কী হওয়া উচিত অর্থনীতির ভিত্তি: ঋণ নাকি সঞ্চয়?

অস্ট্রিয়ান ধারার অর্থনীতিবিদদের মতে, পৃথিবীকে এমন একটি অবস্থায় নিয়ে আসার মূল কারণ, ফিয়াট মানির মতো একটি জঘন্য মুদ্রা এবং একটি চরিত্রহীন অর্থব্যবস্থা যা সঞ্চয় নয়, ঋণকে অর্থনীতির ভিত্তি বলে মনে করে।

শিশির ভট্টাচার্য্যশিশির ভট্টাচার্য্য
Published : 19 Dec 2022, 08:15 AM
Updated : 19 Dec 2022, 08:15 AM

এক। প্রবল ও দুর্বল ভোগ-বাসনা

‘নগদ যা পাও হাত পেতে নাও, বাকির খাতা শূন্য থাক। দূরের বাদ্য শুনে কী লাভ, মাঝখানে যে বেজায় ফাঁক।’ ধরা যাক, রাম একটা গরু বিক্রি করল রহিমের কাছে। ওমর খৈয়ামের উপরোক্ত রুবাই বিশ্বাস করে, গরু বিক্রির টাকা দিয়ে রাম সেদিনই দামি কোনো রেস্টুরেন্টে গিয়ে বেশ তৃপ্তি সহকারে খেতে পারে কিংবা কিনতে পারে দামি কোনো পোশাক অথবা টাকাটা সে স্রেফ উড়িয়ে দিতে পারে নেশা বা জুয়ায়। রাম যদি এটা করে, তবে বলতে হবে, রামের ‘ভোগবাসনা’ প্রবল, কিংবা ইংরেজিতে বললে, রামের ‘টাইম প্রেফারেন্স’ অতি উচ্চ।

পক্ষান্তরে রাম যদি গরু বিক্রির টাকা দিয়ে একাধিক বাছুর কিনে পালন করে কিংবা মাছ ধরার একটা জাল কেনে কিংবা একটা রিকশা কিনে চালায় বা ভাড়া দেয়, তবে বলতে হবে, রামের ভোগবাসনা নিয়ন্ত্রিত, টাকাটা সে এখনই ভোগ করতে চায় না। রাম বিলম্বিত ভোগে আগ্রহী। আপাতত বিনিয়োগ করে টাকাটা সে পরিমাণে বৃদ্ধি করতে চায়, যাতে নিজের এবং উত্তর পুরুষের জীবনে ভবিষ্যতে অধিকতর স্বাচ্ছন্দ্য আসে। যদিও এটা ঠিক যে খেয়ে-পরে বাঁচতে হয় সবাইকে এবং ভোগবাসনা কখনই শূন্যের কোঠায় নেমে আসে না, তবুও আমরা বলব, সভ্যতা নির্মিত হয়েছে সেই ব্যক্তিদের হাতে, ভোগবাসনা যাদের মনে অতি তীব্র নয়, যারা আগামীকালের কথা ভেবেছে, কায়মনোবাক্যে যারা চেয়েছে (ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যে ঈশ্বরী পাটনীর মতো চেয়েছে): ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে!’

একবার বিমানে করে ঢাকায় প্রত্যাবর্তনের সময় এক ব্রিটিশ স্কুল শিক্ষিকার সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল। ওনার পিতামহের আমলেও ইংল্যান্ডে আজকের যুগের মতো খরচের নয়, সঞ্চয়ের সংস্কৃতি চালু ছিল। ‘নো পাউন্ড শ্যুড গো আউট অব দ্য হাউজ!’ অর্থাৎ ‘একটি পাউন্ডও বাড়ির বাইরে যাবে না!’ এই ছিল পরিবারের ‘অর্থ (ব্যয় সংক্রান্ত) নীতি’। সবজি লাগবে, জমি পড়ে আছে বাড়ির পাশে, চাষ করো গিয়ে! মাংস লাগবে, বন্দুক নিয়ে বনে গিয়ে দুই-চারটা খরগোশ মেরে নিয়ে আসো! ‘মাটন’ শব্দটাই নাকি ওনার দাদু চিনতেন না, কারণ আশৈশব বাড়িতে পালন করা ভেড়া বা র‌্যাম দেখে, খেয়ে তিনি অভ্যস্ত। এইভাবে সঞ্চয়ের সুকঠিন অভ্যাসের ভেতর দিয়ে কয়েক শতাব্দী ধরে গড়ে উঠেছিল ইংল্যান্ডের জাতীয় মূলধন, যা দিয়ে হয়েছিল শিল্পবিপ্লব, গড়ে উঠেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো বহু যৌথমূলধন ব্যবসায়, যার শেয়ারহোল্ডারদের খুশি করতে গিয়ে ষড়যন্ত্র করে পলাশীর যুদ্ধজয় করেছিল রবার্ট ক্লাইভ।

