“বাজারে ইলিশ বেশি থাকলেও অতি চাহিদার কারণে দাম বেশিই থাকবে; আর মানুষ বেশি দামেই কিনবে,” বলেন এক বিক্রেতা।
Published : 21 Aug 2024, 09:24 AM
ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাওয়ায় ইলিশ মাছ নিয়ে হা-হুতাশের শেষ নেই স্বল্প আয়ের মানুষের। অন্তর্বর্তী সরকারের মৎস্য উপদেষ্টা অবশ্য সেই মাছের দাম কমানোর উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়েছেন। দাম কমলেও তা কি স্বল্প আয়ের মানুষের নাগালে আসবে?
ভরা মৌসুম হিসেবে এখন ইলিশের দাম কমার আশায় ছিলেন অনেকেই। তবে বাজারের চিত্র ভিন্ন; ১ কেজি আকারের মাছ কিনতে গুনতে হচ্ছে অন্তত দেড় হাজার টাকা।
জেলেরা বলছেন, সাগরে ২৩ জুন পর্যন্ত মোট ৬৫ দিন মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা ছিল। নিষেধাজ্ঞা শেষে ইলিশ শিকারে গিয়ে কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ মাছ মিলছে না।
কারওয়ান বাজারের মাছ ব্যবসায়ী আব্দুল আওয়াল বললেন, ইলিশের দাম এখনও তেমন কমে নাই; সরবরাহও খুব বাড়ে নাই।
“মাছ হচ্ছে দ্রুত পচনশীল। যদি ইলিশ বেশি ধরা পড়ে, আর দেশের বাইরে রপ্তানি না হয়- তাহলে দাম কমবে। এক কেজি ওজনের মাছ ১ হাজারের কাছাকাছি হবে। তবে এর চেয়ে কমবে না।”
ইলিশ শিকারের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতার বর্ণনায় চাঁদপুরের সম্রাট বেপারি বলেন, “এই কয়েকদিন মাছ ধরতে গিয়ে কোনো লাভ হয় নাই। ডিজেলের দাম এতো বেশি যে- সেই অনুপাতে মাছ না পেয়ে আমরা হতাশ।
“দেশের জনসংখ্যা বাড়তেছে, কিন্তু মাছের সংখ্যা নদীতে কমে গেছে। দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ছে, শ্রমিক খরচও বাড়ছে। আগে শ্রমিক নিতে যে খরচ হতো, এখন এর চেয়ে দ্বিগুণ হয়।”
ফেইসবুকে ধাপ্পাবাজি, বাস্তবতা কী
মৎস্য উপদেষ্টা ফরিদা আখতার গেল ১১ অগাস্ট সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ইলিশ নিয়ে নিজের ভাবনার কথা তুলে ধরেন। বলছিলেন, দেশের মানুষের চাহিদা মিটিয়ে তারপর ইলিশ রপ্তানি করা হবে।
ফরিদার কথায়, “দেশের মানুষ যাতে ইলিশ মাছ পায় এবং দাম কমে, সেই উদ্যোগ নেওয়া হবে। দেশের মানুষ ইলিশ পাবে না, আর রপ্তানি হবে সেটা হতে পারে না।”
গত কয়েক বছর ধরে দুর্গাপূজা উপলক্ষে ভারতে ইলিশ রপ্তানি করে আসছিল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার। গত পূজার সময়েও ভারতে ইলিশের প্রথম যে চালান গেছে, একই দিন তার চেয়ে বেশি দামে ইলিশ কিনতে হয়েছে বরিশালবাসীকে।
এছাড়া পয়লা বৈশাখ আসার আগ দিয়েও এই মাছে দাম চলে যায় সাধারণ ক্রেতার নাগালের বাইরে। চলতি বছরে অবশ্য বৈশাখ পাড়ি দেওয়ার পর এই মাছের দাম কমেনি।
সরকার পতনের আগে রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে প্রতি কেজি ইলিশ কিনতে গুনতে হয়েছে হাজার থেকে ১৫০০ টাকা। সরকার বিদায়ের পর সেই দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি দুইশ থেকে আড়াইশ টাকা।
