সন্জীদা খাতুন শুধু একজন ব্যক্তি নন, তিনি একটি প্রতিষ্ঠান। তিনি আমাদের সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাঁর চলে যাওয়া মানে একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি নয়— বরং একটি নতুন পথচলা, যেখানে তাঁর শিক্ষা, আদর্শ এবং সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের পথপ্রদর্শক হয়ে থাকবে।
Published : 25 Mar 2025, 07:15 PM
বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গন আজ এক শূন্যতায় স্তব্ধ। ২৫ মার্চ ৩ টা ১০ মিনিটে ছায়ানটের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, রবীন্দ্রনাথের একনিষ্ঠ সাধক, শিক্ষাবিদ ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব সন্জীদা খাতুন চলে গেছেন এই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে।
খবরটি শুনে কেমন হতবিহ্বল হয়ে পড়লাম। তাঁর সঙ্গে আমার খুব যোগাযোগ ছিল তা নয়। কিন্তু তিনি আছেন, এটাই তো ছিল অনেক বড় ভরসা।
তাঁর প্রস্থানে শুধু সংগীত কিংবা শিক্ষা নয়, বাঙালির চেতনাবোধের এক অপূরণীয় ক্ষতি হলো। তিনি শুধু একজন শিক্ষক, গবেষক বা সংগঠক ছিলেন না— তিনি ছিলেন এক অনন্য দৃষ্টিভঙ্গির মানুষ, যিনি জীবনব্যাপী বাঙালির সংস্কৃতি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও রবীন্দ্রনাথকে একসূত্রে গেঁথে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন।
আমার সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর সরাসরি ছাত্র হওয়ার। ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হয়ে তাঁকে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছি। সেই দিনগুলো এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে, যখন তিনি আমাদের ক্লাসে আসতেন রবীন্দ্রনাথের বিশাল ভুবনের দরজা খুলে দিতে। তিনি কোনো লেখার শুধু পাঠ কিংবা বিশ্লেষণ করতেন না; তিনি আমাদের শেখাতেন কীভাবে শব্দের গভীরে যেতে হয়, কীভাবে সাহিত্যের সৌন্দর্য শুধু বর্ণনায় নয়, তার অন্তর্নিহিত দর্শনে লুকিয়ে থাকে। তাঁর কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের পঙক্তি নতুন মাত্রা পেত—
"কেন দূরে থাকি, ওগো বন্ধু, কাছে আসি, কাছে"— এই কথাগুলোর গভীরতা তিনি শুধু বোঝাতেন না, অনুভব করাতেন।
ছায়ানট এবং বাঙালির সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ
বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জাগরণের এক অনন্য প্রতিষ্ঠান ছায়ানট। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনের মধ্য দিয়ে ছায়ানটের যাত্রা শুরু। সন্জীদা খাতুন ছিলেন এই সংগঠনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও প্রাণশক্তি। তাঁর নেতৃত্বেই বাংলা নববর্ষ উদযাপনের সাংস্কৃতিক ধারা প্রতিষ্ঠিত হয়, যা আজ আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এই পথ সহজ ছিল না। ১৯৭১ সালের ভয়াবহ দুঃসময়ে যখন পাকিস্তানি বাহিনী আমাদের সংস্কৃতির শেকড় উপড়ে ফেলতে চেয়েছিল, তখনও ছায়ানটের সংগঠকরা নির্ভয়ে সামনে এগিয়েছিলেন। সন্জীদা খাতুন ছিলেন তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য।
স্বাধীনতার পরও তিনি সংস্কৃতির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশে কাজ করে গেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, একটি জাতির স্বাধীনতা শুধু ভৌগোলিক সীমানায় সীমাবদ্ধ নয়— সেটি তার ভাষা, সাহিত্য, সংগীত ও শিল্পের মধ্য দিয়ে সত্যিকারের পরিচয় পায়। তাঁর কাছে সংস্কৃতি মানে ছিল আত্মপরিচয়ের প্রতিচ্ছবি, যা একটি জাতিকে তার শেকড়ের সঙ্গে যুক্ত রাখে।
ব্যতিক্রমী পথপ্রদর্শক