কাম্যতার ক্রমহ্রাসবিধির মতো দ্রুত ও বিলম্বিত লয়ের ভোগবাসনা ব্যষ্টিক অর্থনীতি বা মাইক্রো ইকনোমিকসের সিলেবাসে পাবেন। কিন্তু এর প্ররোক্ষ প্রভাব পড়ে সামষ্টিক অর্থনীতি বা ম্যাক্রো ইকনোমিকসের ওপর। অস্ট্রীয় ঘরানার অর্থনীতিবিদদের মতে, যে সমাজের মানুষ ভোগবাসনা বিলম্বিত করে সঞ্চয় করে, তারা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জীবনটা সহজ করে রেখে যেতে পারে, যার ফলে সমাজ দিন দিন ধনী ও উন্নত হয়। মানুষের হাতে যখন পয়সা থাকে, সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিল্পকলা এবং বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন– সব ক্ষেত্রে সমাজ এগিয়ে যায়। এর উদাহরণ ইতিহাসে আমরা একাধিকবার দেখেছি, রোমে এক নম্বর স্বর্ণমুদ্রার যুগে, মধ্যযুগের আরব দেশে আব্বাসীয় সাম্রাজ্যে উত্তম স্বর্ণমুদ্রা শাহাদা যখন চলমান ছিল বাজারে, ফ্লোরিন বা ডুকাট যখন ছিল ইতালিতে এবং সবশেষে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগের চার দশকে। আমরা এটাও দেখেছি, যখনই মুদ্রার মান নিয়ে দুই নম্বরী হয়েছে, মূল্যের আধার কিংবা সঞ্চয়ের বাহন হিসেবে মুদ্রা তার দায়িত্ব ঠিকঠাকমতো পালন করতে পারেনি।

‘হে দারিদ্র্য তুমি মোরে করেছ মহান! কিংবা ‘সূচের ছিদ্র দিয়ে উট প্রবেশ করবে, কিন্তু ধনী কখনও স্বর্গে যেতে পারবে না!’ এ ধরনের ডাহা মিথ্যা কথা কোনো সমাজে যদি আসলেই বিশ্বাসে পরিণত হয়, তবে সে সমাজে জীবনেও উন্নতি আসবে না। দারিদ্র্য একটি পাপ। সামাজিক অবিচার অপরাধের সূতিকাগার। দারিদ্রের কারণে খাদ্যের অভাবে শরীরের ক্ষতি হয়, পোশাকের অভাবে মনে অন্যের প্রতি অনর্থক জাতক্রোধ সৃষ্টি হয়, উপযুক্ত শিক্ষার অভাবে মনেরও ক্ষতি হয়। নজরুল বা ডিকেন্সের মতো দু-একটি পদ্মফুল দারিদ্র্যের পঁচা গোবরে ফুটতে পারে বটে, কিন্তু গোবর কখনও কোনো জাতির অর্থনৈতিক লক্ষ্য হতে পারে না।

মানুষ ভোগবাসনা সীমিত বা বিলম্বিত করে তখনই, যখন সে দেখে যে আজকের পরিশ্রমের মূল্যটা সে উত্তর পুরুষের হাতে তুলে দিয়ে যেতে পারছে। যখন সে দেখে যে তার সময়ের মুদ্রা মূল্য বা সঞ্চয়ের বিশ্বস্ত বাহন নয়, দিন দিন মুদ্রা তার মূল্য হারাচ্ছে, উত্তর পুরুষ দূরে থাক, নিজে অবসরে যাবার আগেই অবমূল্যায়িত হয়ে যাচ্ছে তার সঞ্চয়, সেক্ষেত্রে কোন দুঃখে মানুষ নিজের ভোগবাসনা বিলম্বিত করতে যাবে? মানব ইতিহাসে তখনই সঞ্চয় বৃদ্ধি পেয়েছে, যখন সমাজে প্রচলিত মুদ্রাটি একটি উত্তম মুদ্রা, যেমন ধরা যাক, স্বর্ণমুদ্রা ছিল।

‘আমার সমস্ত স্বর্ণ মোহনলালকে দিয়া গেলাম!’ ব্যোমকেশের এক গল্পে অষ্টাদশ শতকের বাংলার এক দুর্গাধিপতি এই কথাটা কোথাও লিখে রেখে গিয়েছিলেন। কিন্তু দুই শ বছর পরেও উত্তরাধিকারীরা বুঝতে পারছিল না, কে এই মোহনলাল। যদিও দুর্গের আঙিনায় রাখা কামানের গায়ে ফারসিতে নাম লেখা ছিল ‘মোহনলাল’, তবুও তিনি তো কোনো ব্যক্তি নন যে তার বা তার উত্তরাধিকারীদের কাছে গিয়ে পূর্বপুরুষের গচ্ছিত স্বর্ণ দাবি করা যাবে। দুর্গের মেঝের নিচে থাকা সুরঙে স্বর্ণ গলানোর বড় কড়াই, পোড়া কয়লা, আলিবর্দীর আমলের একটি মোহর, সোরা-গন্ধক ইত্যাদি দেখে গোয়েন্দা ব্যোমকেশ মাথা খাটিয়ে বের করেছিলেন, অষ্টাদশ শতকের উচ্ছৃঙ্খল সৈন্যদের হাতে লুট হওয়া থেকে বাঁচাতে কামানের নলের মধ্যেই ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল তরল স্বর্ণ, যাতে কোনো একদিন সেটা উত্তরাধিকারীদের হস্তগত হয়।

অর্থনীতির ইতিহাসবিদেরা লক্ষ্য করেছেন রোমান আমলে পূর্বপুরুষ গড়ে যে পরিমাণ সম্পদ উত্তরপুরুষের হাতে তুলে দিয়ে যেতে সক্ষম হতো, ফিয়াট মানির আমলের পিতা-মাতারা তার ধারে কাছেও নেই। পিতারা এখন উদয়াস্ত কাজ করে যায়, কিন্তু পুত্রের হাতে তেমন কিছু তুলে দিয়ে যেতে পারে না। পুত্রেরাও উদয়াস্ত খাটে, কিন্তু জীবনের শেষে গিয়ে জমে না কিছুই। ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকাতেও ইদানিং লোকজন ভয়ে আছে, সরকার পেনশনটাও দিতে পারবে কিনা। ফিয়াট মানির যুগের আগে মানুষ (আমেরিকায় অন্তত, চমস্কি যেমনটা বলেছেন) নিজের টাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত, নিজের টাকায় বাড়ি কিনত। এখন ব্যাংকের ঋণ বা বিদেশিরা (নিজেদের দেশ থেকে) পাচার করে আনা টাকা ছাড়া বাড়ি কেনা বা লেখাপড়ার প্রশ্নই আসে না, পাশ্চাত্যে: ইউরোপ-আমেরিকা-কানাডায় এবং অন্যত্রও।

