বর্ষবরণের শোভাযাত্রাকে কেবলমাত্র ‘আনন্দ’ হিসেবে দেখার ভেতর দিয়ে দেশের গ্রামীণ নিম্নবর্গ এবং বৈচিত্র্যময় জাতিসত্তার সংস্কৃতির সাথে যোজন যোজন দূরত্বই জারি থাকে। কোনো বহুত্ববাদী অন্তর্ভুক্তি ঘটে না।
Published : 11 Apr 2025, 10:36 PM
বাংলাদেশের বর্ষবিদায় ও বরণের কৃত্য-উৎসব নিয়ে আমার পাঠ-প্রক্রিয়া খুব বেশি দিনের নয়। ১৯৯৭ সালে প্রথম চৈত্রসংক্রান্তির চড়ক পরব নিয়ে লিখেছিলাম। নরসিংদী, মৌলভীবাজার ও গাজীপুর জেলায় তখনকার প্রচলিত চড়ক নিয়ে লেখাটি ছবিসহ ‘সঞ্চারী’ নামের এক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিল। এরপর দেশের নানাপ্রান্তে পাহাড়, সমতল, বিল, চর, হাওর, বরেন্দ্র, গড়, বন কী নগরে নানা সমাজের নানা জীবনের বর্ষবিদায় ও বরণের কৃত্য-পরবগুলো বোঝার চেষ্টা করে চলেছি।
কৃষিউৎপাদন ব্যবস্থা, ক্ষমতা ও কর্তৃত্ববাদ, নিওলিবারেল ব্যবস্থা, পরিবেশ ও জলবায়ুগত পরিবর্তন প্রতিনিয়ত কীভাবে এসব কৃত্য-পরবের সাথে জড়িত তা বোঝার চেষ্টা করছি। এসব নিয়ে গত বিশ বছর ধরে লাগাতার লেখালেখি করে চলেছি। জনসংস্কৃতির এই ডিসকোর্স কিছুটা হলেও নাগরিক আলাপতলে বুদবুদ তুলেছে। বিশেষ করে বর্ষবরণ ও বিদায় উৎসব দীর্ঘসময় ধরে প্রবল বাঙালি জাত্যাভিমানের চাদরে ঢাকা ছিল। সেই চাদর কিছুটা হলেও সরছে, দেশের অন্যান্য জাতিসত্তার কৃত্য-পরবও পাবলিক পরিসরে পরিচিত হচ্ছে।
পহেলা বৈশাখে পান্তা-ইলিশের গ্রামীণ চল নেই। এই তর্ক কিছুটা হলেও, আজ, অন্ততপক্ষে ইলিশ আহরণ বিষয়ক এই রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞা দ্বারা স্বীকৃত হয়েছে। আমরা নানাভাবে তিতাশাক, নানা জাতের ফুল, বুনো সবজি, কাঁচা আমসহ কৃত্য-পরবের বাস্তুসংস্থানগত ঐতিহাসিকতা তুলে ধরবার চেষ্টা করেছি। গ্রামজনপদে এসব চর্চার পরিসর তৈরিতে এক বিঘত হলেও ব্যস্ত থেকেছি। বৈশাখকে কেবলমাত্র লাল-সাদা কিংবা ফাল্গুনকে হলুদ-কমলা, একুশকে সাদা-কালো রঙের কর্পোরেট বাইনারিতে বন্দি করার বিরুদ্ধে আলাপ তুলেছি। বর্ষবিদায়ের কৃত্য-পরব নিয়ে সক্রিয় না হলেও; প্রায় পয়ষট্টি বছর ধরে বর্ষবরণের একটা নগরকেন্দ্রিক ধরণও দাঁড়িয়েছে ছায়ানটের আয়োজনের মধ্য দিয়ে।