শিক্ষক সন্জীদা খাতুন ছিলেন অনন্য। তাঁর পাঠদানে ছিল প্রাণের উচ্ছ্বাস, ছিল গভীর অন্তর্দৃষ্টি। তিনি শুধু বইয়ের পৃষ্ঠার মধ্যে আটকে থাকতেন না— শিক্ষার্থীদের ভাবনার জগৎ উন্মুক্ত করে দিতেন। তিনি চাইতেন, আমরা রবীন্দ্রনাথকে শুধু আবৃত্তি না করি, তাঁকে বুঝতে শিখি। তিনি বলতেন— "কবিতা শুধু চিত্র নয়, কবিতা শব্দের ভিতরে গড়ে ওঠা এক অনুভবের ভাস্কর্য।"
তাঁর ক্লাসে বসে মনে হতো, বাংলা সাহিত্য আর শুধুই সাহিত্য নেই— এটি আমাদের জীবন, আমাদের ইতিহাস, আমাদের অস্তিত্ব। তিনি কখনো পাঠ্যবইয়ের বাইরে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্র পড়াতেন, কখনো নজরুলের বিদ্রোহী সত্তার ব্যাখ্যা দিতেন, কখনো বা জীবনানন্দের কাব্যে বাঙালির নিঃসঙ্গতাকে অনুধাবন করাতেন।
রবীন্দ্রসংগীত ও মুক্তচিন্তা
সন্জীদা খাতুন রবীন্দ্রসংগীতকে শুধু সংগীত হিসেবে দেখেননি, তিনি একে জীবনের অংশ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তিনি রবীন্দ্রসংগীতের মাধ্যমে বাঙালির মুক্তচিন্তা, সৌন্দর্যবোধ এবং আত্মজাগরণের পথ দেখিয়েছেন। তাঁর কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের গান ছিল এক অনন্য অভিজ্ঞতা— যেখানে সুর, ব্যঞ্জনা এবং উপলব্ধি একসঙ্গে মিশে যেত।
বাংলাদেশে রবীন্দ্রসংগীতকে জনপ্রিয় করতে তাঁর ভূমিকা ছিল অসামান্য। পাকিস্তান আমলে যখন রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছিল, তখন তিনি এবং তাঁর সহযোদ্ধারা এর বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। স্বাধীনতার পরও, যখন সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ও সংকীর্ণ রাজনৈতিক চিন্তাধারা রবীন্দ্রনাথকে বিতর্কিত করতে চেয়েছিল, তখন তিনি আরও দৃঢ়ভাবে তাঁর অবস্থান প্রকাশ করেছেন।
আগে আমরা বাঙালি
সন্জীদা খাতুনের লেখা জীবনবৃত্ত পাঠে জানা যায়, একসময় বাংলা একাডেমিতে কাজ করেছিলেন তিনি ছোট্ট একটা খুপরিতে বসে সকাল ৯টা ৩০ থেকে বিকেল ৪টা ৩০ পর্যন্ত চলত কাজ। ঊনবিংশ শতাব্দীতে যে বাংলা বইগুলো বের হয়েছিল, সেগুলো থেকে কিছু বই বেছে নিয়ে তাতে আরবি-ফারসি শব্দ খুঁজে বের করে নমুনা আর রেফারেন্সসুদ্ধ কার্ডে লিখে সংগ্রহ করতে হতো। এ কাজটা দীর্ঘ সময়ের নয়। এক বেলা কাজ করে আরেক বেলায় লাইব্রেরিতে বই পড়ে কাটিয়ে দেওয়া যেত; কিংবা অফিসের লাইব্রেরি থেকে বই এনেও তা পড়া যেত। এখানে বসেই অনেক বই পড়েছেন তিনি।
যে অভিধানটি নিয়ে কাজ হচ্ছিল, তার প্রধান সম্পাদক ছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্। তিনি হঠাৎ একদিন এসে এমন এক কথা বললেন, যা সন্জীদা খাতুনের কাছে উদ্ভট বলে মনে হলো। বাংলা একাডেমির নিয়মে ‘ঙ’ বাদ গেছে। সুতরাং এখন যদি ‘বাঙালী’ লিখতে হয়, তাহলে কীভাবে লেখা হবে? তিনি বের করেছেন, বাঙালি না লিখে লিখতে হবে ‘বাংআলী’। এ কথা শুনে তো সন্জীদা খাতুনের চক্ষু চড়কগাছ! এ বানান কী করে লেখা যায়! সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে তিনি গেলেন বাংলা একাডেমির পরিচালক সৈয়দ আলী আহসানের কাছে। ‘আমি তাহলে এবার কী করব? কীভাবে লিখব?’ জানতে চাইলেন সন্জীদা খাতুন।
‘অভিধানের বানান হবে প্রচলিত বানান। এখানে তো বানান বদল হতে পারে না।’—বললেন পরিচালক।
আবার এই সৈয়দ আলী আহসানের একটি প্রশ্নও হতবিহ্বল করে তুলেছিল সন্জীদা খাতুনকে। বাংলা একাডেমির পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানে সন্জীদা খাতুনকে গান করতে বলা হয়েছিল। সন্জীদা খাতুন মহানন্দে গাইলেন, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি...’।
সৈয়দ আলী আহসান বললেন, ‘ও গান গাইলে কেন? আইবি থেকে আপত্তি করেছে।’
সন্জীদা বললেন, ‘আমরা বাংলাকে ডিজওউন করব কেন?’
আলী আহসান বললেন, ‘আমরা তো পাকিস্তানি।’
সন্জীদা বললেন, ‘তার আগে আমরা বাঙালি।’
পানিপড়া, তাবিজ ...
