ড্যান মজিনা যখন বাংলাদেশে একটি নতুন রাজনৈতিক দলের উত্থান ঘটতে পারে বলে মন্তব্য করলেন, তখনও দেশের অধিকাংশ মানুষ এটি কল্পনাও করেনি যে শেখ হাসিনার মতো একজন প্রবল পরাক্রমশালী শাসককে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সরিয়ে দেওয়া যাবে।
Published : 13 Nov 2024, 07:32 PM
গত জুলাই মাসের শেষ দিকে যখন সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনটি গণঅভ্যুত্থানে রূপ নিল এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের গদি নড়বড়ে হয়ে গেল, তখন বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা যুক্তরাষ্ট্রের টাইম টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক দলের উত্থান ঘটতে পারে। আবার পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলোও পুনরুজ্জীবিত হতে পারে। এটা হতেও পারে, না-ও হতে পারে।” অর্থাৎ তিনি কথাগুলো বলেছেন খুব কৌশলে।আবহাওয়ার পূর্বাভাসের মতো– বৃষ্টির সম্ভাবনার মতো, বৃষ্টি হতে পারে, নাও হতে পারে। এই ধরনের কথাকে অর্থহীন মনে করা হলেও রাজনীতি ও কূটনীতিতে এই মাঝামাঝি কথারও গুরুত্ব অনেক। বিশেষ করে যখন এই ধরনের কথা কোনো মার্কিন কূটনীতিক বলেন।
ড্যান মজিনা ওই সাক্ষাৎকারে বলেন, “বাংলাদেশে কয়েক দশক ধরে রাজনৈতিক অচলাবস্থা চলছে। এটা ভাঙা উচিত। এ জন্য প্রয়োজন অর্থপূর্ণ সংস্কার।” এখানে ‘অচলাবস্থা’ ও ‘সংস্কার’ শব্দ দুটি খেয়াল করা দরকার। সাম্প্রতিক অভ্যুত্থানে যেসব স্লোগান উচ্চারিত হয়েছে, যেসব কথা বলা হয়েছে, যেসব সংকটের সমাধান দাবি করা হয়েছে তার অন্যতম এই রাজনৈতিক অচলাবস্থা। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার আড়ালে একদলীয় শাসনের ভেতরে ঢুকে দেশের রাজনীতিতে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল এবং সেখান থেকে বের হওয়ার জন্য যে বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন— ওই কথাটি অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আছে।
এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত শব্দগুলোর একটি হলো ‘সংস্কার’। অতএব একজন মার্কিন কূটনীতিক যখন অচলাবস্থা ও সংস্কার শব্দ ব্যবহার করেন, তখন বুঝতে হবে তিনি বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত এবং এখানে কী হচ্ছে ও কী হতে যাচ্ছে, সে বিষয়ে তিনি ওয়াকিবহাল।তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের ধারণাটি এখন আর গোপন কোনো বিষয়ও নয়।
বাস্তবতা হলো, ড্যান মজিনা যখন বাংলাদেশে একটি নতুন রাজনৈতিক দলের উত্থান ঘটতে পারে বলে মন্তব্য করলেন, তখনও দেশের অধিকাংশ মানুষ এটি কল্পনাও করেনি যে শেখ হাসিনার মতো একজন প্রবল পরাক্রমশালী শাসককে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সরিয়ে দেওয়া যাবে এবং আওয়ামী লীগের মতো একটি বিরাট দলকে ক্ষমতাচ্যুতই শুধু নয় বরং দলটির শীর্ষ থেকে মাঝারি পর্যায়ের অধিকাংশ নেতাকে দেশ ছেড়ে পালাতে হবে অথবা আত্মগোপনে চলে যেতে হবে।
বিএনপি-জামায়াতের পুনরুত্থান
রাজনীতিতে যে শেষ কথা বলে কিছু নেই তার বড় উদাহরণ বিএনপি ও জামায়াত। এই দুটি দলকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করে দিতে আওয়ামী লীগ শাসনামলের ১৫ বছরে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেই বিএনপি এখন দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দল। আর ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাসহ নানা অভিযোগে যে জামায়াতে ইসলামী একসময় বাংলাদেশের রাজনীতিতে অঘোষিতভাবে নিষিদ্ধ ছিল— ওই দলটি এখন এতটাই প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে যে, অনেকেই এটা মনে করেন আগামী নির্বাচনে তারা হয়তো এককভাবেই তিনশ আসনে প্রার্থী দেবে এবং অনেক আসনে জয়লাভ করবে। অতি উৎসাহী কেউ কেউ এরকমও মনে করেন যে, আগামী নির্বাচনে জামায়াত সরকার গঠনের মতো আসনও পেয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় এটি এখন পর্যন্ত সম্ভব নয় বলেই মনে হয়। তবে এটা ঠিক যে, জামায়াত এখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে বড় ফ্যাক্টর।
