রাষ্ট্রসংস্কার কোথায় কোথায় হওয়া প্রয়োজন— শিক্ষায়, স্বাস্থ্যে, শিশুকল্যাণে, বাণিজ্যেসহ রাষ্ট্রব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতে। আশ্চর্য হলো, এর অনেককিছুই আলোচিত হয়েছে ‘সুলতানার স্বপ্ন’ গল্পের বইটিতে। আমাদের বর্তমান রাষ্ট্রসংস্কারের উদ্যোগীরাও সেজন্য রোকেয়ার বইটা আবার পড়ে দেখতে পারেন।
Published : 26 Dec 2024, 05:54 PM
রোকেয়ার স্বপ্ন কী? সুলতানার স্বপ্ন— যার কথা রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন লিখেছেন তার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ গল্পটিতে। ২৫ বছর বয়সে রোকেয়ার ইংরেজিতে লেখা সুলতানা’স ড্রিম প্রথম প্রকাশিত হয় ইন্ডিয়ান লেডিজ ম্যাগাজিনে। সেই ১৯০৫ সালে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাবঞ্চিত রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন শিক্ষাদীক্ষায় পিছিয়ে থাকা বাংলার প্রেক্ষাপটে মুসলিম পারিবারিক রক্ষণশীলতার ঘেরাটোপে বসে এই যে কল্পনাটি করেছিলেন তা এক বিরাট বিস্ময়। ১৯০৮ সালে এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। ১৯২২ সালে তিনি নিজেই এটি বাংলায় অনুবাদ করেন। সুলতানা’স ড্রিম লেখার পর তিনি বিরাট কর্মযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়েন। বাংলার পশ্চাৎপদ সমাজ থেকে নানারকম কুসংস্কার দূর করতে এবং মেয়েদেরকে সংস্কারের নাগপাশ থেকে মুক্ত করে পূর্ণ মানবিক মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে বেগম রোকেয়া একের পর এক সংগ্রামী কাজ করেছেন এবং গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ ইত্যাদি লিখেছেন এই মহীয়সী নারী।
এখানে বলে রাখা ভালো সর্বসাধারণ্যে ‘বেগম রোকেয়া’ নামে পরিচিত এই মানুষটির নাম ছিল রোকেয়া খাতুন। ইংরেজিতে তিনি সই করতেন Roquiah Khatun নামে। রংপুরের পায়রাবন্দের রোকেয়া খাতুন বিয়ের পর কলকাতায় গিয়ে স্বামীর নাম সঙ্গে জুড়ে পরিচিত হন রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন বলে। নামের আগে-পরে তিনি নিজে কখনও ‘বেগম’ শব্দটি ব্যবহার করেননি।
বাংলার বেগম রোকেয়া মানবজাতির জন্য সৃষ্টি করে গেছেন অমূল্য মানসসম্পদ। কিন্তু বাংলায় রোকেয়া নিয়ে আলোচনা সেই তুলনায় অনেক কম। কেবল তাই নয়, যেটুকু আলোচনা হয় তাও একপেশে ও খণ্ডিত। তবে রোকেয়াকে নিয়ে আগ্রহ ক্রমান্বয়ে বিশ্ব পরিসরে এবং দেশেও বাড়ছে। যদিও সাম্প্রতিককালে দেশে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে কিছু রোকেয়া-বিদ্বেষেরও প্রকাশ ঘটেছে। এই অবস্থায় রোকেয়াকে নতুন করে দেখার প্রয়োজনয়ীতা অনস্বীকার্য।
রোকেয়ার জন্ম ও মৃত্যু দুইই ৯ ডিসেম্বর। দিনটি বাংলাদেশে রোকেয়া দিবস হিসেবে পালিত হয়। এবার এ দিবস উপলক্ষে দেশের চারজন নারী বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য রোকেয়া পদকে ভূষিত হয়েছেন। এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, “বেগম রোকেয়া অত্যন্ত কঠিন সময়ে বড় হয়েছিলেন যখন মেয়েরা তাদের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার পর্যাপ্ত সুযোগ পায়নি। কঠিন সময়ে রোকেয়া একজন সাহসী মেয়ে ও মহিলা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তার কাজ, চিন্তা ও কল্পনাশক্তি আমাকে অবাক করে।”
