একজন সমরেশ মজুমদার এবং একটি কিংকর্তব্যবিমূঢ় রচনা

বিরাট সংখ্যক আবিষ্ট পাঠকগোষ্ঠী কৈশোরে চোখে দেওয়া রঙিন চশমা খুলে তাঁকে তাত্ত্বিক অণুবীক্ষণ যন্ত্রের তলায় রাখতেই চান না। আসলে মানুষের ভালোবাসার চেয়ে বড় কিছু নেই।

উম্মে ফারহানাউম্মে ফারহানা
Published : 8 May 2023, 05:50 PM
Updated : 8 May 2023, 05:50 PM

সমরেশ মজুমদারের প্রয়াণের খবর জেনে আমি খানিকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় বোধ করছিলাম, কয়েক সেকেন্ড পরে আমার মস্তিষ্ক আমাকে মনে করিয়ে দিলো যে আমার স্কুলজীবনের এক বন্ধু তানভীরের খুব প্রিয় লেখক ছিলেন তিনি। তাহলে তানভীরকে ফোন করা যেতে পারে। ফোন হাতে নিয়েও ফোনটা করলাম না, বরং ফেইসবুক স্ক্রল করতে লাগলাম। বন্ধুদের অনেকেই অন্তর থেকে শোক জ্ঞাপন করছেন। তাঁরা কৈশোরের ও প্রথম যৌবনের অনেক স্মৃতি মনে করছেন, অনেকেই দীপাবলি হতে চেয়েছিলেন, অনেকেই জয়িতা। আবার অনিমেষ হতেও চেয়েছিলেন হয়তো কেউ কেউ, সম্ভাবনা কম। আমরা নায়ক হতে চাই কিন্তু পঙ্গু হতে চাই না– অনিমেষকে একটি করুণ চরিত্র বলেই মনে হয়েছে আমার কাছে। তাই সমরেশ মজুমদারের পুরুষ ভক্তদের মধ্যে কেউ নিজেকে অনিমেষ বলে ভাবতেন না বলেই অনুমান করি। কিন্তু একজন ফেইসবুক বন্ধু যে তাঁর স্ট্যাটাস আপডেটে লিখলেন কিশোরবেলায় অনেকেই নাকি নিজের ভেতর অনিমেষকে ধারণ করতেন?

দীপাবলির প্রসঙ্গে পরে আসি। আগে অনিমেষকে নিয়ে বলি। ‘উত্তরাধিকার’, ‘কালবেলা’ ও ‘কালপুরুষ’ ট্রিলজির আমি পড়েছিলাম উল্টো দিক থেকে। অনিমেষের পুত্র অর্ক এবং অনিমেষ ও মাধবীলতার মধ্যবয়সের আখ্যান দিয়ে। পরে ‘কালবেলা’ আর ‘উত্তরাধিকার’ হাতে আসে। ‘কালপুরুষে’র শেষদিকের একটা অংশে অনিমেষের খুব আঁতে ঘা লাগে কেউ একজন তাঁকে মাস্টারনির স্বামী বলে উল্লেখ করায়। মাধবীলতা তখন একটি নিম্নবিত্ত এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন, এলাকাটিকে আমরা সোজা ভাষায় বলি ‘বস্তি’, যেখানে সাধারণত দরিদ্র মানুষেরা থাকেন এবং সেজন্য শিক্ষিত মাধবীলতার রুচির সঙ্গে প্রতিবেশীদের রুচি মেলে না। তো আমার ক্লাস সেভেন বা এইটে পড়া মাথায় ব্যাপারটা এক ধরনের আঘাত করলো। নায়ক এত সংকীর্ণমনা হবে কেন? আমি তখনো ‘মেল ইগো’ নামক টার্মের সঙ্গে পরিচিত হইনি। পরবর্তীকালে সাহিত্যে লেখাপড়া করে জেনেছি প্রটাগনিস্ট মানেই দোষত্রুটির ঊর্ধ্বে কোনো মহামানব বা মহামানবী হবে এমন কোনো শর্ত নেই। কিন্তু তখন আমার মনের মধ্যে কাঁটাটা বিঁধেই ছিল।

