আমাদের দেশীয় ‘বাস্তিল’ দুর্গ যেহেতু ‘মাইক্রো’ এবং ক্ষেত্রবিশেষে অদৃশ্য তাই সাধারণ মানুষের সামনে নির্দিষ্ট কোনো বাস্তিল দুর্গ অভিমুখে যাত্রা করার সুযোগ নেই। তাই তারা দুধের সাধ ঘোলে মিটায় আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশেষ করে ফেইসবুক, ইউটিউব আর টিকটকে ঝাল মিটায়।
Published : 14 Jul 2024, 08:11 AM
বাস্তিল দুর্গের পতনের মাধ্যমে ফরাসি বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল। এটি ছিল, রাজতন্ত্রের দুঃশাসন এবং দমন আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে শত শত বছর ধরে দেশটির সাধারণ মানুষের বঞ্চিত হওয়ার আর নির্যাতিত হবার বহিঃপ্রকাশ। ওই সময় ফ্রান্সের শতকরা ৯৫ ভাগ সম্পত্তির মালিক ছিল দেশটির পাঁচ ভাগ মানুষ। সেই পাঁচ ভাগ মানুষ আবার আয়কর থেকেও রেয়াত পেত। বাস্তিল দুর্গ ছিল নির্যাতনের প্রতীক। ওই দুর্গে একবার কেউ নিক্ষিপ্ত হলে আর জীবিত ফিরতেন না। দুর্গের ভেতরে ছিল মানুষ হত্যার যাবতীয় বন্দোবস্ত।
১৭৮৯ সালের ১৪ জুলাই দেশটির নির্বাচিত প্রতিনিধি এবং সাধারণ মানুষ বাস্তিল দুর্গ অভিমুখে যাত্রা করে। অবস্থা বেগতিক দেখে দুর্গের পক্ষ থেকে আলোচনার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তাতে শেষ রক্ষা হয়নি। বিক্ষুদ্ধ মানুষ প্রতিরোধ ভেঙে দুর্গে প্রবেশ করে এবং দুর্গের পতন ঘটায়।
১৪ জুলাই বাস্তিল দুর্গের পতন বা ফরাসি বিপ্লব দিবস। দিনটি ফ্রান্সের জাতীয় দিবস। আজ থেকে ২৩৪ বছর পূর্বে ১৭৮৯ সালে এদিন জনবিক্ষোভে তৎকালীন ফরাসি রাজতন্ত্রের প্রতীক কুখ্যাত বাস্তিল দুর্গের পতন হয়েছিল।
আমাদের দেশে দৃশ্যত বাস্তিল দুর্গের মত কোনো দুর্গ নেই। তবে দৃশ্যমানতার বাইরে অদৃশ্য অনেক মাইক্রো বাস্তিল দুর্গ থাকার আলামত উড়িয়ে দেয়া যাবে কি? অদৃশ্য এরকম বায়বীয় মাইক্রো দুর্গের এসব মাজেজায় প্রশাসনের নানা স্তরের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা আমমোক্তারগণ রাতের আঁধারে ঘুমন্ত মানুষের বাড়িতে গিয়ে ভ্রাম্যম্যাণ আদালত বসান, থানায় ধরে এনে মানুষ নির্যাতন করেন, ক্রসফায়ারের মাধ্যমে মানুষদের ওপারে চালান করেন, ভয় দেখিয়ে জমি সম্পত্তি, বাড়ি প্রতিষ্ঠান দখল করেন— এরকম ঘটনা আমাদের দেশে ঘটেছে কি না? এরকম প্রশ্ন যাদের উদ্দেশে তারা আপনার-আমার করের টাকায় মজুরিভুক্ত রাষ্ট্রযন্ত্রের কর্মচারী হয়ে দেশের মানুষের উপর অনেকটা বাস্তিল দুর্গের মাজেজা ফলান। এরা দেশের জনগোষ্ঠীর যে অংশের প্রতিনিধিত্ব করেন তাদের সংখ্যা কুড়ি লাখের অধিক হবে না।
সর্বসাকুল্যে দেশের সরকারি চাকুরে দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা একভাগের বেশি হবে না। অথচ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এদের তোষণে এবং পুষণে একের পর এক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এদেরকে অতিরিক্ত আস্কারা দিতে আইনগত অগ্রাধিকারের উদ্যোগ পর্যন্ত নেয়া হয়েছে।
আবদার মেটাতে এদের সুযোগ-সুবিধাও অনেক বাড়ানো হয়েছে। যার ফলে তাদের একটি অংশের বাড়বাড়ন্ত সবকিছুর সীমা ছাড়িয়ে গেছে। সীমা ছাড়ানোর দৃষ্টান্তে মোটাদাগে উল্লেখ করা যায় সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদ, সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ, রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউর রহমান, কক্সবাজারের টেকনাফ থানার সেই ওসি প্রদীপ এবং বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের গাড়িচালক আবেদ আলী আর দুর্নীতি দমন কমিশনের আব্দুল বাছিরের নাম। এখন প্রশ্ন দুর্নীতির চমকপ্রদ এরকম আমলনামার অধিকারী এই নামগুলোই কি প্রথম এবং শেষ? চলমান প্রশাসনের অন্দরে উনাদের মত গুণধর বাকিরা কি নানা দফতর বিভাগ এবং প্রতিষ্ঠানে বহাল তবিয়তে নেই?
