সমতলের আদিবাসীদের চৈত্র-বৈশাখ

বিভিন্ন আদিবাসী জাতির উৎসবের রীতি-নীতি যেমন স্বতন্ত্র তেমনি উৎসবের পেছনে তাঁদের আদি বিশ্বাসের মিথগুলোও অনন্য। যা সমৃদ্ধ করেছে আদিবাসী সংস্কৃতিকেও।

সালেক খোকনসালেক খোকন
Published : 13 April 2023, 06:01 PM
Updated : 13 April 2023, 07:29 PM

বাঙালি ছাড়াও বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে এ দেশে। আদিবাসীরাও এর অন্তর্ভুক্ত। ভিন্ন এঁদের ভাষা, ভিন্ন এঁদের সংস্কৃতি। চৈত্র-বৈশাখে পাহাড় ও সমতলের আদিবাসীরাও উদযাপন করে থাকে নানা উৎসব। যার দ্বারা ওই জনগোষ্ঠীর স্বতন্ত্র পরিচয় পাওয়া যায়। আদিবাসীদের উৎসব ও পূজা-পার্বণ মূলত সক্রিয় আচরণগত দিক হলেও বিশ্বাসের পূর্ণ প্রতিফলন ঘটে সেখানে। মূলত সমাজের, গ্রামের এবং নিজস্ব পরিবারের মঙ্গল কামনাই থাকে উৎসবের উদ্দেশ্য। আবার বিভিন্ন আদিবাসী জাতির উৎসবের রীতি-নীতি যেমন স্বতন্ত্র তেমনি উৎসবের পেছনে তাঁদের আদি বিশ্বাসের মিথগুলোও অনন্য। যা সমৃদ্ধ করেছে আদিবাসী সংস্কৃতিকেও।

চৈত্র-বৈশাখে আদিবাসী উৎসবের কথা উঠলেই আমাদের দৃষ্টি চলে যায় পাহাড়ের দিকে। গণমাধ্যমসহ সবার মুখে আলোচিত হয় বৈসাবি’-এর কথা। অথচ এটি আলাদা কোনো উৎসবের নাম নয়। মূলত ত্রিপুরাদের ‘বৈসুক’ উৎসব থেকে ‘বৈ’, মারমাদের ‘সাংগ্রাইং’ থেকে ‘সা’ আর চাকমাদের ‘বিজু’ উৎসব থেকে ‘বি’– এভাবে তিনটি নামের আদ্যাক্ষর এক করে হয়েছে ‘বৈসাবি’। এ ছাড়া তঞ্চঙ্গ্যারা বিষু, অহমিয়ারা বিহু এবং অন্যরাও নিজ নিজ নামে অভিহিত করে তাদের বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের উৎসবকে। ফলে বৈসাবি শব্দের অন্তরালেই চাপা পড়ে যাচ্ছে স্বতন্ত্র জাতিগুলোর উৎসবের নামটি।

পাহাড়ের আদিবাসী উৎসবগুলো নিয়ে যতটা আলোচনা হয় ততটাই উপেক্ষিত থাকে সমতলের আদিবাসী উৎসবগুলো। বৈশাখে তাদের উৎসব দেখব বলেই একবার গিয়েছিলাম দিনাজপুরে। খুব ভোরে এক বন্ধুকে নিয়ে চলে যাই বিরল উপজেলার সীমান্ত এলাকায়। বৈশাখের প্রথম প্রহরে রাস্তার পাশে নানা সাজ-পোশাকে বাঙালিদের ভিড়। কোথাও কোথাও লেগেছে বৈশাখী মেলাও। সবকিছু পেছনে ফেলে চলে আসি বহবলদীঘিতে।

বিশটি ভুনজার আদিবাসী পরিবারের বাস এখানে। একটি বাড়িতে ঢুকে দেখি তুলসি গাছের পাশে মাটিতে বেশ কয়েকটি সিঁদুর ফোঁটা দেয়া। বেশকিছু ফুলও পড়ে আছে সেখানে। বোঝা যায় একদিন আগেই পূজার আনুষ্ঠানিকতা হয়েছে।