তবে ইলিশের দাম কমার গুঞ্জন ছড়িয়েছে ফেইসবুকে। তাতে কান দিয়ে প্রতারিত হচ্ছেন অনেকেই।
রোববার কারওয়ান বাজারে এক কেজি ওজনের ইলিশের দাম শুনে আর দামাদামি করার সাহস হচ্ছিল না ক্রেতা হান্নানের। বাধ্য হয়ে আধা কেজি আকারের ইলিশের দাম জানতে চাইলেন।
এই আকারের প্রতি কেজি ইলিশের দাম ১২০০ টাকা শুনে চোখ কপালে ওঠা দশা হান্নানের। বললেন, “ফেইসবুকে দেখলাম দাম কম, কিন্তু বাজারে এখনও বেশি।”
বিক্রেতা দুলাল চন্দ্রসের উদ্দেশে তিনি বললেন, “এতো দাম হলে তো কিনে খাওয়ার উপায় নাই। রপ্তানি বন্ধ হয়েও তো লাভ হলো না। ধরাছোঁয়ার বাহিরে দাম চাচ্ছেন।”
তখন দুলালকে বলতে শোনা গেল, “আমাদের দাম বেশিতেই কিনে আনতে হয়েছে। আমরা তো আপনাকে লস দিয়ে বিক্রি করতে পারব না।”
নিজের অভিজ্ঞতা আর ধারণা থেকে হান্নান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এখন ইলিশের মৌসুম চলে, দাম কমার কথা।
“কিন্তু ব্যবসায়ীদের নিশ্চিত একটা বড় সিন্ডিকেট আছে- যারা দাম কমানোর পক্ষে না। এজন্যই দাম কমতেছে না। নদী থেকে অন্য মাছও তো ধরে, সেগুলোর দাম তো কম; শুধু ইলিশের দামই বেশি।”
বিক্রেতা দুলালকে জিজ্ঞেস করতেই বললেন, “এক কেজির একটা ইলিশ কয়েকদিন আগেও ১৭০০ টাকা বিক্রি করছি, আজ ১৫০০ টাকা। দাম তো ২০০ টাকা কমছেই।
“তবে যদি ইলিশ বেশি ধরা পরে, তাহলে দাম আরও কমবে। নাহয় দাম কমার সুযোগ নাই্। ভারতে ইলিশ রপ্তানি করার সঙ্গে দেশের বাজারে ইলিশের দাম একেবারে কমে যাবে- এটা ভুল ধারণা।”
কারওয়ান বাজারে বছর দশেক ধরে ইলিশের ব্যবসা করা দুলাল চন্দ্রের ভাষ্য, “ইলিশের চাহিদা অন্য সকল মাছের চেয়ে বেশি। তাই বাজারে ইলিশ বেশি থাকলেও অতি চাহিদার কারণে দাম বেশিই থাকবে। আর মানুষ বেশি দামেই কিনবে।”
ফেইসবুকে দাম কমার তথ্য দেখে রোববার কারওয়ান বাজারে এসেছিলেন শাহ মো. খালিদ বিন মজিদ। জানালেন, বাস্তবে দাম না কমায় ইলিশ আর কেনা হয়নি তার।
“ইলিশের দাম এক টাকাও কমে নাই। ফেইসবুকে দেখেছি, তাই আশা ছিল কমবে; কিন্তু বাজারে এসে দেখছি উল্টা চিত্র। আসলে সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলে দাম কমানো সম্ভব না। অনেকগুলো হাত হয়ে বাজারে মাছ আসে।”
মারুফ নামের এক ইলিশ বিক্রেতা বললেন, “ইলিশের দাম খুব একটা কমবে না। কারণ ইলিশের চাহিদা সবসময়ই থাকে।”
তার দোকানের সামনের বিভিন্ন আকারের ইলিশের মূল্যতালিকা ঝুলছিল। তাতে দেখা যায়, দেড় কেজি আকারের প্রতি কেজির দাম ২৫০০ টাকা, এক কেজি আকারের প্রতি কেজির দাম ১৭০০ টাকা, ৮০০ গ্রাম আকারের প্রতি কেজির দাম ১৪০০ টাকা এবং ৬০০ গ্রাম আকারের প্রতি কেজি ইলিশের দাম ১৩০০ টাকা।
সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের শুক্রবারের তথ্য অনুযায়ী, দেশের বাজারে ইলিশের সর্বনিম্ন মূল্য ৮০০ টাকা। এক মাস আগে এই দাম ছিল ৭০০ টাকা এবং এক বছর আগে এই সময়ে সর্বনিম্ন দাম ছিল ৬৫০ টাকা।
রপ্তানির প্রভাব কতটা?
