ভিন্নমতকে ধারণ করতে হবে। যুক্তি দিয়ে যুক্তির মোকাবিলা করতে হবে। জোরের যুক্তি দিয়ে জুলুমবাজি দিয়ে কোনো মহৎ কিছু করা যায় না। সামাজিক বিভেদও দূর করা যায় না।
Published : 06 Sep 2024, 08:07 PM
না, আপনাকে ঠিক এপাশে থাকতে হবে। না হলে ওপাশে। আপনি হয় এই দল। না হলে ওই দল। দলনিরপেক্ষ কিংবা এদল-ওদলের মাঝামাঝি থাকার কোনো সুযোগ নেই। আমাদের দেশে ক্রমেই আমরা এমন এক সংস্কৃতি নির্মাণ করছি, যেখানে আসলে দলনিরপেক্ষ বা মাঝামাঝি থাকার কোনো অপশন বা সুযোগ নেই।
আপনি যদি ভাবেন, আপনি যথেষ্ট নিরপেক্ষ, আপনি এদল কিংবা সেদল বোঝেন না, একজন নাগরিক হিসেবে যেকোনো দলের ভালো কাজের প্রশংসা করেন, আর খারাপ কাজের সমালোচনা করেন, তাহলেও আপনাকে রেহাই দেওয়া হবে না। যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল, তখন তাদের সমালোচনা করলে বলা হতো, ‘স্বাধীনতাবিরোধী’, ‘বিএনপি-জামায়াতের দোসর’। আর তা না করলে কিংবা কোনো ভালো উদ্যোগের প্রশংসা করলে বলা হতো আওয়ামী ফ্যাসিবাদের দোসর। এখন অবশ্য আরো অনেক কিছুই বলা হয়। কেউ একজন ব্যঙ্গ করে বলেছেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর বাঙালি এখন বনলতা সেন হয়ে গেছে। কিছু বললেই বলে: ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
সরাসরি সত্য বলার মধ্যে অনেক ঝুঁকি আছে। বুদ্ধিমান মানুষ সেই ঝুঁকি নিতে চান না। বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেকেই তাই রসিকতার আশ্রয় নিচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি রসিকতা খুবই জনপ্রিয় হয়েছে। ‘নাস্তা খাওয়ার সময় বুয়াকে বললাম, ভাজিতে লবণ কম হয়েছে। বুয়া বলল, ১৫ বছর কোথায় ছিলেন? কখন তো কোনো অভিযোগ শুনি নাই!’
সামাজিক মাধ্যম জুড়ে এমন রসিকতার ছড়াছড়ি। তবে কেউ কেউ অনেক অপ্রিয় সত্য কথাও সাহস করে লিখছেন। এক তরুণ গল্পকার লিখেছেন, ‘যখন রিক্সাচালক আন্দোলনকারীদের স্যালুট দিল, তখন সে হয়ে গেলো বৈষম্যবিরোধী। আর যখন সে দাবি জানালো হয়ে গেলো আওয়ামী লীগ!’ আসলে এখন একমুখী, একচোখা দৃষ্টিভঙ্গিরই জয়-জয়কার চলছে। ক্ষমতাকে প্রশ্ন না করা বা চলমান ব্যবস্থাকে পাকাপোক্ত করার এটা অবশ্য একটা কৌশল। ক্ষমতাবানরা সবসময়ই বিরুদ্ধমতকে দমন করতে চায়। কখনো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দিয়ে। কখনো গোয়েন্দাদের দিয়ে তুলে নিয়ে গিয়ে। কখনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমষ্টিগতভাবে অপমান-ঘৃণা ছড়িয়ে। আগামীদিনে যাতে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কেউ কোনো কথা বলতে না পারে, সে জন্য এই