মহত বা গোত্র প্রধানের খোঁজ করতেই ষাটোর্ধ এক বৃদ্ধর দেখা মেলে। হাসিমুখে পিঁড়ি টেনে বসতে দেন তিনি। নাম তার বাতাসু ভুনজার। তিনি জানালেন, বৈশাখ উদযাপনের অংশ হিসেবেই গোত্রের সবাই আজ দলবেঁধে বেরিয়েছে শিকারে। ভুনজাররা এখনও পূর্বপুরুষদের রীতি অনুসারে চৈত্র মাসের শেষদিন আর বৈশাখ মাসের প্রথম দিনকে বিশেষ পূজা আর আচারের মাধ্যমে পালন করে। তাদের ভাষায় এটি চৈতবিসিমা উৎসব। এ উৎসবের অংশ হিসেবে চৈত্র মাসের শেষ দিন এরা বাসন্তী পূজা করে থাকে।

কেন এই পূজা? প্রশ্ন করতেই বাতাসুর উত্তর ‘বাপ-দাদারা পূজেছে, তাই পূজি’।

বাসন্তী পূজা নিয়ে ভুনজারদের মধ্যে এখনও প্রচলিত আছে কিছু আদি বিশ্বাস। এক সময় চিকিৎসার জন্য এ অঞ্চলে কোনো ডাক্তার ছিল না। তখন ডায়রিয়া আর বসন্তে মারা যেত শত শত আদিবাসী। এই দুটি রোগ থেকে মুক্তি পেতেই ভুনজাররা চৈত্রের শেষ সন্ধ্যায় ঠাকুরের কাছে পূজা করে। বাতাসু জানায়, বসন্ত রোগ থেকে মুক্তির জন্য এই পূজা করা হতো বলেই এর নামকরণ হয়েছে বাসন্তী পূজা।

এ পূজায় একটি মাটির ঘটিতে আমপাতা, কলা, নারকেল, ধূপ আর চার ফোঁটা সিঁদুর দিয়ে ঠাকুরের উদ্দেশে পূজা দেয়া হয়। কেউ কেউ এইদিনেই বলি দেন মানতের হাঁস, মুরগি কিংবা পাঁঠা। এর আগে চৈত্রের শেষ শুক্রবার এঁরা উপোস থাকেন। উদ্দেশ্য ঠাকুরের সন্তুষ্টি ও রুজি বৃদ্ধি। বিনা লবণে আতপ ভাত খেয়ে উপোস শুরু। উপোস অবস্থায় খাওয়া যায় শুধুই ফলমূল আর দুধ।

বাসন্তী পূজা শেষে ভুনজাররা সবাই কালাইসহ নানা ধরনের ছাতু-গুড় খেয়ে আনন্দ ফূর্তিতে মেতে ওঠেন। সে কারণেই গত রাতে চলেছে খ্যামটা নাচ আর হাঁড়িয়া খাওয়া। বাতাসু ভুনজারের বিশ্বাস প্রতি চৈত্রে এই পূজার কারণেই তাদের গোত্রে এখন আর ডায়রিয়া কিংবা বসন্ত রোগের প্রাদুর্ভাব হয় না।

কথায় কথায় পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে রবি ভুনজার। বাতাসুর ছেলে সে। কথা বলছে বেশ চেঁচিয়ে। আমাদের দেখে খানিকটা লজ্জিত হয়। গতরাতের বাসন্তী পূজার হাড়িয়ার ঘোর তার তখনও কাটেনি। কেমন মজা করলেন। বলতেই সে ভুনজারদের খট্টা ভাষায় গেয়ে ওঠেন একটি গান:

‘কেলা গাছে আয়না টাঙ্গাবে রে

কালো তরী মনো না ভুলারে

হে হাগলে হাগলে...

রবির গান থামতেই বাতাসু আবার কথা শুরু করেন। বাঙালিদের মতো বৈশাখে আদিবাসীরা তাদের প্রিয়জনকে নতুন কিছু উপহার না দিলেও বৈশাখের সকালে তারা সবাই মিলে পোনতা (পানতা ভাত) খান। তবে পানতার সাথে মেলে না কোনো ইলিশের টুকরো। পূর্বপুরুষের আমল থেকেই চৈতবিসিমার অংশ হিসেবে এ আদিবাসীরা বৈশাখের সকালে কাঁচামরিচ আর পেঁয়াজ দিয়ে সেরে নেয় পানতা খাওয়া। এদের বিশ্বাস বৈশাখের প্রথমে পানতা খেলে সারাবছর গায়ে রোদ লাগলেও তারা কষ্ট পায় না। তাছাড়া পানতার পানি তাদের শরীরকে ঠান্ডা রাখে।

