভিশনের অনুষ্ঠান এত উপভোগ করে না। তখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছিল না, ডিশ অ্যান্টেনা আসছে আসছে এমন ভাব।

মনে পড়ে বাংলাদেশ টেলিভিশনের ছবি পরিষ্কারভাবে উপভোগ করার জন্য ছাদে অ্যারিয়াল লাগানো হতো। ছোট ভাই অ্যারিয়াল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে জানতে চাইত, ‘ঠিক আছে তো?’ আমি নিচ থেকে বলতাম, ‘ক্লিয়ার হয়নি, আরেকটু দেখ।’

১৯৮৬ সাল থেকে ঢাকার বিভিন্ন শিশু সাহিত্য প্রতিযোগিতায় আমার অংশগ্রহণ শুরু হয়। বাংলাদেশ বেতার, নতুন কুড়ি, জাতীয় শিশু সাহিত্য প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে পুরস্কার অর্জনের কত-শত স্মৃতি মনের খাতা জুড়ে আছে। তখন তো আর হাতে হাতে ক্যামেরা মোবাইল ছিল না। ক্যামেরা ছিল, তবে তা ছিল ব্যয়বহুল। তাও কিছু ছবি অ্যালবামে আছে এখনো। তখন পুরস্কার পেলে আমার বাবা-মা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখে বলতে পারতেন না, আমার মেয়ে পুরস্কার পেয়েছে। সত্যি বলতে কি তখন বিষয়গুলো ছিল একান্তই মনের তুষ্টির জন্য কাজ করা। কেউ জানল কি না তা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা ছিল না কারও। সবার একটিই ইচ্ছে ছিল কাজ করে যাওয়ার। যুগে যুগে যত শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি, রাজনীতিবিদ এসেছেন তারা কাজ করেছেন নিবিষ্টভাবে। কাজই তাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। তারা সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য ছুটতেন না এবং অহেতুক প্রতিযোগিতা করতেন না।

স্বাধীনতার লাভের পর প্রথম বিজয় দিবস উদযাপনের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর দিকনির্দেশনায় ‘বাংলাদেশ’ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। এই গ্রন্থে কাজ করা দু-জন মানুষ জীবিত আছেন এখনো। তাদের সাথে সাক্ষাৎ করার সুযোগ হয়েছে আমার। তাদের একটিই কথা বঙ্গবন্ধু এই গ্রন্থটি এমনভাবে চেয়েছিলেন যেন, এটি বহির্বিশ্বে দেশের প্রতিনিধিত্ব করে। একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ, অথচ কত স্বপ্ন ছিল সবার চোখেমুখে। ওই বইয়ের সম্পাদকমণ্ডলি রাষ্ট্রপতির আগে বঙ্গবন্ধুর ছবি দিয়েছিলেন দেখে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আগে রাষ্ট্রপতির ছবি, তারপর প্রধানমন্ত্রীর ছবি থাকবে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনকে বঙ্গবন্ধু ‘স্যার’ সম্বোধন করতেন। ধ্বংসস্তূপ থেকে দেশ গড়ার জন্য জোয়াল কাঁধে নিয়ে বঙ্গবন্ধু যখন অগ্রসর হচ্ছিলেন তখনই দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রকারীরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। এক রাতের মধ্যে বাংলাদেশ বেতার হয়ে যায় রেডিও বাংলাদেশ। কেউ কেউ বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের কপালে চুমু খায়, কেউ আবার হত্যাকারীদের বলেছিল ‘সূর্য সন্তান’। ক্ষমতার পালাবদল করতে গিয়ে দেশটির কথা কেউ না ভেবে নিজের আখের গোছাতে থাকে। চলতে থাকে ইতিহাস বিকৃতির মহোৎসব। একটা সময় শুরু হয় সমাজে বন্ধ্যাত্ব এবং শূন্যতা। নানা সেক্টরে যে শূন্যতা তখন তৈরি হয়েছিল তা কিন্ত আর পূরণ হয়নি।