ছায়ানট আয়োজিত রমনার বটমূলের (বটমূল ভুলভাবে প্রচলিত, প্রকৃতপক্ষে এটি অশ্বত্থমূল) বৈশাখ আয়োজন, মঙ্গল শোভাযাত্রা, বৈশাখী মেলা কিংবা পাহাড়ে তথাকথিত ‘বৈ-সা-বি উৎসব’ (যদিও এই নামে কোনো উৎসব নেই পৃথিবী নামক এই গ্রহে। চাকমাদের বিজু, ত্রিপুরাদের বৈসু এবং মারমাদের সাংগ্রাইং উৎসবের প্রথম বর্ণ নিয়ে এই মহান জাত্যাভিমানী কাণ্ডটি ঘটানো হয়েছে) আয়োজন নানাভাবেই আমাদের সাংস্কৃতিক পরিসরের চেহারা বিনির্মাণ করে চলেছে। এ চেহারা নিয়ে আমরা নানা শ্রেণি-বর্গ থেকে প্রশ্ন তুলতে পারি। ক্ষমতা, জাত্যাভিমান, কর্তৃত্ব, উৎপাদনসম্পর্ক থেকে বিচ্ছিন্নতা, জননিরাপত্তা, অন্তর্ভুক্তি, অপরায়ণ, নয়াউদারবাদ, বহুত্ববাদ এরকম বহুস্তর থেকে বাহাস তোলা যায়। কিন্তু কোনো যুক্তি-প্রমাণ ছাড়া বর্ষবিদায় ও বরণের পরবকে ‘হিন্দুয়ানী’ ট্যাগিংও করা হচ্ছে। মঙ্গল শোভাযাত্রায় কেন পেঁচা, পাখি, পটচিত্র, ঘোড়া, টেপা-পুতুল, মুখোশ বানানো হবে এই হলো বিবাদের বিষয়। এই ধরণের বাইনারি দিয়া আমরা অস্বীকার করি নিম্নবর্গের সাংস্কৃতিক চৈতন্য। চৈত্রসংক্রান্তির চড়কের নানান কৃত্যমূলক পরিবেশনার অন্যতম অনুষঙ্গ নানা চরিত্রের মুখোশ। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল কিংবা হাওরাঞ্চল জুড়ে গাজীর গীত এক পবিত্র পারর্ফমেন্স। গাজীর গানের অন্যতম অনুষঙ্গ হলো গাজী-কালু-চম্পাবতী-বাঘ-কুমির নানা চরিত্রের বর্ণিল পটচিত্র। দেশের সর্বাধিক মাটির ঘোড়া মানত করা হয় উত্তরাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলের পীরের দরগা ও বিশেষ মাজারগুলোতে। আমরা কী বাংলাদেশের গ্রামীণ নিম্নবর্গের বহুমুখী জটিল সম্পর্কের জীবনসংস্কৃতিকে অস্বীকার করবো? দাবিয়ে রাখবো? বর্ষবিদায় ও বরণকে হিন্দুয়ানি ট্যাগিংয়ের বিশৃঙ্খলা বিগত কর্তৃত্ববাদী সরকারের সময় আবারো উসকে ওঠেছিল। তখন লিখেছিলাম, ‘বাংলা নববর্ষ নিয়ে বিতর্কের মতলব কী’। লেখাটি ২০২৪ সালের ১৪ এপ্রিল দৈনিক সমকালে প্রকাশিত হয়েছিল।
রক্তক্ষয়ী জুলাই অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশ আজ অন্তর্ভুক্তি এবং বহুত্ববাদের আওয়াজ নিয়ে এক নয়া রাজনৈতিক বন্দোবস্তির জন্য দাঁড়িয়েছে। দেশব্যাপী গ্রাফিতির ভেতর দিয়ে নয়া রাজনৈতিক বন্দোবস্তির এই জনআকাঙ্ক্ষা আজ প্রকাশিত। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে বর্ষবিদায় এবং বরণ নিয়ে আমাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রতিবেশগত এবং সাংষ্কৃতিক জিজ্ঞাসাগুলো কী? আমরা কী তা প্রশ্ন করছি।