বৈশাখের প্রথমদিন ভুনজাররা তীর ধনুক আর কোদাল নিয়ে দলবেঁধে শিকারে বের হন। সন্ধ্যা অবধি চলে শিকার। সন্ধ্যায় ঠাকুরকে ভক্তি দিয়ে শিকারগুলো দিয়ে রান্না হয় খিচরি (খিচুরি)। রাতভর চলে আনন্দফুর্তি আর প্রিয় পানীয় হাড়িয়া খাওয়া। বাঙালির বৈশাখের আয়োজনকে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি গ্রাস করলেও আদিবাসী সংস্কৃতিতে খেমটা আর ঝুমুর নাচ এখনও আদি ও অকৃত্রিম রয়েছে।

দুপুরের দিকে ভুনজার পাড়া থেকে বের হয়ে কালিয়াগঞ্জের পথ ধরি। রবি ভুনজার তখনও থেমে থেমে গান গাইছে। চলতে চলতে কানে বাজে সে গানের সুর:

‘পানের ডেলা পানে রইলো

সুপারিতে ঘুনো লাগি গেল, মা

সুপারিতে ঘুনো লাগি গেল

হে সেবেল, সেবেল, ওয়াহাগলে, ওহাগলে, হে...’

আঁকাবাঁকা মেঠোপথ পার হতেই বিশাল শালবন ঠেকে। লাল মাটির পথ পেরিয়ে সীমান্ত রক্ষীদের ক্যাম্প পেছনে ফেলে চলে আসি শালবনের একেবারে ভেতরে। চারপাশে গা ছমছমে পরিবেশ। বনের ভেতরেই একটি আদিবাসী পাড়ার সামনে থেমে যাই।

পাড়াটি মুন্ডা পাহানদের। মাটি আর ছনের আদিবাসী ঘরগুলোর একপাশে গহিন শালবন। আর অন্যপাশের মাঠ পেরোলেই কালো কাঁটাতারের বেড়া। আমাদের দেখে এগিয়ে আসে সবুজ পাহান। তাকে নিয়েই পাড়াটি ঘুরি।

মুন্ডা পাহানদের দুপুরের খাওয়া শেষ হয়েছে তখন। সবুজ পাহান জানাল বৈশাখের রীতি অনুসারে তারা ভাতের সাথে খেয়েছে ১২ ভাজা অর্থাৎ ১২ পদের তরকারি দিয়ে। ভুনজারদের মতো তারাও সকালে খেয়েছেন পানতা ভাত। আর সন্ধ্যায় ঠাকুরকে ভক্তি দিয়ে চলবে নাচগানের আসর।

সবুজের দাদা শ্যামল পাহান। বয়স সত্তরের মতো। বড় একটি গাছের ছায়ায় বসা। আলাপ জমাই তার সঙ্গে।

বৈশাকে কেন পানতা খান?

প্রশ্ন শুনে মুচকি হাসেন। অতঃপর আদিবাসী সুরে গান ধরেন:

‘হামে লাগে প্রথমে আদিবাসীই

পনতা ভাত ভালোবাসি...

তার গানে আমরা বেশ মজে যাই। কথা চলে চৈত্র-বৈশাখের নানা উৎসব নিয়ে।

বৈশাখের মতো চৈত্রের শেষদিনেও মুন্ডা পাহানরা আয়োজন করে নানা আচারের। ওইদিন তারা বাড়িঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে একে অপরের গায়ে কাদা আর রঙ ছিটায়। পূর্বপুরুষদের রীতি অনুসারে যার গায়ে কাদা বা রঙ দেয়া হয় তাকেই খেতে দিতে হয় প্রিয় পানীয় হাড়িয়া। মুন্ডারা বিশ্বাস করে এতে বন্ধুত্ব বা সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হয়। চৈত্রের শেষদিন এবং বৈশাখের প্রথম দিনের এ উৎসবকে তারা বলে সিরুয়া বিসুয়া।

