অলবার্স প্যারাডক্স ও মুজিব ইতিহাসের পুনর্লিখন

যতই মুছে ফেলা হোক পুরাতন আঁচড় ভেসে উঠে মনে করিয়ে দেয় পুরাতন সত্য। পঁচাত্তরের পর সম্ভাব্য সব কিছু করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর অবদান মুছে ফেলতে কিন্তু তাকে ভুলিয়ে দিতে গিয়ে তাকেই নির্মাণ করে চলেছে বার বার।

এম এম খালেকুজ্জামানএম এম খালেকুজ্জামান
Published : 27 August 2022, 09:47 AM
Updated : 27 August 2022, 09:47 AM

Olbers' paradox নামে এক এক কূটাভাস বেশ জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন জার্মান জ্যোতির্বিজ্ঞানী হাইনরিখ অলবার্স। ১৮২৬ সালে এই কূটাভাসটি আবিষ্কার করেন তিনি। একাডেমিয়ায় অন্যদের সাথে আলোচনা করেন, তিনি বলেছিলেন, রাতের অন্ধকার আকাশে সূর্য নেই ঠিকই কিন্তু অযুত নক্ষত্র তো আছে কিন্তু তাতে আঁধার কাটে কি? বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে এবং তার রক্তাক্ত প্রস্থানের পর আওয়ামী লীগের বহু নেতা থাকলেও আলো ছড়াতে পারেননি বা হাল ধরতে পারেননি অন্য কোনও আওয়ামী নেতা। অলবার্স প্যারাডক্সের যেন এক উদাহরণ। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে ইয়েটস-এর ‘centre cannot hold’ কথাটাও যেন সত্যের আকার পায় পঁচাত্তর পরবর্তী আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে।

মহাত্মা গান্ধী গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর প্রেমেন্দ্র মিত্র লিখলেন-

‘তিনটি গুলি’

আমরা দিলাম শেষে তুলি

তিনটি কঠিন ক্রুর গুলি।

প্রথম গুলির নাম

অন্ধ মূঢ় ভয়।

দ্বিতীয়টি আমাদের

নিরালোক মনের সংশয়।

বিবর -বিলাসী হিংসা

তৃতীয় গুলির পরিচয়।

এই বাংলার স্বাধীনতার প্রবাদপুরুষ শেখ মুজিবকে ঘাতকগণ তিনটি নয় এর কয়েকগুণ বেশি গুলি করেছিল। প্যাথলজিক্যাল হেট্রেড-এর চূড়ান্ত প্রকাশ। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দিন লন্ডনের দ্য ডেইলি টেলিগ্রাম পত্রিকায় একটি অস্বস্তিকর সত্য শিরোনামে তার হত্যার খবর প্রকাশিত হয়, “এই করুণ মৃত্যুই যদি মুজিবের ভাগ্যে ছিল তাহলে বাংলাদেশ সৃষ্টির কোনো প্রয়োজন ছিল না।”

এই বাংলার মানুষের সামগ্রিক স্মৃতিতে (কালেক্টিভ মেমোরি) গভীরভাবে গেঁথে আছে ১৫ অগাস্ট। মেমোরি কিউরেশন নিয়ে যত খুঁতখুঁতই থাকুক না কেন অগাস্ট তড়িয়ে বেড়াবেই। এই বাক্য শেষ করতে না করতে উদয় উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে ১৫ আগস্টের আরেক ঘটনা যেটি নতুন দুই দেশের জন্ম নিশ্চিত করেছে (আসলে তিনটি দেশ, তাদের দুটি দেশ এ বছর পালন করছে ৭৫ বর্ষপূর্তি)। উপমহাদেশের দেশগুলোতে প্রতিবছর ১৫ অগাস্ট ফিরে ফিরে আসে নানা বিভঙ্গে। April is the cruelest month-এর আদলে বলা যায় আগস্ট সবচাইতে বিধুর এক মাস।

স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় অনন্য এই কারণে যে উপনিবেশ তিরোহিত হওয়ার পর বাংলাদেশই একমাত্র ভূখণ্ড যেটি নৃতাত্ত্বিক-ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা লাভ করেছিল। এর আগে এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার কোনো দেশ এ ধরনের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা অর্জন করতে পারেনি। আরেক স্মরণীয় সাফল্য হলো মাত্র ২৪ বছরের মধ্যে পাকিস্তানের উপনিবেশ থেকে মুক্ত হতে পারা। রাষ্ট্রচিন্তক রওনক জাহানের এই মতকে তাত্ত্বিকভাবে সব স্কুল অফ থটের অনুসারীরা মান্যতা দিয়েছেন।

নিখিল বাংলার না হলেও শেখ মুজিবের বাংলার বিরাটাংশের ক্ষেত্রসমীক্ষা জারি ছিল সত্তরের নির্বাচনের আগপর্যন্ত। রাজনীতি সচেতন বঙ্গবন্ধুর চর্চা আর ধী শক্তি তার মনন ও অন্তর্চক্ষু তৈরি করে দিয়েছিল। তাকে পরিণত করেছিল রাজনীতির ভবিষ্যৎদ্রষ্টা রূপে, না হলে আশু শারীরিক-রাজনৈতিক মৃত্যুর সন্ধিক্ষণেও কেন তিনি অবিচল? কেন তিনি উচ্চারণ করবেন স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য রণধ্বনি?

