বর্তমানে গরুর নাম রাখা হয় ‘হিরো আলম’, ‘জায়েদ খান’, ‘ডিপজল’, ‘মিশা’, ‘শাকিব খান’, জায়েদ খান’, ‘পরীমণি’ বা ‘তাহেরী’। মাদারীপুরের একটি খামারে কোরবানিতে বিক্রির জন্য একটি ষাঁড় গরুর নাম রাখা হয়েছে ‘প্রিন্স মামুন’। এটির ওজন আনুমানিক ২৫ মণ। দাম হাঁকা হচ্ছে ১৫ লাখ টাকা।
Published : 15 Jun 2024, 04:28 PM
গরু নিরীহ হলেও আলোচিত একটি প্রাণী। ঈদুল আজহা, সর্বসাধারণ্যে যা কোরবানির ঈদ পরিচিত, এলে গরুর দাম ও কদর কয়েক গুণ বেড়ে যায়। কেমন গরু কোরবানি করা হবে, সেই গরু কোত্থেকে সংগ্রহ করা হবে, তার দাম কী রকম হবে, সেই টাকা কোথা থেকে আসবে, এককভাবে কোরবানি দেওয়া হবে, নাকি ভাগে দেওয়া হবে, কোরবানির পশুর হাটে গিয়ে গরু কেনা হবে, না অনলাইনে কেনা হবে— এসব নিয়ে এখন বাংলার ঘরে ঘরে আলোচনা, গবেষণা। আসলে কোরবানির ঈদ এলে বোঝা যায় গরু কতটা উপকারী প্রাণী এবং এর গুরুত্ব কত।
কোরবানির ঈদে আমাদের দেশের কিছু কিছু গরু রীতিমতো ‘তারকা’র মর্যাদা পায়। তাদের নিয়ে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়। নিজের প্রিয় গরুগুলোকে খামারিরা আদর করে বিভিন্ন নাম দিয়ে থাকেন। বাহারি সব নামের বিশালাকার এসব গরু হাটে আসা ক্রেতাদের আকর্ষণের কেন্দ্রে থাকে। অনেক ক্রেতাই কোরবানির জন্য এমন বাহারি নামের গরু কেনেন।
উল্লেখ্য, আমাদের দেশে হাটে বিক্রির জন্য আসা অসংখ্য গরুর মধ্যে কয়েকটি বিশেষ জাতের গরুর চাহিদা থাকে সবচেয়ে বেশি। শাহীওয়াল, হোলস্টাইন ফ্রিজিয়ান, ব্রাহমা আর মীরকাদিম জাতের গরু সব সময়েই চাহিদার শীর্ষে থাকে। এসব গরুর দামও তুলনামূলকভাবে বেশি হয়। সেই সঙ্গে এসব গরুর রয়েছে বাহারি সব নাম। অবশ্য গরুকে একটি আলোচিত বা জনপ্রিয় নাম দিয়ে বাজারে তোলা সাম্প্রতিক প্রবণতা। গত কয়েক বছর ধরে চলছে এই হুজুগ।
একসময় গরুর নাম রাখা হতো শরীরের বর্ণ দেখে। রং সাদা হলে ‘ধলা’ বা ‘ধলু’, কালো হলে ‘কালু’, লাল হলে ‘লালু’ নাম রাখা হতো। কেউ গরুর মেজাজ অনুযায়ী রাম রাখতেন ‘রাজা’, ‘বাদশা’ বা ‘সম্রাট’। এবারও অনেক খামারিদের এইসব নামে নিজেদের পছন্দের পশুদের নাম রাখতে দেখে গেছে। কেউ রেখেছে ‘লালু মাস্তান’, ‘কালা মানিক’, কিংবা ‘রাজা বাবু’। আবার গরুর মেজাজ ও দেহের গড়ন অনুযায়ী ‘রাজা’, ‘বাদশা’, ‘জমিদার’, ‘বাহাদুর’ এমন অনেক নামই রেখেছেন ক্রেতাদের দৃষ্টি আর্কষণের জন্য। এমনকি বিশাল দেহের গঠনের কারণে দুই বিখ্যাত রেসলার ‘রক’, ‘আন্ডারটেকার’ নামেও গরুর নাম রাখতে দেখা গেছে।
গত দুই-তিন বছর ধরে দেশের চলচ্চিত্র জগতের আলোচিত-সমালোচিত তারকাদের নামেও গরুর নাম রাখতে শুরু করেছেন খামারিরা। বর্তমানে গরুর নাম রাখা হয় ‘হিরো আলম’, ‘জায়েদ খান’, ‘ডিপজল’, ‘মিশা’, ‘শাকিব খান’, জায়েদ খান’, ‘পরীমণি’ বা ‘তাহেরী’। মাদারীপুরের একটি খামারে কোরবানিতে বিক্রির জন্য একটি ষাঁড় গরুর নাম রাখা হয়েছে ‘প্রিন্স মামুন’। এটির ওজন আনুমানিক ২৫ মণ। দাম হাঁকা হচ্ছে ১৫ লাখ টাকা। গরুটিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল করতেই টিকটকারের নামের সঙ্গে মিল রেখে এর নাম ‘প্রিন্স মামুন’ রাখা হয়েছে বলে জানান খামারি আইয়ুব আলী বেপারী।