এ ছাড়া তারা চন্দ্র হিসাব মতে চৈত্রমাসেই আয়োজন করে চৈতালিপূজার। রোগ থেকে মুক্তি পেতে ঠাকুরের কৃপা লাভই এ পূজার উদ্দেশ্য। এ পূজায় আগের রাতে উপোস থেকে পরেরদিন দুপুরে পূজার প্রসাদ দিয়ে উপোস ভাঙ্গাই নিয়ম। মঈনকাঁটা বা বেল গাছের নিচে মাটির উঁচু ডিবি তৈরি করে, লাল নিশান আর ধূপ কাঠি টাঙ্গিয়ে, পান, সুপারি, দুধ, কলা, দূর্বা ঘাস, বাতাসা, কদমফুল, সিঁদুর, হাড়িয়া দিয়ে ধূপ জ্বালিয়ে ঠাকুরকে পূজা দেয়া হয় চৈতালিপূজায়। একই সাথে বলি দেয়া হয় মানতের কবুতর, হাঁস কিংবা পাঁঠা। পূজা শেষে চলে খিচুরি খাওয়া। রাতভর চলে হাড়িয়া খাওয়া আর নাচগান।

মুন্ডা পাহানদের পাড়া থেকে আমরা পা রাখি টিনপাড়া গ্রাম। এটি মূলত ওরাওঁ গ্রাম। ওরাওঁরা আদি থেকেই কৃষি পেশার সঙ্গে যুক্ত। তাই তাদের উৎসবগুলো আবর্তিত হয় ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে। বৈশাখের প্রথম প্রহরেই ওরাওঁরা দলবেঁধে শিকারে বের হয় তীর ধনুক নিয়ে। কিন্তু তার আগেই এরা পূজো দেয় বাঘমন্ত্রীকে। এদের বিশ্বাস এটা না করলে শিকার তো মিলবেই না বরং পড়তে হবে জীবন হারানোর মতো বিপদে। এ কারণেই এরা বনে ঢোকার আগে মাটিতে তীর-ধনুক রেখে, জল ছিটিয়ে দূর্বাঘাস ও আতপ চাউল রেখে ধূপ জ্বালিয়ে বাঘমন্ত্রীকে স্মরণ করে এবং তার সন্তুষ্টির জন্য পূজা দিয়ে থাকে। বিকেলে শিকার থেকে ফিরলে শিকারগুলো দিয়ে সম্মিলিতভাবে খিচুড়ি রান্না করা হয়। রাতভর চলে আদিবাসী নাচ-গান আর প্রিয় পানীয় হাড়িয়া খাওয়া। এভাবে বছরের প্রথম দিনটিকে এরা দলবদ্ধতা ও বীরত্বের প্রতীক হিসেবে নানা আচার পালনের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করে।

ওরাওঁরা খাদ্য হিসেবে অনেক ধরনের গাছের পাতা ব্যবহার করে থাকেন। তাই চৈত্রমাসে এরা গ্রাম রক্ষাকারী আত্মাকে স্মরণ করে পূজা অর্চনা করে থাকেন। এ সময় প্রতিটি পরিবার তাদের পূর্বপুরুষের কথা স্মরণ করে কিছু খাদ্য ভোগ হিসেবে তুলে রাখেন এবং পূজা দেন। পরিবারের সকলের সুস্থতা কামনা করাই এই পূজার উদ্দেশ্য। কোনো কোনো পরিবার এ সময় মোরগ বলি দেয়। এ উৎসব চলাকালে নাচগানের মাধ্যমে প্রত্যেক ওরাওঁ পরিবার ঘরের প্রবেশ দরজায় প্রচুর পানি ঢালে এবং শালফুল ঘরের চালে ঝুলিয়ে দেয়।

এরপর আসি তুরি পাড়ায়। কথা হয় তুরি গোত্রের প্রধান লবানু শিংয়ের সঙ্গে। উৎসবে এ আদিবাসীদের আচার খানিকটা ভিন্ন। চৈত্র মাসের শেষ পাঁচদিন তুরিরা পালন করে চৈতাবালির অনুষ্ঠান। শুরুর দিন থেকেই এরা ছাতুগুড় খেয়ে নাচগান করে। চৈত্রের শেষদিন এরা বাড়িতে রান্না করে সাত পদের তরকারি। সাত পদ দিয়ে ভোজ সেরে এরা চৈত্রকে বিদায় দেয়। বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে চলে নাচগান পর্ব। চৈত্রের পরের দিনই বৈশাখ। বৈশাখ শুরু হলেই তুরিরা বন্ধ করে দেয় মাছ-মাংস খাওয়া। পুরো একমাস এরা খায় শুধুই নিরামিষ। প্রতি রাতে পাড়ায় পাড়ায় চলে কীর্তন। কীর্তন করেন শুধুই পুরুষেরা। এ সময় দূর-দূরান্ত থেকে অন্যান্য আদিবাসীরাও ভিড় জমায় তুরি পাড়ায়। বৈশাখের শেষের দিকে এরা প্রতি বাড়ি থেকে চাল তুলে একত্রে খিচুড়ি রান্না করে খায়। ভগবানের কৃপালাভের আশায় চলে এমন আচার। এ সময় এরা বাড়ি-ঘরে আলপনাও এঁকে রাখে তারা।