কৌশল হতে পারে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করলেই সে ‘লীগ’ হয়ে যাবে। আগে যেমন হতো বিএনপি-জামায়াত! জামায়াত-শিবিরের দালাল, বিএনপির দালাল, লীগের দালাল, ভারতের দালাল, নাস্তিক, শাহবাগী এমন ট্যাগ লাগিয়ে দিয়ে আসলে একদল মানুষের প্রতিবাদী সত্তাটাকে দুর্বল করে দেওয়া হয়। অন্যায় ও পীড়নকেই বৈধ করে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়।
অথচ গণঅভ্যুত্থানের পর কতজন কত স্বপ্ন দেখেছিল। গণঅভ্যুত্থানের নেতারাও অনেক কথা বলেছিলেন। কথা ছিল সব চিন্তা ও মতের জন্য একটা গণতান্ত্রিক পরিসর নির্মাণ করা হবে। সবাই সব কথা নির্ভয়ে উচ্চস্বরে বলতে পারবে। একটা ‘ইনক্লুসিভ বাংলাদেশ’ গঠন করা হবে। গায়ের জোরে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে রাখা স্বৈরশক্তি প্রতিবাদ-আন্দোলন দমন করতে শত শত মানুষকে হত্যা করেছে। রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়েছে। শত শত মানুষ পঙ্গু হয়ে গেছে। পুরো দেশটা তছনছ হয়ে গেছে। বিপুল রক্তপাত, ক্ষত ও ক্ষতির বিনিময়ে এক ফ্যাসিবাদী শাসককে বিদায় করে আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারিনি। আবারো একটা একটা সামষ্টিক হুজুগেপনা দেশের নিয়ামক শক্তি হয়ে উঠেছে। যা ভয়াবহ! আরেকটা স্বপ্নভঙ্গের মিনারের সামনে দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে দাঁড় করিয়েছে।
দেশে এক অদ্ভুত তন্ত্র কায়েম হয়েছে। একে বলা যায় ‘মাটিয়ে মিশিয়ে দেওয়ার তন্ত্র।’ গণঅভ্যুত্থানের পর এখন যারা মৌতাতে মাতোয়ারা রয়েছে, তারা যেকোনো সমালোচক বা তাদের অপছন্দের কাউকে পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ছে। নানা বদনাম ও কলঙ্ক দিয়ে তাকে সামাজিকভাবে নিঃশেষ করে দেওয়ার উল্লাসে মেতেছে। তাদের কাছে অপকর্ম মানেই যেমন যেমন লীগ, প্রতিবাদ মানেও লীগ। অপকর্মের সঙ্গে আওয়ামী লীগকে মিলিয়ে দেখাটা নির্মম হলেও নিরর্থক নয়। এর পেছনে জোরাল কারণ আছে। কিন্তু প্রতিবাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগকে মিলিয়ে ফেলাটা কী ঠিক? বঞ্চিত আনসার সদস্যরা তাদের প্রতি সংঘটিত অন্যায় ও বৈষম্যের প্রতিবাদ জানাবে না? রিকশাচালক কিংবা ব্যাটারি চালিত রিকশাচালকের কি দাবি জানানোর অধিকার নেই? তারা প্রতিবাদ করবে না? শিক্ষক, ডাক্তার গার্মেন্টস শ্রমিক বা অন্যান্য পেশাজীবীরা কি ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য প্রতিবাদী হবে না? প্রতিবাদী হলেই তারা রিকশা লীগ, আনসার লীগ, ব্যাটারি লীগ, শিক্ষক লীগ, ডাক্তার লীগ, গার্মেন্টস শ্রমিক লীগ হয়ে যাবে?
