শহরাঞ্চল এক একটি ‘তাপীয় দ্বীপ’– করণীয় কী

তাপ প্রবাহের ঝুঁকি দেশব্যাপী হলেও শহরাঞ্চলে এর অনুভব অনেক বেশি। অবাধে গাছপালা কেটে ফেলা, প্রাকৃতিক পরিবেশ ও প্রতিবেশ ধ্বংস করে নগরায়নের জন্য কাঠামো ও স্থাপনা তৈরি ক্রমশ শহরাঞ্চলগুলোকে এক একটি তাপীয় দ্বীপে পরিণত করছে।

মোহন কুমার দাশমোহন কুমার দাশ
Published : 19 April 2023, 05:30 AM
Updated : 19 April 2023, 05:30 AM

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক তাপপ্রবাহ বিগত সময়ের তাপপ্রবাহের ঘটনাগুলোর সাপেক্ষে ব্যতিক্রম। ঢাকার উত্তাপ দিয়েই আলাপের সূত্রপাত করা যাক। বসবাসের উপযোগিতার দিক থেকে শহরটির অবস্থান ক্রমাগত তলানিতে নেমে এসেছে। ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) পৃথিবীর শহরগুলোর বসবাস উপযোগিতার যে তালিকা করেছিল বছরদুয়েক আগে তাতে ঢাকার অবস্থান ছিল শেষ দিক থেকে চার নম্বরে। ইআইইউ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শহরের ওপর জরিপ চালিয়ে ১৪০টি শহরের র‍্যাঙ্কিং প্রকাশ করেছিল। ওই তালিকায় ১৩৭ নম্বরে ছিল ঢাকার অবস্থান, এ সব কথা আমাদের সবারই জানা আছে। সংবাদপত্রের বদৌলতে নিশ্চয়ই আমাদের সবার জানা হয়ে গেছে, ঢাকার উষ্ণতার কথাও। এই সেদিন গত ১৫ এপ্রিল ঢাকার তাপমাত্রা ছিল ৪০.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা ৫৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ঢাকার ঐতিহাসিক রেকর্ড ছিল ৪২.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস ৩০ এপ্রিল ১৯৬০ সালে। এ শহরে এখন গাছপালার পরিমাণ কমছে, নদী, জলাশয় দখল ও দূষণ কবলিত। যার ফলশ্রুতিতে রেকর্ড তাপমাত্রার চেয়ে বেশি কষ্টদায়ক হয়ে ওঠে মানুষের জীবন।

তাপপ্রবাহ নিয়ে আমাদের এই আলাপে ঢাকা একটি উদাহরণ মাত্র। তবে একটু পেছনে তাকালেই দেখতে পাব শহরটিতে নদী হত্যার মতো ঘটনা ঘটেছে। এখনও ঘটে চলেছে। আমরা ধোলাই খাল বলে যে এলাকাটিকে চিনি, সেটি খুব বেশি দিন আগে নয়, ইতিহাসবিদরা বলে গেছেন, মুঘল আমলেও দোলাই ছিল ঢাকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নদী। ওই দোলাই নদীরই একটা অংশ এখন ধোলাই খাল। এই দোলাই নদী নিয়ে গত শতাব্দীর তিরিশের দশকের একটি জীবন্ত বর্ণনা পাওয়া যায় সমরেশ বসুর 'কোথায় পাবো তারে' উপন্যাসে। উপন্যাসের ছেলেটির বর্ণনা পাই, দোলাই নামের ওই নদীটি ‘লোহার পুল পেরিয়ে, ফৌজী ব্যারাকের ডাঙা ছুঁয়েছে। এবার ডানদিকে বাঁক। তারপর বাঁক নিলেই বুড়িগঙ্গা।’ 

