সবকিছু মিলিয়ে দেশে এক উদ্বেগজনক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সরকারে যারা আছে তারা যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকতে চাইছে, যারা বাইরে আছে তারাও সবকিছুর বিনিময়ে সরকারে আসতে চাইছে।
Published : 06 Oct 2023, 01:41 PM
রাজনীতিতে অচলাবস্থা নিরসনের কোনো সম্ভাবনা আপাতত দেখা যাচ্ছে না। বিএনপি গো ধরেছে, তারা নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না। ওদিকে ক্ষমতাসীনরা বলছে, সংবিধানে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো বিধান নেই, উচ্চ আদালতের রায়ে তা বাতিল হয়ে গেছে। কাজেই দলীয় সরকারের অধীনেই যথা সময়ে নির্বাচন হবে। এ নির্বাচনে কেউ না এলে ক্ষমতাসীনদের কিছুই করার নেই।
এদিকে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপ হচ্ছে। অর্থনীতির সূচকগুলো একে একে নেতিবাচক সীমায় উপনীত হচ্ছে। সবচেয়ে বড় সংকট দেখা দিয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে। অর্থনীতিবিদদের হিসেব মতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায় বাদ দেওয়া হলে বাংলাদেশের নিট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ১৭ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। গত ২৪ মাস বা দুই বছরে প্রতি মাসে ১০০ কোটি ডলার করে রিজার্ভ কমেছে। ২০২২ সাল থেকে দেশে রেমিটেন্স বা প্রবাসী আয়ের প্রবাহও কমছে। ২০২২ সালে যেখানে মাসে ২০০ কোটি ডলার আসত, সেখানে ২০২৩ সালের প্রথম তিন প্রান্তিকে দেশে প্রতি মাসে গড়ে ১৫০ থেকে ১৬০ কোটি ডলার প্রবাসী আয় এসেছে। সরকারি নীতির দুর্বলতার কারণে প্রবাসী আয় কমে যাচ্ছে, পক্ষান্তরে হুন্ডি ও হাওলা বেড়ে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতি মাসে বাংলাদেশ ব্যাংককে ১০০ কোটিরও বেশি ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে। এটা যদি চলতে থাকে, তাহলে এক সময় রিজার্ভ ফুরিয়ে যাবে। তখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। রিজার্ভ কমে যাওয়ার মূল কারণ নীতিগত সমন্বয়হীনতা ও নেতৃত্বের অভাব। বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচারও এর জন্য অন্যতম কারণ। টাকার মূল্যমান কৃত্রিমভাবে ধরে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। মূল্যস্ফীতি কমাতে হলে সুদের হার বাড়াতে হয়, মুদ্রানীতির সঙ্গে আর্থিক নীতির সমন্বয় করতে হয়। কিন্তু সরকার তা করতে পারেনি। রিজার্ভের অর্থ যেখান থেকে আসে ও ব্যয় হয়, এই দুটোর মধ্যে ভারসাম্য নেই। ২০২০–২১ অর্থবছরে দেশে আমদানি হয়েছিল ৬০ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলারের; ২০২১–২২ অর্থ বছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮২ দশমিক ৫০ ডলারে। ফলে সার্বিক ভারসাম্য ৬ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার ঘাটতি হয়েছে। এ কারণে রিজার্ভ ধরে রাখা যাচ্ছে না। এখানেই শেষ নয়, চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ সামলাতে হচ্ছে সরকারকে। রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে ঋণ শোধ করার ধারা অব্যাহত থাকায় রিজার্ভের ক্ষয় মাত্রাতিরিক্তভাবে বেড়ে গেছে।