দুর্গাপূজার সময় ভারতে ইলিশ রপ্তানির কারণে বাংলাদেশের বাজারে কেমন প্রভাব পড়ে?
এ প্রশ্নের উত্তরে বাংলাদেশ ফিশ এক্সপোর্টার্স অ্যান্ড ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নিজাম উদ্দিন বলেন, “এ কারণে দাম বাড়ে নাই। যখন ইলিশ কম থাকে, তখন দাম এমনিতেই বেশি থাকে।
“ভারতের চেয়ে বাংলাদেশে দাম কম। ব্যবসায়ীদের ভারতে রপ্তানি করলে লাভ অনেক বেশি হতো, দেশেও ডলার আসতো আগে।”
নিজাম বলেন, দুর্গাপূজা উপলক্ষে ১০ থেকে ১৫ দিন ভারতে ইলিশ রপ্তানির সুযোগ পেয়ে আসছিলেন তারা।
“ব্যবসায়ীরাও ভারতে কিছুটা বেশি দামে বিক্রি করতে পারতো। এমনিতে ইলিশ রপ্তানি সবসময় বন্ধই থাকে।”
ইলিশের দাম বর্তমানে কিছুটা কমেছে জানিয়ে তিনি বলেন, “মৌসুম শুরু হওয়ায় কেজি প্রতি ৩০০ টাকার মতো করে দাম কমেছে। তবে রপ্তানি বন্ধ করার কারণে কমেছে- বিষয়টা এমন না।”
ইলিশের অভয়ারণ্য যেখানে ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের তথ্য অনুযায়ী, মোহনা থেকে সমুদ্রের ১,২০০ কিলোমিটার উজানে ও উপকূল থেকে ২৫০ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত ইলিশ পাওয়া যায়। দেশের সমুদ্র, মোহনা ও উপকূলসহ ৩৮টি জেলার ১০০টি নদী-নালায় ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। তবে দেশের ছয়টি উপকূলীয় জেলা ইলিশের অভয়ারণ্য হিসেবে পরিচিত। * চাঁদপুরের ষাটনল থেকে লক্ষ্মীপুরের চর আলেকজান্ডার পর্যন্ত মেঘনা নদীর ১০০ কিলোমিটার। * ভোলার মদনপুর চর ইলিশা থেকে চর পিয়াল পর্যন্ত সাহাবাজপুর শাখা নদীর ৯০ কিলোমিটার। * ভোলার ভেদুরিয়া থেকে পটুয়াখালীর চর রুস্তম পর্যন্ত তেঁতুলিয়া নদীর প্রায় ১০০ কিলোমিটার। * পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার আন্ধারমানিক নদীর পুরো ৪০ কিলোমিটার। * শরীয়তপুরের নড়িয়া ও ভেদরগঞ্জ উপজেলা এবং চাঁদপুরের মতলব উপজেলার মধ্যকার ২০ কিলোমিটার। * বরিশালের হিজলা, মেহেন্দীগঞ্জ ও বরিশাল সদর উপজেলার কলাবাদর ও গজারিয়া মেঘনা নদীর প্রায় ৮২ কিলোমিটার। |
উৎপাদন প্রবৃদ্ধি কমছেই
নদীতে দখল-দূষণ, ডুবোচর ও বাঁধ-সেতুসহ নানা অবকাঠামোর প্রভাবে নদীতে ইলিশের বিচরণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাতে মাছটির প্রজনন হুমকির মুখে পড়ছে, ভাটা পড়ছে উৎপাদন।
চাঁদপুর মৎস্য বণিক সমবায় সমিতির সভাপতি আবদুল বারী বলেন, “নদীতে দূষণ বাড়তেছে, বঙ্গোপসাগর থেকে যেসব জায়গা দিয়ে মাছ ঢুকে- ভোলা, হাতিয়া এসব জায়গায় প্রচুর পরিমাণে ডুবোচর তৈরি হয়েছে। এজন্য মাছ সহজে ঢুকতে পারছে না।
“এছাড়াও বৃষ্টির পরিমাণ কম থাকায় পানির লবণাক্ততা না কাটে তাহলে ইলিশ মাছ আসে না। এরপর নির্বিচারে জাটকা ও মা ইলিশ নিধন করা হয়। এসব নানা কারণে মাছের পরিমাণ কমে যাচ্ছে।”