কাছাকাছি সময়ের মধ্যে ‘কালবেলা’ পড়লাম। আমাদের বাসায় বই পড়ার ব্যাপারটা ছিল সম্পূর্ণ পারিবারিক। খাওয়ার টেবিলে আমরা সদ্য পড়া উপন্যাস নিয়ে আলাপ করতাম। আব্বার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে এই উপন্যাসের ঐতিহাসিক গুরুত্ব এবং বয়ানের ত্রুটি ঝাপসাভাবে বুঝলাম। বলা বাহুল্য, হাই স্কুলে থাকতে ‘প্রতিবিপ্লব’ নামের কোনো শব্দও আমি শুনিনি। সশস্ত্র সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের পক্ষে বা বিপক্ষে থাকার স্বাধীনতা যে কোনো ব্যক্তির থাকতে পারে। কিন্তু উপন্যাসে সৃষ্ট ‘হাইপার রিয়েলিটি’ পরবর্তী প্রজন্মের ইতিহাস পাঠকে প্রভাবিত করে বলেই আখ্যান রচয়িতার প্রতিক্রিয়াশীল স্বর আমার কাছে ঝামেলাজনক বলে মনে হয়। অনিমেষের পরনির্ভরশীল করুণ জীবন যে আসলে একজন নায়ককে (হিরো অর্থে, প্রটাগনিস্ট অর্থে নয়) পঙ্গু হিসেবে দেখাবার, বিপ্লব নয় বরং বিপ্লবের প্রতি মধ্যবিত্তের প্রতিক্রিয়াশীলতাটাকেই দেখায় সেটা প্রাঞ্জলভাবে বুঝতে না পারলেও অনুভব করতে পারতাম ঠিকই।

একইভাবে দীপাবলি নামের অনাথ কন্যাটির ভারতের একটি পশ্চাৎপদ মফস্বল শহরে বেড়ে ওঠার সংগ্রাম যে একটি এন্টি-ফেমিনিস্ট বয়ানে বলা হয়েছে তা বুঝতেও আমার খুব বেশি সময় লাগেনি। ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করার ঝুঁকি ছিল এই যে, অধিকাংশ মানুষের প্রিয় লেখক যিনি, তাঁর সমালোচনা করাটা ভক্তকুল সাধারণত মেনে নেন না। হাসান আজিজুল হকের ‘সাবিত্রী উপাখ্যান’ শীর্ষক উপন্যাসে ধর্ষণের উপস্থাপনের ত্রুটিগুলো দেখাতে গিয়ে আমি দুয়েক ভক্তের কাছে তিরস্কৃত হয়েছিলাম। পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিকে ধারণ ও বহন করে লেখা আরেকটি উপন্যাসে মূল চরিত্রের নাম ছিল মোহর, সে ক্রিকেট খেলত এবং ছোট শহর থেকে এসেছিল। ক্রসড্রেসার এই মেয়েটির পুরুষশাসিত সমাজের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ ঘোষণা করার চেষ্টা দেখে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে নারী স্বাধীনতার আন্দোলন আসলে পুরুষের সমকক্ষ হবার বা পুরুষকে নকল করবার আন্দোলন। যদিও দীপাবলি বা মোহর কেউই নিজেকে নারীবাদী বলে দাবি করেনি। কিন্তু স্বাধীনচেতা, স্বাবলম্বী কিংবা স্বতন্ত্র চিন্তার অধিকারী মেয়েদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার দুঃসাহস দেখাতে গিয়ে তিনি দেখিয়েছেন নারীর ভঙ্গুরতা, দুর্বলতা আর হেরে যাওয়ার ভবিতব্যকেই। যেভাবে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কুন্দনন্দিনীকে ‘বিষবৃক্ষে’র বীজ বলে বিশেষায়িত করে তার জন্য ট্র্যাজিক মৃত্যু লিখে তাকে শাস্তি দেন, তেমনভাবে সমরেশ মজুমদার এই সকল উপন্যাসের নায়িকাদের এমন চরম শাস্তি দেন না, কিন্তু নিজের মিসোজিনিস্ট মনোভাব লুকাতেও পারেন না পুরোপুরি। ‘গর্ভধারিণী’ উপন্যাসের ক্ষেত্রে এই দুটি ব্যাপারই সমানভাবে প্রকাশিত। অন্তত আমার পাঠ তাই বলে।

তাহলে সমরেশ মজুমদারের লেখা কোনো উপন্যাসই কি আমার ভালো লাগেনি? ভক্ত না হয়েও কৈশোরে তাঁর বহু লেখা পড়েছি, হাতে পেয়েছি বলেই। ‘দৌড়’ ভালো লাগেনি বলে কলেজের এক বান্ধবী আমাকে বলেছিলেন “সব মানুষের মধ্যেই কিছু পিকিউলিয়ারিটি থাকে”, তাঁর মতে ‘দৌড়’ সবার ভালো লাগতে হবে। বরং ভালো লেগেছিল ‘আট কুঠুরি নয় দরজা’। আমার মতে এই লেখকের সবচেয়ে বড় গুণ দুটি। এক, ভাষার সাবলীলতা আর দুই, প্লটের বৈচিত্র্য। ‘তিন নম্বরের সুধারানী’, ‘জলের নিচে আকাশ’, ‘শেষের খুব কাছে’, ‘মনের মত মন’ পড়তে তখন বেশ লেগেছিল। যদিও খুব বেশিদিন মনে থাকবার মতন কিছু নয় কোনোটিই । কিশোর উপন্যাসের মধ্যে ‘সীতাহরণ রহস্যে’র গল্পটা এখনো মনে আছে। পাঠকের কৌতূহল ধরে রাখার মতন টেকনিক তিনি খুব ভালো আয়ত্ব করেছিলেন। আবার দেশ-বিদেশের নানান সাম্প্রতিক বা ঐতিহাসিক উপাদানের ব্যবহারেও ছিলেন সমান কুশলী। যতদূর মনে পড়ে, ‘নবীন সন্ন্যাসী’ নামের এক উপন্যাসের প্লট ছিল পৌরাণিক।