এখন প্রযুক্তির যুগ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আর অ্যান্ড্রয়েড মুঠোফোনের যুগ। ঘরে বসেই আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে কাউকে টেনে হিঁচড়ে নিচে নামাই আবার কাউকে ওপরে ওঠাই। যখন-তখন যা মনে আসে লিখতে পারি। গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসাতে পারি। আমাদের অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে তা স্বীকার করতেই হবে। কিন্ত মানসিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক উন্নয়নের কথাও ভাবতে হবে। চিন্তার উন্নয়ন পরিবার থেকে নিয়ে আসতে হবে। রাষ্ট্র তার দায়িত্ব পালন করছে। কিন্তু মানসিক উন্নয়নের কাজটি তো আমাদেরই করতে হবে।

আমাদের সন্তানেরা সৃজনশীল প্রশ্ন লিখে এ প্লাস পাচ্ছে। কিন্ত বাস্তবে সৃজনশীলতার ছোঁয়া কি দেখতে পাচ্ছি? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা রকমের ছবি দিয়েই আমরা আধুনিক বনে যাচ্ছি। কোনো অনুষ্ঠানে গেলে ওই অনুষ্ঠান উপভোগ না করে ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। নানা রকমের পোশাকের মোড়কে নিজেদের সাজিয়ে সামাজিক মাধ্যমে উপস্থাপন করছি। ওদিকে টিনএজ ছেলেমেয়েরা সামাজিক মাধ্যমে অশ্লীল ভিডিও দেখছে আর কেউ কেউ এটা নিয়ে ব্যবসা করছে।

এসব ব্যাপারে কেউ যেন কিছু ভাবছেই না! দ্রব্যমূল্য বাড়লেও কেউ প্রতিবাদ করে না, অপরদিকে দাম কমলেও কেউ ধন্যবাদ দেয় না। একটা ভার্চুয়াল জাতি হয়ে পড়ছি আমরা। যেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আমাদের সমস্ত নির্ভরতার জায়গা। কেউ একজন কিছু লিখল, আর তার পেছনে সবাই ছুটতে থাকে– যেন সে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা। ব্যস তিনি হয়ে গেলেন ভাইরাল। বিদ্যালয়গুলোতে বাচ্চারা মুঠোফোন নিয়ে যাচ্ছে, ভার্চুয়াল গ্রুপ করছে, সেগুলোর স্ক্রিনশট শেয়ার করছে। ওদিকে কিশোরীদের কেউ কেউ নানা সম্পর্কে জড়িয়ে যাচ্ছে– কেউ কেউ প্রতারিত হচ্ছে। কেউ যেন দেখার নেই। এই যে বগুড়ায় বিদ্যালয়ে ঝাড়ু দেয়া নিয়ে এত ঘটনা, তার মূলই তো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। এই মাধ্যমেই তো উষ্মা ছড়ানো হলো। কেন বিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের মুঠোফোন ব্যবহারে লাগাম টেনে ধরতে পারল না? কেন পরিবারগুলো লাগাম টেনে ধরতে পারল না? আমরা ঘটনাকে প্রাধান্য দিচ্ছি। ঘটনাগুলো কেন ঘটছে তার মূল খুঁজে বের করছি না।

তাহলে কি আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করব না? প্রযুক্তির সুবিধা নেব না? অবশ্যই নেব, কিন্তু এর ইতিবাচক দিকটা দেখে নেব। অনেক দেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আমরা যদি ক্ষতিকর গেমস বন্ধ করতে পারি, তাহলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কুরুচিপূর্ণ কন্টেন্ট কেন বন্ধ করতে পারব না?

যখন থেকে হিন্দি সিরিয়াল আমাদের ওপর জেকে বসল, তখন থেকেই মানুষ বাংলা নাটক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল। হিন্দি সিরিয়ালের ঝকমকে পোশাক, সাজগোজ অনুসরণ করতে লাগল। এরপর ইউটিউবে নানা রকমের কুরুচিপূর্ণ কন্টেন্ট বানানো শুরু হলো। আমরা এগুলো নিয়ে ভাবলামই না। তরতর করে এসব আগ্রাসন স্বর্ণলতার মতো সমাজে জড়িয়ে গেল।

এখনো সময় আছে, লাগাম টানার। আমি টেলিগ্রাম যুগের মানুষ, হলুদ খাম খুলে চিঠি পড়ার যুগের মানুষ। দুপুরবেলা বাংলাদেশ বেতারে চলচ্চিত্রের গান শোনা যুগের মানুষ, সপ্তাহে একদিন মায়ের হাতে সুস্বাদু গরুর মাংস খাওয়া যুগের মানুষ। ক্রিংক্রিং শব্দে বেজে ওঠা টেলিফোন ধরে এপাশ থেকে হ্যালো বলা যুগের মানুষ, সাত টাকা মিনিটে মুঠোফোনে কথা বলার যুগের মানুষ। তখনও বেশ আধুনিক ছিলাম, এখনো তাই। কিন্তু আধুনিকতার চটকদারির সাথে একাত্ম নই।

