ভারত চুক্তি স্থগিত করায় পাকিস্তানের ওপর প্রভাব কতুটুকু পড়বে, কিংবা আন্তঃসীমান্ত পানি ব্যবস্থাপনার কী হবে, সেসব উত্তর খুঁজেছে বিবিসি।
Published : 26 Apr 2025, 08:18 AM
কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলার পর ভারত সিন্ধু পানি চুক্তি বাতিল করায় অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগছে, এতে পাকিস্তানের ওপর কী প্রভাব পড়বে। ভারত কী সিন্ধুর পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করতে পারবে?
পারমাণবিক শক্তিধর দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বহু বছর ধরে উত্তেজনা চললেও সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিতের মত কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি।
কিন্তু এবার কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর হামলায় ২৬ জনের প্রাণহানির ঘটনায় ভারতের নেওয়া কঠোর পদক্ষেপের অংশ হিসেবে এই চুক্তি স্থগিতের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
নয় বছর ধরে আলোচনা ও সমঝোতার পর বিশ্ব ব্যাংকের মধ্যস্থতায় ১৯৬০ সালে সিন্ধু পানি চুক্তি হয়েছিল। একে আন্তঃসীমান্ত পানি ব্যবস্থাপনার একটি উদাহরণ হিসেবে দেখা হয়।
চুক্তির আওতায় রয়েছে সিন্ধু অববাহিকার ছয়টি নদী। এর মধ্যে ভারতের অংশে পূর্বাঞ্চলীয় রাভি (ইরাবতী নদী), বিয়াস ও সুতলেজ (শতদ্রু) নদী পড়েছে। আর পশ্চিম অববাহিকার সিন্ধু, ঝেলাম ও চেনাব নদীর ৮০ শতাংশ পড়েছে পাকিস্তানের ভাগে।
বিবিসি লিখেছে, এই পানি চুক্তি নিয়ে অতীতে আপত্তি জানিয়েছে পাকিস্তান। দেশটি ভারতের কিছু জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র ও পানি উন্নয়ন প্রকল্প নিয়েও আপত্তি তুলেছে আগে।
পাকিস্তানের অভিযোগ, ভারত চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করে পানি প্রবাহ কমিয়ে দিয়েছে। পাকিস্তানের কৃষির ৮০ শতাংশ এবং এক-তৃতীয়াংশ জলবিদ্যুৎ সিন্ধু অববাহিকার পানির ওপর নির্ভরশীল।
ভারত এই চুক্তি পর্যালোচনার কথাও বলেছে। দেশটির সরকার বলে আসছে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে এই চুক্তির পরিবর্তন প্রয়োজন।
বছরের পর বছর দুই দেশ বিদ্যমান চুক্তির আওতায় পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু এবারই প্রথম একটি পক্ষ থেকে চুক্তি স্থগিতের ঘোষণা দিল।
ভৌগোলিকভাবে সিন্ধু অববাহিকার উজানের অংশে ভারত। ফলে অবস্থানগত কারণে ভারতের সুবিধাটা বেশি। কিন্তু চুক্তি স্থগিতের মানে আসলে কী? ভারত কী সিন্ধুর পানি ধরে রাখতে পারবে? অথবা সিন্ধুর পানি অন্যদিকে প্রবাহিত করতে পারবে, যা থেকে পাকিস্তান বঞ্চিত হবে? ভারত কী আসলেই সেরকম কিছু করার সক্ষমতা রাখে? বিশেষজ্ঞদের জবাবে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে বিবিসি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভরা মৌসুমে পাকিস্তানের অংশের পশ্চিমাঞ্চলীয় নদীগুলোর হাজার হাজার কোটি ঘনমিটার পানি ধরে রাখা ভারতের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। এত বিশাল পরিমাণ পানি ধরে রাখার মত অবকাঠামো কিংবা পানি সরিয়ে নেওয়ার মত বিস্তৃত খালেরও অভাব রয়েছে ভারতের।
‘সাউথ এশিয়া নেটওয়ার্ক অন ড্যামস, রিভারস অ্যান্ড পিপল’ এর হিমাংশু ঠক্কর বলেন, ভারতের অবকাঠামোর বেশিরভাগই নদী প্রবাহিত জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র, যার জন্য বিশাল পানি সঞ্চয়ের প্রয়োজন হয় না।
জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো নদীর পানির স্রোতকে কাজে লাগিয়ে টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। ফলে প্রকল্পগুলোর অনেক বেশি পানি ধরে রাখার কোনো প্রয়োজন পড়ে না।
ভারতীয় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপর্যাপ্ত অবকাঠামোর কারণে ভারত সম্পূর্ণভাবে পানি কাজে লাগাতে পারছে না। এমনকি ঝিলাম, চেনাব ও সিন্ধুর ২০ শতাংশ থাকার পরও তারা কাজে লাগাতে পারছে না।
এ কারণে ভারতীয় বিশেষজ্ঞরা পানি ধরে রাখার অবকাঠামো তৈরির কথা বলছেন। তবে চুক্তির ধারা বা শর্ত দেখিয়ে পাকিস্তান এ বিষয়টির বিরোধিতা করছে।
ভারতীয় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারত এখন বিদ্যমান অবকাঠামোগুলো পরিবর্ধন করতে পারে। অথবা পানি ধরে রাখার জন্য কিংবা পানি সরিয়ে নেওয়ার জন্য পাকিস্তানকে না জানিয়েই নতুন অবকাঠামো তৈরি করতে পারে।
চুক্তি স্থগিতের কারণে অতীতের মত ভারতকে এখন প্রকল্পের নথিপত্র পাকিস্তানকে দেখানোর প্রয়োজন পড়বে না বলে মনে করেন হিমাংশু ঠক্কর।
সিন্ধু অববাহিকায় ভারতের অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জও রয়েছে। একটি হল ওই অঞ্চলের কঠিন ভূখণ্ড আর কিছু প্রকল্প নিয়ে ভারতের ভেতরেই বিরোধিতা বা প্রতিবাদ রয়েছে।
কাশ্মীরের পেহেলগামে সবশেষ হামলার আগে ২০১৬ সালেও একবার ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে হামলা হয়েছিল। সেই ঘটনার পর ভারতের পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় বিবিসিকে বলেছিল, তারা সিন্ধু অববাহিকায় কিছু বাঁধ ও পানি সংরক্ষণ প্রকল্প নির্মাণের গতি বাড়াবে। যদিও সে ধরনের প্রকল্পের কোনো সরকারি তথ্য নেই। তখন ওই কথা বলা হলেও পরে আর সেটি বেশিদূর আগায়নি।
আবার পাকিস্তানি ইংরেজি দৈনিক ডন লিখেছে, ভারত সিন্ধুর পানিপ্রবাহ বন্ধ করতে পারে কিনা, এর তাৎক্ষণিক উত্তর হল ‘না’। ভরা মৌসুমে পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করার মত কার্যকর কিছু করতে পারবে না ভারত।
এর ব্যাখ্যায় সংবাদমাধ্যমটি লিখেছে, সিন্ধু, ঝেলাম ও চেনাব নদী বিশাল। মে থেকে সেপ্টেম্বর মাসে তুষার গলা শুরু করলে নদীগুলো হাজার হাজার কোটি ঘনমিটার পানি ধারণ করে। এসব নদীর উজানে ভারতে কিছু অবকাঠামো রয়েছে। যেমন- বাগলিহার ও কিষাণগঙ্গা। কিন্তু এসব অবকাঠামোর কোনোটিই এত পরিমাণ পানি ধরে রাখার মত করে তৈরি হয়নি। এগুলো নদীর পানির স্রোতকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে, যাদের পানি ধরে রাখার সক্ষমতা খুব সীমিত। এছাড়া ভারত যদি বিদ্যমান সব বাঁধের মধ্যে সমন্বয় ঘটিয়েও কিছু করে, তাতে পানি প্রবাহের সময় পরিবর্তন হতে পারে সামান্য।
কিছু বিশেষজ্ঞের বরাতে বিবিসি লিখেছে, বিদ্যমান অবকাঠামোগুলো দিয়ে যদি ভারত পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ শুরু করে, তবে পাকিস্তান শুকনো মওসুমে প্রভাবটা বুঝতে পারবে। সেসময় পানির পরিমাণ সবচেয়ে কমে যায়।
টাফট্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘আরবান এনভায়রনমেন্ট পলিসি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল স্টাডিজ’ এর সহকারী অধ্যাপক হাসান এফ খান ডনকে বলেন, শুকনো মওসুমে কী ঘটবে সেটা উদ্বেগের বিষয়। যখন সিন্ধু অববাহিকায় পানি সবচেয়ে নিচের স্তরে থাকে, তখন পানি সংরক্ষণ একটা ব্যাপার হয়ে ওঠে, সময়টা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এইখানে চুক্তির শর্তের অনুপস্থিতির বিষয়টি তীব্রভাবে টের পাওয়া যেতে পারে।
