Published : 06 May 2025, 09:14 AM
ইতিহাস, ঐতিহ্য, স্থাপত্যকীর্তি ও শিল্পশৈলীর নিদর্শনসমৃদ্ধ কুমিল্লার লালমাই অঞ্চলে নতুন পুরাকীর্তির হদিশ মিলতে পারে এমন সম্ভাবনায় শুরু হয়েছে খনন কাজ।
চলতি বছরের এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া খনন ও অনুসন্ধান কাজ জুন মাস পর্যন্ত চলবে বলে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর জানিয়েছে।
সদর দক্ষিণ উপজেলার বারপাড়া ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ধর্মপুর গ্রামে (চারাবাড়ি) লালমাই পাহাড়ের দক্ষিণ অংশে ‘বালাগাজীর মুড়ায়’ মাটি খননের সময় ‘পুরাকীর্তি’র সন্ধান মেলে। পরে কুমিল্লা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর খনন কাজ শুরু করে।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, কুমিল্লা আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, তাদের চট্টগ্রাম ও সিলেট আঞ্চলিক দপ্তর এবং কুমিল্লার একটি দল এই খনন ও অনুসন্ধান কাজ পরিচালনা করছে।
আঞ্চলিক পরিচালক নাহিদ সুলতানার তত্ত্বাবধানে পরিচালিত সাত সদস্যের খনন দলে ফিল্ড অফিসার মো. আবু সাইদ ইনাম তানভীর, ময়নামতি জাদুঘরের কাস্টোডিয়ান মো. শাহীন আলম, গবেষণা সহকারী মো. ওমর ফারুক, সার্ভেয়ার চাইথোয়াই মার্মা ও আলোকচিত্রী শঙ্খনীল দাশ রয়েছেন।
বালাগাজী মুড়ায় খনন বিষয়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক নাহিদ সুলতানা বলেন, “প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব বিবেচনা করে প্রায় ৮০ বছর আগে কুমিল্লা জেলার সদর দক্ষিণ উপজেলায় অবস্থিত বালাগাজীর মুড়াকে সংরক্ষিত প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান ঘোষণা করা হয়। যা ১৯৪৫ সালের শিমলা গেজেটে প্রকাশ করা হয়।
“নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় নির্দেশনা অনুযায়ী এ বছর বালাগাজীর মুড়ায় খনন ও অনুসন্ধান কাজ পরিচালনা করা হচ্ছে।”
প্রত্নতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লালমাই পাহাড়ের শালবন বৌদ্ধ বিহারের দক্ষিণে এই প্রথম কোনো প্রত্নক্ষেত্র পাওয়া গেল। এটি খ্রিষ্টীয় সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীর কুমিল্লা ময়নামতি-অঞ্চলের ‘পট্টিকেরা’ জনপদের অংশ হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
পট্টিকেরা সমতটের পাঁচটি রাজধানীর একটি ছিল। ১০ থেকে ১২ একর এলাকাজুড়ে খনন করা গেলে শালবন বিহার, আনন্দ বিহার কিংবা রূপবান মুড়ার মত আরও একটি নিদর্শন উন্মোচিত হতে পারে। এমনকি ব্যাতিক্রমী কোনো নিদর্শন পাওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে।
কুমিল্লা ময়নামতি জাদুঘরের কাস্টোডিয়ান ও খননকার্য পরিচালনা দলের সদস্য মো. শাহীন আলম বলেন, “বড় বড় ইট দিয়ে তৈরি প্রায় ছয় ফুট চওড়া প্রাচীন একটি দেয়ালের অংশবিশেষ উন্মোচিত হয়েছে, যা হয়তো কোনো স্থাপনার কর্নার। খননকালে তিন-চার ফুট পুরু একাধিক মাটির স্তর সরানোর পরে সন্ধান মেলে প্রাচীন সভ্যতার ঐতিহ্যবাহী দেয়ালের এ ধ্বংসাবশেষ।”
“বালাগাজীর মুড়া নামে পরিচিত প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানটিতে উন্মোচিত প্রাচীন স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ লালমাই ময়নামতিতে আবিষ্কৃত হাজার বছর আগের প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান শালবন বিহার, আনন্দ বিহার, ভোজ বিহার, ইটাখোলা ও রূপবান মুড়ার প্রাচীন মন্দির ও বিহারের ধ্বংসাবশেষের সমসাময়িক হতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে মনে করছেন প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও অনুসন্ধান টিম। মাত্রই তো খনন ও অনুসন্ধান কাজ শুরু করা হয়েছে। সম্পূর্ণ খনন ও গবেষণা কাজ শেষ করার পরে বিস্তারিত জানা যাবে।”
তিনি বলেন, “বালাগাজীর মুড়া স্থানীয়দের কাছে ‘চারাবাড়ি’ নামে পরিচিত। মূলত এ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানটির উপরিভাগে প্রচুর চারা অর্থাৎ মৃৎপাত্রের ভগ্ন টুকরো থাকায় স্থানীয়ভাবে এ নাম হয়।”
খনন ও অনুসন্ধান কাজের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ফিল্ড অফিসার) মো. আবু সাইদ ইনাম তানভীর বলেন, “চলতি বছরের এপ্রিল মাসের প্রথম দিক থেকে বালাগাজীর মুড়ায় প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও অনুসন্ধান কাজ শুরু হয়েছে, যা আগামী জুন মাস পর্যন্ত চলবে।”
কুমিল্লার ইতিহাসবিদ আহসানুল কবির বলেন, “ধর্মপুরের বালাগাজী মুড়ায় যে প্রত্ননিদর্শন পাওয়া গেছে তা কোটবাড়ি এলাকায় শালবন বিহার, ইটাখোলা মুড়া, রূপবান মুড়াসহ যে সব নিদর্শন উন্মোচিত হয়েছে তার সঙ্গে সম্পর্কিত থাকারই সম্ভাবনা বেশি।
“লালমাই পাহাড়কে কেন্দ্র করেই যেহেতু সমতটের একটি রাজধানী, পট্টিকেরার অবস্থান ছিল, এটি সে সময়কার স্থাপনাও হতে পারে। তবে পুরো নিদর্শন উন্মোচিত হলে সব কিছু পরিষ্কার হবে।”
তিনি বলেন, “কুমিল্লা অঞ্চলে দেড় সহস্রাধিক বছরের ইতিহাস মাটির নিচে লুকানো আছে। যা এখনও আবিষ্কার হয়নি। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর বিচ্ছিন্নভাবে খোঁড়াখুঁড়ি না করে, একটি জায়গাকে পুরো প্রকল্প ধরে তার সম্পূর্ণভাবে উন্মোচন করা উচিত। না হয় পাঁচথুবী ইউনিয়নের মহন্তের মুড়ার মত অসম্পূর্ণ উন্মোচিত অবস্থায় অবহেলায় পড়ে থাকবে অমূল্য এসব নিদর্শন।”
ময়নামতি জাদুঘরের কাস্টোডিয়ান মো. শাহীন আলম বলছেন, “পুরো কুমিল্লাজুড়ে ৫০-৬০টির মত প্রত্নক্ষেত্র রয়েছে বলে প্রত্নতত্ত্ববিদরা অতীতে ধারণা করেছেন। এর মধ্যে লালমাই পাহাড়ি অঞ্চলে ২০টি প্রত্নক্ষেত্র রয়েছে। যার মধ্যে ১২টি প্রত্নক্ষেত্র খনন করে উন্মোচন করা হয়েছে।”