জনপরিসরে ভেতরে ভেতরে এরকম আওয়াজ অনেক দিন ধরেই আছে যে, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি দেখা হয়েছে। তারা পরীক্ষিত দল। প্রতিটি দলই একাধিক মেয়াদে ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু প্রত্যেকেই জনগণের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। দেশকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে নিয়ে যেতে পারেনি। অতএব এবার নতুন কেউ আসুক। মনে মনে এই চাওয়াটি হয়তো অনেকেরই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, পরীক্ষিত এই তিন দলের বাইরে আর কোন দলের ওপর দেশের মানুষ আস্থা রাখবে, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মতো ধর্মভিত্তিক দলের ওপর নাকি গত জুলাই-অগাস্টের অভ্যুত্থানে দৃশ্যত যারা নেতৃত্বে ছিলেন, সেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং তাদের সঙ্গে যুক্ত মানুষেরা এমন একটি রাজনৈতিক দল গঠন করবেন— যাদের জনপ্রিয়তার সামনে পরীক্ষিত তিনটি দল তো বটেই, ধর্মভিত্তিক বড় দলগুলোও ম্লান হয়ে যাবে? নাকি বড় নেতা হিসেবে পরিচিত মানুষদের ছোট দলগুলো স্রোতের বিপরীতে গিয়ে একটা নতুন সমীকরণ তৈরি করবেন? অর্থাৎ বাংলাদেশে সত্যিই একটি নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান তথা জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠনের সম্ভাবনা আসলে কতটুকু?
জাতীয় নাগরিক কমিটি
গণঅভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগের পতনের মাস দেড়েক পরেই ৫৫ সদস্যের ‘জাতীয় নাগরিক কমিটি’ নামে যে ‘অরাজনৈতিক’ সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে, তার আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী এবং সদস্যসচিব আখতার হোসেন— যারা ওই অভ্যুত্থানে সক্রিয় ছিলেন। এর মধ্যে নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী এবি পার্টির সহকারী তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্র ফেডারেশনেরও সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন তিনি। আর আখতার হোসেন গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির আহ্বায়ক। তিনি ডাকসুর সাবেক সমাজসেবা সম্পাদক।
এই কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন কমিটি ঘোষণার পর বলেন, জাতীয় নাগরিক কমিটি একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠনের মাধ্যমে কাজ শুরু করছে। অচিরেই সব মহানগর, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের অংশগ্রহণকারী সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় নেতৃত্ব এবং বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষের সঙ্গে তারা আলোচনা করবে। তৃণমূল পর্যন্ত এ কমিটির বিস্তৃতি ঘটানোর মাধ্যমে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের শক্তিকে সংহত করে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে পুনর্গঠনের লক্ষ্যে কাজ করে যাবে।
নাগরিক কমিটির তরফে যে আটটি প্রাথমিক কাজের কথা তুলে ধরা হয়, সেখানে একটি ছিল এরকম— গণপরিষদ গঠন করে গণভোটের মাধ্যমে নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান তৈরির জন্য গণ-আলোচনার আয়োজন করা।
