আর্জেন্টিনা, রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো

আর্জেন্টিনায় দু-মাস অবস্থানকালে কবিগুরু প্রায় ৩০টি কবিতা রচনা করেন। চৌত্রিশ বছর বয়সী ওকাম্পোকে তিনি ‘বিজয়া’ বলে ডাকতেন। এ বিজয়াকে তিনি তার ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করেছিলেন।

সুজন চৌধুরীসুজন চৌধুরী
Published : 11 Dec 2022, 09:47 AM
Updated : 11 Dec 2022, 09:47 AM

“আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী
তুমি থাক সিন্ধুপারে ওগো বিদেশিনী”

একদিন ‘আমি চিনি গো চিনি’ বলে যে ‘বিদেশিনী’র কল্পনা করেন রবীন্দ্রনাথ, কে জানত ঠিক ত্রিশ বছর পর সেই বিদেশিনীর সাথে দেখা হবে হাজার মাইল দূরে বুয়েনস আইরেসে!

১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্যে নোবেল পেলেন। এশিয়ায় এই প্রথম কোনো নোবেল পুরস্কার। গীতাঞ্জলি ইংরেজির পাশাপাশি স্প্যানিশ, ফরাসিসহ বহুভাষায় অনূদিত হয়। বিশ্বব্যাপী কবিগুরুর নাম ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৩০ সালের মধ্যে কবিগুরু পাঁচটি মহাদেশের প্রায় ত্রিশটি দেশ ভ্রমণ করেন। সাহিত্য-দর্শন-শিল্পকলা-রাজনীতিসহ নানা বিষয়ে বিভিন্ন সভা-সেমিনারে বক্তব্য রাখেন।

১৯১৪ সালে বুয়েনস আইরেসে বসে গীতাঞ্জলি-এর ফরাসি অনুবাদ পড়ে মুগ্ধ হন আর্জেন্টিনার বিখ্যাত সাহিত্যিক ও নারীবাদী লেখিকা Victoria Ocampo. স্রষ্টার প্রতি নিবেদিত অধ্যাত্মিক প্রেমের এ গানগুলি যেন ওকাম্পোর জীবনে গভীর দাগ কাটে। ইতোমধ্যে ঘটে ওকাম্পোর বিবাহ-বিচ্ছেদ। গীতাঞ্জলি তার জীবনে নিয়ে আসে নব-প্রাণ। এ যেন জীবনের গান, প্রেমের গান, আত্মোৎসর্গের গান। গীতাঞ্জলি পড়ে গীত নয়, যেন গীতিকারের প্রেমে পড়েন ওকাম্পো! অধীর আগ্রহে প্রহর গোনেন কবে দেখা হবে গীতিকারের সাথে!

১৯২৪ সাল। পেরু সরকারের আমন্ত্রণে পেরুর স্বাধীনতা সংগ্রামের শতবর্ষ উদযাপনে যোগ দিতে যাচ্ছেন তেষট্টি বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ। ভারত মহাসাগর, আটলান্টিক মহাসাগর হয়ে পেরুর পথে দীর্ঘ এ সমুদ্রযাত্রায় ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন কবি। থামেন আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আইরেসে। ওঠেন সান ইসিদ্রো নামক ছোট্ট শহরতলির এক হোটেলে। এ খবর ছড়িয়ে পড়ে আর্জেন্টিনার সাহিত্যমহলে। ছুটে যান ওকাম্পো। একনজর দেখবেন সেই গীতিকারকে যার গীত তাকে করেছে ঋদ্ধ, করেছে খাঁটি, দিয়েছে জীবনের সন্ধান। কবির অসুস্থতায় তিনি উদ্বেলিত হন। কবিকে সুস্থ করার জন্য হোটেল থেকে রিও ডি প্লাতা নামক নদীর ধারে একটি বাগানবাড়িতে নিয়ে আসেন।

কবিগুরু যেন এবার গেয়ে উঠলেন–

“ভুবন ভ্রমিয়া শেষে আমি এসেছি নূতন দেশে
আমি অতিথি তোমারি দ্বারে ওগো বিদেশিনী”

কবিগুরুর সেবাযত্নের কোনো ঘাটতি রাখেননি এ ‘বিদেশিনী’। রবীন্দ্রনাথ প্রায় দু-মাস কাটান আর্জেন্টিনায়। কবিগুরুকে ঘিরে আর্জেন্টিনার সাহিত্যিকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে ব্যপক উৎসাহ-উদ্দীপনা। কবিগুরুর সাথে ওকাম্পোর আলাপ শুধু সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও দর্শনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, দু-জনের মধ্যে রচিত হয়েছে গভীর বন্ধুত্ব, সহমর্মিতা ও মমত্বের বন্ধন। কবিগুরুর প্রতি ওকাম্পোর কিংবা ওকাম্পোর প্রতি কবিগুরুর ভালোবাসা জাগতিক ভালোবাসার উর্ধ্বে, যাকে ‘platonic love’ বলে অভিহিত করেছেন অনেকেই। আর্জেন্টিনায় দু-মাস অবস্থানকালে কবিগুরু প্রায় ৩০টি কবিতা রচনা করেন। চৌত্রিশ বছর বয়সী ওকাম্পোকে তিনি ‘বিজয়া’ বলে ডাকতেন। এ বিজয়াকে তিনি তার ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করেছিলেন। বিজয়া ও রবীন্দ্রনাথ পরপস্পকে মনে রেখেছেন আজীবন। তাদের মধ্যে প্রায় অর্ধশত চিঠি চালাচালি হয় যার সাহিত্যমূল্য অনেক। কবিতা লিখতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের খাতা-কলমের কাটাকাটিতে মূর্ত হয়ে উঠত বিচিত্র ছবি। রবীন্দ্রনাথের আকা ছবির ভক্ত ছিলেন ওকাম্পো। ১৯৩০ সালে প্যারিসে রবীন্দ্রনাথের চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন ওকাম্পো। প্যারিসেই দ্বিতীয় এবং শেষবার মুখোমুখি হন দুই মহান হৃদয়।

ওকাম্পো কখনো বাংলায় আসেননি কিন্তু বাংলার প্রতি তার ভালোবাসা সহজে অনুমান করা যায়। ১৯৭১ সালে ৮১ বছর বয়সেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার সপক্ষে আর্জেন্টিনায় মিছিল-সমাবেশ করে জনমত গঠন করেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। ১৯৭৮ সালে এ মহান আর্জেন্টাইন সাহিত্যিকের প্রয়াণ। বাঙলায় তার কোনো স্মৃতি নেই। হয়তো রবীন্দ্র সঙ্গীত-সাহিত্য-চিত্রকর্মেই লুকিয়ে আছেন এই আর্জেন্টাইন সাহিত্যিক। কবিগুরুর ভাষায়–

“দিনেকের দেখা, তিলেকের সুখ
ক্ষণেকের তরে শুধু হাসিমুখ
পলকের পরে থাকে বুক ভ’রে
চিরজনমের বেদনা।

তারি মাঝে কেন এত সাধাসাধি
অবুধ আঁধারে কেন মরি কাঁদি
দূর হতে এসে ফিরে যাই শেষে
বহিয়া বিফল বাসনা”