চুক্তি অনুযায়ী পানি সংক্রান্ত তথ্য পাকিস্তানকেও জানানোর কথা ভারতের। এটি বন্যার পূর্বাভাস, সেচ পরিকল্পনা, জলবিদ্যুৎ ও খাবার পানির জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।
সিন্ধুর পানি চুক্তি বিষয়ক ভারতের প্রাক্তন কমিশনার প্রদীপ কুমার স্যাক্সেনা পিটিআইকে বলেন, ভারত এখন পাকিস্তানের সঙ্গে বন্যার তথ্য শেয়ার বন্ধ করতে পারে।
বর্ষাকালে এই অঞ্চলে বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি দেখতে পাওয়া যায়। সাধারণ জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলে এই পরিস্থিতি। পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ বলছে, ভারত এর আগেই পানির প্রবাহ সংক্রান্ত তথ্য খুব কম দিয়েছে।
সিন্ধুর পানি চুক্তি বিষয়ক পাকিস্তানের প্রাক্তন অতিরিক্ত কমিশনার সিরাজ মেমন বলেন, ভারত চুক্তি স্থগিতের ঘোষণার আগেও মাত্র ৪০ শতাংশ তথ্য শেয়ার করত।
এ অঞ্চলে পানি-সংক্রান্ত উত্তেজনা দেখা দিলে প্রতিবারই যে বিষয়টি সামনে আসে তা হল, উজানের দেশটি ভাটির দেশের বিরুদ্ধে পানিকে ‘অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করছে কিনা।
এটাকে অনেক সময় বলা হয় ‘জলবোমা’, যেখানে উজানের দেশ পানি ধরে রেখে হঠাৎ ছেড়ে দেয় কোনো সতর্কতা ছাড়াই। এতে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চলে নিচু এলাকায়।
ভারত ‘জলবোমা’ ব্যবহার করবে?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেটি করলে ভারত নিজেই ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। নিজদের ভূখণ্ডের মধ্যেই বন্যা তৈরি হতে পারে। কারণ ভারতের বাঁধগুলো পাকিস্তান সীমান্ত থেকে অনেক দূরে। তবে এখন কোনো সতর্কতা ছাড়াই ভারত তার জলাধারের পলি অপসারণ করতে পারে। এর ফলে ভাটিতে, অর্থাৎ পাকিস্তানে ক্ষতির কারণ হতে পারে।
সিন্ধুর মত হিমালয়ের নদীগুলো উচ্চমাত্রায় পলি জমে। সেগুলো দ্রুত বাঁধ ও ব্যারেজে জমা হয়। ফলে হঠাৎ পলি অপসারণ করলে ভাটির অংশে গিয়ে তা বড় রকমের ক্ষতির কারণ হতে পারে।
এর বড় একটি চিত্র হল ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় ভারতের উজানে চীন এবং সিন্ধুর উৎপত্তি তিব্বতে।
২০১৬ সালে কাশ্মীরে হামলার ঘটনায় ভারত সতর্ক করে বলেছিল, ‘রক্ত আর পানি একসঙ্গে প্রবাহিত হতে পারে না’। হামলার ঘটনায় পাকিস্তানকে দায়ী করে ভারত। আর সেসময় চীন ভারতের উজানের ‘ইয়ারলুং সাংপো’ নদীর একটি উপনদীর পানিপ্রবাহ আটকে দেয়। ওই উপনদীটি উত্তর-পূর্ব ভারতে গিয়ে হয়েছে ব্রহ্মপুত্র।
পাকিস্তানের মিত্র চীন তখন জানায়, সীমান্তের কাছে একটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের প্রয়োজনে তারা এটি করেছে। কিন্তু ওই পদক্ষেপকে সেসময় ইসলামাবাদকে সাহায্য করতে বেইজিংয়ের এগিয়ে আসা হিসেবে দেখা হয়।
তিব্বতে বেশ কয়েকটি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করেছে চীন। এরপর ‘ইয়ারলুং সাংপো’ নদীর নিম্নাংশে বিশ্বের বৃহত্তম বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের অনুমতি দিয়েছে চীন। বেইজিং বলছে, এর পরিবেশগত প্রভাব খুব সামান্য। কিন্তু ভারতের আশঙ্কা, বাঁধটি ‘ইয়ারলুং সাংপো’ নদীর প্রবাহে চীনকে উল্লেখযোগ্য নিয়ন্ত্রণ দিতে পারে।