দেশে খারাপ রাজনীতি চালু করেছে বিএনপি। সেটা করেও দলটির জনপ্রিয় হতে অসুবিধা হয়নি। সম্ভবত এজন্য কিছু ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ বিএনপিকে অনুসরণ করছে।
Published : 12 Jul 2023, 08:07 PM
অচেনা নম্বর থেকে একটি ফোনকল এলো। ধরলাম। ওদিক থেকে বাজখাই গলায় একজন বললেন, ‘আপনি মিয়া ভালো হইবেন না। বিএনপির বিরুদ্ধ না লিখলে কি আপনের বউ আপনারে ভাত দেয় না? আপনের পিরিতের আওয়ামী লীগের নষ্টামি চোখে পড়ে না।’
ব্যস, ক্রুদ্ধ ব্যক্তিটি আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন কেটে দিলেন।
এমন অভিজ্ঞতা আমার নতুন নয়। বহু বারই এমন প্রতিক্রিয়া শুনতে হয়েছে। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকি, আর মনে মনে ভাবি, আওয়ামী-প্রীতির ছাপ আর গা থেকে মুছতে পারব না।
রাজনীতিটা একটু বুঝি বলে রাজনীতি বিষয়ে হুট করে কোনো মন্তব্য করি না। আমাদের দেশে অনেক রাজনৈতিক ভাষ্যকার আছেন, যারা তাৎক্ষণিকভাবে ‘পাবলিক খায়' এমন মন্তব্য করেন, যা বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয় না।
যেমন একটি উদাহরণ দেই। রাজনৈতিক চিন্তাবিদ ও লেখক বদরুদ্দীন উমরের একটি সাক্ষাৎকার পড়লাম গত ১০ জুলাই। তিনি সাক্ষাৎকারের এক জায়গায় বলেছেন, ‘বিএনপির শ্রেণি চরিত্রের মধ্যে আওয়ামী লীগের কোনো পার্থক্য নেই। তবে আওয়ামী লীগ আরও পাকা, তাদের অভিজ্ঞতা বেশি। তাদের মধ্যে প্রতিহিংসা আরও বেশি। এসব কারণে বিএনপির চাইতে আওয়ামী লীগ আরও বেশি খারাপ।’
পাঠকদের অনেকেই হয়তো উমর সাহেবের এই বক্তব্যের জন্য তাকে বাহবা দেবেন। কারণ তিনি বিএনপিকে তুলনামূলকভাবে আওয়ামী লীগের চেয়ে ভালো বলে সার্টিফিকেট দিয়েছেন। কিন্তু আমি তার এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত নই। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শ্রেণি চরিত্রে যদি কোনো পার্থক্য না-ও থাকে, তবু আওয়ামী লীগ বিএনপির চেয়ে বেশি প্রতিহিংসাপরায়ণ, বেশি খারাপ—এটা কি উপযুক্ত যুক্তি ও তথ্য দিয়ে প্রমাণ করা সম্ভব? ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট ও ২০০৪ সালের ২১ অগাস্টের ঘটনার পর আওয়ামী লীগ কি সত্যি প্রতিহিংসাপরায়ণ আচরণ করেছে? আওয়ামী লীগ সত্যি বিএনপির চাইতে খারাপ হলে ও প্রতিহিংসাপরায়ণ হলে বিএনপি বা আওয়ামী লীগবিরোধী অন্য শক্তিগুলো কি টিকে থাকতে পারত?
