ইয়েস স্যার!

সুশাসন ও নজরদারির অভাবে সরকারি কর্মচারীরা সেবা প্রদানকে আর ‘কর্তব্য’ মনে করে না। সেবাগ্রহণকারী জনগণও ভুলে যায় যে সেবা পাওয়াটা তার ‘অধিকার’। উভয় পক্ষের সম্মতিতে সরকারি সেবাকে ‘অনুগ্রহ’ মনে করার একটি রেওয়াজ দাঁড়িয়ে যায় এবং যেকোনো প্রশাসন এই অনুগ্রহ প্রদানের বিনিময়ে মূল্য দাবি করতে শুরু করে। ‘ইয়েস স্যার’ সেই মূল্য প্রদানের অতি প্রাথমিক ‘শৃঙ্গার’।

শিশির ভট্টাচার্য্যশিশির ভট্টাচার্য্য
Published : 24 March 2023, 05:33 PM
Updated : 24 March 2023, 05:33 PM

পাবলিক সার্ভিস কমিশন। পাবলিক সার্ভেন্ট। ইংরেজি ভাষার এই দুই কর্মধারয় সমাসবদ্ধ শব্দের উচিত বাংলা অনুবাদ হতো যথাক্রমে ‘গণসেবা কমিশন’ এবং ‘গণদাস’ কিংবা ‘জনসেবক’। কিন্তু কোনো কারণে বাংলাদেশের সংবিধানে শব্দগুলোর অনুবাদ করা হয়েছিল যথাক্রমে ‘সরকারি কর্ম কমিশন’ এবং ‘সরকারি কর্মচারী’। বাংলা অনুবাদে ইংরেজির ‘সার্ভিস’ বা ‘সেবা’ কথাটা বাদ গেছে, কিংবা ইচ্ছা করে বাদ দেয়া হয়েছে।

মধ্যযুগের ইওরোপে গির্জা বা রাজার কর্মচারী মাত্রকেই ‘ক্লার্ক’ বলা হতো। ল্যাটিন থেকে উদ্ভূত ‘ক্লার্ক’ শব্দ দিয়ে বোঝাত ‘একজন শিক্ষিত ব্যক্তি যিনি ‘ক্লিয়ার’ বা পরিষ্কারভাবে দেখতে সক্ষম’। যদিও ‘ক্লার্ক’ বলতে বাংলা ভাষায় আজ আমরা ‘কেরানি’ বুঝি, শব্দটির ব্যুৎপত্তি বা উৎপত্তিগত বিচারে একজন সচিব এবং একজন অধ্যাপক দুজনেই ক্লার্ক, কারণ প্রথমত, লেখাপড়া শিখে তারা যেকোনো বিষয় পরিষ্কার বুঝতে পারেন এবং দ্বিতীয়ত এই পরিষ্কারভাবে বোঝার জন্যে সরকার বা রাষ্ট্র থেকে তারা বেতন পান। লর্ড মাউন্টব্যাটেন যখন ইংল্যান্ডের রাজাকে পত্র লিখতেন, নিজের নামের অব্যবহিত উপরে তাকে লিখতে হতো: ‘ইওর মোস্ট ওবিডিয়েন্ট ক্লার্ক’। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির যুগে ক্লার্কদের সম্ভবত ‘রাইটার’ বলা হতো, কোলকাতায় পশ্চিমবঙ্গের সচিবালয় ‘রাইটার্স বিল্ডিং’ যার প্রমাণ।

রাষ্ট্রের বেতনভুক যিনি, সচিব, ডাক্তার, অধ্যাপক...যাই তিনি হোন না কেন, তিনি জনগণের দাস বৈ নন। দেশ-কাল নির্বিশেষে মালিকই ছিল দাসদাসীর দণ্ডমুণ্ডের মালিক। মিশরে-চীনে প্রভুর মৃত্যু হলে দাসদাসীদের প্রভুর সঙ্গে জীবন্ত কবর দেওয়া হতো। রামায়ণের কাহিনিতে হনুমান নিজেকে রামের দাস মনে করতেন। নিজের বুক চিরে তিনি নাকি দেখিয়েছিলেন সেখানে রয়েছে প্রভু ও প্রভুপত্মী রাম-সীতার প্রতিকৃতি (দক্ষিণ এশিয়ার অফিসগুলোতে যেমন থাকে সরকার-প্রধানদের প্রতিকৃতি!), যার অন্তর্নিহিত অর্থ হচ্ছে দাস প্রভুকে নিজের অন্তরের অন্তস্থলে ধারণ করবে। 

