রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি— সবক্ষেত্রেই অপমান করা আর অপমান করে আনন্দ পাওয়া আমাদের স্বভাব হয়ে গেছে। আমাদের নিজের মানুষ সে শাসক হোক বা সাধারণ— তার অপমানে এত বিকৃত আনন্দ আগে দেখিনি।
Published : 06 Apr 2025, 04:49 PM
গৌতম বুদ্ধের আশ্রমে তার এক শিষ্য সব সময় মন খারাপ করে থাকতেন। তার মন খারাপের কারণ ছিল, তিনি কারও বলা ছোট-বড় কোনো কথাই সহ্য করতে পারতেন না। মাধুকরী করতে গেলে অনেক বাড়ি থেকেই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য সহ্য করতে হতো তাকে। অপমানিত হওয়া লাগত। কেউ তাকে বলত, এত হৃষ্টপুষ্ট যুবক হয়ে ভিক্ষা করতে তোমার লজ্জা লাগে না? ভালো কোনো কাজ করতে পার না? কেউ বলত, পরিবার ছেড়ে এমন সন্ন্যাসী হতে তোমার লজ্জা হয় না? সবার কাছে অবশ্য নয়, তবে কিছু মানুষের কাছ থেকে এমনটা শুনতেই হতো তাকে। যারা এই অপমানগুলো করত, তাদের প্রতি তার মনে রাগ ও ক্ষোভ জমা হতো। শিষ্যটি চাইতেন সবাইকে জবাব দিতে, কিন্তু গৌতম বুদ্ধ সব সময় ক্ষমার কথা বলতেন, সহনশীলতার কথা বলতেন। তিনি শিষ্যদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, ভিক্ষা চাইতে গেলে যে যা-ই বলুক, কাউকে পাল্টা অপমান করা যাবে না। এই কারণে শিষ্যটি চাইলেও কিছু বলতে পারতেন না। কিন্তু মুখে কিছু না বললেও তার মনের মধ্যে এসব নিয়ে একটা যুদ্ধ চলত। কখনো তার প্রচণ্ড রাগ হতো, কখনো মনে হতো সন্ন্যাসী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েই সে ভুল করেছেন।
অবশেষে, যখন তার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেল, তিনি বুদ্ধের কাছে গিয়ে মনের মধ্যে চলা সব কথা খুলে বললেন। বুদ্ধ সব শুনে তাকে বললেন, আমাদের মনের মধ্যে চিন্তা করার অপার শক্তি আছে। মনের চিন্তা যদি সঠিক হয়, তবে তা আমাদের সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছে দিতে পারে। আর যদি চিন্তা ভুল হয়, তবে তা আমাদের বড় ক্ষতিও করতে পারে।
এরপর একদিন গৌতম বুদ্ধ ও ওই শিষ্য একটি গ্রামে মাধুকরী করতে গেলেন। সেখানে বুদ্ধকে দেখে সবাই খুব আদর-যত্ন করল। বুদ্ধের সঙ্গে শিষ্যটিও ছিল বলে তাকেও অনেক সম্মান করা হলো। অপমান তো দূরের কথা, সেদিন যে সম্মান পাওয়া গেল, তা শিষ্যটি আগে কখনো পাননি। শিষ্যটি মনে মনে ভাবলেন, এটাই তো রাজপুত্রের সঙ্গে থাকার সুবিধা। সবাই জানে গৌতম বুদ্ধ একজন রাজপুত্র ছিলেন। ভিক্ষা করতে এলেও তাকে অপমান করার সাহস কার আছে? অপমান তো আমাদের মতো ছোটখাটো মানুষদের হতে হয়। আমাদের কেউ কেউ তো মানুষ বলেও মনে করে না। বুদ্ধ শিষ্যটির মুখের হাসি ও আনন্দ দেখে মুচকি হাসলেন।
তারপর তারা ওই গ্রাম থেকে ভিক্ষা নিয়ে একটু দূরের আরেকটি গ্রামে গেলেন। শিষ্যটি আনন্দের সঙ্গে সেখানে গেলেন। তিনি ভেবেছিলেন, এখানেও তাদের খুব সম্মান করা হবে, আগের গ্রামের মতোই আদর-যত্ন পাওয়া যাবে। কিন্তু এই গ্রামে ঠিক উল্টোটা হলো। এই গ্রামের কিছু মানুষ বুদ্ধকে সহ্য করতে পারত না, তাকে অপছন্দ করত। তাই তারা বুদ্ধ ও তার শিষ্যকে আজেবাজে কথা শোনাল। কেউ কেউ বুদ্ধকে এতটাই অপমান করল, যা শিষ্যটির প্রতি কেউ কখনো করেনি। শিষ্যটি দেখলেন, গ্রামের লোকেরা বুদ্ধকে অপমান করছে, কিন্তু বুদ্ধ তবু শান্ত রয়েছেন। তিনি সেই মানুষদের আশীর্বাদ করছেন, তাদের কল্যাণ কামনা করছেন এবং হাসিমুখে সেখান থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। এসব দেখে শিষ্যটি খুব অবাক হলেন।
ভিক্ষা নেওয়া শেষ হলে বুদ্ধ শিষ্যটিকে নিয়ে আশ্রমে ফিরে এলেন। ফিরে এসে শিষ্যটি লক্ষ করলেন, বুদ্ধের মধ্যে কোনো পরিবর্তন নেই। তিনি অন্য দিন যেমন থাকেন, আজও তেমনই আছেন। তিনি মনে মনে ভাবলেন, এত অপমানের পরেও কি বুদ্ধের একটুও খারাপ লাগেনি? তিনি কীভাবে এত শান্ত থাকছেন? অবশেষে ধৈর্য ধরতে না পেরে শিষ্যটি বুদ্ধকে বলেই ফেললেন, হে বুদ্ধ! আমার মনে হয়, আমাদের ওই গ্রামকে বয়কট করা উচিত। আমাদের কারও ওই গ্রামে আর ভিক্ষা করতে যাওয়া উচিত নয়। যারা আপনাকে আর আমাকে অপমান করেছে, তাদের বহিষ্কার করা উচিত। আমার তো তখন থেকে রাগে শরীর জ্বলে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এখনই গিয়ে ওদের কিছু কথা শুনিয়ে আসি। আপনি কীভাবে এত শান্ত থাকছেন? ওদের কথায় কি আপনার একটুও খারাপ লাগেনি?