এবারের কোরবানি ঈদে আলোচিত গরুর তালিকায় সবার উপরে আছে ‘বস’, ‘টাইগার’, ‘মেসি’, ‘টাইটানিক’সহ মোট ৬টি বিশাল আকারের গরু। মোহাম্মদপুরের সাদেক অ্যাগ্রোর বিশেষ খামারে হেলে দুলে আয়েশী ভঙ্গিতে বেড়ে উঠেছে বস। আকর্ষণীয় চেহারা ও শরীরের রাজকীয় গড়নের ফলে যে কাউকে নজরকাড়ে ব্রাহমা জাতের গরুটি। ১৪০০ কেজি ওজনের এই গরুটি বিক্রি হয়েছে ৩৭ লাখ টাকায়। একই জাতের টাইগার এবং রোজোকে সরাসরি আনা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস থেকে। টাইগারের ওজন এক হাজার আর রোজো এরই মধ্যে পৌঁছে গেছে ১১০০ কেজিতে। স্বভাবে একেবারে শান্ত এই দুই গরু। এই গরু দুটি বিক্রি হয়েছে ৩৫ লাখ টাকায়। টাইগার ও রোজো। লম্বায় প্রায় ১২ ফুট আর উচ্চতায় ৬ ফুট ৩ ইঞ্চি এটি হলিস্টিন ফিজিয়ান জাতের গরু। এই গরুর নাম দেওয়া হয়েছে টাইটানিক। কোরবানির জন্য টাইটানিককে বিক্রি করা হয়েছে সাড়ে ১৭ লাখ টাকায়। মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলার সিনবাদ নামে একটি গরুর দাম হাঁকা হয়েছে ২৫ লাখ টাকা। কোরবানির হাটে ‘পরীমনি’ নামের মহিষও বিক্রি হয়েছে একটি।
কোরবানির গরু নিয়ে এই মাতামাতি কতটা ধর্মীয় বিধান পালনের সৎ উদ্দেশ্য থেকে আর কতটা নিজেকে ‘বড়লোক’ প্রমাণ করার অসুস্থ প্রতিযোগিতার ফল, সেই তিক্ত আলোচনায় না গিয়ে আমরা বরং গরু নিয়ে কিছু সাধারণ আলোচনা সেরে নিতে পারি।
প্রথমেই একটি পুরনো কৌতুক।
ক্লাসে শিক্ষক জিজ্ঞেস করল, বলতো গরু আমাদের কি দেয়?
মাংসবিক্রেতার ছেলে বলল: গোস্ত দেয়;
খামারির ছেলে বলল: দুধ দেয়:
আর চাষির ছেলে বলল: কি আর দেয়? গোবর দেয়, লাত্থি দেয় আবার গুঁতাও দেয়!
আসলে যার যেমন অভিজ্ঞতা আর কি!
তবে গরু কেবল লাথি কিংবা গুঁতোই দেয় না; বরং দুধ দেয়, মাংসও দেয়। অনেকটা শিল্পপতিদের মতো। তারা কেবল ‘শ্রম শোষণ’ই করে না, জীবিকা দেয়, মজুরি দেয়, যা দিয়ে গরিব মানুষ বেঁচে থাকার রসদ সংগ্রহ করে। গরু আমাদের আরও অনেক কিছুই দেয়। হাম্বা দেয়, হাড়, লেজ, গোবর, চামড়াও দেয়। গোমূত্র জমিকে উর্বর করে। কোনো কোনো দেশে তা পবিত্রতার প্রতীক। ওষুধ হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। যদিও গোমূত্র বা গোচোনা অনেক ‘বিধ্বংসী’ ক্ষমতার অধিকারী। কথায় আছে, ‘সোয়া মণ দুধ নষ্ট করে এক ফোঁটা গোচোনা।’ এর মর্মার্থ হলো, সোয়া এক মণ দুধের মধ্যে এক ফোঁটা চোনা, মানে গরুর এক ফোঁটা মূত্র পড়লে তা নষ্ট হয়ে যায়, খাওয়ার উপযুক্ত থাকে না।
আমাদের জীবনযাত্রা অর্থনীতির সঙ্গে গরুর রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। ছোটবেলায় গরু নিয়ে রচনা লেখেনি এমন মানুষ নেই বললেই চলে। বাবা-মা কিংবা শিক্ষক-অভিভাবক-প্রেয়সীর কাছে গরু সম্বোধন শোনেনি এমন হতভাগ্য বাঙালিও বড় বেশি খুঁজে পাওয়া যাবে না।
মানুষের জীবনে এমন কোনো ক্ষেত্র পাওয়া দুষ্কর, যেখানে গরুর ভূমিকা নেই। তাই গরু হলো এই পৃথিবীর সব মানুষের কাছে সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গৃহপালিত পশু। সবচেয়ে সম্মানিত প্রাণীও বটে। কোনো কোনো সম্প্রদায় গরুকে ‘মাতা’ বলে সম্মান করে।
বলদ, ষাঁড়, গাভি, বাছুর, দেশি, বিদেশি ইত্যাদি নানা ধরনের গরু আছে। তবে সুসাহিত্যিক সুকুমার রায় এক আজব গুরুর কথা লিখেছিলেন, তার নাম ‘ট্যাশ গরু’। ‘ট্যাঁশ গরু গরু নয়, আসলে তে পাখি সে; যার খুশি দেখে এস হারুদের আফিসে।’ তবে বিভিন্ন অফিস-আদালতে এমন বিচিত্র গরুর অভাব নেই। সেগুলোর বিস্তারিত বিবরণ দিতে গেলে চাকরি থাকবে?