দাস-দাসীরা মালিকের সামনে মাথা নত করে থাকবে, এটাই যুগান্তরের রীতি। মোঘল বাদশাহ যখন দরবারে ঢুকতেন, তখন আমির-ওমরাহদেরও মাথা নিচু করে কুর্নিশ করতে হতো। ফরাসি পর্যটক ফ্রঁসোয়া বের্নিয়ে (১৬২০-১৬৮৮) তার ভ্রমণকাহিনিতে লিখেছেন, পারস্যের এক রাষ্ট্রদূত মোঘল সম্রাটের সামনে মাথা নিচু করতে রাজি ছিলেন না। সম্রাট আওরঙ্গজেব দরবারের প্রবেশপথে একাধিক নিচু তোরণ বানানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন যাতে সেই দূতকে একাধিকবার মাথা ঝুঁকিয়ে দরবারে ঢুকতে হয়।

হাতটানের বদভ্যাস থাকে চাকর-বুয়াদের, যেমন দক্ষিণ এশিয়ার প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর রয়েছে ঘুস-টুস খাবার বদভ্যাস। নিয়োগ এবং স্বভাব— এই দুই বিচারেই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ভৃত্য সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। যারা পুরা সরকারি চাকরি করে, তারা জনগণের খাস নোকর বা বাঁধা বুয়া। আধা সরকারি কাজ করে যারা, যেমন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা, তারা আধা নোকর বা আধা বুয়া। সরকারি প্রকল্পে কাজ করে যারা, তারা ঠিকা বুয়া।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক নিজেকে সরকারি কর্মচারীদের তুলনায় উচ্চস্তরের জীব মনে করেন বটে। এই মনে করাটা অবশ্যই ভুল, কারণ জনগণকে শিক্ষাসেবা দেবার বিনিময়ে তারাও সচিবদের মতোই বেতন নিচ্ছেন। কারও চৌদ্দ পুরুষে কেউ যদি কখনও চাকরি করে বেতন নিয়ে থাকে, বিপ্লবপূর্ব ফ্রান্সে সেই ব্যক্তিকে অভিজাত বলে গণ্য করা হতো না বলে জানিয়েছেন ভলতেয়ার (১৬৯৪-১৭৭৮) তার ‘কঁদিদ’ উপন্যাসে। মধ্যযুগে একটা সময় পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকেরা পাঠদানের বিনিময়ে ছাত্রদের কাছ থেকে সম্মানি নিতেন। শিক্ষকেরা যেদিন থেকে গির্জা বা নগর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে মাসকাবারি বেতন নিতে স্বীকৃত হলেন ইতালিতে, তখনই কোনো শিক্ষক নাকি মন্তব্য করেছিলেন, ‘আজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরব অস্তমিত হলো। 

কানাঘুষায় শোনা যায়, বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে আজকাল নাকি কয়েক লক্ষ টাকা উৎকোচ দিতে হয়। লক্ষাধিক টাকা ঘুষের লেনদেন হয় মালি বা সাফাইকর্মী নিয়োগে, কখনও সোনার ছেলেদের হাত দিয়ে, কখনও সরাসরি। ভিসিরা যা-ইচ্ছা-তাই করেন বা ‘যাচ্ছেতাই’ ভাবে বিশ্ববিদ্যালয় চালান। বাগানের জন্যে গোবর কিনে কোটি টাকা বিল করেছেন এমন ভিসিও আছেন। এসবের অর্থ হচ্ছে, পুলিশ বা আমলাতন্ত্রের চেয়ে আলাদা কিছু নয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। 