সন্জীদা খাতুন ছিলেন মিতভাষী। তাঁর সঙ্গে যাঁরা মিশেছেন তাঁরা জানেন, বাইরে থেকে আপাকে নিরস কাঠখোট্টা মনে হলেও আসলে তিনি ছিলেন একজন সরস প্রাণখোলা রসবোধসম্পন্ন মানুষ। সন্জীদা খাতুনের লেখার পাঠকদেরও তাঁর এই রসবোধের কথা অজানা নয়। তাঁর লেখা ‘অতীত দিনের স্মৃতি থেকে সামান্য উদাহরণ।
তাঁর নিজের লেখা থেকেই জানা যায়, শৈশব-কৈশোরে দুরন্ত ছিলেন সন্জীদা খাতুন। ঝোঁকের মাথায় অনেক কিছুই করতেন। একবার এক বান্ধবী পীর সাহেবের কাছে যাওয়া শুরু করল। পানিপড়া, তাবিজ ইত্যাদির সঙ্গে যোগাযোগ হলো তার। পীর সাহেবের কাছে গিয়ে সে এমনভাবে কথা বলত, যেন ওর মতো দুঃখী আর কেউ নেই। সন্জীদা খাতুন ভাবলেন, তিনিও পীর সাহেবের কাছে যাবেন। মায়ের শখ করে বানানো বোরকা পরে একদিন বান্ধবীর সঙ্গে চললেন পীর সাহেবের কাছে। বান্ধবীকে বললেন, ‘তোর পীর সাহেবকে বলব, আমার স্বামী আমাকে নেয় না। দেখি তিনি কী করেন।’
বান্ধবী আগেই এ কথা পীর সাহেবকে বলে রেখেছিল কি না, সেটা সন্জীদা খাতুন জানেন না। কিন্তু পীর সাহেবের কাছে পৌঁছানোর পর তিনি বললেন, ‘নেকাব তোলো।’ নেকাব তুলে ইনিয়ে-বিনিয়ে সন্জীদা খাতুন তাঁর বানিয়ে তোলা ‘দুঃখের কথা’ বললেন। জানালেন, স্বামী তাঁকে নেয় না। চোখ তুলে দেখেন পীর সাহেব হাসছেন। তারপর তিনি সন্জীদাকে বললেন, ‘ঠিক আছে, যাও। বিয়ের তাবিজ দিয়ে দেব।’
কাকতালীয়ভাবে এর কয়েক দিন পর একটা বিয়ের প্রস্তাবও এসেছিল সন্জীদা খাতুনের।
তখন বেশ টাউন সার্ভিস বাসে উঠতেন তিনি। একদিন শখ হলো টুপি-পায়জামা-চাপকান পরে তিনি আজিমপুরে বড়দিদির বাড়িতে যাবেন। তাঁর এই সাজপোশাক দেখে মা-ও সঙ্গ নিলেন। বাসের কাছে এসে ছেলেদের মতো এক লাফে বাসে উঠলেন। মা-ও উঠলেন। কন্ডাক্টর সন্জীদাকে মেয়ে বলে চিনতে পারল না। ছেলেই মনে করল। মায়ের সম্মানে বলল, ‘লেডিস!’ আর সন্জীদা খাতুনকে ক্রমেই পেছনের দিকে যেতে বলল। ছেলেরা তো পেছন দিকেই যায়। এদিকে মা রাগ করে বলেন, ‘এই দিকে সরে আয়!’ কন্ডাক্টর একটু অবাক হয়ে বারবার সন্জীদা খাতুনের দিকে আড়চোখে তাকাতে লাগল।
যা হোক, দ্রুত পৌঁছে গেলেন তাঁরা আজিমপুরে। কিন্তু ফেরার সময় বাস ফাঁকা থাকলেও মা তাঁকে আর বাসে চড়তে দেননি। একটা রিকশা ভাড়া করে ফিরলেন বাড়ি ।
চিরকালের অনুপ্রেরণা
সন্জীদা খাতুন শুধু একজন ব্যক্তি নন, তিনি একটি প্রতিষ্ঠান। তিনি আমাদের সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাঁর চলে যাওয়া মানে একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি নয়— বরং একটি নতুন পথচলা, যেখানে তাঁর শিক্ষা, আদর্শ এবং সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের পথপ্রদর্শক হয়ে থাকবে।
আমার ব্যক্তিগত জীবনে তাঁর প্রভাব অনস্বীকার্য। তাঁর ক্লাসের সেই দিনগুলো, তাঁর কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথ, তাঁর চেহারায় এক অদ্ভুত দৃঢ়তা—এসব স্মৃতি আজও আমার হৃদয়ে গেঁথে আছে। তিনি বলতেন— "সংস্কৃতি মানে কেবল গান বা কবিতা নয়, এটি জীবনকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি।"
সন্জীদা খাতুন আমাদের শিখিয়েছেন কীভাবে সেই দৃষ্টিভঙ্গিকে ধারণ করতে হয়, কীভাবে ভাষার প্রতিটি শব্দ, সংগীতের প্রতিটি সুর, এবং সাহিত্য-শিল্পের প্রতিটি রং আমাদের পরিচয় হয়ে ওঠে।
আজ তিনি নেই, কিন্তু তাঁর কণ্ঠের সেই রবীন্দ্রসংগীত আজও বাতাসে ভাসে— "তবু মনে রেখো…"
আমরা আপনাকে মনে রাখব, সন্জীদা আপা, চিরকাল।