দায়িত্বশীল তরফ থেকে যত কথাই বলা হোক বিআরটিএ বা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ, শিক্ষাভবন, থানা পুলিশ, ভূমি অফিস, সমাজসেবা অফিস, অবসর ভাতা অফিস, প্রকৌশল কার্যালয়সহ দেশের কোন কোন মুল্লুকে ঘুষ ছাড়া কতটুকু কাজ করা যায় তা ভুক্তভোগীরাই জানেন। সংবাদমাধ্যমে যতটুকু দুর্নীতির কাহিনি প্রকাশ পাচ্ছে, বাস্তবতা কি তার চেয়ে ভয়াবহ নয়? এটা প্রমাণের জন্যে পত্রিকার খবরের ওপর নির্ভর করার দরকার নেই। ছদ্মবেশে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীরা সেবা প্রদানকারী দফতরগুলোতে অতর্কিতে উঁকি দিয়ে দেখতে পারেন।
সেই সঙ্গে কুড়ি লাখের অনধিক সরকারি চাকুরের মধ্যে সৎ আর দুর্নীতিবাজ নির্বিশেষে সবার সম্পদের হিসাব জনগণের সামনে প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া যায়। তাতে বোঝা যাবে একজন সৎ চাকুরিজীবী থেকে একজন অসৎ চাকুরের সম্পদের কী পাহাড়সমান ফারাক।
ঘুষ দুর্নীতি আর আমলাদের বাড়াবাড়ি নিয়ে সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ। আমাদের দেশীয় 'বাস্তিল' দুর্গ যেহেতু 'মাইক্রো' এবং ক্ষেত্রবিশেষে অদৃশ্য তাই সাধারণ মানুষের সামনে নির্দিষ্ট কোনো বাস্তিল দুর্গ অভিমুখে যাত্রা করার সুযোগ নেই। তাই তারা দুধের সাধ ঘোলে মিটায় আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশেষ করে ফেইসবুক, ইউটিউব আর টিকটকে ঝাল মিটায়। এক একটা প্রদীপ, বেনজীর, আজিজ, মতিউর, বাছির আর আবেদ আলীর খবর আসে আর জনতা মনে করে পাইছি একটারে। আদতে এভাবে বিচ্ছিন্ন পতিত কয়েকটারে নিয়ে উল্লসিত হলেই দুর্নীতি কমে যাবে বা থেমে যাবে তা মনে করার কারণ নেই। দুর্নীতি দমনে দরকার কাঠামোগত সংস্কার এবং প্রশাসনের সকল স্তরে শুদ্ধি অভিযান।
দুর্নীতি কেবল আমাদের দেশেই হয় না। কম বেশি সব দেশেই দুর্নীতি হয়। কোনো কোনো দেশে দৃশ্যমান দুর্নীতি না থাকলেও অদৃশ্য দুর্নীতি কোনো অংশে কম নয়। দুর্নীতির আবার ক্ষুদ্র বা বৃহৎ অর্থাৎ 'মাইক্রো' এবং 'ম্যাক্রো' ব্যাপারস্যাপার রয়েছে। যেসব দেশকে কার্যত আমরা দুর্নীতির সূচকে ভালো অবস্থানে দেখি সেসব দেশে মাইক্রো দুর্নীতি অর্থাৎ মাঠপর্যায়ে ঘুষের প্রচলন না থাকলেও নীতি নির্ধারণী এবং লবিস্ট স্তরে দুর্নীতির চৰ্চা প্রক্রিয়াগতভাবে করা হয়ে থেকে। এসব ক্ষেত্রে দুর্নীতির সামনে প্রথমে চিহ্নিত করা হয় আইনগত বাধা। তারপর আইনগত বাধা দূরীকরণে ধাপগুলো নির্ধারণ করা হয়। প্রথম ধাপে জনমত খতিয়ে দেখার জন্যে সংবাদমাধ্যম পর্যায়ে আলোচনা বিতর্কের সূত্রপাত করা হয়।
এরপর আমলাতান্ত্রিক পর্যায়ে রূপরেখা নির্ধারণ করা হয়। সেই রূপরেখা অনুযায়ী রাজনৈতিক পর্যায়ে আইন পাল্টানোর পদক্ষেপ নেয়া হয়ে থাকে। এরকম দুর্নীতির বড় সুযোগ থাকে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বমূলক বড় বড় প্রকল্পে। এভাবে বহুজাতিক কোম্পানি দেশে দেশে একচেটিয়া সুবিধা লাভ করে থাকে এবং কার্যত ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যায়।