সেখানে তিনি আরও গুরুত্বপূর্ণ নতুন যে কথা বলেছেন তা হলো, ‘সুলতানার স্বপ্ন’ যেটা বেগম রোকেয়া রেখে গেছেন তা নিয়ে একটা সিরিজ পুরস্কার চালু করা যায়। তিনি প্রস্তাব করেছেন, সুলতানার স্বপ্ন ২০২৪, সুলতানার স্বপ্ন ২০২৫— এরকম ধারাবাহিক পুরস্কারের। কারণ সুলতানা থেমে যায়নি। “এটা চলছে, চলমান চিন্তা।” তিনি বলেছেন, কুসংস্কারমুক্ত সমাজ গড়তে যিনি সবচেয়ে ভাল আইডিয়া দিবেন প্রতি বছর তেমন একজনকে এই পুরস্কার দেয়া যেতে পারে।
তাহলে সুলতানার স্বপ্নটা কী যা বাংলাদেশের সমাজ গড়ারও স্বপ্ন হতে পারে? আমাদের প্রচলিত ব্যাখ্যায় রোকেয়া কেবলমাত্র একজন নারীবাদী সমাজ সংস্কারক ও লেখক। এই উপন্যাসেও এমন একটি ছবি আছে যেখানে দেখা যায়, সুলতানার আধো পরিচিত ভগিনী সারার লেডিল্যান্ডে বা নারীস্থানে নারীরাই রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালনা করে, আর পুরুষেরা অন্তঃপুরবাসী মানে ঘরের কাজ করে। আজ থেকে প্রায় সোয়াশো বছর আগে অনগ্রসর বাংলায় বসে এমন একটি সমাজ কল্পনা করতে পারাটা নিঃসন্দেহে দুঃসাহসিক।
তবে এরচেয়েও দুঃসাহসিক ধারণা আছে তার লেখায়। আজকাল আমরা যখন রাষ্ট্রসংস্কার বলে বলে অনেকদিন ধরে হৈচৈ করছি, আসলে কী করব তা না বুঝেই, তখন সুলতানার স্বপ্নের দেশটি থেকে একবার ঘুরে আসা যায় শ দুয়েক টাকায় একখান বই কিনে বা অনলাইনে সম্পূর্ণ ফ্রি পড়ে। বোঝা যাবে রাষ্ট্রসংস্কার কোথায় কোথায় হওয়া প্রয়োজন— শিক্ষায়, স্বাস্থ্যে, শিশুকল্যাণে, বাণিজ্যেসহ রাষ্ট্রব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতে। আশ্চর্য হলো, এর অনেককিছুই আলোচিত হয়েছে ‘সুলতানার স্বপ্ন’ গল্পের বইটিতে। আমাদের বর্তমান রাষ্ট্রসংস্কারের উদ্যোগীরাও সেজন্য রোকেয়ার বইটা আবার পড়ে দেখতে পারেন।
বিগত দিনের আওয়ামী শাসন জিডিপি অর্জনের ক্ষেত্রে আংশিক সফল হয়েছিল। এজন্য তাদের উন্নয়নের গল্পটা জিডিপির মাপকাঠিতে সত্য ছিল। কিন্তু প্রয়োজনীয় সব মানবিক দিক থেকেই সেটি ছিল মিথ্যা। সে কারণেই তাসের ঘরের মত ধসে পড়ল আওয়ামী লৌহ দুর্গ। আওয়ামী উন্নয়নের গল্পে বাহ্যিক চমক থাকলেও সারবত্তা ছিল না। সত্যিকার উন্নয়নের নতুন আধুনিক মাপকাঠির মাঝে জাতিসংঘ প্রবর্তিত ‘মানব উন্নয়ন সূচক’ (এইচডিআই) ও মোট জাতীয় সুখ (জিএনএইচ) প্রতিযোগিতায় এগিয়ে। আর আশ্চর্য হলো সুলতানার কথামত: নারীস্থানের আরেক নাম হতে পারতো ‘সুখস্থা ‘।
আবার স্বপ্নের নারীস্থান রাষ্ট্র হিসেবে ধর্মবাদী, ধর্মহীন ও ধর্মনিরপেক্ষ কোনোটিই নয়। এটি বরং একটি ধর্মরাজ্য যেখানে, ভগিনী সারার কথায়: “আমাদের ধর্ম প্রেম ও সত্য। আমরা পরস্পরকে ভালবাসিতে ধর্মতঃ বাধ্য এবং প্রাণান্তেও সত্য ত্যাগ করিতে পারি না।”শিক্ষা বলতে রোকেয়া শুধু সনদপ্রাপ্তি বুঝতেন না; তিনি বলেছেন প্রকৃত শিক্ষার কথা যা মানুষের মনকে বিকশিত করে। সুলতানার এ স্বপ্নের রাজ্যে কোনো অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড নেই, কর্মসময় দৈনিক দুই ঘণ্টা, শিশুমৃত্যু ও অকালমৃত্যু দুর্ঘটনা ছাড়া নেই বললেই চলে, মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স একুশ। আধুনিক অনেক উন্নত রাষ্ট্র এখন এগুলো নিজেদের মত করে বাস্তবায়নের পথে।
