স্বল্প আয়ের মানুষগুলো ভরা মৌসুমেও বাজারে গিয়ে ইলিশের দামদর করে চাপিলা, রুই কিংবা পাঙাস কিনে ফিরে আসেন। মনে মনে ভাবেন, দাম আরেকটু কমলে কেনা যাবে। নিজেকে প্রশ্ন করেন, সরকার এত কিছু পারে, ইলিশ মাছের দামটা কমাতে পারে না?
Published : 16 Sep 2024, 04:53 PM
অন্তর্বর্তী সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেছেন,‘এবার দুর্গোৎসবে বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীসহ অন্য নাগরিকরা যেন ইলিশ খেতে পারে, সেটি নিশ্চিত করা হবে। ভারতের চেয়ে দেশের জনগণকেই প্রাধান্য দেওয়া হবে।’ তার ভাষায়: ‘আমরাও দুর্গোৎসব পালন করি। আমাদের জনগণও এটি উপভোগ করবে। আমরা ক্ষমা চাচ্ছি, কিন্তু আমরা ভারতে কোনো ইলিশ পাঠাতে পারব না। এটি দামি মাছ। আমরা দেখেছি, আমাদের দেশের মানুষই ইলিশ খেতে পারে না। কারণ সব ভারতে পাঠানো হয়। যেগুলো থাকে, সেগুলো অনেক দামে খেতে হয়।’
অন্তর্বর্তী সরকারের এই উপদেষ্টার কথাগুলো সংবাদমাধ্যমে এসেছে ১৪ সেপ্টেম্বর। এর আগে ১১ অগাস্টও তিনি দেশের মানুষের চাহিদা মিটিয়ে তারপর ইলিশ মাছ বিদেশে রপ্তানি করা হবে বলে জানিয়ে দিয়েছিলেন।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা ফরিদা আখতারের রাষ্ট্রীয় এই পরিচয়ের বাইরেও একজন কৃষিঅন্তঃপ্রাণ মানুষ বলে পরিচিতি রয়েছে অনেককাল ধরে। তার জীবনসঙ্গী ফরহাদ মজহার এবং তিনি নিজেও নয়া কৃষি আন্দোলনের জন্য খ্যাত। তাদের ‘শস্য প্রবর্তনা’ নিরাপদ খাদ্যের জন্য পরিচিত। কৃষক ও প্রান্তিক মানুষের প্রতি সংবেদনশীল মানুষ হিসেবে ফরিদা আখতারকে চিনি প্রায় দেড় যুগ ধরে। শ্যামলীতে তার অফিস কাম বাসায় যে কত দুপুর বিষমুক্ত সবজি ও মাছ দিয়ে ভাত খেয়েছি, তার কোনো হিসাব নেই। নয়াকৃষি সম্পর্কে জানা ও রিপোর্ট করার জন্য তার সঙ্গে একাধিকবার টাঙ্গাইল ও কুষ্টিয়ায় গিয়েছি। ফলে খুব কাছ থেকে তাকে দেখা ও জানাবোঝার সুযোগ হয়েছে। ফলে এটি বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে যে,ফরিদা আখতার যদি সত্যিই কাজ করতে পারেন বা যদি তাকে সত্যিই কাজ করতে দেওয়া হয়, তাহলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে তিনি এমন কিছু করবেন, যা আগে হয়তো কোনো মন্ত্রী করেননি বা করতে পারেননি। অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে কেন কৃষি মন্ত্রণালয়েরও দায়িত্ব দেওয়া হলো, সেটি খুব পরিষ্কার নয়। ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, ফরিদা আখতার বরং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের চেয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ে অনেক ভালো এবং অনেক বেশি কাজ করতে পারতেন।সেটি অন্য প্রসঙ্গ এবং আপাতত এ আলোচনা থাকুক।