দুই। ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পীবেৎ

কানু বিনে গীত নাই, ঋণ বিনে গতি নাই। মানুষ এখন পড়তে গিয়ে ঋণে পড়ে, গাড়ি কিনতে গিয়ে ঋণে পড়ে, বিয়ে করতেও ঋণে পড়ে। পঞ্চাশের দশকে চমস্কি প্রতি সেমিস্টারে শ তিনেক ডলার টিউশন ফি দিতেন। এখন প্রতি সেমিস্টারের টিউশন ফি দশ-বিশ হাজার ডলার, সুতরাং ঋণ না নিয়ে উপায় কী? ‘পড়া’ ক্রিয়াটা এখানে গুরুত্বপূর্ণ। যদিও কেউ কেউ ‘পড়ে’ আবার উঠতে পারে, কিন্তু বেশির ভাগই পারে না। ঋণের সুদ গুনতে গুনতে যুবসমাজ জেরবার। যে টাকা ঋণ নেওয়া হচ্ছে, মুদ্রাস্ফীতির কারণে তা ক্রমাগত অবমূল্যায়িত হচ্ছে। ধরা যাক, বাংলাদেশে আপনি ঋণ নিয়েছেন এক লক্ষ টাকা। বার্ষিক ১০% ভাগ মুদ্রাস্ফীতির কারণে ৫ বছরের মাথায় টাকাটা নেমে আসছে ৫১ হাজারে। যদি ১০% সুদের কারবারে ঋণ নিয়ে থাকেন, তবে প্রতি বছর ১০ হাজার টাকা করে ৫ বছরে আপনি সুদ দিচ্ছেন ৫০ হাজার টাকা। তিন পাঁচে পনেরোর পাঁচ, আপনার হাতে থাকছে একখানা ভাঙা পেন্সিল।

শুভঙ্করের ফাঁকিতে জীবন জেরবার। এর প্রভাব পড়ছে সমাজে, সমাজ বলে যদি কিছু এখনও থাকে। পৃথিবীর সর্বত্র টাইম প্রেফারেন্স বা ভোগবাসনা বেড়ে গেছে। বিবাহ-বিচ্ছেদের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান, বিবাহের সংখ্যা ক্রমহ্রাসমান। যুবক-যুবতীরা বিবাহে আগ্রহী নয়, তারা সন্তান নিতে চায় না। কী লাভ? কার জন্যে এত কষ্ট করে বাচ্চা মানুষ করার মতো বিরক্তিকর কাজ করতে যাবে তারা? ভবিষ্যৎ তো দেখতে পাচ্ছে না কেউ। সমাজের জন্য, দেশের জন্য সন্তান দরকার, কিন্তু বেহুদা আমি কেন সমাজের কথা, দেশের কথা ভাবতে যাব? সমাজ কিংবা দেশ কি ভাবছে আমার কথা? পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঋণগ্রস্ত হয়ে বাড়ি করলেন, বাড়ির দাম ধরুন দুম করে পড়ে গেল, পড়ে যায় ক-দিন পর পর, তখন কী করবেন? চাকরিটা চলে গেল, ঋণের কিস্তি দুই মাস দিতে পারলেন না, ব্যাস, ব্যাংক আপনার বাড়িটা ক্রোক করবে। ব্যাংক তো প্রথমেই সুদটা নিয়ে নেয়। সুদের পুরোটা আর আসলের যে কিছুটা ইতোমধ্যে পরিশোধ করেছেন, সেটাও গচ্ছা যাবে। সব মিলিয়ে অবস্থা মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়।

অর্থনীতির ঘরানা বা ধারার মধ্যে একটি হচ্ছে বহুপঠিত, বহুচর্চিত কিনসীয় ধারা। অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত, অনেকটা উপেক্ষিতই বলা যায়, একটি ধারা বা ঘরানা হচ্ছে অস্ট্রিয়ান ধারা। লুদভিগ ফন মিজ (১৮৮১-১৯৭৩) এবং ফ্রিডরিখ হায়েক (১৮৯৯-১৯৯২) অস্ট্রিয়ান ধারার অর্থনীতির দুই দিকপাল। অস্ট্রিয়ান ধারার অর্থনীতিবিদদের মতে, পৃথিবীকে এমন একটি অবস্থায় নিয়ে আসার মূল কারণ, ফিয়াট মানির মতো একটি জঘন্য মুদ্রা এবং একটি চরিত্রহীন অর্থব্যবস্থা যা সঞ্চয় নয়, ঋণকে অর্থনীতির ভিত্তি বলে মনে করে।

ঋণ মুদ্রাস্ফীতিতে ভূমিকা রাখছে। প্রতিবার ব্যাংক যখন কাউকে ঋণ দিচ্ছে, ‘এম-থ্রি’-এর পরিমাণ বাড়ছে। ‘এম থ্রি’ যত বাড়ে, এম টু এবং এম ওয়ানও পরিমাণমতো বাড়াতে হয়। ‘এম-ওয়ান’ হচ্ছে সেই মুদ্রা যা কাগজের টাকা বা ধাতব মুদ্রায় আপনি ব্যাংক থেকে তুলতে পারেন। ‘এম টু’ হচ্ছে সেই মুদ্রা যা ব্যাংকে জমা থাকে ডিজিটাল অবস্থায় এবং যা আপনি চাইলেই ‘এম-ওয়ান’ হিসেবে ব্যাংক থেকে তুলতে পারেন। ‘এম থি’ হচ্ছে সেই মুদ্রা যা ব্যাংক আপনাকে ঋণ দেয়। এ মুদ্রার বেশিরভাগ ব্যাংকেই জমা থাকে– আপনি চাইলেই ‘এম থ্রি’-এর সবটা উপযুক্ত কারণ দর্শানো ছাড়া ‘এম ওয়ান’ হিসেবে তুলে নিতে পারেন না কিংবা ‘এম টু’ হিসেবে অন্য হিসাবে পাঠাতে পারেন না।।

