Published : 01 May 2022, 12:37 AM
শ্রম ছাড়া উৎপাদন সম্ভব নয়, শ্রমের মর্যাদা ছাড়া গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়, শ্রমিকের জীবনের নিরাপত্তা ছাড়া উৎপাদনশীল মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব না। শ্রম এবং মেধা দিয়ে যে উৎপাদন তা থেকেই সমাজ বিকশিত হয়, পুঁজি বিকশিত হয়। কিন্তু মানুষ যখন কৃষি থেকে বিচ্যুত হয়ে শিল্পে এসেছে তখন থেকে পুঁজিপতিরা ক্ষুদ্র থেকে দ্রুতই বড় হতে শুরু করে এবং যে মানুষ কৃষক থেকে শ্রমিকে রূপান্তরিত হয়েছে তারা সত্যিকার অর্থে সর্বহারা শ্রেণি হিসেবে আরো কঠিন পরিস্থিতিতে পড়ে। পুঁজির মালিক শ্রমিকের সাথে ক্রীতদাসের মতো আচরণ শুরু করে, তাদের ওপর চালাতে থাকে শোষণ, নির্যাতন। শ্রমিকদেরকে এমনভাবে পুঁজির জালে আবদ্ধ করে ফেলে যে তারা বাঁচার জন্য ১২ ঘন্টা, ১৪ ঘন্টা, ১৬ ঘন্টা, ২০ ঘন্টা কাজ করতে বাধ্য হয়। ভবিষ্যতে একটা সুন্দর পৃথিবীর কথা চিন্তা করারও সময় তারা পায় না। এই পরিস্থিতির অবসান ঘটিয়ে একটি সমতার সমাজে উত্তরণ ঘটানোর ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক নেতারা সমাজবিপ্লবের দায়িত্ব পালন করল। ১৮৭৯ সালে প্যারিসে প্যারি কমিউন বিপর্যয়ের পর শ্রমিকরা আট ঘন্টা কাজের দাবিতে রাস্তায় নেমে পড়ে। আমেরিকার শিকাগো শহরের প্রায় ৪০ হাজার কারখানার শ্রমিকদের নিয়ে আট ঘন্টা কাজের দাবিতে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। তারা শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করতে থাকে। কিন্তু মালিকরা ভীত হয়ে অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ শুরু করে এবং আন্দোলনকারীদের নামে নানা ধরনের অপপ্রচার চালাতে থাকে। ১৮৮৬ সালের পহেলা মে শ্রমিকদের সমাবেশে তারা আক্রমণ চালায় এবং তাতে অনেক মানুষ মারা যায়। একটা পর্যায়ে মালিক শ্রেণি আট ঘন্টা কাজের দাবি মেনে নেয়ার ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়।
১৮৮৬ সালের সেই রক্তাক্ত মে দিবসের পর ১৩৬ বছর পার হয়েছে। সেদিনে আমেরিকার শিকাগো শহরের শিল্পাঞ্চলের শ্রমজীবী মানুষরা ৮ ঘন্টা কাজের দাবিতে যে সংগ্রাম গড়ে তুলেছিল এতে অসংখ্য শ্রমিককে রক্ত ঝরাতে হয়েছে, অনেককে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিতে ঝুলতে হয়েছে। তাদের রক্ত ও জীবনের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শ্রমিকের ৮ ঘন্টা কাজের দাবি। যে কারণে সারা দুনিয়ার শ্রমজীবী মানুষের কাছে মে দিবস একটি ঐতিহাসিক দিবসে পরিণত হয়। সে সত্যটি আজ চাপা পড়ে গেছে। এখন আমাদের দেশেও 'মে দিবস' উদযাপিত হচ্ছে। এমনকি এইদিনে কোনো কোনো জেলা শহরে আনন্দ-বিনোদন, ভালো খাওয়া-দাওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু চেতনাকে ঝলসে দেয়ার মতো ঘটনা ঘটছে না। এমনকি সংস্কৃতিকর্মীরা কেমন যেন অসহায়, নির্জীব হয়ে পড়েছে। অবশ্য তারা অসহায় হয়ে পড়েছেন নাকি নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা, প্রলোভনের পেছনে দৌড়ে ক্লান্ত সেটা অবশ্য বলা মুশকিল। সব যেন এক ধোয়াশার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। শোষণের এই চক্রব্যুহ্য থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। অথচ একসময় সুকুমার ভট্টাচার্যরা কি অদম্য সাহসে কলম হাতে তুলে নিয়েছিলেন। লিখেছিলেন–