কয়েকদিন ধরে ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’ শব্দটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনার মহামারী লক্ষ্য করছি। আমার এক মনোবিজ্ঞানী বন্ধু ফেইসবুকে লিখেছেন ‘রুচি বিষয়ে জ্ঞান দাও বন্ধুরা’। তার এই লেখা দেখে মন্তব্য করলাম, ‘বন্ধু, রুচির শ্রেণি বিন্যাস আছে। যেটা বয়স, কাল, স্থানভেদে ভিন্নতর হয়। যেমন এক সময় আমি যাদের শ্রদ্ধা করতাম, এখন তাদের সাথে কথা বলতে রুচিতে বাধে। কারণটা কী জানো? কারণ হচ্ছে রুচির ভিন্নতা সেই মানুষটির চাল-চলন। আবার এক সময় যেটি খুব রুচি করে খেতাম, এখন আর তা ভালো লাগছে না, এটা হলো জিহ্বার স্বাদের পরিবর্তন। এক সময় যে রকমের পোশাক ভালো লাগত, এখন সেই রং এবং সেই ডিজাইনের পোশাক ভালো লাগে না। কারণ হলো, চোখের এবং মনের পরিবর্তন।

এক সময় যা করার জন্য মরিয়া ছিলাম, এখন মনে হয় এত মরিয়া হওয়া ঠিক হয়নি তখন। একসময় যে রকম বই পড়তে ভালোবাসতাম, এখন সেই বই না পড়ে অন্যরকম বই পড়তে ভালো লাগে। এক সময় জোরে জোরে গান শুনতাম, এখন মনে হয় আস্তে শুনলেই ভালো লাগে। একসময় নিজেকে ভালোবাসতামই না। নিজেকে ভালোবাসতে হয় তাও বুঝতাম না। এখন নিজেকে ভালোবেসে ইচ্ছেমতো ঘুমাতে ইচ্ছে করে, নিজেকে নানা ধরনের গিফট দিতে ইচ্ছে করে। ঘুরতে ফিরতে ইচ্ছে করে।

এই যে এতগুলো উদাহরণ দিলাম, এগুলো সব রুচিবোধ থেকে আসে। বন্ধুকে বলি, তুমি তো মনোবিজ্ঞানী, তাই তোমার কাছে রুচির সংজ্ঞা এক রকম, আর আমি সমাজ বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করি, আমার কাছে রুচির সংজ্ঞা অন্য  রকম। এক-একজনের এক-এক রকমের রুচি। তবে সমাজের রুচির সাথে চলতে গেলে সামাজিক পরিমিতিবোধ থাকা জরুরি। যা এখন আর আগের মতো নেই। ওই কারণেই রুচির দুর্ভিক্ষ চলছে। যা বলতে গেলে অনেক কথা বলতে হবে। এক লাইনে যদি বলি, সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিল্প, চলচ্চিত্র, শিক্ষার বদল খেয়াল করে দেখো। সামাজিক অবক্ষয় যখন বেড়ে যায়, তখন সকল সেক্টরেই রুচির অভাব দেখা যায়। রুচি শব্দটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যা দেশ, কাল, পাত্রভেদে আলাদা।’

এক যুগ আগে শিক্ষার্থীদের বেশভূষা, চালচলন যেমন ছিল এক যুগ পরে ভীষণরকম ভিন্নতা চোখে পড়ে। এক যুগ আগে সামাজিক বন্ধন আর এখনকার সামাজিক বন্ধনেও যেন বিস্তর ফারাক। এখন যেন সবকিছুতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা।

আমাদের সন্তানদেরকে বাংলাদেশের সত্যিকারের ইতিহাস জানানো জরুরি। নদীর কাছে, জলের কাছে নেয়া জরুরি– তারা যেন ঘাড়কুঁজো প্রজন্ম না হয়, তাই তাদেরকে সময় দেয়া জরুরি। কাকে কেমন সম্মান দেবে তা শেখানো জরুরি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যত্রতত্র ব্যবহারের কুফল সম্পর্কে জানানো জরুরি। সন্তান মধ্যরাতে তার নিজ কক্ষে মুঠোফোন ব্যবহার করছে কিনা তা লক্ষ্য রাখা জরুরি।

