জনগণের ঘরের দুয়ারে যে সমস্যা তা সরকারকে বিবেচনায় নিতে হবে বাজারের ওপর ন্যূনতম নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে, বাজারে জনগণের প্রবেশগম্যতা সহজ এবং নিশ্চিত করতে হবে।
Published : 16 Nov 2024, 09:03 AM
রাজনীতি নিয়ে অস্পষ্টতা বাড়ছে। কী হচ্ছে বা হতে যাচ্ছে তার গতিপ্রকৃতি সহজ মনে হচ্ছে না। অফিস-আদালত-বাজার ও নাগরিক জীবন পরিচালনায় একধরনের নির্লিপ্ততা দেখা যাচ্ছে। এর গভীর প্রভাব পড়ছে সমাজের নানা ক্ষেত্রে। বাজার ব্যবস্থা তার মধ্যে অন্যতম।
একটি দেশ কেমন চলে তা মাপার বড় মাপকাঠি হলো বাজার। বাজার হলো সরকার ও জনগণের জন্য দৈনন্দিন পরীক্ষার ক্ষেত্র। ধনী, নির্ধন, গরিব, শ্রমিক ও খেটেখাওয়া মানুষ সবাইকে বাজারে যেতে হয়, বাজার করতে হয়, বেঁচে-বর্তে থাকতে হয়। অথচ, একটি সহনশীল বাজার ব্যবস্থা গড়ে উঠছে না।
সহনশীল বাজার ব্যবস্থা গড়ে তোলার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তৎপরতা চোখে পড়ছে না। জিনিসপত্রের দাম ক্রমশ বাড়ছে। জনগণ হা-হুতাশ করছে। বাজারে পণ্যদ্রব্যের দাম বাড়ার কারণে জনগণের খাদ্য অধিকার সংকুচিত হচ্ছে। প্রতিদিনের জীবন কঠিন হয়ে উঠছে। বাজারের ওপর রাষ্ট্রের ন্যূনতম নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে। আর তা না হলে বাজারের পাগলা ঘোড়ার লাগাম টানবে কে?
মুলার মতো অতিসাধারণ সবজির মূল্য গিয়ে ঠেকেছে ৮০ টাকায়। ঢাকার অদূরে কলাতিয়া বাজারে কচু ৬০ টাকা কেজি আর ওই কচু মোহাম্মদপুর নবোদয় কাঁচাবাজারে এসে হচ্ছে ১০০ টাকা কেজি। পনের থেকে বিশ কিলোমিটার দূরত্বে কচুর দাম কেজিতে ৪০ টাকা বেড়ে যাচ্ছে। এ স্বল্প দূরত্বের মধ্যে কোন ভূতের বাস তা চিহ্নিত করতে হবে। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টাটা বাঁধবে কে?