আসা যাক ইলিশের প্রসঙ্গে। ফরিদা আখতার কেন ইলিশ প্রসঙ্গে এতটা হার্ডলাইনে গেলেন? অতীতের কোনো মৎস্য মন্ত্রী কিংবা সরকারের কোনো নীতিনির্ধারক ভারতে ইলিশ রপ্তানি নিয়ে এত সোজাসাপ্টা কথা বলেননি। এর পেছনে কারণ কি শুধুই ভারতবিরোধিতা নাকি ইলিশ নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের আবেগ-অনুভূতি? কারণ সম্ভবত দ্বিতীয়টি। অর্থাৎ ইলিশ মাছ নিয়ে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মনে যে বেদনা, যে না পাওয়ার আক্ষেপ— সেই অনুভূতির সঙ্গে ফরিদা আখতার খুব ভালোভাবে পরিচিত। কারণ প্রান্তিক মানুষের সঙ্গে তার যোগাযোগ অনেক বেশি।
যে কৃষক জমিতে বিষমুক্ত ফসল ফলান; যে নারী তাঁতের কাপড় বোনেন; যে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হাটেবাজারে পুরি-সিঙাড়া বিক্রি করেন, এমনকি যে মানুষটি স্কুল কলেজ মাদ্রাসায় অল্প বেতনে শিক্ষকতা করেন— স্বল্প আয়ের এই মানুষগুলো ভরা মৌসুমেও বাজারে গিয়ে ইলিশের দামদর করে চাপিলা, রুই কিংবা পাঙাস কিনে ফিরে আসেন। মনে মনে ভাবেন, দাম আরেকটু কমলে কেনা যাবে। নিজেকে প্রশ্ন করেন, সরকার এত কিছু পারে, ইলিশ মাছের দামটা কমাতে পারে না? বাড়িতে মেয়ের জামাই এলে তারও মনে হয় বাজার থেকে এক কেজি সাইজের না হোক, অন্তত ৮০০ গ্রাম ওজনের দুটি ইলিশ কিনে আনবেন। কিন্তু বাজারে গিয়ে দেখেন ৮০০ গ্রাম ওজনের দুটি ইলিশ কিনতেও হয়তো দু্ই হাজার টাকা লাগে। এই টাকা দিয়ে তার হয়তো পুরো মাসের চাল-ডাল-তেল-নুন হয়ে যায়। ফলে অতিথি আপ্যায়নে শেষ পর্যন্ত ব্রয়লার মুরগিই ভরসা।
কয়েকটি প্রশ্ন সামনে রেখে এগোনো যাক:
১. ইলিশের দাম কেন এত চড়া এবং ভারতের রপ্তানি বা পাচার বন্ধ হলেই কি ইলিশের দাম সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে চলে আসবে?
২. প্রায়ই গণমাধ্যমের সংবাদ শিরোনাম হয়, ভারতে পাচারকালে বিপুল পরিমাণ ইলিশ জব্দ। প্রশ্ন হলো, ভারতে পাচার করে কী লাভ? ভারতের লোকেরা কি বাংলাদেশিদের চেয়ে বেশি দামে ইলিশ কেনে বা কিনতে পারে?
৩. বাংলাদেশের স্থানীয় বাজারেই যেখানে ইলিশের দাম আকাশছোঁয়া, সেখানে ভারতে পাচার করতে হবে কেন?
৪. ইলিশের দাম আসলেই কেন এত বেশি এবং এই মাছটি নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে কেন এত খেদ, আক্ষেপ, আবেগ?
৫. ভারতে পাচার না হলে বা রপ্তানি না হলেই কি দেশের বাজারে ইলিশের দাম কমে যাবে?
৬. অনেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছেন, ইলিশ মাছ নদী ও সমুদ্রে ধরা পড়ে। তাকে কোনো খাবার দিতে হয় না। তারপরও তার দাম কেন এত বেশি? এই প্রশ্নটি কতখানি যৌক্তিক?