সাঁওতালরা ফাগুন মাসের শেষে বা চৈত্রের শুরুতে আয়োজন করে থাকে বাহাপরব বা বাহা উৎসবের। দিনাজপুরের মহেশপুর গ্রামে খুব কাছ থেকে দেখেছি ওই উৎসবটি। সাঁওতাল ভাষায় ‘বাহা ’ মানে ‘ফুল’ আর ‘পরব’ মানে ‘অনুষ্ঠান’ বা ‘উৎসব’। বসন্তে শাল, শিমুল, পলাশ, মহুয়া, চম্পা ফুল ফোটে চারদিকে। বিচিত্র সাজে সজ্জিত হয় প্রকৃতি। কিন্তু বাহাপরবের আগে সাঁওতাল নারীরা ওই ফুল উপভোগ করেন না। মূলত এ উৎসবের মাধ্যমেই তারা শালফুলকে বরণ করে নেয় নানা আনুষ্ঠানিকতায়।

বাহাপরব উৎসবটি তিন দিনের। তবে প্রথমদিনের অনুষ্ঠানই প্রধান। এ উৎসবের মূল উদ্দেশে জাহেরএরা, গোসায়এরা, মরেকু, তুরইকু নামক দেবতা বা বোঙ্গার সন্তষ্টি লাভ।

পরবের একদিন আগে জাহের থান ও মাঝি থান নানাভাবে সাজানো হয়। নতুন সবুজ পত্রপল্লবে সেজে ওঠা ধরণী হলো পবিত্র কুমারী কন্যার প্রতীক। পরব শুরুর পূজায় দেবতাকে শাল ও মহুয়াফুল উৎসর্গ করা হয়। অনুষ্ঠানে সাঁওতালরা শালফুলকে বরণ করে নেয় নানা আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে। এর পরেই সাঁওতাল মেয়েরা খোঁপায় রং-বেরংয়ের ফুল পরতে পারে।

গ্রামের এক প্রান্তে নির্দিষ্ঠ স্থানে এ পূজার আয়োজন করা হয়। এ উপলক্ষে নির্দিষ্ঠ দিনে জাহের থানে শাল গাছের খুঁটি দিয়ে অন্যান্য দেব-দেবীর জন্য প্রতীক হিসেবে ছোট ছোট কয়েকটি চালাঘর তৈরি করা হয়। সাধারণত গ্রামের যুবকেরাই জঙ্গল থেকে শাল গাছ কেটে আনে এবং চালাঘর তৈরিকে সাহায্য করে। পূজার জায়গাটি ভালোভাবে নিকানো হয় গোবর দিয়ে। চালের গুঁড়ো দিয়ে আঁকা হয় আলপনা।

পূজা উপলক্ষে মহত বা পুরোহিতকে উপোস থাকতে হয়। পূজার জন্য দেবতার আসনও প্রস্তুত করেন তিনি। পূজার উপকরণ হিসেবে ফল-মূল, চাউল, সিঁদুর, ধান, দূর্বা ঘাস আর নানা সামগ্রী তিনি কুলোতে সাজিয়ে রাখেন। একটু উঁচু জায়গায় তিনটি ধনুক গেড়ে দিয়ে সিঁদুর মাখিয়ে দেওয়া হয়।

পূজা উপলক্ষে পুরোহিত বা মহতকে তাঁর বাড়ি থেকে বন্দনা করে পূজাস্থলে নিয়ে আসা হয়। এ সময় তিনি উচ্চকন্ঠে মন্ত্র পড়েন– ‘জোহার এবে খানদো, মরেকু তুরেকু,আলেয়া আতু নুতুমতে...’।

এরপর বলি দেয়া হয় কয়েকটি লাল মুরগি বা পশু। পুরোহিত গ্রামের কল্যাণের জন্য দেবতাদের কাছে প্রার্থনা করেন। পরে বলি দেওয়া পশুর মাংস দিয়ে খিচুরি রান্না করে সবাইকে খাওয়ানো হয়।