আজ কেন্দ্রীয় ব্যাংক ছাড়া একটি দেশ কল্পনা করা কঠিন। বিশ্ব ব্যাংক ছাড়া বিশ্ব কল্পনা করা কঠিন। কিন্তু গত দশ হাজার বছর এই সব প্রতিষ্ঠান ছাড়াও পৃথিবী চমৎকার চলেছে। মিশরের কয়েক হাজার বছরের সভ্যতায় কোনো টাকা বা মুদ্রাই ছিল না। এই সব আর্থিক প্রতিষ্ঠান এমন কিছু ভালো কাজ যে করে, তাও নয়। সব সাড়ে তিন নম্বর। সরকার নিজের খরচ চালাতে না পেরে ঋণ নেয় এবং সেই ঋণ পরিশোধ করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ছাপায়। কারও না কারও আঙুলের ইশারায় কদিন পর পরই বাংলাদেশের একেকটি সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক আদায়-অযোগ্য কুঋণ দিয়ে লাটে ওঠার উপক্রম হয়। সরকার তখন টাকা ছাপিয়ে সেই ঘাটতি সামাল দেয়। কয়েক বছর আগে হলমার্ক কেলেঙ্কারীতে সোনালী ব্যাংকের যে টাকা হাপিস হয়ে গিয়েছিল, ‘সে আর এমন কি টাকা!’ বলেছিলেন প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী। জানতে ইচ্ছে হতে পারে, এই সব হাজার এক দুই নম্বরীর ফলে আসলে কী ক্ষতিটা আসলে হয়? ক্ষতি আর কি, সেই মুদ্রাস্ফীতি, জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়া, যাতে আপনারা সারা জীবন ধরেই হাঁসফাঁস করছেন। পণ্যের দাম তো বাড়ে ছাড়া কমে না কখনো।

আপনি যখন ঋণ নেন, তখন সেই ঋণ আপনাকে পরিশোধ করতে হয় পরিশ্রম করে টাকা উপার্জন করে কিংবা সঞ্চয় করে। আপনার উঠানে যদি একটা টাকার গাছ থাকত, তবে আপনি উপার্জনও করতেন না, সঞ্চয়ও করতেন না। বেশিরভাগ সরকারি প্রতিষ্ঠান লোকসানে চলছে এটা সবাই জানে, কিন্তু সরকারের ভ্রুক্ষেপ নেই, কারণ যেকোনো মুহূর্তে, যেকোনো পরিমাণ টাকা ছাপিয়ে সরকার যেকোনো খারাপ অবস্থা ‘আপাতত’ সামাল দিতে পারবে। আপনি ‘কালি ও কলম’ দিয়ে প্রতিবাদ করবেন, সরকার ‘তালি ও মলম’ দিয়ে সব ম্যানেজ করে ফেলবে।

কয়েক শতক আগেও সরকারের কাজ ছিল: সীমান্ত পাহারা দেওয়া, ব্যক্তিগত সম্পত্তির নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা এবং ব্যক্তি স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। মুদ্রা কিংবা অর্থনীতি সরকার নিয়ন্ত্রণ করত না। আধুনিক যুগের সবচেয়ে বড় কুসংস্কার হচ্ছে এটাই যে মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করার ভার সরকারের ওপর থাকা উচিত। সামষ্টিক অর্থনীতিতে এই ব্যাপারটা একটা স্বতঃসিদ্ধের মতো হয়ে গেছে– যেন এটাই অমোঘ সত্য, অন্য কোনোভাবে দেশ বা পৃথিবীর অর্থনীতি যেন চলতেই পারে না।

কিনসীয় ও মার্কসীয় অর্থনীতিবিদদের মতে, রাষ্ট্র যাকে ‘টাকা’ বলে ঘোষণা করে, তাই হচ্ছে ‘টাকা’। রাষ্ট্রের কাজই হচ্ছে ইচ্ছেমতো টাকা ছাপানো। কমিউনিস্ট ও ক্যাপিটালিস্ট উভয় প্রকার দেশই ইচ্ছেমতো টাকা ছাপায়। উভয় ধরনের সরকারই অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করে, কম আর বেশি। যাকে আমরা ‘পুঁজিবাদ’ বলি, সেটা আসলে ‘ঢিলেঢালা কমিউনিজম’, কারণ বাজারের ওপর সব সরকারেরই নিয়ন্ত্রণ আছে। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে অর্থনৈতিক গবেষণার লক্ষ্য হওয়া উচিত, কীভাবে সেই টাকা অর্থনীতির সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়া যায়।

ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে সুইজারল্যান্ডে সঞ্চয়স্পৃহা সবচেয়ে বেশি এবং ভোগবাসনা বা টাইম প্রেফারেন্স সবচেয়ে কম, কারণ এই দেশে দীর্ঘদিন, ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত, স্বর্ণ রিজার্ভ রেখে মুদ্রা ছাপানো হতো। খাঁটি স্বর্ণে তৈরি মুদ্রা বা রিজার্ভের বিপরীতে ছাপানো টাকা উত্তম মুদ্রা এবং এর ক্রয়ক্ষমতা বেশি। টাকার ক্রয়ক্ষমতা যখন কমে যায় কিংবা মানুষ যখন ভাবে যে তার দেশ ও সমাজের টাকা ‘উত্তম মুদ্রা’ নয়, তখন মানুষের সঞ্চয়ের ইচ্ছা কমে যায়। পাশ্চাত্যে মানুষ সঞ্চয় করার প্রতি আগ্রহী নয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই। আপনি যখন আসলেই বুঝতে পারবেন, সঞ্চয় করে আপনি প্রকৃতপক্ষে টাকা হারাচ্ছেন, তখন আপনার ভোগবাসনা বেড়ে যাবে নিজে থেকেই। প্রাচ্যের লোক এখনও সঞ্চয়ে আগ্রহী, কারণ তারা এখনও সরকারি ফিয়াট মানির ‘ফুলের মতো পবিত্র’ চরিত্র বুঝে উঠতে পারেনি।

পাশ্চাত্যের মানুষ এখন সঞ্চয়ে নয়, ঋণে বিশ্বাস করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যেক পরিবার গড়ে তাদের বার্ষিক আয়ের ১০০% ভাগেরও বেশি ঋণগ্রস্ত। সরকার ও পরিবার মিলিয়ে ঋণের পরিমাণ বার্ষিক জিডিপি বা গড় আভ্যন্তরীণ উৎপাদনের কয়েকগুণ বেশি। এর মূলে আছে কিনসীয় অর্থনৈতিক বিশ্বাস। কিনসের তত্ত্ব অনুসারে সঞ্চয় মন্দা সৃষ্টি করে এবং ঋণ প্রবৃদ্ধি আনয়ন করে। তিনি আরও বলেছেন, ‘জাতীয় ঋণ’ কিছুই নয়, কারণ জাতি তো আমরাই এবং জাতীয় ঋণ যেহেতু নিজেদের কাছে নিজেদের ঋণ, সেহেতু এ নিয়ে চিন্তিত হবার কিছু নেই। টাকাটা আমাদেরই এক পকেট থেকে অন্য পকেটে যাচ্ছে।

প্রকৃত সত্য হচ্ছে, ঋণ সঞ্চয়ের একেবারে বিপরীত আচরণ। সঞ্চয় সমৃদ্ধি নিয়ে আসে আর ঋণ নিয়ে আসে পতন। মহাভারতে যুধিষ্ঠীরকে বকরূপী ধর্মদেবতা প্রশ্ন করেছিল: ‘সুখী কে?’ যুধিষ্ঠীর উত্তর দিয়েছিলেন: ‘অঋণী, অপ্রবাসী, দিনান্তে শাকান্নভোজী যে ব্যক্তি, সেই প্রকৃত সুখী!’ পক্ষান্তরে কিনসীয় অর্থনীতি আমাদের এখন শেখাচ্ছে সেই চার্বাক নীতি: ‘যাবৎ জীবেৎ সুখং জীবেৎ, ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পীবেৎ!’ অর্থাৎ ‘যতকাল বাঁচবে, সুখে বাঁচবে এবং ঋণ করে হলেও ঘি খাবে!’ এই ঘটনা নতুন নয়। হাজার দুই বছর আগে, রোমান সাম্রাজ্যের পতনের অব্যবহিত পূর্বে, রোমান সম্রাটেরাও ঠিক এই নীতিই অবলম্বন করেছিলেন বটে!

আজ থেকে শ খানেক বছর আগেও মানুষ নিজের টাকায় বাড়ি, লেখাপড়া, বিয়ের টাকা জোগাড় করত সঞ্চয় করে। আজ মানুষ সব কাজেই ঋণ করে। এমনকি ধনীরাও নিজের টাকায় কিছু করতে চায় না, প্রতিটি কাজে তারাও ঋণ করে। নিজের জমানো ধন ব্যাংকে জমা দিয়ে বৃহত্তর ঋণগ্রহণ করে। এই অবস্থা কিছু দিন চলতে পারে, কিন্তু এই অভ্যাস দিয়ে টেকসই উন্নয়ন হবার কথা নয়, কারণ এর ফলে মানুষ সমাজের মূলধন খেয়ে ফেলছে। কোনো কৃষক যদি তার বীজধান সিদ্ধ করে খেয়ে ফেলে, সে বীজতলা তৈরি করবে কীভাবে, আর চাষবাসই বা হবে কীভাবে?

অজুর্নের প্রশ্নবাণে অস্থির হয়ে গীতার শেষ দিকের কোনো অধ্যায়ে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন: ‘সর্ব ধর্মান পরিত্যাজ্য মাম একম শরণম ব্রজ। অহম ত্বাম সর্বপাপাভ্যাম মোক্ষয়িস্যামি মা শুচ!’ যার মানে হচ্ছে: ‘সব ধর্ম ত্যাগ করে তুমি শুধু আমারই শরণ নাও। আমি তোমার সব পাপ মোচন করব, একদম চিন্তা করে না!’ পাশ্চাত্যের সরকারগুলোও মানুষকে বলে যাচ্ছে: ‘মা শুচ! ফালতু চিন্তা করো না। ‘ডু ফুর্তি’, ঋণ করে করে তুমি পেট পুরে ঘি খেতে থাকো আর সুদ গুণতে থাকো। তোমার অবসর ও বার্ধক্যের সব ভার আমি নিলাম।’