গরু হারালে মানুষের নাকি কাণ্ডজ্ঞান লোপ পায়। কথিত আছে, গ্রামের এক লোকের গরু হারালে সে সকালে খুঁজতে বেরিয়ে দুপুরে শুষ্ক মুখে বাড়িতে প্রত্যাবর্তনের পর পুত্রকে ‘ভাই’ সম্বোধন করে এক গ্লাস পানি আনতে বলেন। এটা শুনে স্ত্রী বিস্মিত হয়ে বলেছিলেন, ‘তুমি কি পাগল হয়ে গেছ? ছেলেকে কেউ ভাই বলে? ‘এর জবাবে নাকি লোকটি বলেছিল, ‘গরু হারালে এমনই হয়, মা।’
গরুরা নিজেদের মধ্যে গুঁতোগুঁতি করতে পছন্দ করে। বিশেষ করে বলদ বা ষাঁড় শ্রেণির গরুরা। আমাদের বুদ্ধিজীবী সমাজেও তেমন প্রবণতা আছে। কেউ কাউকে সহ্য করতে পারেন না। পারলে গুঁতিয়ে প্রাণ সংহার করেন। এমনকি এই উপকারী প্রাণীটির বানান নিয়েও পণ্ডিতদের মধ্যে তর্কাতর্কির ঘটনা ঘটে। ‘গরু’ না ‘গোরু’— এ নিয়ে অনেক পণ্ডিতের মধ্যে রয়েছে সংশয়। ২০১৬ সালের আগেও আমাদের দেশে অকাতরে নির্দ্বিধায় লেখা হয়েছে গরু। কিন্তু এরপর অভিধানে আকস্মিক ‘গোরু’ লেখা শুরু হয়।
কোনো কোনো পণ্ডিত প্রাচীন বই-পুস্তক ঘেঁটে বলেন, ৫০টি চর্যাপদের মধ্যে ‘গরু’ শব্দ নেই। ১৪৫০-১৫০০ খ্রিষ্টাব্দে বড়ু চণ্ডীদাস লিখেছেন গরু, গরূ, গোরো এবং বিদ্যাপতি লিখেছেন ‘গরুঅ’। ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দে মালাধর বসু লিখেছেন ‘গোরু’, ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে মুকুন্দ দাস লিখেছেন ‘গোরু’ এবং ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে নজরুল ইসলাম লিখেছেন ‘গোরু’। ১৯২৯–৩০ খ্রিষ্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের লেখায়ও ‘গোরু’ বানান দেখা যায়। যদিও পরে তিনি ‘গরু’ লিখতে শুরু করেন। পশ্চিমবঙ্গেও সেই সূত্রে গরু প্রচলিত হয়ে যায়।
গো (সংস্কৃত, গম+ও) /গোরু/গরু (সংস্কৃত, গরূপ) অর্থ হলো: জ্ঞান, ঐশ্বর্য, ধনু, গাভি, ষাঁড়, বৃষ, নিরেট বোকা/মূর্খ প্রভৃতি।
বাংলাদেশের বাংলা একাডেমি উচ্চারণ অভিধান ও ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে ‘গরু’ লেখা হয়েছে। কারণ সংবৃত অ-ধ্বনির পরে ই/ঈ/উ/ঊ-কার থাকলে অ-ধ্বনি ও-ধ্বনি উচ্চারিত হয়। যেমন: গরু>গোরু। জামিল চৌধুরী সম্পাদিত ‘বাংলা একাডেমি অধুনিক বাংলা অভিধান’ (২০১৬ খ্রিষ্টাব্দ) লিখেছে ‘গোরু’।
পণ্ডিতদের মধ্যে বানান নিয়ে দলাদলি থাকলেও গরুর কিন্তু এ নিয়ে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। তাদের তো জন্ম হয়েছে জবাই ও কোরবানি হওয়ার জন্য! সমাজে ও পরিবারে উপকারী ব্যক্তিরা যেমনটি হয়।
তবে সব মানুষই কিন্তু প্রকারান্তরে গরু হতে চেষ্টা করে। এ কারণেই পৃথিবীভর্তি ভালোমানুষকে গো-বেচারা বলা হয়!