ফরাসি দেশে ভূমিদাসেরা জমির মালিককে বলত ‘সেনিয়র’। এই ল্যাটিনমূল শব্দ থেকে মধ্যযুগের ফরাসিতে তদ্ভব শব্দ ‘সিয়র’ বা ‘সীর’ এবং ইংরেজিতে ‘স্যার’-এর সৃষ্টি হয়। ভারতবর্ষে প্রথম দিকের পাবলিক সার্ভেন্টরা সবাই ছিল উপনিবেশক ককেশিয়ান বা সাদা চামড়ার ইংরেজ এবং প্রজা বা পাবলিক ছিল সব উপনিবেশিত কালা আদমি। বর্ণ ও ক্ষমতাবৈষম্যের কারণে কালো আদমি জনগণকে বাধ্য হয়ে ‘স্যার’ বলতে হতো তাদের সাদা সার্ভেন্টকে। প্রায় সত্তর বছর আগে ইংরেজ বিদায় হয়েছে, কিন্তু কিছু দিন আগে পর্যন্ত বাংলাদেশে ‘ইওর মোস্ট ওবিডিয়েন্ট সার্ভেন্ট’ দিয়ে আবেদনপত্র শেষ করার রেওয়াজ ছিল।

‘নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ অভেদ ধর্ম-জাতি’ লিখেছেন নজরুল। এগুলো আজকাল নেহায়েতই কথার কথা। জাতপাতের ভারতবর্ষের সামাজিক ক্ষমতাক্রমে অনাদিকাল থেকে যে ব্রাহ্মণ আর ক্ষত্রিয়েরা বাকি সব জাতের ওপর ছড়ি ঘুরিয়ে গেছে, কালের বিবর্তনে তারা হারিয়ে গেছে, কিন্তু ছড়িটা তাদের রয়ে গেছে। ব্রাহ্মণের শূন্যস্থান পূরণ করেছে আমলারা, ক্ষত্রিয়ের শূন্যস্থান পূরণ করেছে সেনাবাহিনী। শিক্ষকেরাও নিজেদের ব্রাহ্মণ মনে করেন বটে, কিন্তু তাদের না আছে ব্রাহ্মণের জ্ঞান, না আছে ক্ষমতা, না আছে আত্মসম্মানবোধ। এমন আমলা বিরল নয়, জ্ঞান ও কাণ্ডজ্ঞান কোনোটাই যাদের নেই, শুধু ক্ষমতাটুকু আছে। জ্ঞানের অভাবে তারা মূর্খ, ক্ষমতান্ধ হয়ে তারা উদ্ধত। মূর্খতার ঔরসে, ঔদ্ধত্যের গর্বে কালক্রমে ধ্বংসের সূচনা হয়। 

সুশাসন ও নজরদারির অভাবে সরকারি কর্মচারীরা সেবা প্রদানকে আর ‘কর্তব্য’ মনে করে না। সেবাগ্রহণকারী জনগণও ভুলে যায় যে সেবা পাওয়াটা তার ‘অধিকার’। উভয় পক্ষের সম্মতিতে সরকারি সেবাকে ‘অনুগ্রহ’ মনে করার একটি রেওয়াজ দাঁড়িয়ে যায় এবং যেকোনো প্রশাসন এই অনুগ্রহ প্রদানের বিনিময়ে মূল্য দাবি করতে শুরু করে। ‘ইয়েস স্যার’ সেই মূল্য প্রদানের অতি প্রাথমিক ‘শৃঙ্গার’। ‘স্যার’ দিয়ে ক্ষমতা-রমণের শুরু বটে, কিন্তু উৎকোচ দিয়েই শেষ নয়।

ক্যারিয়ারের শুরুতেই যাদের ‘স্যার’ বলতে শেখানো হয়েছে, ক্যারিয়ার মধ্যগগনে এসে অন্যের মুখে ‘স্যার’ ডাক শুনতে তারা চাইতেই পারে। ক্ষমতানুক্রম-শিকলের নিচের কড়াগুলো যখন উপরের দিকে উঠে আসে, সারাটি কর্মজীবন ধরে মুখ বুজে সহ্য করা গুচ্ছের লাথিঝাঁটার শোধ নেবার উদগ্র ইচ্ছা তাদের হতেই পারে। এক সচিবকে একবার দেখেছি অধস্তন অতিরিক্ত সচিবকে অকথ্য ভাষায় সর্বসমক্ষে অপমান করতে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অতটা ‘গলাচিপা’ হয়তো নয়, কিন্তু অন্তত একজন উপাচার্যকে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের মতো উচ্চপদস্থকে গ্রাম্যভাষায় ধোলাই করতে দেখেছি। সিস্টেমে দোষ অবশ্যই আছে, কিন্তু ব্যক্তিও ধোয়া তুলসীপাতা নয়। ব্যক্তিকে অসম্মান করার রেওয়াজ সমাজে যখন প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, সিস্টেমও তখন সহজেই কলুষিত হয়। 