সরকারের কথায় বিশ্বাস করে মানুষ সঞ্চয়ের পথে যাচ্ছে না। আগে পরিবারের এক সদস্য বিপদে পড়লে অন্য সদস্যরা তার সাহায্যে এগিয়ে আসত। বাবা-মা ছেলেমেয়েকে বড় করত এই আশায় যে বুড়ো বয়সে বাবা-মাকে তারা দেখাশোনা করবে। সরকারই যেহেতু ভবিষ্যতের ভার নিয়েছে, সেহেতু ছেলেমেয়ে আর বাবামায়ের কথা ভাবে না। তরুণেরা বিয়েও করতে চায় না, কারণ সরকারই যদি ভবিষ্যতের ভার নেয়, তবে বিয়ে করা বা ছেলেমেয়ের ঝামেলায় যাবার প্রয়োজন কী? অস্ট্রীয় ঘরানার অর্থনীতিবিদেরা দাবি করছেন, হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা পরিবার সংস্কৃতি ভেঙে পড়ার পেছনে অন্যতম নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে ফিয়াট-মানি-ঋণ-ভিত্তিক কিনসীয় অর্থনীতি।

তিন। বিকল্প অর্থনীতি

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির শেষে রাশিয়ার সেনাবাহিনী ইউক্রেইনে ঢুকে পড়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে রাশিয়ার মুদ্রা রুবলের মূল্য ৩০% ভাগ কমে গিয়েছে। এটা যদি পশ্চিমা অপপ্রচারও হয়ে থাকে, রুবলের মূল্য কিছুটা তো অবশ্যই কমেছে। রাশিয়ার অর্থবাজারে রুবলের পরিমাণ বৃদ্ধি এর অন্যতম কারণ হওয়া অসম্ভব নয়। রাশিয়া হয়তো যুদ্ধের ব্যয় নির্বাহের জন্যও নতুন রুবল ছাপতে বাধ্য হয়েছে।

অর্থের যে চারটি অপরিহার্য কাজের কথা আমরা পড়েছি অর্থনীতির পাঠ্যপুস্তকে: ১) বিনিময়ের মাধ্যম, ২) মূল্যের একক, ৩) মূল্যের আধার এবং ৪) সঞ্চয়ের বাহন’– অর্থ এর একটিও করতে পারে না, যদি তার পরিমাণ কাম্য পরিমাণের চেয়ে বেড়ে যায়। কোনো অর্থনীতিতে মুদ্রার কাম্য পরিমাণ কী হবে, সে প্রশ্ন উঠতে পারে। অস্ট্রীয় ধারার অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, যেকোনো পরিমাণ অর্থ দিয়েই একটি অর্থনীতি চলতে পারে, তবে শর্ত হচ্ছে দুটি: প্রথমত, মুদ্রা ক্ষুদ্রতর মুদ্রায় বিভাজনযোগ্য হতে হবে এবং দ্বিতীয়ত, মুদ্রার পরিমাণ বাড়ানো যাবে না, কারণ, পরিমাণ বেড়ে গেলেই মুদ্রার মূল্য অর্থাৎ এর ক্রয়ক্ষমতা কমে যাবে।

সুতরাং টাকা ভালো কি খারাপ, সেটা টাকার পরিমাণের ওপর নির্ভর করে না, নির্ভর করে তার ক্রয়ক্ষমতার ওপর। লেনদেন পরিচালনা এবং সঞ্চয় করার মতো যথেষ্ট টাকা অর্থনীতিতে থাকলেই হলো। টাকা যদি কম থাকে, তবে সেটা ক্ষুদ্রতম মুদ্রায় বিভাজিত হওয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে। ব্রিটিশ আমলে শুনেছি, এক পয়সাতেও অনেক কিছু কেনা যেত। বাংলাদেশে এক পয়সা কেন, এক টাকাতেও তেমন কিছু পাওয়া যায় না। ব্রিটিশ আমলের তুলনায় এখনকার বাজারে টাকার পরিমাণের পার্থক্য এর অন্যতম কারণ।

অস্ট্রীয় ঘরানার অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে আদর্শ মুদ্রা হওয়া উচিত সেটাই, যার সরবরাহ স্থির– কেউ যার সরবরাহ বাড়াতে পারে না। স্বর্ণ হাজার বছর ধরে উত্তম মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে শুধু এই একটি কারণে। খনন করে, রসায়ন ও পদার্থবিদ্যার যাবতীয় জ্ঞান কাজে লাগিয়েও সেই আলকেমির যুগ থেকে আজ পর্যন্ত স্বর্ণের পরিমাণ বছর শতকরা কমবেশি দুই ভাগের বেশি বাড়ানো যায়নি।

কিনসীয় অর্থনীতিতে সরকার টাকা ছাপিয়ে বিনিয়োগ করে। সাধারণ মানুষ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করে। প্রথমত, এই দুই বিনিয়োগের পিছনে মূলধন বলে কিছু নেই। দ্বিতীয়ত, টাকা ছাপানোর কারণে টাকার ক্রয়ক্ষমতা কমে মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি হয়। তৃতীয়ত, বিনিয়োগকারীরা ব্যাংক থেকে ঋণ নেবার কারণে ব্যাংকের টাকার (এম ১-২-৩) পরিমাণ বৃদ্ধিও মুদ্রাস্ফীতির কারণ হয়। অবাক হবার কিছু নেই যে কিছুদিন পর পরই কিনসীয় অর্থব্যবস্থায় একটি মন্দা সৃষ্টি হয়। মন্দার প্রতিষেধক হিসেবে সরকার আরও টাকা ছাপায়, যার ফলে মুদ্রাস্ফীতি আরও বেড়ে যায়।