পূজা হয়ে গেলে বিকেলে গ্রামের পুরোহিতকে সাথে নিয়ে সবাই দলবেঁধে গ্রামে ফিরে আসে। এ সময় মহিলারা পুরোহিতকে ঘিরে গোল হয়ে নাচতে থাকে। তার মাথায় থাকে শাল ফুলের ডালা। তার সঙ্গে এক যুবক মাটির কলসীতে এক কলসী জল ভরে মাথায় নিয়ে বাড়ি বাড়ি চলতে থাকে। এক একটি বাড়ির ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় গৃহস্থ নারীরা ওই পুরোহিত ও যুবকটির পা ধুইয়ে দেন। এরাও প্রত্যেক গৃহস্থকে ঝুড়ি থেকে পবিত্র শাল ফুল প্রদান করে। অনেক অঞ্চলে পূজাস্থল থেকেই গৃহস্থ নারীরা শাল ফুল গ্রহণ করে পরম ভক্তির সঙ্গে। অতঃপর শুরু হয় আনন্দ নৃত্য। পুরুষেরা বাজায় মাদল-ঢোল। তালে তালে ঝুমুর নৃত্যে ব্যস্ত হয় আদিবাসী নারীরা। খোঁপায় শালসহ নানা রঙের ফুল ঝুলিয়ে, হাত ধরাধরি করে নাচে সবাই। এ সময় সাঁওতাল আদিবাসীরা গান গায়;

‘অকয় মায় চিয়ায়া হো বির দিসমদ?

অকয় মায় দহয় হো আতোওে পাঁয়রি?

মারঙ বুরুয় চিয়ায়া হো রি দিসমদ্,

জাহের এরায় দহয় হো আতোরে পাঁয়রি।’

(ভাবার্থ: বনভূমি কে খুঁজবে?/গ্রামে কে বসতি স্থাপন করবে?/মারঙ বুরু বনভূমি খুঁজবেন/জাহের এরা গ্রামের বসতি স্থাপন করবেন।)

উৎসবের দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠানকে বলে ‘বাহা বাস্কে (এক রাতের বাসি)’। এদিন সাঁওতালরা একে অপরের গায়ে পানি ছিটানো অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এদের বিশ্বাস পানি ছিটানোর মধ্য দিয়ে পুরনো যত হিংসা, বিদ্বেষ, শত্রুতা আছে তা দূর হয়ে যায়। ফলে পরস্পরের সঙ্গে তৈরি হয় বন্ধুত্বের সেতুবন্ধন। উৎসবের তৃতীয় দিনটিতে চলে শুধুই নানা আনন্দ আয়োজন।

বৈশাখের প্রথম প্রহরে সাঁওতালরা পুরনো বছরের পানতা খেয়ে নতুন বছরের শুভ সূচনা করে। অতঃপর তাদের একদল তীর-ধনুক নিয়ে বেরিয়ে পড়ে শিকারে। অন্য দলটি দলবেধে নদীতে ছোটে মাছ ধরতে। মাছ ধরাকে সাঁওতালরা বলে ‘হাকু গোজ চালাও’। নারীরা বাড়ি বাড়ি তেলের ও চিতল পিঠা তৈরি করতে থাকে। দুপুরে নানা পদ দিয়ে ভোজ সেরে নেয় এরা। এক সময় সাঁওতালরা বৈশাখে বিশ পদের রান্না দিয়ে ভোজ সারত। বিকেল থেকে সাঁওতাল গ্রামগুলোতে আয়োজন চলে ঝুমুর নাচের। সাঁওতাল নারীরা দলবেঁধে হাত ধরাধরি করে নেচে-গেয়ে বরণ করে নেয় নতুন বছরকে।

আদিবাসীদের হাজার বছরের সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে আছে এমন নানা ধরনের লোকজ উৎসব। আদিবাসী উৎসব ও পূজা-পার্বণগুলো বেশিরভাগই আবর্তিত হয় সনাতন ধর্মবিশ্বাস ঘিরে। মূলত সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি লাভ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ এবং মনবাসনা পূরণের নানা ইচ্ছা নিয়েই তারা পালন করে আসছে এ উৎসবসমূহ। চৈত্র-বৈশাখের উৎসবও আদিবাসীদের মিলনমেলা। উৎসবে দলগত নৃত্য, গান, বিশ্বাসের নানা আচার আর প্রাণখোলা আড্ডায় তারা ভুলে যায় চিরচেনা দুঃখ আর হিংসা-বিদ্বেষের বিভেদটুকু।