সন্তানের যদি গানের গলা ভালো হয়, তাকে গান শেখাব, আর যদি ড্রয়িংয়ে ভালো হয়, তাকে ড্রয়িং শেখাব। সে যেটা পারে না, তাকে তা চাপিয়ে না দেয়ার মানসিকতা তৈরি করা জরুরি। ঈদ, পূজা, পার্বনে আমাদের সংস্কৃতির সাথে তাকে পরিচয় করিয়ে দেয়া জরুরি। দেশের পতাকা, দেশের মানচিত্রকে সম্মান করতে শেখানো জরুরি। আরও জরুরি তাদের মধ্যে দেশাত্মবোধ তৈরি করা।

প্রশ্ন করা যেতে পারে, শিশুরা নদী পাবে কোথায়? নদী তো দখল হয়ে যাচ্ছে। একটা প্রবাল দ্বীপ ছিল, তাও ভূমিদস্যুদের লোভে আজ ধ্বংসের পথে, একটা সুন্দরবন ছিল সেখানেও গাছ কেটে উজাড় করা হচ্ছে, একটা সমুদ্রের তীরে ঝাউবন ছিল, ওই ঝাউবন নেই হয়ে গেছে কংক্রিটের দালানে। তাহলে বাচ্চাদের নিয়ে অভিভাবকেরা যাবেন কোথায়? এই সীমাবদ্ধতার মাঝেও কিছু নদী এখনো বেঁচে আছে। প্রবাল দ্বীপটাও বেঁচে আছে। সময় করে সন্তানদের সমুদ্রের কাছে নিয়ে এতটুকু অন্তত অনুভব করতে শেখাই যে, সমুদ্র অনেক বড়। বিশাল ঢেউ তাকে ক্ষত-বিক্ষত করে, তবু সে গর্জে উঠে। জীবন চলার পথে তুমিও এমন ঝড়বৃষ্টির কবলে পড়বে, তোমাকেও মাথা তুলে দাঁড়াতে হবে। আমাদের সন্তানের মাঝে লুকিয়ে আছে মহৎ মানুষ হয়ে বেড়ে ওঠার প্রতিভা। শুধু দরকার পরিচর্যা।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব দরজায় কড়া নাড়ছে, চ্যাটজিপিটি হাতের নাগালে। এই বিপ্লবের ভিড়ে আমাদের সন্তানেরা যেন অমানবিক না হয়, সৃজনশীলতা না হারায় এটাই চাওয়া। এখনো কিন্ত বাংলার বিলে-ঝিলে হাঁস সাঁতার কাটে, সাদা বক উড়ে বেড়ায়, মাঠে গরু চরে। গ্রামে যাত্রাপালা হয়। একেবারে ক্ষয়ে যায়নি সমাজটা। কিছু নদী মরে গেলেও অনেক নদীই বেঁচে আছে। আমাদের প্রাণ আছে, প্রকৃতি আছে, ভালোবাসা আছে।

কাটছাট করে সস্তা জনপ্রিয়তা হয়ত পাওয়া যায়, কিন্তু মন দিয়ে করা কাজের স্থায়িত্ব অনেক। ছোটবেলায় পাঠ্যবইয়ে কাজী নজরুল ইসলামের ‘তোষামোদ’ কবিতাটি পড়েছিলাম, যার শেষ লাইন ছিল এমন, ‘সাহেব কহেন, “জাগিয়া দেখিনু, জুটিয়াছে যত হনুমান আর অপদেব!’/ “হুজুরের চোখ, যাবে কোথা বাবা?”/প্রণমিয়া কয় মোসাহেব।” এমন মোসাহেব সমাজের জন্য ক্ষতিকর, দেশের জন্য ক্ষতিকর। ‘ব্যক্তিত্ব’ এবং ‘বিনয়’ পাশাপাশি হাত ধরাধরি করে এগিয়ে চলে। এই শব্দ দুটির অর্থ হৃদয়ঙ্গম করতে পারলেই সর্বত্র রুচির দুর্ভিক্ষের প্রতিকার ঘটবে।