বাংলাদেশের প্রায় সব জাতিসত্তা এবং বাস্তুতন্ত্রেই চৈত্র মাসেই বছর শেষ হচ্ছে এবং বৈশাখে শুরু হচ্ছে। সময়টি বর্তমানে দেশের কৃষিউৎপাদনের ক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটি বোরো ধানের মওসুম। আবহাওয়া, বাজার এবং রাষ্ট্রের নানাবিধ সিদ্ধান্ত সবকিছু এসময় সন্দিহান ও শঙ্কায় থাকে গ্রামীণ কৃষিজীবী ও কৃষক সমাজ। যদিও ষাটের দশকের আগ পর্যন্ত এ সময়ে এ শঙ্কা ছিল না, কারণ তখন কার্তিক-অগ্রায়হণ মানে আমন মওসুম ছিল প্রধান। কৃষি, পরিবেশ, বাজার, ক্ষমতাকাঠামো সবকিছু প্রতিনিয়ত পাল্টে দিচ্ছে গ্রাম জনপদ ও জীবনের চিত্রভাষ্য। সেক্ষেত্রে বর্ষবিদায় ও বরণ ঘিরে তৈরি হওয়া এবং জারি থাকা মৌলিক সংকট, ঝুঁকি এবং জিজ্ঞাসাগুলো জুলাই অভ্যুত্থানের পর জোরালোভাবে আলাপের বিষয় হওয়া জরুরি ছিল।
কিন্তু নিদারুণভাবে তা ঘটছে না। এখনো কর্তৃত্ববাদী রেজিমের সেইসব বাইনারি চিন্তার ছায়াই উসকে দেয়া হচ্ছে। মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম কী হবে এটাকেই করা হচ্ছে জনতর্কের বিষয়। এখনো কী মোটিফ, কী প্রতীক শোভাযাত্রায় থাকবে এবং কী থাকবে না তাতে কৃষক-শ্রমিকের কোনো অংশগ্রহণ নেই। তর্কটা চলছে কৃষিউৎপাদন বিচ্ছিন্ন শহরের বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্তজনের ভেতর। এই তর্ক কেবল বাইনারি বিভাজন টিকিয়ে রাখছে না, বরং চর্চা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে কর্তৃত্ববাদ। এই প্রবণতা জনআকাঙ্ক্ষা দাবিয়ে রাখতে চাইছে। ঠিক পতিত রেজিম যেভাবে প্রবল হেজিমনি চাপিয়ে রেখেছিল।
বর্ষবিদায় ও বরণের মৌলিক জিজ্ঞাসা ও সংকট আড়াল করে বাইনারি বিভাজন এবং কর্তৃত্ববাদী ন্যারেটিভ চাপানোর বিরুদ্ধে পতিত রেজিমের বিরুদ্ধে গত বৈশাখে লিখেছিলাম। সেখান থেকে কিছু অংশ আজকের আলাপেও টানা যাক, ‘‘...এই তর্ক দেশের কৃষিসভ্যতার ভিত ও বুনিয়াদকে অস্বীকার করছে। এই ভূগোলের প্রকৃতি ও সংস্কৃতির ঐতিহাসিক সম্পর্ককে আড়াল করতে চাচ্ছে কিংবা তারা এইসব ঐতিহাসিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। বর্ষবিদায় ও বরণের সংস্কৃতি নিয়ে এই তর্ক দেশের মেহনতি কৃষিজীবী সমাজকে নিদারুণভাবে অনৈতিহাসিক করার বাহাদুরি। ব্রিটিশ উপনিবেশের এমন বাহাদুরির রক্তদাগ এখনো আছে। পাকিস্তানি জুলুমের রক্তক্ষত আছে। আছে স্বাধীন দেশে সবুজবিপ্লবের রক্তচাবুক। বর্ষবিদায় ও বরণের সংস্কৃতিকে একতরফাভাবে ‘হিন্দুয়ানি’ কিংবা কোনো পুস্তকি ধর্মের সাথে জবরদস্তি করে আলাপে হাজির করবার ভেতর দিয়ে আমরা মূলত প্রমাণ করছি এই ভূগোলের বাস্তুতন্ত্র, প্রকৃতি এবং সংস্কৃতির সাথে আমাদের কোনো ধারাবাহিক সম্পর্ক নেই। এমনকি আমরা প্রমাণ করছি দেশের গ্রামজীবনের কৃত্য, পরব, কৃষি-আচার নিয়ে আমাদের কোনো জানাবোঝা নেই। এভাবে কৃষি ও কৃষকসমাজ চিরকালই যেন অবজ্ঞা আর অবহেলার কিংবা প্রবল বয়ানে উপস্থাপিত ..।’’