সুলতানার মত এক অবলা নাগরিকের কথাতেই স্বপ্নের নারীস্থান হচ্ছে স্বাস্থ্য, শান্তি, জ্ঞান বা মেধা, প্রেম ও সত্যের দেশ। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। রোকেয়ার কল্পনার ঘুড়ি আরও রঙিন ও নজরকাড়া। রোকেয়া মনে করেননি যে এরকম একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা হাওয়ার ওপর গড়ে উঠতে পারে— সমতুল বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিগত বিকাশ ছাড়াই বা তাকে পাশ কাটিয়ে। সে কারণে সুলতানার স্বপ্ন কেবলমাত্র এক নারীবাদী গল্প ও ইউটোপিয়া মাত্র নয়— এ এক ব্যতিক্রমী বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিও। যে পরিচয়টি দুঃখজনকভাবে রোকেয়ার বাংলায় উপযুক্ত আলোচনার অভাবে অবহেলিত। তবে সুখের বিষয় হলো, পশ্চিমে ব্যাপারটা এমন নয়, বরং উল্টো।
লন্ডনভিত্তিক বিজ্ঞান-লেখক থমাস লিউটন ২০১৯-এ ফেমিনিস্ট ভিশনস অব সায়েন্স অ্যান্ড ইউটাপিয়া ইন রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন’স সুলতানা’স ড্রিম প্রবন্ধে একে বলেছেন “বিশ্বে প্রথম দিককার নারীরচিত বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিগুলোর একটি।’ লিউটন আরও লিখেছেন— বিজ্ঞান ও সাম্রাজ্যবাদের দীর্ঘকালীন সুসম্পর্কের সমালোচনা রোকেয়ার সুলতানার স্বপ্ন। রোকেয়া লিখেছেন, “আমরা অপরের জমি-জমার প্রতি লোভ করিয়া দুই দশ বিঘা ভূমির জন্য রক্তপাত করি না; অথবা এক খণ্ড হীরকের জন্যও যুদ্ধ করি না–যদ্যপি তাহা কোহেনূর অপেক্ষা শত গুণ শ্রেষ্ঠ হয়; কিম্বা কাহারও ময়ূর সিংহাসন দর্শনেও হিংসা করি না। আমরা অতল জ্ঞান-সাগরে ডুবিয়া রত্ন আহরণ করি। প্রকৃতি মানবের জন্য তাহার অক্ষয় ভাণ্ডারে যে অমূল্য রত্নরাজি সঞ্চয় করিয়া রাখিয়াছে, আমরা তাই ভোগ করি।”
সম্প্রতি বিজ্ঞানভিত্তিক গল্প-প্রবন্ধের লেখক আশরাফ আহমেদ ‘বাংলা সাহিত্যের প্রথম কল্পবিজ্ঞান লেখক বেগম রোকেয়া’ শীর্ষক ব্যতিক্রমী গবেষণাগ্রন্থটিতে (আগামী প্রকাশনী, ২০২৪) সুলতানার স্বপ্নের নারীস্থান সম্পর্কে লিখেছেন, “দেশে কোনো অপরাধ নেই, মেয়েরা স্বাধীনভাবে চলাফেরা ও কাজকর্ম করতে পারে। শিক্ষা ও বিজ্ঞানই সব সমস্যার সমাধান— এই মতবাদে বিশ্বাসী রাজ্যের রানীর উৎসাহ ও আদেশে মেয়েদের জন্য অসংখ্য স্কুল ও দুটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে।” এর একটিতে সৌরশক্তিভিত্তিক প্রযুক্তি তৈরি ও অন্যটিতে মেঘ থেকে বৃষ্টি সংগ্রহের কৌশল উদ্ভাবন নিয়ে গবেষণা হয়।
আশরাফ আহমেদের মতে এসব বিজ্ঞানভিত্তিক উন্নত প্রযুক্তি ও রাষ্ট্রীয় নীতির কারণে “দেশটি পরিষ্কার ও ঝকঝকে থাকে, সর্বত্র থাকে মনোমুগ্ধকর ফুলের বাগান। সেই দেশে বাল্যবিবাহ নেই, দুর্ভিক্ষ ও মহামারি নেই, নেই প্রসূতির ও শিশু-মৃত্যু। সত্যবাদিতা, ভালবাসা ও মানবতাই সেই দেশের ধর্ম।”
অতএব রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ একটি নারীবাদী ইউটোপিয়া ও বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি তো বটেই, এছাড়াও এটি একটি উন্নত বৈষম্যহীন রাষ্ট্রের পরিকল্পনাও যা বৃহত্তর রাষ্ট্রসংস্কার কর্মকাণ্ডের প্রথম ধাপ। সে কারণে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসের সুলতানার স্বপ্ন নিয়ে বছরভিত্তিক সিরিজ পুরস্কারের প্রস্তাবটি খুবই প্রয়োজনীয় ও সময়োপযোগী। শতবর্ষের ঐতিহাসিক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজ সুলতানার স্বপ্ন বাস্তবায়নের সময় এসেছে বাংলাদেশের নতুন বিপ্লবী প্রজন্মের হাতে।