ব্যবসায়ীরা দুটো পয়সার জন্য ব্যবসা করেন এটা সত্য। কিন্তু তাই বলে বাজারে গলাকাটা পরিস্থিতি কি মানা যায়? বাজার হয়ে উঠছে কসাইখানাসদৃশ। সুনির্দিষ্ট তৎপরতার অভাব পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। বাজারে ক্রেতার আত্মমর্যাদা, মানসম্মান, পছন্দ ও রুচি সবই আহত-নিহত হচ্ছে।
বাজার গিয়ে ক্রেতারা অনেকসময় অশোভন আচরণের শিকার হচ্ছেন। নিম্ন বা স্বল্পআয়ের মানুষ ব্যাগ হাতে কাচুমাচু হয়ে বাজার যাচ্ছেন। পছন্দসই পণ্যটির দরদাম করতে গিয়ে নিত্য হেনেস্তার শিকার হচ্ছেন। কেবল স্বাভাবিক পণ্য নয় বাজারে ভাঙ্গা ডিম, গিলা-কলিজা, আধাপচা সবজির দামও বেড়েছে।
সরকারের কাছে সংস্কার গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু জনগণের কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রতিদিনের বাজার, প্রতিদিনের বেঁচে থাকা। দু্ই বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে গেছে পুরো ব্যবস্থা। রাষ্ট্র বা সরকারের চেয়ে বাজার সিন্ডিকেটকে শক্তিশালী মনে হচ্ছে। প্রকৃত অর্থে সরকারের শক্তিমত্তাকে ছাপিয়ে যাচ্ছে বাজার। অসম বাজার ব্যবস্থা থেকে সবাই সমান মুনাফা নিতে পারছে না। যেমন, উৎপাদক বা কৃষক উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। অন্যদিকে, মধ্যস্বত্ত্বভোগী ও ফড়িয়ারা তুলে নিচ্ছে সিংহভাগ মুনাফা।
খুচরা ব্যবসায়ীরা মুনাফা লাভে কম যায় না। ছোট বাজারগুলো ঘিরে খুচরা ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটও দেখা যাচ্ছে। এসব বাজারে সব দোকানে একই পণ্যের একই দাম। কেজি প্রতি ৭০ টাকা আলু, সব দোকানেই ৭০ টাকা।
লক্ষ্য করার মতো বিষয় হলো— গ্রামের বাজার, শহরের বাজার, রাজধানীর বাজারের মধ্যে পণ্যের দামে বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই। যেমন, রাজধানীর মোহাম্মদপুর হাউজিং সোসাইটি রোডে পাকা পেঁপে ৮০ টাকা কেজি। যুগপৎভাবে রাজশাহীর উপশহর নিউমার্কেটেও পেঁপের কেজি ৮০ টাকা।
রাজশাহী জেলার তানোর উপজেলার মোহাম্মদপুর গ্রামের একজন প্রান্তিক কৃষক প্রতি কেজি ওল বিক্রি করছেন ৫০ টাকায়। ওই ওল রাজশাহী শহরে এসে কেজি প্রতি হয়ে যাচ্ছে ৮০ টাকা। দূরত্ব ৩৫ কিলোমিটার। এক্ষেত্রে শ্রম, পরিবহন কষ্ট, পুঁজি বিনিয়োগের প্রশ্ন হয় তো আসবে। তাই বলে কেজি প্রতি ৩০ টাকা বেশি হওয়ার কি বিশেষ যুক্তি থাকতে পারে? মুনাফার কি ন্যূনতম সিলিং থাকবে না! মোবাইল ও প্রযুক্তির কারণে সবাই জেনে যাচ্ছে স্থানীয় ও জাতীয় বাজারের মূল্য পরিস্থিতি।
বাস্তব অর্থে, বাজার দেখার কেউ নেই। অভিভাবকহীন বাজার। যার যা ইচ্ছে সেভাবে মুনাফা তুলে নিচ্ছে। পরিস্থিতি বদলের জন্য মানুষ সংগ্রাম করল, জীবন দিল, আহত হলো। কিন্তু বাজার বিষয়ে দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন নেই।
একজন কৃষক সংস্কার পদবাচ্য বা নির্বাচন কমিশন সংস্কার মতো বিষয়গুলো হয়ত অত পরিষ্কার বোঝেন না, তিনি যা বোঝেন তা হলো রাষ্ট্র বা সরকার তাকে স্বস্তি দিতে পারছে কিনা। চাল-ডাল, আটা, শাকসবজি, ওষুধপত্র কিনতে বা বিদ্যুৎ বিল দিতে গিয়ে আয়-ব্যয়ের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে পারছে কিনা। না তাকে বাড়তি অর্থ গুণতে হচ্ছে বা অন্যের কাছে হাত পাততে হচ্ছে।