ভবিষ্যৎ দেখতে পেরেছিলেন বলেই বঙ্গবন্ধুর ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ছয় দফার ঘোষণা ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের পথে এগিয়ে যাওয়ার এক রোডম্যাপ। ছয় দফার ধারাবাহিকতায় বাংলার ছাত্রদের ১১ দফা থেকে উদ্ভূত হয় দেশ কাপানো ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান। এ সবই ছিল জনগণের পদ্ধতিগত আন্দোলন। এর পাশাপাশি আইন মেনে এরই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের সেনা শাসকদের জারি করা লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্কের (এলএফও) অধীনে সত্তরের নির্বাচনে অংশগ্রহণের মতো দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নেন। যদিও তার এই নির্বাচনে অংশগ্রহণে তখন অনেক রাজনৈতিক চিন্তকই অবাক হয়েছিলেন কারণ ওয়েস্টমিনস্টার ঘরানার গণতন্ত্রে বিশ্বাসী হয়েও বঙ্গবন্ধু কী লক্ষ্যে একটি সামরিক শাসকের আইনি ফরমানের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিলেন। এবং নির্বাচনে ভূমিধস বিজয়ে প্রমাণিত হয় বঙ্গবন্ধু কতটা দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। যেটি ছিল তার অসামান্য দূরদৃষ্টির পরিচায়ক।

তিনি বরাবরই আইন ও সংবিধাননিষ্ঠ এক নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন তাই স্বাধীনতার অল্প সময়ে একটি অসামান্য আধুনিক সংবিধানের কাছে বিশ্বস্ত থাকার অঙ্গীকার করলেন। অগণিত সাধারণ মানুষের এক আশ্চর্য রক্ষাকবচ হিসেবে আবির্ভুত হল সংবিধান, এই বাংলার মানুষ পেল সাংবিধানিক অধিকার।

ইতিহাস বহতা স্রোতস্বিনী ধারার মতো গতিময়। কখনও কখনও সময়ের আয়না বলা হয় ইতিহাসকে। ইতিহাস কী? এর জবাব সহজে মেলে না। জবাব মিললেও হতে পারে জট পাকানো। সলতে পাকানোর মতো। সলতের কারিগরের ওপর নির্ভর করে যেমন সলতের নির্মাণ তেমনি ইতিহাসের লেখকদের ওপর নির্ভর করে এর নির্মাণ। অনুমাত্র অনুষঙ্গে কখনও কখনও পর্বত প্রমাণ তথ্যযোগে গড়ে ওঠে এক একটা আখ্যান। ইতিহাসের নির্মাণ-অবিনির্বাণে যারা ভূমিকা রাখেন তাদের দায় সবার আগে। নিখাদ কিংবা খাদ মেশানো তথ্য নিয়ে গড়া ইতিহাস থেকে আকর সংগ্রহ করে ভাবীকালের চর্চাকারী। আবার ইতিহাস কখনও কখনও নিজে কিংবা তার চালকের সাহয্যে শুধরে নেয় কোনো ভ্রান্তিকে। আকবর আলী খান যথার্থ বলেছেন, পূর্ব পাকিস্তানের জন্ম হলো একটি ঐতিহাসিক দুর্ঘটনা, বাংলাদেশের আবির্ভাব তার সংশোধন।

বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পরপরই আমাদের রাজনীতির করুণ মেরুকরণ শুরু হয়। তখন ইতির চাকা থমকে দাঁড়ায়, নেতির চাকা গতি পায়। মুছে দেওয়ার চেষ্টা করা হয় মুজিব কীর্তি। All history was a palimpsest... জর্জ অরওয়েল এই কথা দাগ রেখে যাওয়া ঐতিহাসিক যেকোনো ঘটনার সাথে মিলে যায়। পালিম্পসেস্ট– আগের লেখা মুছে দিয়ে নতুনভাবে লেখা বা পুনর্লিখন। নতুন কিছু লিখলেও পুরাতন সত্যলিখনের আভাস পাওয়া যায়। যতই মুছে ফেলা হোক পুরাতন আঁচড় ভেসে উঠে মনে করিয়ে দেয় পুরাতন সত্য। পঁচাত্তরের পর সম্ভাব্য সব কিছু করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর অবদান মুছে ফেলতে কিন্তু তাকে ভুলিয়ে দিতে গিয়ে তাকেই নির্মাণ করে চলেছে বার বার।