তবে তার কিছু দাবি অনুমানভিত্তিক বলে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক হাসান ফারুক।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আগের চেয়ে ইলিশের পরিমাণ কমছে না, বরং বাড়ছে। তবে প্রবৃদ্ধির হার হয়ত কমেছে। জেলেদের তো অনুমানভিত্তিক কথা। তারা দেখা যাবে এত মাসে কম পেয়েছে, আবার আরেক মাসে বেশি পেয়েছে।”
ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদন হয়েছে ৫.৩৩ লাখ মেট্রিক টন, যা আগের বছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধির হার ৩.০২ শতাংশ।
২০১৯-২০ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছে ৫.৫০ লাখ মেট্রিক টন, প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৩.২৩ শতাংশ।
২০২০-২১ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছে ৫.৬৫ লাখ মেট্রিক টন, প্রবৃদ্ধির হার ছিল ২.৭৩ শতাংশ।
২০২১-২২ অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদন হয়েছে ৫.৬৭ লাখ মেট্রিক টন, প্রবৃদ্ধির হার কমে হয়েছে ০.৩৫ শতাংশ।
আর ২০২২-২৩ ইলিশ উৎপাদন হয়েছে ৫.৭১ লাখ মেট্রিক টন, প্রবৃদ্ধির হার হয়েছে ০.৭০ শতাংশ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্যবিজ্ঞানের শিক্ষক হাসান ফারুক বলেন, “জাটকা ইলিশ ও মা ইলিশ না ধরার জন্য সরকারের অনেক কর্মসূচি রয়েছে। তাছাড়া দেখভালের জন্য জনবলও আছে।”
তবে ইলিশ ধরার ওপর বাংলাদেশ ও ভারত যে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে থাকে- তাতে সমন্বয় না থাকায় নিরাপদ প্রজনন নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।
এবছর বাংলাদেশের ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা শুরু হয় ২০ মে, শেষ হয় ২৩ জুলাই। আর ভারতে ৬১ দিনের নিষেধাজ্ঞা শুরু হয় ১৫ এপ্রিল, শেষ হয় ১৪ জুন।
ফলে বাংলাদেশের নিষেধাজ্ঞা চলাকালে ভারতের জেলেরা ৩৮ দিন বাংলাদেশ জলসীমায় ঢুকে ইলিশসহ অন্য মাছ ধরার সুযোগ পান বলে ভাষ্য ট্রলারমালিক ও জেলেদের।
দামের হেরফের
ইলিশের জন্য চাঁদপুরের সুখ্যাতি থাকলেও সেখানকার দাম ঢাকার চাইতেও বেশি। রোববার চাঁদপুরে ইলিশের দাম কেজিতে প্রায় ১০০ থেকে ১৫০ টাকা বেশি দেখা গেছে।
সেদিন রাজধানীর অদূরের জেলাটিতে ১ কেজি ওজনের প্রতি কেজি ইলিশ বিক্রি হচ্ছিল ১৬০০ থেকে ১৭০০ টাকায়। আর দেড় কেজি ওজনের ইলিশ বেচা হচ্ছিল ১৮০০ থেকে ১৯০০ টাকায়।
চাঁদপুরে দাম বেশি হওয়ার কারণ কী? সেখানকার মৎস্য বণিক নেতা আবদুল বারী বলেন, “ঢাকায় দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে মাছ যায়। এগুলো মিক্সিং মাছ। চাঁদপুরের মাছের দাম বেশি। ঢাকায় চাঁদপুরের মাছ বলে বিক্রি করবে, কিন্তু সেটা চাঁদপুরের না।
“চাঁদপুরে মাছ মিক্সিং হয় না। ভোলা বা লক্ষ্মীপুর থেকে মাছ আসলে- সেটা আমরা সেভাবেই বিক্রি করি।”
আবার নদী ও সাগরের ইলিশের দামেও ভিন্নতা আছে।