আমাদের দেশের দুর্নীতি এত খোলামেলা হয়ে গেছে এতে 'মাইক্রো' আর 'ম্যাক্রো'র ব্যাপার নেই। যে যেখানে পারে ছোট হোক বড় হোক, মন্ত্রী হোক, সচিব হোক, পিয়ন হোক, উপাচার্য হোক, গাড়িচালক হোক, সুযোগ পেলে ‘হাভাইত্তা’র মত খাওয়া শুরু করেন। এদের তর সয় না, আইন ও নিয়মকে এরা পাত্তা দিতে চান না। নিজেদের অপকর্মকে জায়েজ করার জন্যে রাজনৈতিক প্রভাব এবং ঘনিষ্ঠতাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন।
একটা বিষয় স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, দুর্নীতি যে পর্যায়ে যেই করুন– ক্ষমতার প্রশ্রয় ছাড়া বছরের পর বছর দুর্নীতির বাড়বাড়ন্ত চলতে পারে না। এখানে ব্যাপার না ক্ষমতায় সামরিক স্বৈরাচার কিংবা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার। নির্বাচিত সরকার মানেই ধোয়া তুলসীপাতা, এরকমটা মনে করার কারণ নেই। বৃক্ষ তোমার নাম কি ফলে পরিচয়। টানা দেড় দশক ক্ষমতায় থাকার পর কোনো দলীয় সরকারের পক্ষে দুর্নীতির বাড়াবাড়ির দায় এড়িয়ে যাবার সুযোগ খুব একটা নেই। দলীয়ভাবে নেতারা মেঠো বক্তৃতা দিতেই পারেন। এটা তাদের এখতিয়ার। তবে তাদের এসব কথা নিজ দলের কর্মী ও সমর্থকরাও বিশ্বাস করেন কি না, সেটা খতিয়ে দেখতে পারেন।
দুর্নীতির গূঢ় অর্থ 'ঘুষ এবং ধ্বংস'। এই ঘুষ এবং ধ্বংসের চর্চা প্রথম শুরু হয়েছিল প্রাচীন মিশরের বিচার বিভাগে, খ্রিস্টপূর্ব তিন হাজার বছর আগে। এই ঘুষ এবং ধ্বংসচর্চায় আমাদের বিচার বিভাগ যে মুক্ত নয়, তা সাবেক একজন প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ, তার দেশান্তরসহ আগে-পরের নানা গল্প থেকে আমরা আর আমরা হলফ করে বলতে পারছি না। পুলিশ প্রধানের গল্পও জেনে গেলাম, জেনে গেছি সেনাপ্রধানের গল্পও। সচিব আমলা ডিসি এসপি ইউএনও অফিসার কেরানি পিয়ন চাপরাশি সবার ক্ষমতা এখন ডালভাত পান্তাভাতের মত প্রয়োগ হচ্ছে। তার ফলনও দারুণ।
দুর্নীতির এই সব হাইব্রিড প্রতিভাবানদের কারো কানাডার বেগমপাড়ায় বাড়ি, কারো বাড়ি মালয়েশিয়ায়, কারো সিঙ্গাপুরে, কারো ইউরোপে। কেউ দুর্গ গড়ে তুলেছেন মোকসেদপুর, ডাসার, পূর্বাচলসহ দেশের নানা প্রান্তে। এদের নাম অনেকেরই নাম খুঁজে পাওয়া যাবে পানামা পেপারে, এদের টাকার হদিস হয়তো মিলবে সুইস ব্যাংকে। এদের উত্থানে আর উন্নয়নে দেশটা ভরে গেছে। প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে এরা নানা প্রকল্প আর ব্যবসায়িক উদ্যোগের নামে গ্রামকে গ্রাম কৃষিজমি গলাধঃকরণ করে গড়ে তুলেছেন পারিবারিক সাম্রাজ্য বা একেকটা দুর্গ। রহস্যে ঘেরা এসব দুর্গ সম্পর্কে অসহায় সাধারণ আদমিদের রয়েছে অপার কৌতূহল। এখানে যারা আসেন রাতে-বিরেতে এরা করা? এরা কি আমাদের মতো রক্তমাংসের মানুষ? নাকি ভিনগ্রহের কোন প্রাণী?
