এবারের নোবেল লরিয়েটদের মূল বক্তব্যই হচ্ছে, অর্থনৈতিক সংকট এবং মন্দা থেকে আমাদের বাঁচাতে পারে ব্যাংক। কাজেই অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে ব্যাংক ব্যবস্থাকে পুরো ঢেলে সাজাতে হবে।
Published : 16 Oct 2022, 06:27 PM
একটি বিশেষ গোষ্ঠী কারসাজি করে যখন ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছে, খেলাপি ঋণ, তারল্য সংকটসহ নানা সংকটে আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাত যখন জর্জরিত, ঠিক তখন ২০২২ সালের অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার ঘোষিত হয়েছে। ব্যাংক ও আর্থিক খাতের সংকট নিয়ে গবেষণা করে এ বছর অর্থনীতিতে নোবেল পেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান বেনএস বার্নানকে, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডগলাস ডব্লিউ ডায়মন্ড ও ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফিলিপ এইচ ডিবভিগ। সুইডেনের নোবেল কমিটির (রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেস) পক্ষ থেকে ২০২২ সালের অর্থনীতিতে নোবেল প্রাপকদের নাম ঘোষণা করে বলা হয়েছে, ‘‘অর্থনীতিতে ব্যাংকগুলির ভূমিকা, বিশেষত আর্থিক সঙ্কটের সময় বাজারের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য তাদের কার্যকলাপ অনুধাবন করতে তিন অর্থনীতিবিদ গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন।’’ শুধু উন্নত দেশের জন্যই নয়, স্বল্পোন্নত দেশের ব্যাংকিং খাতের ব্যবস্থাপনার নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রেও তাদের গবেষণা থেকে দিকনির্দেশনা পাওয়া যেতে পারে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
প্রসঙ্গত, আশির দশকের গোড়ার দিক থেকেই তিন অর্থনীতিবিদ তাদের গবেষণার মাধ্যমে, আর্থিক সঙ্কট মোকাবিলার ব্যাংকের বহুমুখী ভূমিকা সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। ডগলাস ডায়মন্ড এবং ফিলিপ ডিবভিগ একটি তাত্ত্বিক মডেল তৈরি করে বিস্তারিত ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন ব্যাংকগুলির প্রয়োজনীয়তা। বর্ণনা করেছেন কীভাবে সমাজে তাদের ভূমিকাই তাদের পতন সম্পর্কে গুজব তৈরি করে। আর কীভাবে সমাজ এই দুর্বলতা কমাতে পারে।
অর্থনৈতিক সঙ্কটের সময়ে ব্যাংকগুলির বিভিন্ন ভূমিকা নিয়ে তারা তাদের গবেষণাপত্রে লিখেছেন যে, যদি স্বল্পমেয়াদী ঋণ দীর্ঘমেয়াদী ঋণে রূপান্তরিত হয়, তাহলে এর রূপান্তরের সঙ্গে সম্পর্কিত ঝুঁকিগুলি কী কী। তারা আরও বলেন, ব্যাংকের আমানতের ওপর সরকারি গ্যারান্টি আর্থিক সংকটকে অনেকাংশে বাড়তে দেয় না। কারণ সরকারি গ্যারান্টি আমানতকারীদের মধ্যে একটা আস্থা তৈরি করে। তার ফলে আমানতকারিরা নিজেদের অর্থ ব্যাংকে রাখতে ভরসা পায়। আর এই বাড়তি পাওয়া অর্থ ব্যাংক আরও ঋণ বিতরণে ব্যবহার করতে পারে।
অপরদিকে বেন বার্নানকে, আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সঙ্কট, ১৯৩০ সালের ‘গ্রেট ডিপ্রেশন’ বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি বলেছেন, মনে রাখতে হবে যে, কোম্পানিগুলির বিষয়ে ব্যাংকগুলির বিশেষ অন্তর্দৃষ্টি রয়েছে এবং যখন একটি ব্যাংক ব্যর্থ হয়, তখন এই সমস্ত তথ্য হারিয়ে যায়। একটি ব্যর্থ ব্যাংকিং ব্যবস্থা মেরামত করতে অনেক বছর সময় নেয় এবং এই সময়ের মধ্যে অর্থনীতি খুব খারাপ হয়ে পড়ে। বার্নানকের ব্যাখ্যা বোঝা যায় কেন অর্থনৈতিক মহামন্দা এত দীর্ঘায়িত সংকটে পরিণত হয়েছিল।