একে একে উত্তর খোঁজা যাক:
ক. ইলিশ কেন ভারতে পাচার হয়, কারা পাচার করেন, পাচার করে কী লাভ যেখানে দেশের ভেতরেই ইলিশের দাম প্রচুর? তাছাড়া পশ্চিমবঙ্গের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও জীবনযাপনের খরচ যেহেতু বাংলাদেশের মানুষের চেয়ে কম, সেখানে বাংলাদেশ থেকে ইলিশ পাচার করে ওখানে অনেক বেশি দামে বিক্রি করা যাবে, এটিও বাস্তবসম্মত নয়। তাহলে ভারতে ইলিশ কেন পাচার হয়? প্রশ্নটি করেছিলাম প্রখ্যাত ইলিশ গবেষক আনিছুর রহমানকে। তিনি উত্তর দিতে পারেননি। বলেছেন, বিষয়টা রহস্যজনক। বরগুনার সাংবাদিক আবু জাফর সালেহ অনেক দিন ধরে উপকূলের মৎস্যজীবী ও মাছ নিয়ে কাজ করছেন। প্রশ্নটা তাকেও করেছিলাম। সালেহ বললেন, তিনিও প্রশ্নটির উত্তর খুঁজছেন। তবে তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের টাকার তুলনায় ভারতের রুপির মান এখন বেশি। পাচারের সঙ্গে টাকা ও রুপির এই পার্থক্য কিছুটা ভূমিকা রাখতে পারে। অনেক সময় বৈধ পথে ইলিশ নেওয়ার জটিলতা এড়াতে ভারতের অনেক ব্যবসায়ী বাংলাদেশ থেকে ইলিশ নিয়ে যান তাদের ক্রেতাদের স্বার্থ বিবেচনায়। তবে এখান থেকে তারা যে দামে ইলিশ নেন, সেই তুলনায় কী পরিমাণ লাভ করতে পারেন, তা নিয়ে সালেহর যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
প্রশ্ন হলো, ভারতে রপ্তানি বা পাচার বন্ধ হলেই কি ইলিশের দাম কমবে? সেই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে সময় টেলিভিশন। ১৩ সেপ্টেম্বর তাদের একটি খবরে বলা হয়, রপ্তানি বন্ধের পরও বাড়ছে ইলিশের দাম। কারণ বাজারে ইলিশের সরবরাহ বাড়লেও সেটি চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত নয়। ফলে ভারতে রপ্তানি বন্ধের কোনো প্রভাব বাজারে পড়েনি। বরং বাজারে দেড় কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ২২০০-২৩০০ টাকায়। এক কেজি ওজনের ইলিশ ১৭০০-১৮০০ টাকায়।
খ. ইলিশের দাম আসলেই কেন এত বেশি এবং এই মাছটি নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে কেন এত খেদ, আক্ষেপ, আবেগ? এর প্রথম কারণ ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ। এটি উৎসবের মাছ। বাড়িতে ইলিশ রান্না মানে একটা বিশেষ ব্যাপার। সবাই সেই বিশেষত্বের স্বাদ পেতে চায়। ইলিশই একমাত্র মাছ যেটি বাজার থেকে কিনে নিয়ে যাওয়ার পথে মানুষ জিজ্ঞেস করে, কত নিলো? এটি বাংলাদেশের একটি প্রাচীন রীতি। অর্থাৎ ইলিশের প্রতি বাঙালির এই আবেগ, অনুভূতি, ঔৎসুক্য ও জিজ্ঞাসা শত বছরের।
গ. ইলিশের দাম কেন এত বেশি? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে আমাদের কিছু হিসাব বুঝতে হবে। যেমন সামান্য কিছু মাছ নদীতে ধরা পড়লেও ইলিশ মূলত বেশি ধরা পড়ে সমুদ্রে। আর ইলিশের দাম বেড়ে যায় এর আহরণের খরচের কারণে। সাংবাদিক আবু জাফর সালেহ বলছেন, গভীর সমুদ্রে সাধারণত এক সপ্তাহের প্রস্তুতি নিয়ে ট্রলারগুলো ইলিশ মাছ ধরতে যায়। গভীর সমুদ্রে বিশুদ্ধ পানি নেই। ফলে জেলেদেরকে পুরো সপ্তাহের পানি ও অন্যান্য খাবার নিয়ে যেতে হয়। এই জেলেরা মূলত শ্রমিক। অর্থাৎ ট্রলার মালিক তাদের দিন হিসাবে বেতন দেন। একটা ট্রলারে ১০ থেকে ১২ জন জেলে থাকেন। তাদের পুরো সপ্তাহের খাবার দিতে হয়। মূল খরচ ট্রলারের জ্বালানি। ট্রলারগুলো চলে ডিজেলে। এখন প্রতিটি ট্রলারে প্রতি ট্রিপে প্রায় আড়াই লাখ টাকার জ্বালানি লাগে। তার সঙ্গে যোগ হয় জেলেদের বেতন ও খাদ্য। সুতরাং, একটা ট্রলার পাঠাতে ট্রলার মালিকের যদি তিন লাখ টাকা খরচ হয়, তাহলে সেই ট্রলারে তিন লাখ টাকার বেশি মাছ থাকতে হবে। না হলে তার লোকসান। সুতরাং কোন ট্রলারে কী পরিমাণ ইলিশ এলো, তার ওপর নির্ভর করে ওই ট্রলার মালিক কত টাকা লাভ করবেন।
