হিরো আলমে আবদ্ধ রাজনীতি: মুক্তি কোথায়?

ছেলেটিকে বাহবা দেই এই কারণে যে, এত বাধা-বিপত্তি, এত অপমান সে গায়ে মাখে না। তার নিজের গতিতে চলে বারবার আমাদের সমাজকে পরাস্ত করে। এবার নির্বাচনে দাঁড়িয়ে যে কাণ্ড করল তাতে আওয়ামী লীগ-বিএনপির মতো দলেরও ঘুম ছুটে গেছে।

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 11 Feb 2023, 07:59 AM
Updated : 11 Feb 2023, 07:59 AM

এখন মানুষের বিশেষত বাঙালির ভাষাও পাল্টে গেছে। আমাদের সময় উল্টোযাত্রা বলে একটা কথা ছিল। আমি জানি আজকের প্রজন্ম এর অর্থ বোঝে না। কিন্তু আমরা জানি উল্টোযাত্রা বিষয়টি কী এবং কী এর ফলাফল। বাংলাদেশে রাজনীতি মৃত না জীবিত তা বোঝার কিছু মাপকাঠি আছে। একসময় জনপ্রিয়তা যাচাই হতো মেধা ও ভোটের মাধ্যমে। এ কথা বলছি না যে যারা রাজনীতি করতেন তারা সকলে পিএইচিডি ডিগ্রিধারী কিংবা মাস্টার্স পাশ করে আসতেন। আপনি যদি অতীতে চোখ ফেরান দেখবেন স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়কালে যে চার খলিফার কথা বলা হয় তাদের সবাই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আগে-পরে সবসময় পড়াশোনা জানা ছাত্র-ছাত্রীরাই রাজনীতি করতেন। ছাত্র ইউনিয়ন ছিল এর পুরোধা। তখন যারা ছাত্র ইউনিয়ন কিংবা বামঘেঁষা রাজনীতি করতেন তাদের মূল বিষয় ছিল অধ্যয়ন আর আদর্শ। দিনকাল পাল্টেছে। এ কথা বলি না লেখাপড়া জানা মানুষ রাজনীতিতে নেই।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছিলেন কলেজের শিক্ষক। তারা পড়াশোনা জানা মানুষ। কিন্তু কালের শিকার। আর সে শিকারের ফলাফলে দেশ ও দেশের বাইরের বাঙালি পড়ে বিপদে। বেশ কিছুদিন ধরে হিরো আলম হয়ে উঠেছেন দেশের মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। সত্যি কথা বলতে কি গত এক দশকে আর কাউকে নিয়ে এমন তর্ক-বিতর্ক চোখে পড়েনি, যারা তাকে মন্দ বলে বা লেখাপড়া জানে না বলে তুচ্ছ করে তারাও মজে আছে হিরো আলমে। আর যারা ধান্দাবাজ বা আওয়ামীবিরোধী তাদের জন্য হিরো আলম পালে নতুন হাওয়ার মতো। তাকে ঘিরে জমে উঠেছে রাজনীতি। এর ফলাফল কী বা কী হতে পারে সবাই জানি। কিন্তু এর নামই উল্টোযাত্রা।

শুরুতেই বলি আমি হিরো আলমকে কুর্নিশ জানাই। সোশ্যাল মিডিয়ায় যারা আমাকে ফলো করেন বা সাথে থাকেন তারা জানেন আমি গোড়া থেকেই তার প্রতি সহানুভূতিশীল। কারণ তৃণমূল থেকে উঠে আসা যে কাউকে আমি সালাম জানাই। আমাদের জনবহুল সমাজে যখন কেউ নাম করে বা নাম কুড়ায় তখন এটা মাথায় রাখা উচিৎ ওই মানুষটির ভেতর নিশ্চয়ই কিছু আছে। কোটি মানুষের ভেতর যে উঠে আসে সে ব্যতিক্রম। তার ভেতরে এমন কিছু না কিছু থাকে যা সাধারণ মানুষকে ভাবায়। হিরো আলমের উঠে আসা তেমনই। সে প্রান্তিক শ্রেণির মানুষ। ভালো বাংলায় কথা বলতে শেখেনি। তার রুচি নিয়ে যারা প্রশ্ন তোলেন তাদের কাছে জিজ্ঞাসা আপনি আপনার রুচি ও শিল্পবোধ নিয়ে ঘরের কোণায় লুকিয়ে কেন? আপনি কি স্বার্থপর না ভীতু? আমি আমার এই দীর্ঘ লেখালেখির বয়সে দেখেছি একটু নামধাম হলেই দেশের মানুষজন গম্ভীর হয়ে যায়। তাদের চাইতে বয়সে ছোট বা পিছিয়ে পড়া মানুষজনের সাথে ভদ্র আচরণ করে না। নিজের জ্ঞান বা জানাশোনা জাহির করে মঞ্চে। আর কাউকে এতটুকু আলোকিত করার বাসনা না রাখা আমি-আপনি হিরো আলমকে কী দিয়েছি? সে হিসেবটা করেছেন কখনো?