আমাদের রাজনীতি হলো বিরোধিতার, ‘না’ বলার। তাই ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে না বললে পাবলিক খায় না। আমি জনতুষ্টির কথা ভেবে লেখালেখি করি না। নিজের বুঝ-বিবেচনা থেকেই লিখি। কারও ভালো লাগে, কারও লাগে না। সব মানুষ এক মতের হবেন, সেটা আশা করাও ঠিক নয়।
আমাদের দেশে কিছু ‘নিরপেক্ষ’ লেখক-চিন্তক আছেন, যাদের আওয়ামী লীগ সম্পর্কে ‘রিজার্ভেশন’ আছে। তারা আওয়ামী লীগের সমালোচনায় আনন্দ পান, বিএনপির সমালোচনায় মনে কষ্ট পান। বিএনপির দুর্নীতি-অনিয়মের কথা বললে তারা আহত হয়ে বলেন, এখন বিএনপির সমালোচনা কেন? বিএনপির পাপের শাস্তি বিএনপি পেয়েছে। এত বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে আছে। এখন টানা ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ এবং তারা এখন দেশটাকে লুটপাটের ভাগাড় বানিয়েছে। তাই এখন সমালোচনা করতে হবে আওয়ামী লীগের।
কথা মিথ্যা না।
আমরা অর্থাৎ দেশের মানুষেরাই আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিকে দেশের ‘জিম্মাদার’ বানিয়েছি। মোটাদাগে এই দুই দলের ওপরই বেশি সংখ্যক মানুষের আস্থা-ভরসা। আমরা, বাংলাদেশের ব্যাপক জনগোষ্ঠী এটা মেনে নিয়েছি যে, আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি পালাক্রমে দেশ শাসন করবে। এখন এই ধারায় পরিবর্তন আসায়, আওয়ামী লীগ টানা ক্ষমতায় থাকায় ওই ‘নিরপেক্ষ’ ব্যক্তিদের গায়ের জ্বালা বেড়ে গেছে।
বিএনপি ক্ষমতার বাইরে আছে বলে কি বিএনপির রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনায় কোনো পরিবর্তন এসেছে? বিএনপি কি তাদের অতীত রাজনীতির ত্রুটি-বিচ্যুতির মূল্যায়ন-বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গেলে তারা আর দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি-অনিয়মকে প্রশ্রয় দেবে না? হাওয়া ভবন গড়ে তোলা হবে না? প্রতিহিংসার রাজনীতি করবে না? গ্রেনেড-বোমা হামলার ঘটনা আর ঘটবে না? রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নির্মূলে হত্যা-খুনের রাজনীতিকে পৃষ্ঠপোষকতা দেবে না?
না, এমন কোনো অঙ্গীকার বিএনপির পক্ষ থেকে করা হচ্ছে না।
আমি এটা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, বিএনপি ভালো না হলে আওয়ামী লীগ ভালো হবে না। দেশে খারাপ রাজনীতি চালু করেছে বিএনপি। সেটা করেও দলটির জনপ্রিয় হতে অসুবিধা হয়নি। সম্ভবত এজন্য কিছু ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ বিএনপিকে অনুসরণ করছে।
যে যত তত্ত্ব কথাই বলুন না কেন, এখন রাজনীতির মাঠের বাস্তবতা হলো, হয় আওয়ামী লীগ, না হয় বিএনপি। মানুষের মনোজগতে আমরা তো এটাই প্রোথিত করেছি যে আওয়ামী লীগের বিকল্প হলো বিএনপি।
আমি এটা মনে করি না। আওয়ামী লীগের বিকল্প হতে হবে আওয়ামী লীগের চেয়ে উন্নত আদর্শের জনকল্যাণমুখী একটি দলকে। কিন্তু কোথায় সেই দল? কমিউনিস্ট পার্টিকে এক সময় আওয়ামী লীগের ভালো বিকল্প ভাবা হতো। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এবং কমিউনিস্ট পার্টিতে ভাঙনের পর ওই ভাবনার সুযোগ আর নেই।
আমাদের এটা মনে রাখতে হবে যে, আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে বিভিন্ন সময় গুরুত্বপূর্ণ বাঁকবদল হয়েছে। আওয়ামী লীগ যে তার রাজনৈতিক নীতি-কৌশলে সময়ে সময়ে পরিবর্তন এনেছে—মধ্য ডান থেকে মধ্য বাম, মধ্য বাম থেকে বামের দিকে ঝুঁকেছে, তার একটি বড় কারণ তখন আওয়ামী লীগের প্রতিযোগিতা ছিল ভালোর সঙ্গে। তখন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বাস্তবতাও ছিল বাম বা বামমুখী। আওয়ামী লীগ তখন ভালোর জন্য ভালোর (বাম) সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে নিজে ভালো হওয়ার চেষ্টা করছে। দেশের মানুষ ভালোকে (বাম) বর্জন করে খারাপকে (বিএনপি) গ্রহণ করেছে। আওয়ামী লীগও ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য খারাপের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমে ক্রমে খারাপের দিকে ঝুঁকতে ঝুঁকতে বর্তমান পর্যায়ে এসেছে।
বলা হবে, মানুষের মনোজগতে পরিবর্তন আনাই তো রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব। রাজনৈতিক নেতার দায়িত্ব। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাকিস্তানের ধারণা মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় করেছিলেন, আবার তিনিই পাকিস্তানবিরোধিতাও প্রবল করেছিলেন।
এখন কি জনমত পরিবর্তনে আওয়ামী লীগের কোনো দায়িত্ব নেই?