সঞ্চয় ব্যাপারটাকে কিনস সাহেব অন্তরের অন্তস্থল থেকে ঘৃণা করেন। সঞ্চয় মানেই হচ্ছে ব্যয়সংকোচ এবং ব্যয়সংকোচ মানে পণ্য বিক্রি না হওয়া। পণ্য বিক্রি না হওয়া মানে কারখানা বন্ধ হওয়া এবং বেকারত্ব এবং মন্দা। অতিরিক্ত টাকা ছাপিয়ে কিনস মানুষের ভোগবাসনা বাড়িয়ে দিতে চান, যাতে পণ্য বিক্রি হয় এবং কারখানার টাকা সচল থাকে। কিনস সাহেবকে যখন প্রশ্ন করা হয়েছে, এভাবে কতদিন চলবে? একদিন না এক দিন তো অর্থনীতি ধসে পড়বে! কিনস সাহেব উত্তর দিয়েছেন: ‘অর্থনীতি ধসে পড়তে পড়তে আমরাও আর কেউ আর বেঁচে থাকব না।’ তিনি লিখেছেনও: ‘ইন দ্য লং রান, উই আর গন!’ আমরাই যখন থাকব না, তখন পৃথিবীর কী হলো বা না হলো, তা আমাদের মাথাব্যথা নয়! ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’ কিনস কিংবা তার অনুসারীদের মতে ডাহা মিথ্যা একটি প্রার্থনা। ‘চাচা, আপন প্রাণ বাঁচা!’ ‘আপনি বাঁচলে বাপের নাম!’ কিনসের প্রার্থনা অনেকটা এরকম: ‘সন্তানের কী যে হবে, থোড়াই কেয়ার করি! নিজে যেন দুধভাত খেয়ে মরতে পারি!’

গত প্রায় এক শ বছরে কিনসীয় অর্থনীতির ভাবসাব দেখে অস্ট্রীয় ধারার অর্থনীতিবিদদের, নজরুলের ভাষায়: ‘দেখিয়া শুনিয়া খেপিয়া গিয়াছি’ অবস্থা। তারা বলেন, কোনো সুস্থ সমাজের কিনসীয় ধ্যানধারণা অনুসরণ করা উচিত নয়। পাঠ্যপুস্তকে পড়ানো উচিত নয় এমন অর্থনৈতিক তত্ত্ব ও ধারণা। কিন্তু কে শোনে কার কথা! বিশ্বের সরকারগুলো, সে বাইডেন হোক বা পুতিন, কিনসের তত্ত্ব পছন্দ করে, কারণ এই তত্ত্ব অনুসারে তাদের হাতে আসে অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণের সর্বময় ক্ষমতা। এ কারণে তারা চায়, জনগণের মনে কিনসীয় অর্থনৈতিক ধারণার কোনো বিকল্প না থাকুক। অর্থনীতির শিক্ষা, গবেষণা, অ্যাকাডেমিয়া সেই লক্ষ্যেই পরিচালিত হয় সারা পৃথিবীতে।

অস্ট্রীয় ধারার অর্থনীতিবিদেরা একটি বিকল্প অর্থনীতির প্রস্তাব করেছেন। তাদের দাবি, প্রথমত, মুদ্রাব্যবস্থার ওপর সরকারের কোনো প্রকার নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত নয় এবং দ্বিতীয়ত, মুদ্রার পরিমাণ স্থির থাকা উচিত। এই দুটি ব্যাপার অবশ্য একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। সরকারের হাতে নিয়ন্ত্রণ থাকলে মুদ্রার পরিমাণ সরকার বাড়াবেই। ‘সরকার না শোনে ধর্মের কাহিনী’। আবার মুদ্রার পরিমাণ স্থির থাকার অর্থ হচ্ছে, মুদ্রাব্যবস্থার ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকা। অস্ট্রীয় ধারার অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, মুদ্রার পরিমাণ যদি স্থির থাকে, সরকার যদি ফালতু কেরদানি করে অশিক্ষিত পটুত্ব না দেখায়, তবে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে পণ্য ও সেবার দাম এক সময় কমবেই কমবে।

এই ধরনের আর্থপরিবেশ আমরা আমাদের নিকট অতীতে দেখিনি। কিন্তু এমন অর্থনীতি স্বর্ণমুদ্রার যুগে ছিল আরবে-ইউরোপে। অস্ট্রীয় ধারার অর্থনীতিবিদেরা দাবি করেন, সরকারি নিয়ন্ত্রণহীন অর্থনীতি এখনও চমৎকার কাজ করবে। এই বিকল্প অর্থনীতির ফলশ্রুতিতে কিছুদিন পর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেড়ে গিয়ে পণ্যের সরবরাহ (Q) বেড়ে যাবে এবং পণ্যের দাম (P) কমবে। টাকার (M) পরিমাণ স্থির থাকাতে এর হাতবদল (V) বেশি হবে। টাকার দাম বাড়তেই থাকবে এবং টাকা ক্ষুদ্রতর এককে বিভক্ত হবে। পয়সা বা পেনি তার পুরনো মূল্য ফিরে পেতে পারে। মানুষ ভোগে নয়, সঞ্চয়ে আগ্রহী হবে। পণ্য যদি কিনতেই হয়, তবে দীর্ঘ সময় ধরে ব্যবহার করা যায়, এমন ভালো পণ্য কিনতে চাইবে সবাই। ‘মেড ইন চায়না’ মাল কিনে দুই দিন ব্যবহার করে ‘চাই না’ বলে ফেলে দিতে হবে– এমন পণ্যের দিকে মানুষের আগ্রহ থাকবে না। এর ফলে প্রথমে পণ্যের গুণগত মানও বাড়বে। বর্জ্য বৃদ্ধি পেয়ে পরিবেশের ক্ষতি হবে না।