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের নেতৃত্বে আয়োজিত মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম এখন ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’। খুব সচেতনভাবেই আমি বাক্যটি লিখতে গিয়ে ‘প্লাল্টে দেয়া’ শব্দটি ব্যবহার করিনি, সেটি বাইনারি রাজনীতি হতে পারত। ২০১৬ সালে ইউনেস্কোর বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পেলেও একটি শোভাযাত্রার নাম ‘মঙ্গল’ নাকি ‘বর্ষবরণ আনন্দ’ হবে এ নিয়ে আমার আগ্রহ নেই। কারণ এটি দেশের বর্ষবিদায় এবং বরণের ঐতিহাসিক বোঝাপড়ার সাথে যায় না। তবে ‘মঙ্গল’ রূপকল্পটি যেহেতু বাদ পড়ছে, সেটির কারণ কর্তৃপক্ষের ব্যাখ্যা করা জরুরি। কারণ মঙ্গল শোভাযাত্রা কেবলমাত্র বর্ষবরণের নয়, তা একই সাথে চৈত্রসংক্রান্তির বর্ষবিদায়ের স্মৃতি-বিস্মৃতিকেও সামিল করে। বর্ষবরণের শোভাযাত্রাকে কেবলমাত্র ‘আনন্দ’ হিসেবে দেখার ভেতর দিয়ে দেশের গ্রামীণ নিম্নবর্গ এবং বৈচিত্র্যময় জাতিসত্তার সংস্কৃতির সাথে যোজন যোজন দূরত্বই জারি থাকে। কোনো বহুত্ববাদী অন্তর্ভুক্তি ঘটে না। বর্ষবিদায় ও বরণের শোভাযাত্রা ‘কেবলমাত্র’ আনন্দ নয়, বিগত সময়ের বিষাদ-গ্লানি-যন্ত্রণার স্মৃতি-বিস্মৃতিকেও ধারণ করে।
বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের বিষু, পাঙাল বা মুসলিম মণিপুরীদের গিলা খেলা, হাওরের বেগুন পাতার বর্ত, মুসহরদের সিরুয়া বিষুয়া কিংবা কড়াদের চইত বিশমা, ম্রোদের চানক্রান বা বাঙালিদের সুন্দরবনের দেল বা দেশব্যাপী চড়ক পরব কী কেবলমাত্র আনন্দ আয়োজন? তাহলে বর্ষবিদায় ও বরণের বহুত্ববাদী স্বরকে কেবলমাত্র ‘আনন্দ’ রূপকল্প দিয়ে খণ্ডিত ও খর্ব করা যায় কী? নিশ্চয়ই কর্তৃপক্ষ বিষয়টি ভাববেন, তারচেয়ে বড় বিষয় জুলাই অভ্যুত্থানের পর জনগণের ভাবনাকে এখানে যুক্ত করা জরুরি ছিল। জুলাই অভ্যুত্থানের পর ‘মঙ্গল’ রূপকল্প নিয়ে কোনো বাইনারি থাকার কথা কী? বাঙালি গ্রামীণ সমাজে (এমনকি কিছু আদিবাসী সমাজে) প্রচলিত এক বহুল চর্চিত অনুশীলন ও বিশ্বাস হলো ‘মঙ্গল’ রূপকল্প। মঙ্গলবার একটি শুভ বার। দেশে বহু স্থান নামে মঙ্গল রূপকল্পটি আছে, মঙ্গলবাড়ী কিংবা শ্রীমঙ্গল। বাংলায় একটি গ্রহের নাম আমরা দিয়েছি মঙ্গল। আমাদের এক ধানের নাম মঙ্গল। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট (ব্রি) তাদের উদ্ভাবিত বিআর-১৯ নাম্বার ধানের জনপ্রিয় নাম দিয়েছে ‘মঙ্গল’। বোরো মওসুমের এই ধানটি ১১০ দিনে ফলে। ১৯৮৫ সালে এই ধানের নিবন্ধন হয়। ধানের কি কোনো বাইনারি ধর্ম হয়, হিন্দু বা মুসলিম? ঠাকুরভোগ, ফাতেমা, চুরাক, দেবতাভোগ, গোপালভোগ, গোপালনাড়ু, লক্ষীকাজল, শাহীবালাম, বাদশাভোগ, ফকির, লক্ষীদীঘা, গৌড়াকাজল, হরিশংকর এমন নামের ধানগুলোর নাম কী বদলে ফেলা সম্ভব? এইসব ধান তো মুসলিম, হিন্দু, আদিবাসী, বাঙালি সব কৃষকই চাষ করছে। তারা কেউ কেন সহস্র বছরের এইসব নাম বদলায়নি এই প্রশ্ন তোলা জরুরি। কেন বারবার কর্তৃপক্ষের নামে কিছু মানুষ বাংলাদেশের জনগণের জন্য একতরফা সিদ্ধান্ত নেয়, যার সাথে জনআকাঙ্ক্ষার ঐতিহাসিক ও প্রতিবেশগত সম্পর্ক নেই। কেন তজিংডং পাহাড়ের নাম পাল্টে বিজয় রাখার বাহাদুরি করে রাষ্ট্র? এসব ঘটনা প্রমাণ করে রাষ্ট্র বা ক্ষমতার এজেন্সি বারবার নাম চাপানোর ধারাবাহিকতাই বজায় রাখে। কী কর্তৃত্ববাদী রেজিম, কিংবা গণঅভ্যুত্থানের পরেও। বিগত রেজিমে জবরদস্তি করে এক চাইনিজ হাইব্রিড ধানের নামও রাখা হয়েছিল ‘মঙ্গল’। হেজিয়া-৩০৩ ধানকে ‘মঙ্গল’ হিসেবে বিক্রির জন্য নর্দান সিড কোম্পানিকে ২০০৯ সালের ৪ নভেম্বর অনুমোদন দিয়েছিল জাতীয় বীজ বোর্ড। আজ যারা শোভাযাত্রা থেকে ‘মঙ্গল’ খারিজ করছেন কিংবা যারা ‘মঙ্গল’ বহাল রেখেছিলেন, তাদের কেউই, কোনো পক্ষই একটি চাইনিজ হাইব্রিড ধানের নাম ‘মঙ্গল’ দেয়ার প্রতিবাদ করেননি। কারণ এটি দেশের প্রধান উৎপাদনব্যবস্থা কৃষি এবং দেশের প্রধান জনগোষ্ঠী কৃষকের সাথে সম্পর্কিত বিষয়। বর্ষবরণ ও বিদায় গ্রামীণ কৃষিজীবনের সাথে সম্পর্কিত এক ক্রান্তিকালীন কৃত্য-পরব। এই পরব আয়োজন ও পালনে আজও কৃষকের কোনো স্বর নেই, আওয়াজ নেই। রাষ্ট্রীয়ভাবে বর্ষবিদায় ও বরণ আয়োজনের ক্ষেত্রে কৃষিজীবনের সুরক্ষা এবং কৃষকের শিল্পক্রিয়া, দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামতের সম্মানজনক অন্তর্ভুক্তিই হতে পারে জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী রাজনৈতিক বন্দোবস্ত।