হ্যাঁ, আছে। তবে আওয়ামী লীগের অভিজ্ঞতা হলো, সে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে দলটিকে ২১ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকতে হয়েছে। আওয়ামী লীগ কৌশল বদলেছে। সুফল পেয়েছে।
প্রশ্ন হলো, আওয়ামী লীগের মতবদল, পথবদলের সব কিছু কি আওয়ামী লীগের সমর্থক বলে পরিচিত বুদ্ধিজীবীরা সব সময় শর্তহীনভাবে সমর্থন করেছেন?
আওয়ামী লীগের সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা আওয়ামী লীগের খারাপ কাজের সমালোচনা করেন। ধর্মীয় রাজনীতি, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রতি আওয়ামী লীগের নমনীয়তা বা আত্মসমর্পণ কারও কাছে প্রশংসিত হয়নি। সমস্যা হলো, আওয়ামী লীগের সমালোচনা করলে তার বেনিফিট গিয়ে জমা হয় বিএনপির তহবিলে।
বিএনপির সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা কি বিএনপির কোনো খারাপ কাজের সমালোচনা করেন? তারেক রহমানের দুর্বৃত্তির কোনো সমালোচনা ড. এমাজউদ্দিন আহমেদ বা তার মতো কেউ করেছেন? হাওয়া ভবন নামের বিকল্প ক্ষমতাকেন্দ্র গড়ে আওয়ামী লীগ নিধনের নীলনকশা বাস্তবায়নের মতো ঘৃণ্য কাজের কোনো নিন্দা-সমালোচনা বিএনপি-দরদী কেউ করেছেন?
বলা হবে, বিএনপি তো খারাপ। বিএনপির কাছে আমরা ভালো কিছু আশা করি না। কিন্তু আওয়ামী লীগ তো বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া দল। আওয়ামী লীগ কেন কুপথে যাবে, খারাপ করবে?
যারা এমন বলেন, তারা আসলে মেকি বঙ্গবন্ধু প্রেমিক। বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের সহযোগীদের প্রতি যাদের দরদ প্রচ্ছন্ন নয়—তারা কি খুব ভালো মানুষ?
নিরপেক্ষ দাবিদাররা আমাকে আওয়ামী দালাল বলে নিন্দামন্দ করতে পারেন। বিদেশি রাষ্ট্র ও সমাজচিন্তকদের ভারি ভারি সব কিতাব থেকে বাণী উদ্ধৃত করে সবক দিতে পারেন কিন্তু আমি তাদের কাছে সবিনয়ে অনুরোধ করবো, আপনারা চক্ষু মেলিয়া দুই পা ফেলিয়া বাংলাদেশটাকে দেখুন। বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হয় সাধারণ বাঙালির মনন-চিন্তন দিয়েই।
মানুষ এখন অনেক কিছু শিখেছে। মানুষ এখন কেবল ক্ষমতার (দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি-অনিয়মের) হাত বদল চায় না। মানুষ আওয়ামী লীগের চোরবাটপারদের বদলে বিএনপির চোরবাটপারদের ক্ষমতা দিতে চায় না।
বিএনপি অঙ্গীকার করুক, ক্ষমতায় গেলে পুরনো ধারার রাজনীতির বদলে সামনে তাকিয়ে সুশাসন নিশ্চিত করবে, কোনো ধরনের দুর্নীতি-অনিয়মকে প্রশ্রয় দেবে না এবং অন্তত জনাপঞ্চাশেক নীতিনিষ্ঠ মানুষের নাম বলুক যাদের দিয়ে অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করা হবে, তাহলে আমিও তিন তালি দিয়ে মুক্তকণ্ঠে বিএনপির জয়ধ্বনি দেব।
সেটা না হলে কি আওয়ামী লীগের চুরিধারি মুখ বুজে মেনে নেব? না, আওয়ামী লীগকেও ভালো হওয়ার পরামর্শই দেব। লুটপাটে জড়িত কিংবা অযোগ্য হিসেবে পরিচিতদের প্রতি আওয়ামী লীগ কঠোর না হলে আওয়ামী লীগকে খারাপ পরিণতির জন্যই প্রস্তুত থাকতে হবে। বলা হয়ে থাকে, শেখ হাসিনার কোনো বিকল্প নেই। সেটা প্রমাণ করতে হবে খারাপ বা সমালোচিত ব্যক্তিদের মাথা থেকে আশীর্বাদের হাত তুলে নিয়েই। মন্দের প্রশ্রয় দেওয়ার নীতি কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।