Published : 03 Mar 2025, 08:25 PM
একটা দেশের বিবেককে ধ্বংস করার জন্য সবচেয়ে ভালো উপায় হলো ওই দেশের মুক্তচিন্তার প্রবাহকে রুদ্ধ করা এবং বইপত্র প্রকাশ ও বিক্রিকে বাধাগ্রস্ত করা। এই চর্চা বিভিন্ন সময়ে করা হয়েছে, বিভিন্ন দেশে। একটা সমাজে যখন ভয় থাকবে বই প্রকাশ করার কিংবা নতুন চিন্তার রশ্মি ছড়াবার, তখনই উপযুক্ত সময় তাদের অন্য সব অধিকার কেড়ে নেয়ার।
ইসরায়েলি সৈন্যরা গত ৯ ফেব্রুয়ারি পূর্ব জেরুজালেমের ফিলিস্তিনি অঞ্চলের একটা নামকরা বইয়ের দোকানে হামলা চালায়, কারণ তারা ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা ও প্রতিরোধ আন্দোলন নিয়ে বই বিক্রি করছে। হামলা করে ইসরায়েলি সৈন্যরা বইগুলো পুরো তছনছ করে দেয়, দোকান থেকে অনেক বই বাজেয়াপ্ত করে এবং বইয়ের দোকানের মালিকদেরকে ধরে নিয়ে যায়।
শিশুদের বইও এই হামলা থেকে নিস্তার পায়নি। ফিলিস্তিনি শিশুদের রং করার একটা প্রিয় বই হলো, 'ফ্রম দ্য রিভার টু দ্য সি’, এই বইটার সব কপি ইসরায়েলি সৈন্যরা বাজেয়াপ্ত করেছে। ‘নদী থেকে সমুদ্র’ একটা অনেক পুরাতন ফিলিস্তিনি স্বাধীনতার স্লোগান, যার অর্থ– জর্দান নদী থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত মাঝের জায়গাটা পুরোটাই ফিলিস্তিনিদের।
গ্রেফতারকৃত বইয়ের দোকানের মালিকদের দুজন হলেন মাহমুদ মুনা ও আহমেদ মুনা। মুনার বাবা ৪০ বছর আগে ‘দ্য এডুকেশন বুকশপ' নামের বইয়ের দোকানটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন পূর্ব জেরুজালেমে। তিন তলা পর্যন্ত ছড়ানো এই দোকানটি বিপুল বইয়ের সম্ভারের জন্য পরিচিত, যেখানে আরব ও ইসরায়েলি বইপিপাসুরা একত্রে বই দেখেন এবং বই কেনেন।
মুনাকে ইসরায়েলি কোর্টে জামিনের জন্য আনার পর তিনি বলেন, “ইসরায়েলি সৈন্যরা দোকানে ঢুকে বইয়ের তাক থেকে এলোপাতাড়ি বই ফেলতে থাকে। যেসব বইতে ফিলিস্তিনি পতাকা আছে সেগুলোর সব গার্বেজ ব্যাগে ঢুকিয়ে নিয়ে যায়।” দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছে, “হামলার পর যখন মুনার বইয়ের দোকানটা খোলা হয়, দেখা যায় উপচে পড়া ক্রেতা দোকানটিতে এবং তার আশপাশে ভিড় করছে। এত বেশি বই বিক্রি হচ্ছে যে, সবাই হিমশিম খাচ্ছেন ক্রেতাদের ভিড় সামলাতে।” ফিলিস্তিনিরা দলবদ্ধ হয়ে এখন বই কিনছে। মাহমুদ ও আহমেদ মুনার ভাই মুরাদ মুনা বলেছেন, “আমরা দারুণ ব্যস্ত। ইসরায়েলি বাহিনী ফিলিস্তিনিদেরকে ভয় দেখাতে চেয়েছিল, এখন এটাই ফিলিস্তিনিদের উত্তর।”