এই পর্যায়ে দুর্নীতি নিয়ে প্রাচীন চীনের উদাহরণ টানতে চাই। পুরাণ মতে প্রাচীন চীনের 'কিচেন গড' বা রান্নাঘরে দেবতা বিরাজ করার প্রথা বিশ্বাস করত। প্রতিটি চীনা বাড়ির রান্নাঘরে 'কিচেন গড' (Kitchen God)-এর ছবি রাখা হত। এই গড পরিবারের প্রতিটি সদস্যের কার্যক্রমের উপর নজর রাখত। নবর্ষের সপ্তাহখানেক পূর্বে কিচেন গড স্বর্গের অধিপতি আদি দেবতা 'যাদে' বা 'যুদি' বা ইয়াদে বা ইউদি সম্রাট বরাবর প্রতিবেদন পেশ করতেন। এই প্রতিবেদনের উপর নির্ভর করত প্রাচীন চীনের একজন আদম সন্তান আসন্ন বছরে পুরস্কৃত হবেন নাকি শাস্তির মুখে পড়বেন। কোনো কোনো পরিবার ভালো প্রতিবেদন পাবার প্রত্যাশায় রান্নাঘরে রাখা কিচেন গডের ছবিটি পোড়াবার আগে এর উপর চিনির কেক এবং মধু লেপ্টে দিত।
আমরা এখন কোনো প্রাচীনযুগে বাস করছি না। চীনা পুরাণের যুগেও আমরা বাস করছি না। আমরা বাস করছি আধুনিক যুগে, স্বাধীন গণতান্ত্রিক একটি রাষ্ট্রে। দুর্নীতি দমন কমিশন ছাড়াও এই রাষ্ট্রের রয়েছে নানা গোয়েন্দা সংস্থা, বিবিধ নিয়ন্ত্রণ কাঠামো। আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা এবং নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর কাজ ছিল এ সংক্রান্ত অগ্রিম খবর ক্ষমতাকেন্দ্রের সংশ্লিষ্ট দফতর এবং ব্যক্তি বরাবর জানানো। যেমনটা প্রাচীন চীনের কিচেন গডগণ করতেন। নাকি আমাদের দেশের এই সময়ের কিচেন গডরাও চিনির কেকে আর মধুতে লেপ্টে গিয়েছিলেন? আসল সত্য কিন্তু ক্ষমতা স্বর্গের নিয়ামক যারা তারা বলতে পারবেন।
সাধারণ বুদ্ধিতে একটা জিনিস বুঝে উঠতে পারি না। মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ ব্যক্তি পর্যায়ের দুর্নীতির অভিযোগ থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর সংশ্লিষ্টতা নেই বা থাকতে পারে। কিন্তু তার অধীনে মন্ত্রণালয়ের বড় বড় কর্তারা একের পর এক অপকর্ম করে যাবেন বছরের পর বছর ধরে আর 'চোর পালালে বুদ্ধি আসে'র মত করে মন্ত্রী বলবেন তিনি কিছু জানেন না। একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রীর এরকম বক্তব্য কার্যকর গণতন্ত্রের জন্যে মঙ্গল ভয়ে আনতে পারে না।
এখানে বহুল আলোচিত কক্সবাজারে সিনহা হত্যার প্রসঙ্গ সামনে নিয়ে আসতে চাই। সিনহা হত্যার আগে ওসি প্রদীপের অপকর্মের কোনো খবর দৃশ্যত আমাদের গোচরে ছিল না। কিন্তু প্রশাসনযন্ত্রের কর্তাদের অগোচরে থাকে কেমনে? আর তাই যদি থাকে তাহলে প্রশাসন যে কার্যকর সেই দাবি কেমনে করা যাবে? এরকম ওসি প্রদীপ কি একজনই?