সে যখন রবীন্দ্রনাথের গান ভুল ভাবে গাইল, আমরা ফেটে পড়লাম। তাকে টিভিতে এনে অপমানও করলাম। কিন্তু একবারও ভাবলাম না ওর জনপ্রিয়তার কারণে রবীন্দ্রনাথের ওই গানটি যখন ভাইরাল, তখন তাকে একটু শুধরে দেই। তাকে বোঝানো যেতে পারত। শুদ্ধ বাংলায় কথা বলার জন্য অনুপ্রাণিত করা যেতে পারত। কিন্তু এসবে মন নেই আমদের। ছেলেটিকে বাহবা দেই এই কারণে যে, এত বাধা-বিপত্তি, এত অপমান সে গায়ে মাখে না। তার নিজের গতিতে চলে বারবার আমাদের সমাজকে পরাস্ত করে। এবার নির্বাচনে দাঁড়িয়ে যে কাণ্ড করল তাতে আওয়ামী লীগ-বিএনপির মতো দলেরও ঘুম ছুটে গেছে।

পরাজিত হয়ে কেউ এমন তোলপাড় করতে পারে আগে আমরা দেখিনি। বিএনপির অনেক বাঘা-বাঘা নেতারা পরাজিত হলেন। তাদের ভাষায় জোর করে হারানো হলো। এমনকি আমরা বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না এদের কারও কারও জামানত বাজেয়াপ্ত হতে পারে। তারপরও কিছুই হয়নি। বুদবুদ উঠেই মিলিয়ে গেছে। এদিকে হিরো আলম হারার পর আমি ইউটিউবে ওই এলাকার মানুষের মতামত দেখলাম। তারা সরকারি দলের সমালোচনার পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনের পিণ্ডি চটকে ছেড়েছে। একজন বলল, হিরো আলম না দাঁড়ালে নাকি সেন্টারগুলোয় কুকুর ছাড়া মানুষই থাকত না। এরপর কী বলবেন? প্রশ্ন হচ্ছে নির্বাচন ও ভোটাভুটি নিয়ে এমন মানসিকতা কি হিরো আলম তৈরি করেছে? নাকি এর দায় রাজনীতির?

যে ভাবেই হোক হিরো আলম ভোটে হেরেছে। হারার পর কী দরকার ছিল তাকে নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করার? যা পরবর্তীতে গলার কাঁটা হতে পারে? অন্যদিকে বিএনপি তো সুযোগ নেবেই। তাদের মহাসচিব হিরো আলমের কাঁধে বন্দুক রেখে শিকার করতে চেয়েছেন। আর ওই ফাঁদে পা দিয়েছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের মতো দলের সাধারণ সম্পাদকের কাছে মানুষ কি এই কথাগুলো প্রত্যাশা করে? বাংলাদেশ জন্মের সাথে জড়িত এবং নেতৃত্ব দেয়া দলের কথা ও আচরণ হওয়া উচিৎ অন্যদের জন্য মানদণ্ড। অথচ যুগের হাওয়ায় আজ তা বদলে গেছে। নির্বাচনের স্বচ্ছতা আর ভোটের জন্য মরিয়া আওয়ামী লীগের অতীত যারা জানেন তাদের বিশ্বাস করা কঠিন ওই দলটি এখন নির্বাচন, ভোট ও ফলাফলের প্রশ্নে চূড়ান্তভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। রাজনীতির বাইরে থাকা হিরো আলমের মতো একজন ইউটিউবারও চ্যালেঞ্জ জানিয়ে তার সাথে ভোটযুদ্ধে লড়াই করার ডাক পাঠাতে সাহস পায়।

রাজনীতির অধপতন মানুষকে এটাও ভুলিয়ে দিয়েছে একজন সংসদ সদস্য মানেই একজন আইন প্রণেতা। হিরো আলম বলছেন যে, সবাই নির্বাচনে দাঁড়াতে পারে। এবং তা সত্যি বলেই তিনিও হাইকোর্টে আবেদন করে ভোটে দাঁড়াতে পেরেছেন। প্রশ্ন সেখানে না। প্রশ্ন হচ্ছে জিতলে হিরো আলম কি পারতেন আইন প্রণয়নে সাহায্য করতে? জানি অনেকে বলবেন সংসদে এমন অনেকে আছেন যারা ভালো করে কথা বলতে পারেন না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নাম বলতে পারেন না। বাংলা ভাষায়ও অপটু তারা। সেখানে হিরো আলমকে বেমানান মনে হবে কেন? এ প্রশ্নের উত্তর যতদিন না পাবো, ততদিন হিরো আলম তুঙ্গে। তাই তার বিরুদ্ধে বলার আগে ভাবা দরকার ছিল। এখন বল চলে গেছে হাতের বাইরে।

হিরো আলম দোষেগুণে বিখ্যাত। তার জনপ্রিয়তার মূল জায়গা মানুষ। আমজনতা। এরা তেমন একটা রাজনীতি বোঝে না। দল বোঝে কিনা জানি না, তবে আওয়ামীবিরোধী। সারাদেশে এই হাল এখন বাস্তবতা। কাজেই নির্বাচনের আগে সাবধানতা প্রয়োজন। ওই যে বলেছিলাম উল্টোযাত্রার কথা, হিরো আলম তার রথে আছেন এখন। রাজনৈতিক দলগুলো যার যার খেয়াল-খুশি মতো তাকে ব্যবহার করতে চাইবে এটাই স্বাভাবিক। তার রুচি ও মান নিয়ে প্রশ্ন তোলার আগে তাই নিজেদের রুচি, মান ও মানদণ্ড ঠিক রাখাটা জরুরি।

আমাদের দেশ ও সমাজে সবাই সমান এটা যেমন ভাবা দরকার তেমনি যার যেখানে অবস্থান, যার যা অবদান বা দেয়ার যোগ্যতা তাও যেন মেনে চলা হয়। তা না হলে স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরি কোনোদিন সম্ভব হবে না। অযথা তর্কে ডুবে যাবে ভবিষ্যত।