বইয়ের এই দোকানগুলো ফিলিস্তিনি ইতিহাস, এতিহ্য ও সাহিত্যের বই প্রকাশ করত। ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত ফ্রান্সেস্কা আলবানেজও এই হামলার তীব্র নিন্দা করেছেন। তিনি বলেছেন, “পারিবারিকভাবে পরিচালিত এই বুদ্ধিবৃত্তিক বাতিঘরগুলো বর্ণবাদ ও ফিলিস্তিনিদেরকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বড় প্রতিরোধ গড়ে তুলছে।” ‘প্যালেস্টাইন ক্রনিকেল’ ফিলিস্তিনিদের একটি অনলাইন পত্রিকা। এই ঘটনায় তাদের শিরোনাম ছিল, ‘সংস্কৃতি মুছে ফেলো’।
খোদ ইসরায়েলেও অনেকেই ফিলিস্তিনি বইয়ের দোকানে হামলার প্রতিবাদ করেছে। ইসরায়েলের একজন নামকরা ঔপন্যাসিক ডেভিড গ্রসম্যান বলেছেন, “আমি মুনাকে চিনি। ওর বইয়ের দোকানে আমি মাঝে মাঝে যাই। ওখানে হামলা ও মুনাকে কারাবন্দি করা একটা জঘন্য অপরাধ হয়েছে।”
“একটা সরকার যখন বইকে ভয় পায়, তখন বুঝে নিতে হবে ওই সরকারের স্থায়িত্ব নড়েবড়ে হওয়ার এটা আরেকটা লক্ষণ”— বলেছেন ইলান প্যাপে, যিনি একজন ইসরায়েলি ঐতিহাসিক ও শিক্ষাবিদ। তিনি আরও বলেছেন, পরবর্তী অধ্যায় হবে, বইয়ের দোকানে ভাঙচুর ও আগুন ধরিয়ে দেয়া। একজন সাধারণ বই ক্রেতা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে মন্তব্য করেছেন, ‘ইহুদিবাদ = বই পোড়ানো’।
আমরাও যে এ ধরনের হামলার সঙ্গে খুব অপরিচিত, তা নয়। পাকিস্তান আমলে আমাদের মাতৃভাষা কেড়ে নেওয়ার চক্রান্ত হয়, মাতৃভাষা রক্ষার্থে প্রাণ দিতে হলো আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে— ১৯৫২-এর ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখে। তারপর শুরু আমাদের ভাষাকে বিকৃত করা— ‘খবর’ হয়ে গেল 'সমাচার’, 'উড়োজাহাজ' তখন 'হাওয়াই জাহাজ’, 'পোশাক' হয়ে গেল 'উর্দি' এমনি আরও কত আজগুবি উদহারণ আছে। তারপর গভর্নর মোনেম খান বাঙালিদের রবীন্দ্র সংগীত ও রবীন্দ্র সাহিত্য চর্চাকে বিভিন্নভাবে বাধাগ্রস্থ করেছেন। সেই তো পুরনো ইতিহাস!
স্বাধীনতার পর ইদানীংকালে, প্রতিবারই একুশে বইমেলার আগে ক্ষমতাসীনেরা নানান উদ্যোগ নেন যাতে করে তাদের অপছন্দের বই মেলায় না আসে। এইবারও প্রথমে শোনা গিয়েছিলো পাণ্ডুলিপি অনুমোদনের কথা। ভালো কথা, শেষ পর্যন্ত পুলিশ বা বাংলা একাডেমি ওই পথে এগোয়নি। তাই বলে মুক্তভাবে কথা বলা বা বই প্রকাশ যে সর্বতোভাবে সম্ভব হয়েছে তা নয়। সদ্য সমাপ্ত বই মেলায় বইয়ের স্টলে হামলা হয়েছে, বন্ধ হয়েছে বুক স্টল। দুৰ্ভাগ্যক্রমে আমার মনে হচ্ছে এই হামলাকারীদের দলে আমাকে ব্যবহার করা হয়েছে। আমি তো 'তৌহিদী জনতা’র একজন। তৌহিদী জনতার অর্থ আল্লাহর একত্বে বিশ্বাসী জনতা। আমিও এক আল্লাহকে বিশ্বাস করি। তাদেরকে কীভাবে জানাব, আমি ‘তৌহিদী জনতা’র একজন হলেও ওই হামলার সময় আমি ওখানে ছিলাম না, আমি মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণে বিশ্বাস করি না!