তার মানে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত হয়ে তারা জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেবে, এটি হয়তো তাদের লক্ষ্য নয় বা হলেও তারা এখনই সেটি বলছে না। বরং তাদের প্রাথমিক কর্মসূচিতে মনে হচ্ছে তারা অন্তর্বর্তী সরকারকে ট্র্যাকে রাখার জন্য একটি চাপপ্রয়োগকারী শক্তি তথা ছায়া বিরোধীদল হিসেবে কাজ করতে চায়। তবে ভবিষ্যতে তারা যে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত হয়ে রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে না— তা এখনই বলা কঠিন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন
সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থানে বিএনপি, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন, হেফাজতে ইসলামসহ বিভিন্ন বাম ও অন্যান্য দল অংশগ্রহণ করলেও দৃশ্যত এর নেতৃত্বে ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। যে কারণে এই অভ্যুত্থানকে বলা হয় ছাত্র-জনতার আন্দোলন। অর্থাৎ এই আন্দোলনে ছাত্ররা মুখ্য ভূমিকা পালন করলেও বিরাট সংখ্যক শিক্ষক, সাধারণ মানুষ ও রাজনৈতিক দলেরও যে এখানে সমর্থন ও অংশগ্রহণ ছিল সেটি বোঝানোর জন্য এককথায় এটিকে বলা হচ্ছে ছাত্র-জনতার আন্দোলন।
মূলত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারাই আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি ঠিক করেছেন। তাদের মধ্যে কয়েকজনের নাম এখন সারা দেশের মানুষ জানে। তাদের তিনজন (মাহফুজ আলম, নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ) এখন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদেও আছেন। আলোচিত নেতাদের মধ্যে হাসনাত আবদুল্লাহ ও সারজিস আলমও এখন দৃশ্যত আখতারদের নাগরিক কমিটির মতো ছায়া বিরোধীদলের ভূমিকা পালন করছেন। তারা প্রতিনিয়তিই অন্তর্বর্তী সরকারের নানা কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করছেন। এমনকি সম্প্রতি তিনজন উপেদষ্টা নিয়োগের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তাদের নেতৃত্বে বিক্ষোভও হয়েছে।
বলা হচ্ছে, আগামী জাতীয় নির্বাচনে এই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াবে। যার কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে তাদের জেলা কমিটি গঠন শুরুর মধ্য দিয়ে। গত ২ নভেম্বর কুষ্টিয়া জেলায় ১১১ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে সংগঠনের জেলা পর্যায়ে কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, পর্যায়ক্রমে অন্য জেলাগুলোতেও কমিটি গঠন করা হবে।
এটিও এখন পর্যন্ত নাগরিক কমিটির মতো অরাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম এবং তারা যে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত হয়ে রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে না তা এখনই বলা কঠিন। জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে মূল তফাৎ হলো নাগরিক কমিটিতে ছাত্রদের বাইরে মূলত নাগরিক সমাজের নানা শ্রেণিপেশার মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে। আর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কমিটি করা হচ্ছে মূলত শিক্ষার্থীদের নিয়ে। তার মানে ভবিষ্যতে এই দুটি সংগঠন একত্র হয়ে যদি কোনো একটি রাজনৈতিক দল গঠন করে, সেটিও অসম্ভব নয় বলে অনেকে মনে করেন।
যদিও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দল গঠনের বিষয়টিকে গুজব বলে উড়িয়ে দিয়েছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজিব ভুঁইয়া। গত ১৭ সেপ্টেম্বর রাজশাহীতে এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “এখনই কোনো রাজনৈতিক দল খোলার কোনো অভিপ্রায় আমাদের নেই। এই অন্তর্বর্তী সরকারে যারা আছেন, কারওরই ক্ষমতার অভিলাষ নেই। সবারই পেশাগত জীবন আছে, সবাই সেখানে ফিরে যেতে চায়। কিন্তু দেশের মানুষ একটা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে দায়িত্ব এই অন্তর্বর্তী সরকারকে দিয়েছে, সেটি যথাযথভাবে পালন করে মানুষের আশা–আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে একটা নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করাই আমাদের লক্ষ্য।”