এমন অভিজ্ঞতার কথা কেউ কি বলতে পারবেন দেশের সচিবালয় থেকে শুরু করে জেলা, উপজেলা পর্যায়ে কর্মরত প্রকৌশলী, আধা-প্রকৌশলী যারা কর্মরত তারা কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন কতজন জীবনে কোনো ঘুষ খাননি। কেন্দ্র থেকে প্রান্ত পর্যন্ত শুদ্ধি অভিযান চালানো হলে ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হবে। তবে প্রশাসনে সৎ কর্মকর্তা এবং কর্মচারীও অনেক আছেন। এই সত্যও অস্বীকার করছি না। সৎ চাকরিজীবীদের রক্ষা করার জন্যে এবং তাদের সম্মান ফিরিয়ে দেবার জন্যে হলেও সরকারের প্রতিটি বিভাগ ধরে ধরে অভিযান চালানো দরকার এবং তাদের সম্পদের ডিজিটাল তথ্যব্যাংক করা যেতে পারে।
দুর্নীতি দমন কমিশনেও দুয়েকজন বাছিরের তালাশ পাওয়া যায়। তাই এখানে কর্মরত সকলের সম্পদের হিসাব মানুষের জানার অধিকার রয়েছে। অবস্থা এমন হয়েছে এখন কোনো সৎ সরকারি চাকুরীজীবির জন্যে নিজেকে সৎ দাবি করা কঠিন হয়ে পড়েছে। সরকারি চাকুরীজীবির সংখ্যা শতকরা একজনেরও কম। এরকম সুবিধাভোগী এই শ্রেণি বাকি ভুক্তভোগী ৯৯ ভাগ মানুষের বিরাগভাজনের মুখে থাকলে আর যাই হোক প্রশাসনযন্ত্র ঠিকপথে চলতে পারে না। এরকম বাস্তবতায় রাজনৈতিক বক্তৃতায় অনেক কথা বলা যেতে পারে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে 'জিরো টলারেন্স' বা শূন্য সহিষ্ণুতার কথাও বলতে বাধা নেই। কিন্তু তাতে মানুষ আস্থা রাখতে পারে না, স্বস্তিও পায় না।
আমলাতন্ত্র আর সরকারি চাক্কুরীজিবিদের উপর মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ আর অসন্তোষ পাহাড়সমান। এরকম অস্থির অবস্থা থেকে পরিত্রাণ আর সামগ্রিক দুর্নীতি প্রশমন করার জন্য দরকার দেশের আমলাতন্ত্রকে কোম্পানি আমলের আদল থেকে বের করে সংসদীয় গণতন্ত্রের ধারায় স্বাধীন দেশের জনপ্রতিনিধিত্বশীল প্রশাসন কাঠামো গড়ে তোলা। এখন প্রশাসন যেভাবে চলছে তা অনেকটা হুকুম জারির প্রশাসন। কর্তার হুকুমে অধীনস্থরা উঠবেন বসবেন ঠিকই। কিন্ত কর্তার নীতিকথায় কিন্তু প্রশাসনের অপকর্ম থামে না। এর জন্যে দরকার প্রশাসনের প্রতি ধাপে কেন্দ্র থেকে শুরু করে প্রান্ত পর্যন্ত স্বচ্ছতা আর জবাবদিহিতার নানা কাঠামো। আমরা তো স্বাধীনতার ছয় দশকে এখন। আমরা কি সেই কাঠামো দাঁড় করাতে পেরেছি? স্বাধীন দেশে ঔপনিবেশিক কাঠামোর আমলাতন্ত্র দিয়ে দুর্নীতি নির্মূল করা কি আদৌ সম্ভব?