জনপ্রিয় ধারার লেখাকে বা তাঁর লেখককে হেয় করার পক্ষে আমি নই। সমরেশ মজুমদার জনপ্রিয় ছিলেন তা বললে কম বলা হবে। তাঁর জনপ্রিয়তার পেছনে প্রায় ঢেকে গিয়েছেন বাংলা সাহিত্যের আরেক দিকপাল সমরেশ বসু। আমার প্রজন্মের অনেক পাঠকই ‘প্রজাপতি’ নিষিদ্ধ হবার আগে পর্যন্ত সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত কালকূট ছদ্মনামধারী লেখকটিকে চিনত না। সমরেশ নামটি শুনলেই তাঁরা মজুমদারকে বুঝে নিত। জনপ্রিয় হতে পারার পেছনে অনেক কারণ থাকে। প্রথম এবং প্রধান কারণ আমার মনে হয়, সহজবোধ্যতা। সমরেশ মজুমদার সাধারণ পাঠকের বোধগম্য সহজ গদ্য লিখতে পারতেন। লেখক হিসেবে এটি একটি বিরাট দক্ষতা । অনেকে চাইলেও এমন সহজ গদ্য লিখতে পারেন না। ‘বিনিসুতোয়’ শিরোনামের একটি ভ্রমণকাহিনি অত্যন্ত উপাদেয় ছিল বলে আমার এখন মনে পড়ছে। যৌবনের আবেগকে প্রকাশ করার ক্ষমতা তাঁর লেখায় প্রবলভাবে লক্ষ্য করা গেছে।

সাহিত্যের শিক্ষক হিসেবে একটি আর ছাত্রী হিসেবে আরেকটি অভিজ্ঞতা বলে আমার দ্বিধান্বিত স্মৃতিচারণ শেষ করতে চাই। মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ করবার জন্য আমাদের ছাত্রছাত্রীদের একটি ডিজার্টেশন পেপার জমা দিতে হয়। আমার তত্ত্বাবধানে পেপার লিখতে হবে যাদের সেই পাঁচজন ছাত্রী তিনটি করে টপিক লিখে আনলেন। একজন মাত্র একটি টপিক এনেছিলেন, শেষ পর্যন্ত তিনি ওই টপিকেই পেপার জমা দিলেন। টমাস হার্ডির টেসের সঙ্গে সমরেশ মজুমদারের দীপাবলির তুলনামূলক আলোচনা। ছাত্রী হিসেবে অভিজ্ঞতাটি বলার আগে ভক্তদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। শফি আহমেদ স্যার একবার ক্লাসে ট্রিলজি কাকে বলে বলতে গিয়ে বাংলা সাহিত্য থেকে উদাহরণ দিতে বললেন। কেউ একজন ‘সাতকাহন’ উপন্যাসটির নাম বলাতে স্যার রেগে গিয়ে বললেন, “কীসের সাতকাহন আর পঁচিশ কাহন, তোমরা কেউ কোলকাতার কাছেই, উপকণ্ঠে, পৌষ ফাগুনের পালা পড়নি?” বলা বাহুল্য, গজেন্দ্রকুমার মিত্রের নাম শোনেনি অধিকাংশ সহপাঠী, কিন্তু প্রায় সবারই পড়া ছিল সমরেশের ‘সাতকাহন’।

সাহিত্যের ছাত্র এবং শিক্ষক হিসেবে আমরা আসলে সারাজীবন সাহিত্যকর্মকে খুব ক্রিটিক্যালি দেখতে শিখেছি। কৈশোর বা প্রথম যৌবনের মুগ্ধতা আর ভালো লাগায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকলে কোনো কিছুকেই ক্রিটিক্যালি দেখা সম্ভব হয় না। ফেইসবুকের নিউজফিডে শোক এবং শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের প্রবল স্রোত দেখে এটাই বুঝতে পারলাম যে বহু পাঠককে সারাজীবন মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন করে রাখবার মতন বিরল প্রতিভা নিয়ে জন্মেছিলেন সমরেশ মজুমদার। বিরাট সংখ্যক এক আবিষ্ট পাঠকগোষ্ঠী সমরেশ মজুমদারের আবেশ থেকে বের হয়ে কৈশোরে চোখে দেওয়া রঙিন চশমা খুলে তাঁকে তাত্ত্বিক অণুবীক্ষণ যন্ত্রের তলায় রাখতেই চান না। আসলে মানুষের ভালোবাসার চেয়ে বড় কিছু নেই। বিপুল সংখ্যক পাঠকের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে পরপারে যাত্রা করলেন সমরেশ মজুমদার। তাঁর এই অন্তিম যাত্রা শুভ হোক।