বৈশাখ মাস এমনি এমনি দুম করে চলে আসে না। ১১টি মাস পাড়ি দিয়ে আসে বৈশাখ। একটি মাসের পর আরেকটি মাসের শেষ ও শুরুর চক্রে এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ থাকে। সাধারণত প্রতিটি বাংলা মাসের শেষ দিনই এই সন্ধিস্থল, ক্রান্তিকালীন সময়। সংক্রান্তি নামে যা পালিত হয়ে আসছে নিম্নবর্গের ঐতিহাসিকতায়। প্রতিটি সন্ধিক্ষণ আর ক্রান্তিকালে প্রকৃতির সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকে। ফুল-ফল-মাছ-পাখি-রং-রূপ আর নানান শব্দব্যঞ্জনা। মানুষের সমাজ প্রকৃতির এসব নির্দেশনাকে মান্য করে। সখ্য ও সম্পর্ক গড়ে তুলে। তাই রচিত ও পালিত হয় নানা কৃত্য আর পরব।
বলা নেই, কওয়া নেই দুম করেই বাংলাদেশে বৈশাখের এক রূপকল্প দাঁড় করানো হয়েছিল পান্তা আর ইলিশ মাছের আয়োজনে। যার সাথে প্রকৃতির কোনো নির্দেশনা ও যাপিতজীবনের সম্পর্ক নেই। মিশ্র তিতাশাক ও সবজি ছাড়া বাঙালি কী আদিবাসী সমাজে বর্ষবিদায় কৃত্য হয় না। গিমা তিতা, নেইল্যা, গিমা, দণ্ডকলস, আমরুল, থানকুনি, নিম, নিশিন্দা, তেলাকুচা, মালঞ্চ, কানশিরা, বাসক, ঘৃতিকাঞ্চন, শেফালি, কলমি, হেলেঞ্চা, ঘুম, আদাবরুণ, পিপুল, গন্ধভাদালি, কাঁটাখুদি, ক্ষেতপাপড়া এমন ১৩ থেকে ২৯ রকমের তিতা স্বাদের শাক খাওয়ার চল আছে দেশের নানা জনপদে। পাহাড়ে চাকমারা তিতকরলা, তিত্তুলগুলো, হনাগুলো, বনআলু, কচু, বাঁশকোড়লসহ নানা পাহাড়ি সবজি দিয়ে রান্না করেন ‘পাজন’। প্রায় ৩০ থেকে ১০৭ রকমের মিশ্র সবজির এই রান্নাকে চাক ভাষায় বলে ‘কাইনবোং’, মারমারা বলেন ‘হাং-র’ এবং ত্রিপুরারা বলেন ‘মৈজারবং’। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ধন্যবাদ জানাই, এই প্রথম রাষ্ট্রীয়ভাবে চৈত্র সংক্রান্তির আয়োজন করা হয়েছে এবং চৌদ্দ শাকের পদ রাখা হয়েছে। এটি অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা। তবে এক্ষেত্রে নয়া রাজনৈতিক বন্দোবস্ত কী? গ্রামেগঞ্জে কী তিতাশাক আছে? শাকলতা জন্মানোর জমি, খালের কিনার, রাস্তার ধার, গ্রামীণ বন আছে? কৃষিজমি থেকেই এসব শাকলতা নারীরা সংগ্রহ করতেন। কিন্তু পঞ্চাশ বছর ধরে ‘আগাছানাশক’ দিয়ে এসব শাকলতা খুন করা হয়েছে। সিনজেনটা, মনস্যান্টো, বায়ার, কারগিল, বিএএসএফ কোম্পানির মতো শীর্ষ কর্পোরেট কোম্পানি এসব বিষের ব্যবসা করছে। এখন চৈত্রসংক্রান্তির জন্য শাকলতা না পেলে কৃষক কাকে দায়ী করবে? রাষ্ট্র, কোম্পানি না সরকার? আর এই বিশৃঙ্খলার জন্য কোন মন্ত্রণালয় কাকে দায়ী করবে?