বড় নেতাদের ছোট দল
মাহমুদুর রহমান মান্না, সাইফুল হক, আন্দালিব রহমান পার্থ, জোনায়েদ সাকি, নুরুল হক নুর– তারা প্রত্যেকে একেকটি রাজনৈতিক দলের প্রধান। তাদের দলগুলো যতই ছোট হোক না কেন, নেতা হিসেবে তারা বেশ খ্যাতিমান। বিশেষ করে টেলিভিশনের টকশোতে সদ্যবিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকারের নানা কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী, সাহসী ও ঝুঁকিপূর্ণ বক্তব্য দিয়ে তারা আলোচনায় এসেছেন। জনপ্রিয় হয়েছেন। এর মধ্যে মাহমুদুর রহমান মান্না একসময় আওয়ামী লীগ এবং নুরুল হক নুর ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। আন্দালিব রহমান পার্থ জাতীয় পার্টির একাংশের নেতা এবং শেখ পরিবারের নিকটাত্মীয়। নুরুল হক নুর মূলত আলোচনায় আসেন সরকারি চাকরিতে কোটাবিরোধী আন্দোলন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ভিপি হিসেবে। বিশেষ করে ছাত্রলীগের নির্যাতনের কারণে।
সাইফুল হক বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি নামে যে দলের সাধারণ সম্পাদক, ওই দলটি এককভাবে নির্বাচনে অংশ নিলে আদৌ কোনো আসন পাবে বলে মনে হয় না। কিন্তু নেতা হিসেবে সাইফুল হক বেশ পরিচিত মুখ এবং রাষ্ট্রীয় নানা অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার। ওই অর্থে তাদেরকে অনেক সময় ছোট দলের বড় নেতা হিসেবে অভিহিত করা হয়।
বড় নেতাদের এই দলগুলোর মধ্যে মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্য, জোনায়েদ সাকির গণসংহতি আন্দোলন এবং নুরুল হক নূরের গণঅধিকার পরিষদ আওয়ামী লীগের আমলে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন পায়নি। বরং এই দলগুলোর নিবন্ধন ইস্যুটি উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। অথচ ৫ অগাস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরপরই তিনটি দলই নিবন্ধন পেয়েছে। জামায়াতে বি টিম হিসেবে পরিচিত এবি পার্টিও নিবন্ধন পেয়েছে।
এর মধ্যে গত ২ সেপ্টেম্বর নুরুল হক নুরের দল ‘বাংলাদেশ গণঅধিকার পরিষদ’ নিবন্ধন পেয়েছে ট্রাক প্রতীকে। একই দিন নিবন্ধন পায় মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্য। তাদের প্রতীক কেটলি।
এর ১৫ দিন পর গত ১৭ সেপ্টেম্বর রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন পায় গণসংহতি আন্দোলন। তাদের প্রতীক ‘মাথাল’। মাথাল হচ্ছে একধরনের বিশেষ টুপি যা কৃষকরা কাজ করার সময় রোদের হাত থেকে মাথা বাঁচানোর জন্য ব্যবহার করেন।
আওয়ামী লীগের পতনের অর্ধমাসের মধ্যে গত ২১ অগাস্ট রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন পায় আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি)। তাদের প্রতীক ঈগল। মনে রাখা দরকার, ২১ অগাস্ট তারিখটি আওয়ামী লীগের জন্য একটি বেদনার দিন।
প্রশ্ন হলো আগামী জাতীয় নির্বাচনে বড় নেতাদের এই ছোট দলগুলোর ভূমিকা কী হবে? এককভাবে তিনশ আসনে প্রার্থী দেওয়ার মতো সক্ষমতা তাদের নেই এটা যেমন ঠিক তেমনি এককভাবে প্রার্থী দিলেও তারা কয়টি আসতে জিতবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। সেক্ষেত্রে এই দলগুলো মিলে কি একটি নতুন ঐক্য গড়ে তুলবে? ওই ঐক্য বা জোট কী পরিমাণ ভোট ও জনসমর্থন আদায় করতে পারবে? নাকি তারা শেষপর্যন্ত বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করবে?
আওয়ামী লীগের ভোট কী হবে?
আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন ছাত্রলীগকে সম্প্রতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আওয়ামী লীগকে এখনও নিষিদ্ধ করা হয়নি। তবে গত ১২ নভেম্বর সচিবালয়ে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের মালিক, সম্পাদক ও বার্তা প্রধানদের সঙ্গে বৈঠকে তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেছেন, আওয়ামী লীগ আইনত নিষিদ্ধ না হলেও রাজনৈতিকভাবে নিষিদ্ধ এবং এই দলটির পক্ষে আর ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব নয় বলেও তিনি মনে করেন। অন্তর্বর্তী সরকারের আরও একাধিক উপদেষ্টা এবং সরকার ঘনিষ্ঠরাও এমনটাই মনে করেন।
এটা মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, আগামী নির্বাচন এক বছর পরে হোক কিংবা দেড়-দুই বছর, আওয়ামী লীগকে ওই নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া হবে না। যদি তাই হয় তাহলে আওয়ামী লীগের ৩০-৩৫ শতাংশ ভোট (অতীতের তুলনামূলক ভালো নির্বাচনের ফলাফলের আলোকে) কোথায় যাবে? শেষ তিনটি আমলে নির্বাচনি ব্যবস্থা ধ্বংস করা, লাগামহীন দুর্নীতি এবং সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থানে ব্যাপক মানুষ হত্যার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা যথেষ্ট কমেছে বলে মনে করা হলেও অন্তর্বর্তী সরকার ও তাদের স্টেকহোল্ডারদের অনেক আচার-আচরণ ও কর্মকাণ্ডে আওয়ামী লীগের প্রতি মানুষের সিমপ্যাথি বাড়ছে কি না— সেটিও বিরাট প্রশ্ন।
তবে যত যাই হোক না কেন, আওয়ামী লীগের মতো একটি বিরাট দলকে রাতারাতি গণমানুষের স্মৃতি থেকে মুছে ফেলা অসম্ভব। যদি তাই হয় এবং আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া না হয়, তাহলে তাদের ভোটগুলো কোথায় যাবে? তারা কি বড় নেতাদের ছোট দলকে ভোট দেবে নাকি আওয়ামী লীগের ভোটগুলো বিএনপি পাবে? যে বিএনপিকে মাইনাস করার জন্য আওয়ামী লীগ গত ১৫ বছরে নানা উদ্যোগ নিয়েছে, ওই দলকেই আওয়ামী লীগের সমর্থকরা ভোট দেবেন নাকি তারা ভোটদানে বিরত থাকবেন? এমনও কি হতে পারে যে, বিএনপিকে ঠেকাতে আওয়ামী লীগ তাদের ভোটগুলো জামায়াত বা অন্য কোনো দল বা জোটকে দেবে?
তাহলে কি কোয়ালিশন সরকার?
আগামী নির্বাচনে কী হবে, কোনো দল এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করতে পারবে নাকি কোয়ালিশন বা জোট হবে; সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া হবে কিনা বা করলেও তারা কার নেতৃত্বে নির্বাচনে আসবে এবং কতটি আসনে পাবে— তার চেয়ে বড় প্রশ্ন নির্বাচনটি আসলে কবে হবে?
অন্তর্বর্তী সরকার এবং তাদের স্টেকহোল্ডাররা যে সংস্কারের কথা বলে নির্বাচনটি বিলম্বিত করতে চাইবেন, তাতে সন্দেহ নেই। আর সরকার যদি নির্বাচন বিলম্বিত করতে চায় তখন নির্বাচনের দাবিতে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার বিএনপির ভূমিকা কী হবে; তাদের সঙ্গে সরকার ও সরকারের স্টেকহোল্ডার হিসেবে পরিচিত দল ও সংগঠনগুলোর সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি হবে কিনা; হলে ওই পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী কী ভূমিকা পালন করবে— তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে।
যা কিছুই হোক এবং নির্বাচন যখনই হোক না কেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনে ধর্মভিত্তিক দল ও সংগঠনগুলো, বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন ও হেফাজতে ইসলাম বিরাট ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াবে। শেষমেষ বিএনপির সঙ্গে জামায়াত জোট করবে না বলেই মনে করা হচ্ছে, এককভাবে নির্বাচন করবে নাকি অন্যান্য ইসলামিক দলগুলোর সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে একটি নতুন ঐক্য গড়ে তুলে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির বাইরে নতুন শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে— তা এখনই বলা মুশকিল।
এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ না করলেও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটিও আগামী নির্বাচনে বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াতে পারে। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের বিরাট অংশের সমর্থন যদি তাদের পেছনে থাকে। ফলে রাজনীতির অনেক সমীকরণই বদলে যেতে পারে। আবার দিন শেষে এও ঠিক যে, দেশের মানুষ যত কথাই বলুক, ভোট দেওয়ার সময় সে মার্কাই দেখে।
অতএব বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক দল বা শক্তির উত্থান ঘটতে পারে বলে মার্কিন কূটনীতিক ড্যান মজিনার ওই বক্তব্য স্মরণ রেখে এটা বলা যায় যে, যেহেতু একটি বিরাট অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের মতো একটি বড় দল ও শেখ হাসিনার মতো একজন শাসকের বিদায় হলো, অতএব আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রচলিত অংকের সব হিসাব নাও মিলতে পারে।