কোনো দেশের সব মানুষের পছন্দ, অপছন্দ এবং বইয়ের রুচি কখনো অভিন্ন হতে পারে না, আঠারো কোটি লোকের দেশে তো নয়ই। একটা দেশে নানা রকম বিভাজন থাকবেই— শিক্ষার বিভাজন, রুচির বিভাজন, রাজনৈতিক বিভাজন এমনি কত কি! এই বিভাজন নিয়ে তৈরি হয় নান ধরনের গ্রুপ। এদের সকলের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান দেশ ও সমাজের অগ্রগতিতে সহায়তা করে।
আমাদের ছোটো-বড় গ্রুপের সকলেরই পছন্দের-অপছন্দের বই আছে। কোনো গ্রুপ অপছন্দ করবেন ‘লাইলী-মজনুর প্রেম কাহিনী’, কারও অপছন্দ হবে ‘এখনই চাই নির্বাচন’, কারও 'মহিলা রাষ্ট্রপ্রধান চাই না' বইটা খুব অপছন্দ, কারও অপছন্দ ‘পাকিস্তান আমাদের ভাই’, আবার কোনো গ্রুপ খুবই বিরোধী ‘ভারত আমাদের বন্ধু দেশ’ বইটার। এখন এইসব গ্রুপগুলো যদি আলাদা আলাদা ‘মব’ হয়ে সবাই লাঠিসোটা হাতে নিয়ে বইমেলায় ঢুকে পড়ে, তাহলে ভাঙা পড়বে বইমেলার প্রায় সব স্টল, বন্ধ হবে বইয়ের বিক্রি। ভীতসন্ত্রস্ত হবেন ক্রেতারা, ভয় পাবেন বিক্রেতারাও— বন্ধ হয়ে যাবে বইমেলা। লেখকরা মুক্তভাবে লিখতে এবং প্রকাশকরা মুক্তভাবে বই প্রকাশ করতে ভয় পাবেন। বন্ধ হবে মুক্ত চিন্তার বিস্তার।
ভয় হয়! আমরা যেন কেমন অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছি! আমাদের মতের সঙ্গে যাদের মিল নেই, আমরা তাদের ওপর হামলা করছি, আমাদের দাবি নিয়ে আমরা অন্যদের পথ চলা বন্ধ রাখছি এবং পথ চলতে কেউ কাঁধে ভুলে সামান্য ধাক্কা দিলেই তাকে সজোরে আঘাত করছি। এই তো গত ১৩ ফেব্রুয়ারির ঘটনা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার আতকাপাড়া গ্রামের ফকির গোষ্ঠীর বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠানে গানের আয়োজন চলছিল। সেখানে গানের অনুষ্ঠানে পাশের এলাকার তাজুর গোষ্ঠীর বিল্লাল মিয়ার গায়ে ধাক্কা লাগে। এই ধাক্কা এবং গানের উচ্চ শব্দ নিয়ে কথা কাটাকাটি থেকে শুরু হয় বড় ধরনের হাঙ্গামা। এতে টেঁটাবিদ্ধ হয়ে মারা যায় গান শুনতে যাওয়া গ্রামের এক কিশোরী, নাম তার ময়না। আমরা কি আমাদের সব চেতনা শক্তি হারিয়ে ফেলেছি? এই তো কয়েকমাস আগে, নিজেদের অধিকার জানাতে গিয়ে অত্যাচারী শাসকের নিষ্ঠুর গুলিতে ঝরে পড়ল আমাদের অনেক তরুণের তরতাজা জীবন।
আমরা অবশ্যই ফিলিস্তিনিদের বইয়ের দোকানে ইসরায়েলি হামলার নিন্দা করব এবং দাবি জানাব ফিলিস্তিনি ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মুক্তচিন্তা যেন বাধাগ্রস্ত না হয়। আমাদের দেশেও ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মুক্তচিন্তার বিকাশকে যারা বাধাগ্রস্ত করবে, আমরা তাদেরও নিন্দা জানাব।
আমাদেরকে সাধারণ বোধ-বুদ্ধি ফিরে পেতে হবে— যেন আমরা ছোট্ট ময়নার বেঁচে থাকার অধিকারকে টেঁটাবিদ্ধ না করি। আমাদের ছোট্ট ময়নারা যেন মনের আনন্দে গান শুনে মুক্তমনে বিকশিত হতে পারে এবং আমাদের আবু সাঈদ ও মুগ্ধরা যেন মুক্তমনে নিজেদের অধিকারহীনতা নিয়ে কথা বলতে পারেন সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
অন্যদের অধিকারে বাধা দেয়া ভয়-ভীতি-আক্রমণের এইসব ঘটনাগুলো, তা যে দেশেই হোক না কেন, যারাই করুক না কেন— সব একই সুতায় গাঁথা।