দেখতে এক হলেও নদীর ইলিশ আর সাগরের ইলিশের স্বাদ যেমন ভিন্ন, তেমনই দামও ভিন্ন জানিয়ে মৎস্য গবেষক হাসান ফারুক বলেন, “সাগরের ইলিশের চেয়ে নদীর যে ইলিশটা সেটার স্বাদ অনেক বেশি। তাই দামও বেশি।
“কিন্তু বাজারের সাধারণ ক্রেতারা চিহ্নিত করার সুযোগ খুব কম- কোনটা সাগরের আর কোনটা নদীর। দেশে যত ইলিশ ধরা পরে তার ৬০ ভাগ হচ্ছে সাগরের ইলিশ।”
ডিজেলের দামের ‘বড় প্রভাব’
ব্যবসায়ীরা বলছেন, সাগরগামী জালসহ একটা বড় ফিশিং ট্রলার বানাতে খরচ লেগে যায় প্রায় এক কোটি টাকা। একটি ট্রলারে ২০ জন গিয়ে ১০ থেকে ১৫ দিন মাছ শিকার করে। এই সময়টাতে তাদের খাওয়া-দাওয়ায় যে খরচ হয়, সেটা আর জ্বালানি তেলের খরচ মিলিয়ে আগের তুলনায় খরচ বেড়েছে বহুগুণ।
চাঁদপুর মৎস্য বণিক সমবায় সমিতির সভাপতি আবদুল বারীর বলেন, “জ্বালানি তেলের দাম তো অনেক বাড়ছে। চাল-ডাল-তেলের দামও বেশি। ২০০৮ সালে ট্রলারের প্রতি ট্রিপে খরচ যেত ৫০ হাজার টাকা। এখন লাগে ৪ লাখ টাকা।
“সাগরগামী ট্রলারে লার্জ স্কেলে ফিশিং করে। এরা মাছ পেলে দাম অনেক কমে যেত। এরাও এবার মাছ খুব বেশি পাচ্ছে না। মাছ পচনশীল। তাই চাহিদা অনুযায়ী মাছ ধরা পড়লে দাম বাড়ানোর সুযোগ নাই।”
তিনি জানান, চাঁদপুরে বা আশপাশের নদী থেকে নিয়মিত মাছ ধরা হলেও তা চাহিদার তুলনায় অনেক কম। একটি নৌকায় সাতজনের দুই বেলা খাবার আর জ্বালানি তেলসহ সব মিলিয়ে ১৫ হাজার টাকার মতো খরচ হয়। মাছ ধরার পর বিক্রি শেষে পোষাচ্ছে না তাদের।
আবদুল বারী বলেন, “মাছের পরিমাণ এখন অনেক কম। ব্যবসায়ীদের ইনভেস্টমেন্ট অনুযায়ী ৫০ শতাংশও না। ব্যবসায়ীরা পথে বসে যাওয়ার অবস্থা।
“কয়েকবছর আগে একটা ব্যবসায়ীর যে পরিমাণ মাছ হতো, এখন সব মিলিয়েও সেই একজন ব্যবসায়ীর মাছের সমান হয় না। ২০২২ সাল পর্যন্ত চাঁদপুরে যে পরিমাণ মাছ আসতো, ২০২৩ সালে এসেছে তার অর্ধেক। আর এ বছর গতবছরের চেয়েও অর্ধেক “
ইলিশের দাম না কমার পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে ডিজেলের উচ্চ মূল্যকে দায়ী করেছেন ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের পরিচালক মোল্লা এমদাদুল্লাহ। তিনি বলেন, ডিজেলের উচ্চ মূল্যই ইলিশের দাম না কমার অন্যতম কারণ।
একই সুরে মৎস্য গবেষক হাসান ফারুক বলেন, “জ্বালানি খরচ অনেক বেড়ে গেছে। একটা বড় বোট যদি সাগরের দিকে গিয়ে ১৫ থেকে ২০ দিন থাকে- তাহলে সেটার খরচ ৫ থেকে ৬ লাখেরও বেশি হতে পারে।
“আর আগে এই খরচ অর্ধেকেরও মতো ছিল। এজন্য মাছের দাম বেশি।”
ইলিশ আহরণে আগের চাইতে খরচ বাড়লেও মাছটির দাম কমানোর সুযোগ আছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “ঘাটে যেই দাম, সেই দামের চেয়ে অনেক বেশি দামে বিক্রি হয় রাজধানীর বাজারগুলোতে। অনেকগুলো হাত হয়ে আসে। তাই এই জায়গায় নজরদারি করলে দাম কিছুটা কমবে।”