বুড়িগঙ্গার মরণদশা তো আমরা চোখের সামনে দেখছি। ঢাকা শহরে গাছপালা নেই বললেই চলে। গিজ গিজ করা বিল্ডিং, জনসংখ্যার আধিক্য, অতিরিক্ত যানবাহন পুরো পরিবেশ অসহনীয় পর্যায়ে ঠেলে দিচ্ছে। প্রকৃতির ক্ষতি করে গড়ে ওঠা কংক্রিটের স্থাপনা আমার ঢাকা শহর নয়।

শুধু কি ঢাকার তাপমাত্রা অসহনীয় হয়েছে? একটানা প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করেছে। এখানে লক্ষণীয় ছিল একেবারে কম বায়ুপ্রবাহ, নিম্ন আর্দ্রতা, সকালের দিকে কুয়াশাচ্ছন্ন পরিবেশ এবং দেশব্যাপী বৃষ্টিপাতহীনতা। এ সময় বলতে গেলে আকাশ ছিল নির্মল এবং মেঘমুক্ত।

গত ২ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গা ও যশোরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড ছিল ৩৩.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা ক্রমাগত বাড়তে বাড়তে ১৬ এপ্রিল রেকর্ড ৪২.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলো। পরে ১৭ এপ্রিল ঈশ্বরদীতে ৪৩.০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ১৮ এপ্রিল রাজশাহীতে ৪২.০ ডিগ্রি সেলসিয়াস সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে।

তাপ প্রবাহের ঝুঁকি দেশব্যাপী হলেও শহরাঞ্চলে এর অনুভব অনেক বেশি। এর অন্যতম কারণ একটার সঙ্গে আরেকটা লাগানো স্থাপনা, যানবাহন, জনসংখ্যার ঘনত্ব ইত্যাদি। এছাড়াও, নানাবিধ দূষণ যেমন বায়ু, মিথেন, পানি, নদী, জলাশয় ইত্যাদির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা রয়েছে। অবাধে গাছপালা কেটে ফেলা, প্রাকৃতিক পরিবেশ ও প্রতিবেশ ধ্বংস করে নগরায়নের জন্য কাঠামো ও স্থাপনা তৈরি ক্রমশ শহরাঞ্চলগুলোকে এক একটি ‘তাপীয় দ্বীপ’-এর ‘হিট বোম্ব’-এ পরিণত করছে। এ ধরনের পরিস্থিতি শারীরিক ও মানসিক ঝুঁকি অনেকগুণ বাড়িয়ে দেয়।  

চলমান তাপপ্রবাহ কোনো স্থানিক ঘটনা নয়। এর ব্যাপ্তি বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশ; যেমন ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ইত্যাদি। ভারতের মুম্বাইয়ে একটি অনুষ্ঠানে হিট স্ট্রোকে মারা গেছেন ১১ জন এবং অসুস্থ হয়েছেন অসংখ্য।

ঘটনাটি ঘটেছে গত ১৬ এপ্রিল মহারাষ্ট্র ভূষণ পদক বিতরণের জন্য আয়োজিত অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানটি আয়োজন করেছিল মহারাষ্ট্র সরকার। যে স্থানে অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয় যেখানকার তাপমাত্রা ছিল প্রায় ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। প্রচণ্ড তাপমাত্রায় খোলা ময়দানে বসেছিলেন সবাই। বেলা সাড়ে ১১টায় শুরু হওয়া অনুষ্ঠানটি চলে ১টা পর্যন্ত। এই দীর্ঘ সময় থাকার জন্য অতিথিদের বসার ব্যবস্থা করা হলেও মাথার ওপর ছিল না কোনো ছাউনি।

ছাউনি দিয়ে তো আর পৃথিবী ঢেকে দেওয়া যাবে না। আমরা একের পর এক প্রাকৃতিক ছাউনি উজাড় করে দিচ্ছি। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের নানাবিধঅশনি সংকেতের অন্যতম একটি তাপপ্রবাহের ব্যাপ্তি ও তীব্রতা বৃদ্ধি। এছাড়া ‘এল নিনো’এবং ‘লা নিনা’-এর প্রভাব। ‘এল নিনো’ এবং ‘লা নিনা’-এর প্রভাবে সাইক্লোন, বন্যা, খরা এবং সমুদ্রের তাপমাত্রা, স্রোত ইত্যাদির পরিবর্তন ঘটে থাকে।