ঘ. ট্রলারগুলো কাঠের তৈরি। ফলে এগুলোর আয়ু ১০ বছরের বেশি নয়। একটা ট্রলার বানাতে ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকা খরচ হয়। এটি একটি বড় বিনিয়োগ। সুতরাং ট্রলারে কী পরিমাণ মাছ এলো, তার সঙ্গে এই বিনিয়োগ হিসাব করতে হয়। কয়েক মাস পরপর ট্রলার মেরামত করতে হয়। সেখানে অনেক খরচ আছে।
ঙ. ট্রলারের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি ঝড়ে ডুবে যাওয়া কিংবা দস্যুর কবলে পড়ে সেটি ছিনতাই হয়ে যাওয়া। কোনো একটি ট্রলার গভীর সমুদ্রে ডুবে যাওয়া কিংবা ছিনতাই হয়ে যাওয়ার মানে হলো একজন ট্রলার মালিকের প্রায় কোটি টাকার গচ্চা। সেইসঙ্গে বেশ কিছু মানুষের প্রাণ। যদি তারা বেঁচে ফিরতে না পারেন। এত সব ঝুঁকি নিয়ে ব্যবসা করতে হয় ট্রলার মালিকদের। সালেহ বলছেন, তিনি বরগুনা এলাকায় একাধিক ট্রলার মালিককে চেনেন যারা এই ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন।
চ. ইলিশের দাম আকাশচুম্বি হওয়ার আরেকটি কারণ হাত বদল। আড়ৎ থেকে মাছগুলো রাজধানীর খুচরা বাজারে যাওয়া পর্যন্ত চার থেকে পাঁচবার হাত বদল হয়। প্রতিবার হাত বদলে দাম বেড়ে যায়। যেহেতু ইলিশের প্রতি মানুষের আবেগ-অনুভূতি প্রবল, ফলে এই মাছ নিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে একটা দারুণ প্রতিযোগিতাও চলে। মধ্যস্বত্বভোগীরা এখান থেকে একটা বিরাট অংশ তুলে নেন।
ছ. অভিযোগ আছে, আড়ৎদাররা ইলিশের দাম সবসময়ই উঁচুতে তুলে রাখেন। ট্রলার ভরে মোকামে মাছ এলেও তারা সবসময় সংকট জিইয়ে রাখেন। ক্রেতাদের বোঝাতে থাকেন যে চাহিদার তুলনায় মাছ কম। ফলে ভরা মৌসুমেও ইলিশের দাম কমে না।
জ. ইলিশের দাম আকাশচুম্বি থাকার আরেকটি বড় কারণ এর মাত্রাতিরিক্ত চাহিদা। ভরা মৌসুমে যখন বাজারে প্রচুর ইলিশ দেখা যায়, তখন সচ্ছল মানুষেরা একসঙ্গে বাজারে হামলে পড়েন। যার একটি কিনলেও চলে, তিনি পাঁচ হালি কেনেন। কোরবানির মাংসের মতো ইলিশ কিনে ফ্রিজে ভরে রাখেন সারা বছর খাবেন বলে। ফলে ইলিশের চাহিদা সবসময়ই থাকে তুঙ্গে। অর্থাৎ মুক্তবাজার অর্থনীতি তথা পুঁজিতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় যেখানে মানুষের পকেটে টাকা থাকলেই তিনি যা খুশি কিনতে পারেন, যত খুশি কিনতে পারেন, সেখানে যে পরিমাণ ইলিশ বাজারে ওঠে, ক্রেতার চাহিদা তার চেয়ে বেশি। সেই ধরনের বাজার ব্যবস্থায় স্বল্প আয়ের মানুষ, বিশেষ করে যারা ঢাকার মতো বড় শহরে বসবাস করেন; যাদের আয়ের বড় অংশই চলে যায় ঘর ভাড়া ও অন্যান্য খরচে; যাদের চাল-ডাল-তেল-সবজি ও অতি প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্য কিনতেই হিমশিম খেতে হয়, তাদের পক্ষে ইলিশের দিতে তাকিয়ে থাকা এবং বড় জোর দাম জিজ্ঞেস করে কষ্ট পাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।
আরও পড়ুন:
ইলিশ আগে পাবে দেশের মানুষ, পরে রপ্তানি: উপদেষ্টা