নববর্ষে ইলিশ না খাওয়া নিয়ে যখন লেখালেখি শুরু করেছিলাম, কাজটি অতি দুরূহ ছিল। কারণ একটা তকতকে মধ্যবিত্তীয় ফ্যানটাসি ও কর্পোরেট মুনাফার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়েছিল কিছু তিতাশাকলতা, ফুল আর কাঁচা আম নিয়ে। তখন চ্যানেল-২৪ এবং ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন এ বিষয়ে টকশোতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। আলোচক হিসেবে আমার সাথে আরও ছিলেন চিত্র পরিচালক শহিদুল হক খান। তিনি জানিয়েছিলেন, তারা কয়েকজন বন্ধু মিলে ১৯৮০ সালের দিকে পান্তা-ইলিশের প্রচলন করেন নববর্ষে, মাটির সানকিতে করে বিক্রি করেন এবং পোস্টার করেন। সেই টকশোতে তিনি স্বীকার করেছিলেন পান্তা-ইলিশ তার গ্রাম বা কোনো এলাকার কোনো লোকায়ত পরব ছিল না। নববর্ষের সময় রাষ্ট্রীয়ভাবে ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধ করা হয়। তাহলে জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী নয়া রাজনৈতিক বন্দোবস্তির বার্তা কী হবে এক্ষেত্রে? অবশ্যই ইলিশ জেলেদের সংকটকালীন সময়ে রাষ্ট্রীয় সহায়তা, ইলিশের প্রতিবেশ সুরক্ষা কিংবা সর্বস্তরের ইলিশ-সচেতনতা। কিন্তু কেবল ইলিশ আহরণে নিষেধাজ্ঞা দিলেই হবে না। একইসাথে চৈত্রসংক্রান্তির শাকলতা যাতে নিরাপদ থাকে সেক্ষেত্রে দেশে আগাছানাশক বিষ নিষিদ্ধ করতে হবে। তা না হলে জনগণ খাবে কী, কীভাবে তার কৃত্য-পরব পালন করবে? চৈত্রসংক্রান্তির চৌদ্দ শাক হত্যাকারী আগাছানাশকদের নিষিদ্ধকরণ হতে পারে নয়া রাজনৈতিক বন্দোবস্তি।
বর্ষবিদায় ও বরণ পরবের সাথে নাগরিক শোভাযাত্রার সম্পর্কটা বেশ দূরবর্তী। কিন্তু নানা বয়স, লিঙ্গ, ধর্ম, বর্গের মানুষের মিলন এবং যাত্রা তো ঘটে। চৈত্র সংক্রান্তির সর্বাধিক পরিচিত চিহ্ন হলো গ্রামাঞ্চলে ঘুরে বেড়ানো গাজন, দেল, নীল বা চড়কের দল। লাল সালু কাপড় পরিধান করে এবং শিব-গৌরী সেজে, কেউবা মুখোশ চাপিয়ে মাগন সংগ্রহ করেন। মারমাদের সাংগ্রাইং পরবে সাইঙ গ্যাইক, লুংদি, হাইঙ ছোওয়াহ লোকগান গেয়ে গেয়ে পাড়া প্রদক্ষিণ হয়। কড়াদের চইতবিশমা, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের বিষুতেও এমন শোভাযাত্রা আছে। চাক আদিবাসীরা সাংগ্রাইংয়ের আক্যাই বা দ্বিতীয় দিনে পাড়ার তরুণরা বাইক (ঢোল), লাংহোয়াক (ঝাঁঝ) এবং হ্নে (বাঁশি) বাজিয়ে সবাই গ্রাম প্রদক্ষিণ করে ক্যাংয়ে যায়। পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক আমলে সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ষাটের দশকে ছায়ানটের মাধ্যমে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান আয়োজনের ভেতর দিয়ে এক সাংস্কৃতিক লড়াই শুরু হয় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিসরে। একইসাথে এটিও স্মরণ রাখা জরুরি, যে, দেশের গ্রামীণ নিম্নবর্গ সমতল কী