বাজারে ডলারের প্রবাহ বাড়ে রপ্তানি আয়, রেমিট্যান্স, বৈদেশিক বিনিয়োগ ও বৈদেশিক অনুদান থেকে। এই ৪ খাতেই আয়ের ধারা নিম্নমুখী। দেশে গত বছরের এপ্রিল থেকে ডলারের সংকট শুরু হয়। ফলে ডলারের দাম ৮৮ টাকা থেকে বেড়ে ১১০.৫০ টাকা হয়েছে। ব্যাংকের চেয়ে কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম প্রায় ৭ থেকে ৮ টাকা বেশি। ফলে রেমিট্যান্সের বড় অংশ চলে যাচ্ছে হুন্ডিতে। মানি চেঞ্জার্স ও কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণে বিশেষ অভিযান পরিচালনা শুরু করলে ওখানে ডলার লেনদেনে স্থবিরতা নেমে আসে। এখন কিছু লেনদেন হলেও দাম ১১৮ থেকে ১১৯ টাকা। এতে ডলারের প্রবাহ তো বাড়েইনি। বরং কমে গেছে।
পাশাপাশি রয়েছে তেলসহ বিভিন্ন পণ্যের অপরিশোধিত দেনা শোধ করার বাধ্যবাধকতা। আবার বাজার স্থিতিশীল রাখতে ডলার বিক্রি করতে হবে। ফলে মজুতের ওপর ক্রমবর্ধমান চাপ কমার কোনো সম্ভাবনা আপাতত দেখা যাচ্ছে না।
ব্যাংক খাতের শোচনীয় অবস্থাও আরেকটি বড় সমস্যা। অনেক দিন ধরেই এই খাতের অবস্থা খারাপ, এখন পরিস্থিতি প্রায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। ব্যাংকের সঞ্চিতির অবস্থা খারাপ। রাজস্ব আদায়ও কম। আমদানি নিয়ন্ত্রণ ও ঋণপ্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে বিনিয়োগ কমছে। ফলে আয় ও কর্মসংস্থান কমছে।
নানা কৌশলে অর্থপাচারও অব্যাহত রয়েছে। দেশের আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে প্রায় ৩২ শতাংশ। কিন্তু আমদানি পণ্যের পরিমাণ বাড়েনি। আবার যে পরিমাণ রপ্তানি দেখানো হয়েছে, সেই পরিমাণে রপ্তানি আয় আসেনি—৯ থেকে ১২ বিলিয়ন ডলারের গড়মিল আছে। বিপুল পরিমাণ পুঁজি পাচার হয়েছে, এখনও হচ্ছে। বিদেশ থেকে যে অর্থ আসছে, তার চেয়ে বেশি বেরিয়ে যাচ্ছে। টিকে থাকার জন্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে বিভিন্ন গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। সে জন্য ঋণের বোঝা বাড়ছে।
সবকিছু মিলিয়ে দেশে এক উদ্বেগজনক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সরকার তার তৃতীয় মেয়াদের শেষ প্রান্তে উপনীত। এখন চলছে পালা বদলের সময়। সরকারে যারা আছে তারা যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকতে চাইছে, যারা বাইরে আছে তারাও সবকিছুর বিনিময়ে সরকারে আসতে চাইছে। এটা স্বাভাবিক। কিন্তু মার্কিন ভিসা নীতির প্রয়োগ ছাড়াও অস্বাভাবিক আরও অনেক কিছু ঘটছে। দেশে ঘটছে, দেশের বাইরে ঘটছে। যে যা বলার নয় সে তা বলছে, যে যা করার নয় সে তা করছে। ক্ষমতার মেয়াদের শেষ সময়ে এসে দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীনরা ক্রমে বন্ধুহীন হয়ে পড়ছেন। কাছের লোক দূরে সরে যাচ্ছে, দূরের লোক দূরেই থাকছে। সময় খারাপ হলে এমন হয়, হতে পারে। কিন্তু সরকারের কাছের লোকরা এমন অচেনা মানুষের ভান করছে কেন? কেন একেবারে শেষ মুহূর্তে সরকারকে চেপে ধরতে চাইছে? এই চাপের উদ্দেশ্য কি? সত্যিই কী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো এখন দেশের ভেতরের একটা বড় অংশ ক্ষমতার পালাবদল চাইছেন?
বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে যে, ভারতে গিয়ে উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন পার্বত্য অঞ্চলের নেতারা। পার্বত্য শান্তি চুক্তি হয়েছে ১৯৯৭ সালে। এখন পর্যন্ত এই চুক্তির বাস্তবায়ন না হওয়া নিয়ে কঠোর সমালোচনা করা হচ্ছে।
হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদও হঠাৎ খুব সক্রিয় হয়ে উঠেছে। জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সরকার কথা রাখেনি বলে তারা অভিযোগ করেছেন। আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ওয়াদা পূরণ করেনি বলে তারা ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। শুধু তাই নয়, আওয়ামী লীগ সরকারের অবসরপ্রাপ্ত এক সচিব থেকে শুরু করে মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামালসহ অনেকেই এখন সরকারের সমালোচনা করছেন। নীরবতার ব্রত ভঙ্গ করে ক্ষমতাসীনদের তুলাধুনা করছেন অনেকেই।
ক্ষমতাসীনরা যে খুব একটা স্বস্তিতে নেই তা দলের মুখপাত্র হিসেবে পরিচিতজনদের বক্তব্যেই বোঝা যায়। কেমন যেন খেই হারানো, নিজেকে নিজে সান্ত্বনা বা অভয় দেয়ার মতো করে বক্তব্য দিচ্ছেন। এদিকে বিএনপিও ছলেবলেকৌশলে ক্ষমতাসীনদের টেনে নামানোর জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। বিএনপি ক্রমেই সংহত ও শক্তিশালী হচ্ছে। পক্ষান্তরে ক্ষমতাসীনরা যেন একটু একটু করে বন্ধুহীন হয়ে পড়ছে। যখন দেশের রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছিল, তখন বহুজন এই রেকর্ডের দাবিদার ছিলেন। আর রিজার্ভ যখন প্রায় ১৭ কোটিতে নেমে এসেছে, তখন কোথাও কেউ নেই! সেই প্রবাদটির কথাই মনে পড়ছে, সুসময়ে বন্ধু বটে অনেকেই হয় অসময়ে হায় হায় কেউ কারো নয়!
পুনশ্চ:
বর্তমান পরিস্থিতিতে পুরনো একটা গল্প মনে পড়ছে। গল্পটির নায়ক একটা গাধা।
বাড়িতে চোর ঢুকেছে! গাধা ও কুকুর পাশাপাশি বসে আছে। গাধা ভাবছে কুকুর হয়তো চোরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। কারণ চোর বা অচেনা কেউ এলে কুকুরই ঘেউ ঘেউ করে। কিন্তু, না। কুকুর চুপচাপ বসে আছে। কুকুরের নীরবতায় গাধার মনে সন্দেহ দেখা দিলো। সে কুকুরের কাছে এসে বললো ভাই, একটা কিছু করো, চোর তো গুদাম ঘরের তালা ভাঙ্গা শুরু করে দিয়েছে।
গাধার কথায় কুকুর কর্ণপাত না করে বসে রইলো। হঠাৎ গাধা চেয়ে দেখলো কুকুরের সামনে মাংসওয়ালা একটা হাড্ডি। গাধা নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। এ কি দেখছে সে ?
বাড়ির একমাত্র পাহারাদার তার প্রিয় কুকুর-ভাই কি শেষ পর্যন্ত ঘুষ খাওয়া শিখে ফেলেছে ? তাও আবার চোরের মত বেঈমান, বিশ্বাসঘাতক, নিকৃষ্ট প্রাণীর কাছ থেকে ? ছিঃ ছিঃ ছিঃ!
এদিকে চোর তালা ভেঙ্গে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়েছে। গাধা আর চুপ থাকতে পারলো না, সে গগনবিদারী চিৎকার শুরু করে দিলো। তার চিৎকারে বাড়ির মালিকের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। মালিক খুব বিরক্ত হলো। সে ঘর থেকে বের হয়ে দেখলো কুকুর নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে, আর গাধা লাফাচ্ছে। মালিক ভাবলো হয়তো গাধাকে জিনে ধরেছে অথবা এই অপদার্থ গাধাটা পাগল হয়ে গেছে । তাই সে রাগান্বিত হয়ে লাঠি দিয়ে গাধার পিঠে বেশ কয়েকটা আঘাত করল। তারপর গিয়ে শুয়ে পড়ল। এতে গাধা খুবই ব্যথিত হলো।
এখন গাধা কোথায় যাবে? মালিকের সম্পদ রক্ষা করতে গিয়ে উল্টো মার খেতে হলো। চোর ধরা যার দায়িত্ব ছিলো, সে ঘুষ খেয়ে চুপ থেকেছে। আর গাধা অন্যের দায়িত্ব মাথায় নিতে গিয়ে শাস্তি পেয়েছে।
গাধার উপলব্ধি হলো: চোর ও কুকুরের গলাগলি যতদিন থাকবে, ততদিন গাধাদের চোখ বুজে সহ্য করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। কথা বললে বরং হিতে বিপরীত হতে পারে।