বুদ্ধ হেসে বললেন, আচ্ছা, ধরো তুমি একটা কোদাল নিয়ে মাটি খুঁড়তে গেলে। পৃথিবী কি তার প্রতিবাদ করবে? শিষ্য বলল, না। বুদ্ধ বললেন, ঠিক আছে। এবার ধরো, কেউ একটা জ্বলন্ত মশাল নিয়ে নদীতে আগুন লাগাতে চায়। সে কি নদীতে আগুন লাগাতে পারবে? শিষ্য বলল, না। বুদ্ধ জিজ্ঞাসা করলেন, কেন? শিষ্য বলল, কারণ নদীতে জ্বলার গুণ নেই। বুদ্ধ বললেন, কেউ মাটি খুঁড়তে এলে পৃথিবী প্রতিবাদ করে না, কিন্তু তাই বলে পৃথিবী দুর্বল নয়। পৃথিবী চাইলে সবাইকে নিজের মধ্যে সমাহিত করে নিতে পারে। নদীতে কেউ জ্বলন্ত মশাল নিয়ে আগুন লাগাতে চাইলে নদী জ্বলে না, কিন্তু তাই বলে নদী শক্তিহীন নয়। নদী চাইলে এক নিমেষে সবাইকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে। ঠিক তেমনই, কেউ তোমাকে অপমান করলে বা ছোট করার চেষ্টা করলে তুমি ছোট হয়ে যাও না। তোমাকে ছোট মনে হচ্ছে তোমার মনের চিন্তা আর রাগের কারণে। তুমি যদি নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখে যাও, তাহলে এই মানুষগুলোকে উপেক্ষা করতে শিখবে। তখন তারা একবার, দুবার, তিনবার অপমান করার পর আর কোনো আনন্দ পাবে না।
রবীন্দ্রনাথকেও কম অপমান সহ্য করতে হয়নি। স্বয়ং দ্বিজেন্দ্রলাল রায় তার পেছনে লেগেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ইংল্যান্ড থেকে ফিরে আসার পর তাকে নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক নাটক লিখে মঞ্চস্থ করেছিলেন। তখনও কবি নোবেল পাননি। পাবেন কি পাবেন না— এমন নাটকীয়তার মধ্যে তাকে অপদস্থ করার চেষ্টা করে লেখা নাটকটি মানুষ গ্রহণ করেনি। উত্তেজিত জনতা জুতো ছুড়ে প্রতিবাদ জানাতে শুরু করলে দ্বিজেন্দ্রলাল নীরবে হল ত্যাগ করে চলে যান। এরপর তিনি বেশিদিন বাঁচেননি। অন্যদিকে, ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ বাঙালির জীবনে প্রথম নোবেল এনে দেন।
এসব মান-অপমানের গল্প আমার বানানো নয়। এগুলো সবাই জানে। তবু আমরা এ থেকে কোনো শিক্ষা নিই না। রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি— সবক্ষেত্রেই অপমান করা আর অপমান করে আনন্দ পাওয়া আমাদের স্বভাব হয়ে গেছে। আমাদের নিজের মানুষ সে শাসক হোক বা সাধারণ— তার অপমানে এত বিকৃত আনন্দ আমি আগে দেখিনি। দিনশেষে আমাদের দেশ, মানুষ আর ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার মঙ্গলই বড় বিষয়। অনুগ্রহ করে নিজেদের ছোট দেশ, ছোট সমাজের বড় কাউকে অপমান করবেন না। তাকে অন্য কেউ তাচ্ছিল্য বা ছোট করলে সবাই মিলে জবাব দেওয়ার ক্ষমতাই আমাদের শক্তি। তখনই অন্যরা আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাতে বাধ্য হবে।