অথচ যারা এখন এমন ‘চরমপন্থী’ দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাব পোষণ করছেন, মাত্র মাসখানেক আগেই কিন্তু তারা একটা বড় রক্তক্ষয়ী আন্দোলনে বিজয়ী হয়ে এসেছেন। বৈষম্যমুক্ত দেশ গড়ার অঙ্গীকার নিয়েই তাদের অভিযাত্রা শুরু হয়েছে। কথা বলার সুযোগও যেন আরো সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে। কথা বললেই রে-রে করে তেড়ে আসছে কিছু মানুষ। সম্মিলিত অবিমৃষ্যকারী ভূমিকার কারণে গণমাধ্যমগুলো সব ‘বিটিভি’ হতে চলেছে বলে অনেকেই মনে করছেন। গত ২৫ দিনে অনেক খবরই গণমাধ্যমে আসেনি। যার সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত গাজী টায়ার কারখানায় আগুনের ঘটনা। সেখানে প্রায় ২০০ মানুষ নিখোঁজ হলেও ওই ব্যাপারে খবরটা যেমন হওয়ার কথা ছিল, বেশির ভাগ গণমাধ্যমেই তেমনটা আসেনি। অথচ অন্তত ১৫ দিন এটাই সকল গণমাধ্যমের সংবাদ-শিরোনাম হওয়ার কথা ছিল। এসব কথা বললেই ‘আফসোস লীগ’ ‘হতাশ লীগ’, ‘জাস্টিফিকেশন লীগ’, ‘সুশীল লীগ’, ‘গুজব লীগ’, ‘হিন্দু লীগ’, ‘হায় হায় লীগ’ ইত্যাদি ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়া হয়। এসব দেখেশুনে অনেকে সত্যি সত্যি ‘গর্তে’ লুকিয়েছেন। সেধে অপমানিত হতে চায় কয়জন?
একথা অস্বীকার করা যাবে না যে, দেশের একটা বড় অংশের মানুষই কোনো রাজনৈতিক দলের অনৈতিক সুবিধাভোগী নয়। বরং তারা উভয় দিক থেকেই চোখরাঙানি ও দাবড়ানি খাওয়া ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকায়। তারা আসলে ঘরেও না। পাড়েও না। তারা মাঝখানে। তাদের সমস্যাটা একটু অন্যরকম। আমরা যদি বিশ্বাস করে থাকি আমাদের দেশে যে গণতান্ত্রিক প্রথা চালু আছে তাতেই আমাদের অস্তিত্ব সুরক্ষিত, এটাই আমাদের সিস্টেম, এতেই আমাদের ভরসা, তা হলে আমরা যেন ভিন্নস্বরকে মেনে নিই। মাঝখানে থাকা মানুষগুলোকে ট্যাগ লাগিয়ে কোণঠাসা না করি।
ভিন্নমতকে ধারণ করতে হবে। যুক্তি দিয়ে যুক্তির মোকাবিলা করতে হবে। জোরের যুক্তি দিয়ে জুলুমবাজি দিয়ে কোনো মহৎ কিছু করা যায় না। সামাজিক বিভেদও দূর করা যায় না। অনেকে বলেন, এত বড় বিপ্লবের পর এমন একআধটু হয়েই থাকে। তাদের প্রতি করজোরে নিবেদন, তাহলে আসুন আমরা গণমাধ্যমগুলো উন্মুক্ত করে দিই। আমাদের যার যা বক্তব্য উজাড় করে বলতে পারি, লিখতে পারি যে— সেটা নিশ্চিত করি। তর্কের মাধ্যমে আমরা সহ্যশক্তি একইসঙ্গে নিজেদের পক্ষে যুক্তি শাণিত করি। নাগরিক হিসেবে কতটা সহ্য করা উচিত আর কতটা নয়, যা খুশি বিতর্ক করতে পারি সহ্যশক্তির কাম্য অনুপাত বাড়াতে। মানুষ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেবে, না ভণ্ডামির অভিজ্ঞতা বাজিয়ে দেখবে, ওই সিদ্ধান্ত নেবার সুযোগটা অন্তত করে দিই।
মানুষকে কখনো এক ছাতার তলায় আনা সম্ভব নয়। ট্রল করে, অপমান করে, মেরে, পিটিয়ে কিছুতেই নয়। কোনো দিনই কোনো একটি ‘চরমপন্থী’ বিশ্বাস বিশালসংখ্যক মানুষকে প্রভাবিত করে একটি ছাতার তলায় নিয়ে আসতে পারেনি— তা বামপন্থীদের শ্রেণিসংগ্রামই হোক কিংবা উগ্রবাদী ধর্মীয় আদর্শই হোক। বেশিরভাগ মানুষই চরমপন্থী নন, নির্দিষ্ট দলপন্থীও নন, তারা মধ্যপন্থায় বিশ্বাস করেন। তাদের মতামতকে সম্মান করতে হবে।