জনস্বস্তির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মূল্য আছে। জনগণ জীবন-জীবিকা চালাতে গিয়ে যদি উৎকণ্ঠিত হয়, শঙ্কিত হয় তাহলে তা সরকারের জন্য কোনো স্বস্তিদায়ক খবর হতে পারে না। জনগণের মধ্যে যাতে অস্বস্তি তৈরি না হয় তা ম্যানেজ করতে হয়। অ্যারাবিয়ান একটি প্রবাদ রয়েছে, অঙ্গীকার হচ্ছে মেঘের মতো, কেবল মেঘ জমলে হবে না, বৃষ্টি নামতে হবে। একটি অঙ্গীকার তখনই পূর্ণতা পায় যখন তা সফল হয়। রাষ্ট্রকে তার প্রতিশ্রুত অঙ্গীকারগুলো সফল করতে হবে।
অনেকে হয়ত বলবেন আামদের সমাজ একটি দাবিনির্ভর সমাজে পরিণত হয়েছে। এত দাবি কারও পক্ষে পূরণ করা সম্ভব নয়। কিন্তু মূল কথা হলো, বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারকে আরও আন্তরিকতা দেখাতে হবে, জনগণের পাশে থাকতে হবে।
অনিয়ন্ত্রিত বাজারের অভিঘাত সবার ওপর সমান নয়। সমাজের প্রান্তিক পর্যায়ে যাদের অবস্থা বিশেষত দিনমজুর, নিম্ন ও স্বল্পআয়ের মানুষ এ পরিস্থিতির করুণ শিকার। তা খুব স্পষ্ট বোঝা যায়, সকালে ওএমএস পণ্য সংগ্রহে নারী-পুরুষ বৃদ্ধ ও যুবকের সারি দেখলে।
এ রাষ্ট্র নাগরিকদের স্বল্পমূল্যে ওএমএস পণ্য কিনতে বাধ্য করছে। ব্যক্তির মানবিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন হচ্ছে। দরিদ্রদের পরিচয় জনসম্মুখে প্রকাশিত হচ্ছে। এমন নির্মম রাষ্ট্র তো কেউ চাইনি আমরা। গরিবের পরিচয় গোপন রাখার অধিকারও আজ সুরক্ষিত নেই। অথচ ওএমএস অ্যাপ্রোচকে রাষ্ট্র দেখছে জনগণের প্রতি তার বদান্যতা হিসেবে।
অমর্ত্য সেন আবারও সত্য হয়ে উঠছেন। বাজারে যে পণ্য নেই তা নয়, কিন্তু মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ায় তারা কিনতে পারছেন না। পোর্ভাটি অ্যান্ড ফেমেইন গ্রন্থে অর্মত্য সেন বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষ নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি ১৯৪৩ মন্বন্তর এবং ১৯৭৪ দুটি দুর্ভিক্ষের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, বাজারে পণ্য ছিল কিন্তু মানুষের ক্ষয়ক্ষমতা না থাকায় দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এ ক্ষমতাহীনতাকে তিনি উল্লেখ করেছিলেন এনটাইটেলমেন্ট বা রাষ্ট্রপ্রদত্ত অধিকারের সংকোচন হিসেবে।
মানুষের পকেটে আজ টাকা নেই। আয়-রোজগার কমেছে। চাহিদামাফিক পণ্য ক্রয়ের সুযোগ সংকুচিত হচ্ছে। মানুষকে নানাভাবে অভিযোজন করতে হচ্ছে, মানুষ বাধ্য হচ্ছে। জনগণ যদি জীবন-জীবিকা চালিয়ে নিতে না পারে, তাদের মধ্যে অধিকারবোধ কমে আসে তাহলে জনগণ রাষ্ট্রীয় বিন্যাসের সঙ্গে মিসফিট হয়ে যায়।
জনগণের ঘরের দুয়ারে যে সমস্যা তা সরকারকে বিবেচনায় নিতে হবে বাজারের ওপর ন্যূনতম নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে, বাজারে জনগণের প্রবেশগম্যতা সহজ এবং নিশ্চিত করতে হবে। মোদ্দাকথা, বাজার নিয়ে কোনোভাবেই নির্লিপ্ত থাকার সুযোগ নেই।