ব্যয়বৃদ্ধির ফলে ভোগ যতটা না বাড়ে, সঞ্চয়ের ফলে দীর্ঘমেয়াদে ভোগ তার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে বাড়ে। সঞ্চয়কারী (দূর বা অদূর) ভবিষ্যতেও নিজের সম্পদ ভোগ করতে পারবে, অমিতব্যয়ী যা কখনই করতে পারবে না। সঞ্চয়ের ফলে মূলধন সৃষ্টি হয়, কিন্তু ব্যয়ের ফলে, ঋণের ফলে কখনই মূলধন সৃষ্টি হয় না। মূলধন মানেই বিনিয়োগ এবং বিনিয়োগ মানেই কর্মসংস্থান।

চার। স্বশোষণমূলক অর্থনীতি

অর্থনীতির ভিত্তি কী হওয়া উচিত? ঋণ নাকি সঞ্চয়? উপরোক্ত সুদীর্ঘ যুক্তিজালে মোহিত হয়ে আপনি হয়তো বলবেন: ‘সঞ্চয়’। ঠিকই বলেছেন বটে, কিন্তু এতেও সমস্যা আছে। সরকার ও প্রশাসনের দেশ ও জনবিরোধী চরিত্র যদি না বদলায়, তবে কিন্তু ‘সকলই গরল ভেল’। আপনার-আমার পরিশ্রম এবং সঞ্চয় প্রকাশিত হয় টাকায়। কারণে-অকারণে, বিশেষ করে মন্দা এবং যুদ্ধ হলে সরকারগুলো দেদার টাকা ছাপায়। টাকার পরিমাণ বেড়ে গিয়ে শুরু হয় মুদ্রাস্ফীতি। টাকার দাম কমে যায়, পণ্যের দাম বেড়ে যায়। মুদ্রাস্ফীতির মানে হচ্ছে আপনার, আমার পরিশ্রমের মূল্য গিয়ে জমা হবে (এখনই হচ্ছে) অন্য কারও পকেটে, বিদেশে কিংবা ওরা এগারো জনের হিসাবে।

কারা এই ‘এগারো জন’? এটা কোটিপতিদের একটা প্রতীকী সংখ্যা। ধরা যাক, এগারো জন ব্যক্তি চালাচ্ছে বিশ্ব অর্থনীতি। ওরা এগারো জন আগেই আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছিল। করোনাভাইরাস মহামারী এবং ইউক্রেইন যুদ্ধে আপনার-আমার পকেটের টাকায় ওরা ‘কলাগাছ ফুলে বাওবাব’ হয়েছে। তেতাল্লিশের মন্বন্তরে বাংলায় যখন লক্ষ লক্ষ মানুষ মরেছিল, তখনও ‘ওরা এগারো জনের’ বাড়বাড়ন্ত হয়েছিল। এই এগারো জনের অন্যতম ইস্পাহান থেকে আগত এক অবাঙালি শিল্পপতি, যিনি অনেক দানধর্মও করেছিলেন। এনার টাকায় ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতাল! চমৎকার চক্ষুদান! মানুষ যখন পেটের দায়ে জমি বিক্রি করছিল, গ্রামবাংলায় এখানে ওখানে এগারো জন নতুন জোতদার সৃষ্টি হয়েছিল। এদের কথা আমরা কখনও বলি না, দুর্ভিক্ষের জন্য ইংরেজদের দোষ দিয়ে সন্তুষ্ট থাকি, ঠিক যেমন মন্দা-ব্যবস্থাপনার জন্যও শুধু নন্দঘোষ সরকারের দিকেই আঙুল তুলি।

ইংরেজ ও পাকিস্তানি আমলে বাংলাদেশের সঞ্চয় ও পরিশ্রমের মূল্য পাচার হয়ে চলে যেত যথাক্রমে লন্ডন ও ইসলামাবাদে। এই দুঃখজনক প্রক্রিয়ার গালভরা নাম ছিল ‘শোষণ’। এখনও আমাদের সঞ্চয় ও পরিশ্রমের মূল্য লুটপাট, পাচার হয়ে চলে যাচ্ছে সেই বিদেশেই। পার্থক্য হচ্ছে, লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে বিদেশিদের তাড়িয়ে এবার নিজেদের সম্পদ বিদেশে নিয়ে গিয়ে জমা করছি আমরা নিজেরাই। প্রতি বছর একটি পদ্মাসেতুর টাকা তথাকথিত উচ্চশিক্ষার নামে পাশ্চাত্যে পাচার হচ্ছে। এ রকম হাজারও খাতে ও উপায়ে টাকা পাচার হয়ে গত পঞ্চাশ বছর যাবৎ আমরা স্বশোষিত হচ্ছি। কই কোনো রাজনীতিবিদ কখনও তো এই স্বশোষণের অভিযোগ তোলেননি! হয়তো খেয়াল করেননি কিংবা নিজেরাই হয়তো তারা এই অপকর্মে জড়িত।

নব্য উপনিবেশবাদের অন্যতম লক্ষণ এই স্বশোষণ। বাংলাদেশের যে প্রকৃত অর্থনৈতিক উন্নতি হয়নি, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা কিংবা বন্দরনগরী চট্টগ্রামকে দেখে যে একেকটি নোংরা, বিশ্রী, অনুন্নত শহর মনে হয়, দেশের বেশিরভাগ মানুষের মনমানসিকতা যে মধ্যযুগে আটকে আছে– এই সবকিছুর মূলে আছে অতীতের শোষণ এবং বর্তমানের স্বশোষণ। এমন স্বশোষণ চলছে বাংলাদেশসহ অনুন্নত বিশ্বের প্রায় সব দেশে। স্বশোষণের কারণেই দেশগুলো অনুন্নত, নাকি অনুন্নত বলেই তারা স্বশোষণ করছে? ‘ডিম আগে মুরগি আগে?’-এর মতো এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়াও সহজ নয়।