আমলাদের মধ্যে উচ্চতর বর্ণ অ্যাডমিন ক্যাটাগরির কর্মকর্তারা বিশ্বাস করে, রাষ্ট্রের নজরকাড়া সব সুযোগ-সুবিধা শুধু তাদেরই পাওয়া উচিত। সরকারি ঋণ নিয়ে গাড়ি কিনে সেই গাড়ি উবারে ভাড়া খাটিয়ে তারা টুপাইস কামায়, আবার এদিকে সরকারি গাড়িও ব্যবহার করে। তারা মনে করে, যত অধিদপ্তর, পরিদপ্তর আছে সব তাদের দখলে থাকা উচিত। হুমায়ুন আজাদের (১৯৪৭-২০০৪) আশঙ্কামতো ইতোমধ্যে প্রায় ‘সব কিছু তাদের অধিকারে গেছে’। সরকারি কর্মকর্তাদের ঘাড়ের ‘রগ’ চিনে বঙ্গবন্ধু তাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, ‘অগণিত কৃষক-শ্রমিক-পেশাজীবী তোমাদের ভাই, পিতৃসম। ভুলে যেও না, তাদের টাকায় তোমাদের বেতন হয়।’ সেই সতর্কবার্তা বড় বড় অক্ষরে লিপিবদ্ধ রয়েছে সচিবালয়ের দেয়ালে, কিন্তু কোন চোরা কবে ধর্মের কাহিনি শুনেছে?

ব্যক্তিমাত্রকেই সম্মান করা যেতে পারে। সম্মান প্রদর্শনের প্রয়োজনে একে অপরকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করার রেওয়াজও চালু হতে বাধা নেই। কিন্তু ব্যক্তি যখন নেহায়েৎ নিজের পদের ক্ষমতাবলে অন্যের কাছ থেকে সম্মান আদায় করে নিতে তৎপর হয়, কিন্তু নিজে অন্যকে সম্মান করতে চায় না, তখনই সমাজ—দেহে এমন এক অসহনীয় অস্বস্তির সূত্রপাত হয়, টেকসই উন্নয়নের যা সহায়ক নয়। যে ক্ষমতার মূল উৎস জনগণ, জনগণের উপরই সেই ক্ষমতার অপপ্রয়োগ হওয়াটাও দুঃখজনকতো বটে।

এর প্রমাণও আছে। অ্যাডমিন আমলাদের মধ্যে পাকিস্তান আমলের সিএসপিদের শ্রেষ্ঠতর মনে করা হতো এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর বঙ্গবন্ধু নিজেও হয়তো তাদের যোগ্যতায় বিশ্বাস রাখতেন। কিন্তু অন্য অনেকের মতো পাকিস্তানি আমলাদের বিশ্বাস করেও তিনি ঠকেছিলেন। প্রথম আওয়ামী সরকারকে অকার্যকর করার পেছনে সিএসপি আমলাদের হাত থাকা অসম্ভব নয়। বর্তমান পাকিস্তান একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হবার পেছনেও ওই দেশের আমলাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।

ডিসির অফিস থেকে বেরিয়েই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) শিক্ষক উমর ফারুক রংপুরের ডিসি মহোদয়ার ক্ষমতাগর্বী ‘রং’ আচরণের প্রতিবাদ করেছেন। পুরনো একটি বিতর্ক পুনরায় সামনে আনার জন্য তাকে ধন্যবাদ। তবে চট্টগ্রামি ভাষায় একটি প্রবাদ আছে, ‘সব মাছে বিষ্ঠা খায়, পাঙ্গাসের নাম।’ বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকও কি চান না যে সবাই তাকে ‘স্যার’ বলে ডাকুক? পদের আগে ‘মাননীয়’ বিশেষণ ব্যবহৃত না হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মাত্রেই অ-পদস্থ বোধ করেন না কি? নিজের ছাত্ররা ‘ফারুক ভাই’ বা ‘ফারুক সাহেব’ বললে শিক্ষক মহোদয়ের মনও কি উশখুশ করবে না? সচিবকে ‘স্যার’ সম্বোধনের বাধ্যবাধকতার সঙ্গে এই মানসিকতার তফাৎ কোথায়?