২০০৮ সালের আর্থিক মন্দার সময় বার্নানকে মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভের প্রধান ছিলেন এবং তিনি গবেষণালব্ধ জ্ঞানকে বাস্তবে প্রতিফলিত করতে পেরেছিলেন উপযুক্ত নীতি গ্রহণের মাধ্যমে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অর্থনৈতিক সংকট থেকে বের করে আনতে তার ভূমিকা ছিল অনন্য। ওই সময় তিনি ঋণের ক্ষেত্রে সুদের হার শূন্য করে দিয়েছিলেন। এই পদক্ষেপ বিনিয়োগকারীদের চিন্তা অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছিল। আর লোকজনও অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে থেকে ঋণ নিতে কার্পণ্য করেনি। বলা যায় বার্নানকে ঋণ বিলি করে অর্থনীতিকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন।
বার্নানকে ১৯৩০ সালের আর্থিক মন্দার কথা তুলে ধরে নিজের গবেষণায় লিখেছেন যে, অর্থনীতিকে বাঁচাতে যেমন ব্যাংকের ভূমিকা প্রবল, তেমনই ব্যাংকে বাঁচাতে আমানতকারিদের ভুলে গেলে চলবে না। গবেষণায় তিনি দেখিয়েছেন যে, ছোট আমানতকারিরাও খুব বড় ভূমিকা পালন করে। সংকটের সময় সব আমানতকারি যদি ব্যাংক থেকে নিজেদের আমানত তুলে নিতে চাইত তবে অর্থনীতির আর ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হতো না। কারণ ব্যাংক তখনই মজবুত হবে যখন তার কাছে অর্থের জোগান থাকবে। বার্নানকে মনে করেন যেকোনো অর্থনৈতিক সংকট থেকে ঘুরে দাঁড়াতে ছোট আমানতকারিদের ভূমিকা অবহেলা করা যাবে না।
মার্কিন ফেড রিজার্ভের বর্তমান প্রধান জেম পভেল ২০২০ সালের করোনাভাইরাস মহামারীর সময় ঋণের ওপর সুদের হার শূন্যের কাছাকাছি করেছিলেন। ফলে অর্থনীতিতে অর্থের যোগানের ঘাটতি হয়নি। কোনোমতে বেঁচে যায় অর্থনীতি।
বাংলাদেশে সেই ২০১৩ সাল থেকে বিক্ষিপ্তভাবে ব্যাংকিং সঙ্কটের মুখোমুখি হচ্ছে যেখানে বেশ কয়েকটি ব্যাংক ব্যর্থ হয়েছে। বার্নানকের গবেষণা দেখিয়েছে যে, কীভাবে একবার সংকট শুরু হলে, তা শুধু ব্যাংকিং সমস্যাকেই দীর্ঘায়িত করে না, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও কমিয়ে দেয়। ডায়মন্ড-ডিবভিগ-এর গবেষণা দেখিয়েছে, কীভাবে কো-অপারেটিভ ব্যাংক দুর্বল কর্মক্ষমতা তাদের পতনের দিকে পরিচালিত করে।
তাদের গবেষণার আলোকে আমাদের ব্যাংকিং সেক্টরের দুর্বলতা কাটাতে গভীর দৃষ্টি নিবদ্ধের সময় এসেছে। কিন্তু আমরা কি পারব সংকট মোচন করতে? আমাদের দেশে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংক থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। শুধু উদ্যোক্তাদের একটি অংশই নয়, ব্যাংকের কিছু পরিচালক তথা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও এই জাল-জালিয়াতির প্রসারে ভূমিকা পালন করছেন। জালিয়াতির এই টাকা এমন জায়গায় যাচ্ছে যে এক পর্যায়ে ঋণের গ্রাহকের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। যাদের অস্তিত্ব মিলছে, তাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে বেড়ে যাচ্ছে খেলাপি ঋণ, কমে যাচ্ছে আয়। অন্যদিকে ঝুঁকি মোকাবিলার সক্ষমতাও হ্রাস পাচ্ছে। সবটা মিলিয়ে দুর্বল হয়ে পড়ছে ব্যাংক খাত।
এ খাতে খেলাপি ঋণও বড় এক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। গত সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে ১ লাখ ১৬৮ কোটি টাকায় উঠেছে। আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা ও শ্রেণিকৃত ঋণের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার যুক্তি দেখিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণখেলাপিদের আবার বড় ছাড় দিয়েছে। ফলে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে এখন আড়াই থেকে সাড়ে ৪ শতাংশ অর্থ জমা দিলেই চলবে; আগে যা ছিল ১০ থেকে ৩০ শতাংশ। এসব ঋণ পরিশোধ করা যাবে পাঁচ থেকে আট বছরে। যদিও অতীতে এ ধরনের ঋণ পরিশোধে সর্বোচ্চ দুই বছর সময় দেওয়া হতো। আবার তারা নতুন করে ঋণও নিতে পারবেন।
ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতে একের পর এক কেলেঙ্কারি ঘটলেও বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে না। ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ও খেলাপি ঋণ আদায়ে শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে না। সামগ্রিকভাবে পুরো ব্যাংকিং সেক্টরে সুশাসনের জায়গায় বড় ধরনের ঘাটতি আছে।
ব্যাংকিং খাতে দ্বৈত ভূমিকা লক্ষ করা যায়। একদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক, অন্যদিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। ব্যাংকিং খাতে অনেক সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ ব্যাংক নেয় না। ব্যাংকিং ডিভিশন বা সরকারের অন্য পর্যায় থেকে নেওয়া হয়। অথবা বাংলাদেশ ব্যাংক পরে সেটাকে অনুসরণ করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের যে নেতৃত্বদানকারী ভূমিকা, সেটা অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় না। তাদের নজরদারি করা ও পদক্ষেপ নেওয়ার ভূমিকাটা স্বাধীন নয়।
এদিকে ক্রমেই বাড়ছে নগদ টাকার সংকট। ফলে সরকারি খাতে বিনিয়োগ করতে পারছে না ব্যাংকগুলো। বাধ্য হয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেই ঋণ নিচ্ছে সরকার। ব্যাংকগুলোতে আমানতের চেয়ে ঋণ বেড়েছে বেশি হারে। ব্যাংকিং খাতের সুদের হারের সীমারেখা বেঁধে দেওয়ায় ফলে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ সংকুচিত হচ্ছে। দেশে ইনভেস্টমেন্ট জিডিপি রেশিও অনেক কমে যাচ্ছে। বেসরকারি খাতের যে বিনিয়োগ তা মূলত ব্যাংক ফাইন্যান্সিংয়ের ওপর নির্ভরশীল। কেননা, ক্যাপিটাল মার্কেট এখনও যথার্থ ভূমিকা পালন করতে পারছে না।
দুনিয়া দাঁড়িয়ে আছে একটি মন্দার খাদের মুখে। করোনাভাইরাস মহামারীর ফলে বিশ্ব অর্থব্যবস্থার যে ক্ষতি হয়েছিল, সেই ক্ষতের নিরাময় হওয়ার বদলে রুশ-ইউক্রেইন যুদ্ধ তৈরি করেছে গভীরতর বিপদ। বিশ্ব ব্যাংক বা আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার, সব প্রতিষ্ঠানই আশঙ্কা করেছে খুব শিগগিরই বিশ্বে আরেকটি মন্দা আসছে। সেই সময় ব্যাংকিং খাত নিয়ে গবেষণা করা তিন অর্থনীতিবিদকে পুরস্কৃত করে ব্যাংকের গুরুত্বকে নোবেল কমিটি বিশ্ববাসীর সামনে তুলে এনেছেন।
মনে রাখা দরকার যে, এবারের নোবেল লরিয়েটদের মূল বক্তব্যই হচ্ছে, অর্থনৈতিক সংকট এবং মন্দা থেকে আমাদের বাঁচাতে পারে ব্যাংক। কাজেই অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে ব্যাংক ব্যবস্থাকে পুরো ঢেলে সাজাতে হবে। মনে রাখা দরকার যে, পরমাণু-সংক্রান্ত পদার্থবিজ্ঞান শিখে একটা বোমা বানানো যতটা সহজ, তাকে প্রত্যন্ত প্রদেশে আলো দেওয়ার কাজে ব্যবহার করা তার চেয়ে অনেক বেশি কঠিন। ব্যাংক লালবাতি জ্বাললে ধনীদের অসুবিধা কম, তারা সময় বুঝে নিজেদের টাকা সরিয়ে নেন। হয়তো দু-একজন সম্পদশালী ব্যক্তি সাময়িক বিপদে পড়েন। কিন্তু আসল ক্ষতি হয় সাধারণ আমানতকারীর। বহু মানুষের সঞ্চয়কে উৎপাদনশীল বিনিয়োগে চালিত করার ক্ষেত্রে অঙ্কের সঙ্গে প্রয়োজন হয় শাসকদের শুভবুদ্ধি। অঙ্কটা হয়তো ভালো করে দেখিয়েছেন এই তিন গবেষক। কিন্তু আমাদের শাসকরা কি তাদের কথা বিবেচনায় নেবেন?