পাহাড়ে বর্ষবিদায় ও বরণ কৃত্য পালনের জন্য তারও আগে থেকেই লড়াই করছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার মাধ্যমে শুরু হওয়া শোভাযাত্রা পরে মঙ্গল শোভাযাত্রা নাম পেলেও, পহেলা বৈশাখে ঢাকাতেও বহু আগে থেকেই মেলা ও মিছিলের প্রচলন ছিল। সৈয়দ মুহাম্মদ তাইফুর রচিত ‘গ্লিম্পসেস অব ওল্ড ঢাকা (১৯৫৬)’ বইটিতে পহেলা বৈশাখে ঢাকায় আয়োজিত সেই মিছিলের কথা আছে। পহেলো বৈশাখে গোয়ালা মির্জা মান্নাস দেউড়ির নেতৃত্বে একটি মিছিল হতো, যা লালচাঁদ গোয়ালা মিছিল নামে পরিচিত। ১৯০২ সাল পর্যন্ত এই মেলা ও মিছিলের খবর জানা যায়। কোনো কিছুই স্থায়ী নয়, একইসাথে কোনোকিছুই অমীমাংসিত এবং প্রশ্নহীন থাকতে পারে না। আমরা সবকিছু বাইনারি বিভাজন আর নিওলিবারেল বিচ্ছিন্নতা দিয়ে মাপছি। আন্দাজ ও ভাগ-বিভাগ করছি। জনগণের উৎপাদন-রোজগারের সংকট, চারধারের বাস্তুতন্ত্র, প্রাণ-প্রকৃতি, ক্ষমতা ও বাজারের রাজনীতি আমরা আমাদের সংস্কার এবং রূপান্তরের আলাপের কেন্দ্রে এখনো বহাল করতে পারিনি। বিগত কর্তৃত্ববাদী রেজিমের হিন্দু-মুসলিম, আওয়ামীলীগ-বিএনপি, আদিবাসী-বাঙালি এমনতর বাইনারিগুলো কেন এখনো অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়েও খবরদারি করবে?
আজকের আলাপখানি শেষ করবো আমার পূর্বের আরেক লেখাকে উদ্ধৃত করে। ‘বর্ষবরণ: সিরুয়া বিষুয়া ও চইত বিশমা’ শিরোনামে লেখাটি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডে প্রকাশিত হয় ২০২৩ সালের ১৩ এপ্রিল। মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে সেখানে লিখেছিলাম, “মঙ্গল শোভাযাত্রা হয়ে ওঠছে আরো অন্তর্ভুক্তিমূলক এব জনসাংষ্কৃতিক আয়োজন। তবে পহেলা বৈশাখর সকল আয়োজনে প্রবল বাঙালি জাত্যাভিমান জারি আছে। কোনোভাবেই ভুলে গেলে চলবে না, দেশে বাঙালি ভিন্ন আরো ৫০ জাতিসত্তা আছে। তাদের সবার বর্ষবিদায় ও বরণের রীতি, কৃত্য ও আয়োজন আছে। সকল কৃত্য-রীতির বর্ণবিভাগুলো কীভাবে মঙ্গল শোভাযাত্রায় মিশবে সেটি নিয়ে বহু কাজ করবার আছে।’’
সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে চাকমা ভাষায় জু-জু, মারমা ভাষায় অগাসা, ত্রিপুরা ভাষা খুলুমকা, মান্দিতে রিমচাকসুয়া, হাজং ভাষায় হিঙা, খাসি ভাষায় খুবলেই, সাদরিতে গড়লাগি, সাঁওতালি ভাষায় জোহার এবং বাংলায় ধন্যবাদ জানাই। সরকার এই জনআকাংখাকে মর্যাদা দিতে যাচ্ছে। আসন্ন ১৪৩২ বাংলার শোভাযাত্রায় সাংস্কৃতিক এবং জাতিগত মর্যাদা অক্ষুন্ন রেখেই এই অন্তর্ভুক্তি ঘটবে আশা করি। নববর্ষ উপলক্ষে প্রধান উপদেষ্টা নিশ্চয়ই জনগণকে এবার অন্তর্ভুক্তিমূলক শুভেচ্ছা জানাবেন। সেই ভাষণে বাংলাসহ দেশের সব জাতির বর্ষবরণ উৎসবগুলোর নাম উচ্চারণ করে সব জাতিসত্তার মাতৃভাষায় দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানানোর জন্য আরেকটি ক্ষুদ্র আকাঙ্ক্ষা জানিয়ে রাখলাম।