অথচ ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ নামক প্রতিষ্ঠানটির সূচনা যেখানে, সেই পাশ্চাত্যে শিক্ষকদের কেউ ‘স্যার’ বলে না, এমনকি ছাত্ররাও নয়। শিক্ষককে বন্ধুর মতো নাম ধরে ডাকাই সেখানে সাধারণ রেওয়াজ। একজন শিক্ষক মূলত একজন বিদ্যা বা জ্ঞানবিক্রেতা এবং ছাত্রেরা তার সেই বিদ্যা বা জ্ঞান-পণ্যের গ্রাহক বা খরিদ্দার। শিক্ষক কিংবা সচিব দুজনের কেউই মহান কিছু নন, তবে নিজের চরিত্র, কর্মদক্ষতা ও অবদানের কারণে যিনি বা যারা কালক্রমে সমাজের চোখে মহান হয়ে উঠতে পারেন, তার বা তাদের কথা ভিন্ন।

হিন্দু দেবতাদের মধ্যে অনেকেরই একাধিক মাথা ও হাত আছে, কিন্তু একাধিক পা-ওয়ালা দেবতা বিরল। পদবৃদ্ধি হলে অসীম ক্ষমতাবান দেবতাদেরও পতন হয়, মানুষ তো কোন ছার। ‘স্যার’ সম্বোধন বা ‘মাননীয়’ বিশেষণের মধ্যে সম্মান যতটা না আছে, তার চেয়ে বেশি আছে উচ্চপদগর্ব, ক্ষমতাক্রমে উপরের দিকে থাকার অহঙ্কার। মানুষ মাত্রেই জন্মগতভাবে ক্ষমতা-পিয়াসী। পদস্থ হয়ে, সুমধুর ‘স্যার’ ডাক শুনে তার এই ক্ষমতা-পিয়াসের কিছুটা শান্তি হয়। ক্ষমতা একটা সম্পদ এবং সম্পদ মাত্রেরই হারিয়ে ফেলার, অবমূল্যায়িত হবার সার্বক্ষণিক ভয় থাকে। স্বৈরাচারী এবং দমনমূলক মনোবৈকল্যের অন্যতম লক্ষণ বা উপসর্গ এই ‘স্যার’ সম্বোধন।

ঔপনিবেশিক যুগের এই ক্ষমতানুক্রম যৌক্তিক যদি হতো, দেশ-জাতি-সমাজের জন্যে শুভঙ্কর হতো, তবে আমরা একে অবশ্যই সমর্থন করতাম। কিন্তু দুই-দুইবার স্বাধীনতা পাওয়া সত্ত্বেও সব শুভঙ্করের ফাঁকি— যে তিমিরে ছিলাম এক শ বছর আগে, আজও সেই তিমিরেই রয়ে গেছি। পাশ্চাত্যের তুলনায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর পিছিয়ে থাকার অন্যতম কারণ একাধারে ক্ষমতাক্রমিক এবং গণবিরোধী প্রশাসন। অধঃস্তন মাত্রকেই ‘ইয়েস স্যার’ বলতে বাধ্য করা এই পশ্চাদপদ প্রশাসনের অন্যতম বুনিয়াদি ইশারা, একাধারে বংশগত ও সংক্রামক ক্ষমতা-বুভুক্ষার রোগের প্রকটিত উপসর্গ।

উপসর্গ দেখে রোগ নির্ণয় হলেও, উপসর্গ দূর হওয়া মানেই রোগ নিরাময় হওয়া নয়। আইন করে ‘ইয়েস স্যার’ বলা নিষিদ্ধও যদি করা হয়, তার মানে এই নয় যে বাংলাদেশের প্রশাসন রাতারাতি গণবান্ধব হয়ে পড়বে। ক্ষমতা-বুভুক্ষার রোগ সমাজ-মানসের অনেক গভীরে প্রোথিত এবং সেই রোগ শুধু সাধারণ একটি সম্বোধন পরিবর্তন বা নিষিদ্ধ করে দূর করা যাবে না। ক্ষমতানুক্রমের অযৌক্তিকতা সবার কাছে প্রমাণযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য করা গেলে এবং সেই গ্রহণযোগ্যতা মন-মুখ-ব্যবহারে প্রকাশ পেলে এই ক্ষমতা প্রদর্শন রোগ কালক্রমে নিরাময় হতেও পারে।