আমাদের দেশে প্রাক বর্ষা হলো মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত। এ সময় তাপপ্রবাহ ছাড়াও কালবৈশাখী যেমন বজ্রপাত, টর্নেডো, লাইটনিং ইত্যাদি হয়ে থাকে। এখন পর্যন্ত প্রান্তিক মানুষ পূর্বাভাসের সুবিধাবঞ্চিত। প্রতিটি দুর্যোগ আমাদের সামনে কিছু প্রশ্ন রেখে যায় যা পরের দুর্যোগ মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে বিল্ডিং বা দালান কাঠামো স্থাপনা অপেক্ষা জলাশয় ও বৃক্ষাচ্ছাদিত অঞ্চলে অপেক্ষাকৃত কম তাপমাত্রা থাকে। আমাদের দেশে এ তাপপ্রবাহের ব্যাপ্তি মার্চ থেকে জুন মাস পর্যন্ত থাকে। এ দুর্যোগে মানুষের পাশাপাশি কৃষি ব্যবস্থাপনা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়। অতিরিক্ত সেচ কৃষকের জন্য বয়বহুল হয়। ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শুধু কি তাই? যথাসময়ে পানি না পেয়ে কৃষকের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে চলেছে দেশের বরেন্দ্র অঞ্চলে।

নদীমাতৃক বাংলাদেশের চরাঞ্চলে তাপ প্রবাহের প্রভাব নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হয় না। এ প্রান্তিক মানুষগুলো অপেক্ষাকৃত বেশি দুর্ভোগে থাকে এ সময়।

সভ্যতা ও প্রযুক্তির উদ্ভাবন জীবনযাত্রাকে যেমন সহজ করছে, তেমনি প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস করা, নদী, সমুদ্র ইত্যাদি দূষণ করা আমাদের জীবনকে শঙ্কাগ্রস্ত করে তুলেছে। পরিবেশবান্ধব ও টেকসই উন্নয়ন না হলে মানুষ এবং অন্য সব জীববৈচিত্র্যের ধ্বংস অনিবার্য। এ জন্য আশু করণীয় ঠিক করার এখনই উপযুক্ত সময়।

১. যেকোনো আবহাওয়াজনিত দুর্যোগের জন্য আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম থাকা উচিত যেমন: ‘হিট ওয়েভ আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম’ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

২. সস্তা জনপ্রিয়তার পরিবর্তে টেকসই পরিবেশবান্ধব পরিকল্পনা করে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা উচিত।

৩. প্রাকৃতিক পরিবেশ ও প্রতিবেশের যেকোনো ধ্বংসসাধন প্রকারান্তরে দুর্যোগকে আমন্ত্রণ জানানো– এ সচেতনতা তৈরি করা।

৪. দূষণ ও দখলের মতো কার্যক্রম দীর্ঘমেয়াদে আমাদের প্রজন্মকে পঙ্গু করে দেবে এ বোধের জাগরণ জরুরি।

৫. বিজ্ঞান গবেষণা, বিজ্ঞানী ও গবেষকদের উৎসাহ দান এবং দেশে যথাযথ বিজ্ঞান গবেষণার পরিবেশ তৈরি করা।

আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঘটনা বুঝতে এবং বিশ্লেষণের জন্য আধুনিক পর্যবেক্ষণ যন্ত্রপাতি, গাণিতিক মডেল এবং সর্বোপরি সক্ষম ও দক্ষ মানব সম্পদ প্রয়োজন। তাহলে যেকোনো দুর্যোগে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী পূর্বাভাসের সমন্বিত ব্যবস্থা দ্বারা উপকৃত হবে।