হারাবার কিছু ভয় নেই শুধু শৃঙ্খল হবে হারা
জন কল্লোলে উত্তাল নদী মোহনায় দিশেহারা।।
তুফানে তুফানে তুলেছে আওয়াজ সইবো না
আজন্ম কাঁধে শোষণের চাকা বইবো না
এবার লড়াই, এবার লড়াইয়ে অস্ত্র শানিয়ে দাঁড়া।।
মে দিবসে ৮ ঘন্টা কাজের দাবি ছিল প্রকাশ্যে কিন্তু এর অন্তরালে ছিল শোষণমুক্তির আকাঙ্ক্ষা। এক মানবিক কর্মপরিবেশের সার্বজনীন অধিকারের অনুরণন তোলার লক্ষ্যে মে দিবস যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল তা আজ বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বের শ্রমিকরা অর্জন করতে পারেনি। বরং তারা মালিকের হাতের পুতুল হয়ে 'যেমনে নাচায় তেমনে নাচে।' বেঁচে থাকার মতো মজুরি বা বকেয়া মজুরি আদায়ে শ্রমজীবী মানুষকে বারবার আন্দোলনে নামতে হচ্ছে। শ্রমজীবী মানুষের শ্রমের ফলেই উৎপাদন বাড়ছে, রপ্তানি আয় বাড়ছে। জিডিপি বাড়ছে কিন্তু শ্রমিক ন্যায়সঙ্গত মজুরি পাচ্ছে না। মজুরি বৃদ্ধির সাথে সাথেই দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি ঘটছে ফলে শ্রমিকের জীবনমান উন্নয়ন কঠিন হয়ে পড়ছে। অন্যদিকে বকেয়া মজুরি চাইতে গেলে তাদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালানো হচ্ছে। এ ধরনের ঘটনা ঘটছে প্রতি বছর। এ বছরও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। গত ২৮ এপ্রিল টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে দেখলাম বেতন-বোনাসের দাবিতে বিক্ষোভ এবং পুলিশের সাথে শ্রমিকদের সংঘর্ষে অর্ধশতাধিক হতাহত হয়েছেন। এর আগেও উত্তরাতে একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। অথচ রাষ্ট্রকাঠামো সেখানে মালিকের তাবেদার হয়ে নীরব দর্শক।
অত্যন্ত সুকৌশলে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনকে ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে। আইনগতভাবে ট্রেড ইউনিয়ন করতে কোনো বাধা নেই। কিন্তু আইনগুলোতে ফাঁক-ফোকর রেখে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে, কোনো শ্রমিক যদি ট্রেড ইউনিয়ন করতে যায় তাহলে সে তার চাকরি হারাবে। কারণ মালিককে অধিকার দেয়া হয়েছে ১২০ দিনের বেতন দিয়ে সে যেকোনো পর্যায়ের কর্মীকে যখন খুশি ছাটাই করতে পারবে। এরপর রয়েছে অসংখ্য মামলা দিয়ে তাকে হয়রানি করা। এভাবেই সুকৌশলে শ্রমিক আন্দোলনের পথ রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি অত্যন্ত সুকৌশলে অর্থ বিনিয়োগ করে সেমিনার সিম্পোজিয়ামের মাধ্যমে ভালো ভালো কথা বলে মালিকের বিরুদ্ধে শ্রমিকের যে ক্ষোভ, ধিক্কার, তাদের অধিকারের কথা বলার যে শক্তি সেটাকে অবদমিত করে রাখছে। এদের ভোজবাজিতে একজন ভালো শ্রমিকনেতা ক্রমান্বয়ে সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবীতে পরিণত হচ্ছে। এদেরই একটা অংশ চাঁদাবাজি করছে, মালিকের টাকা খেয়ে আন্দোলনকে ভিন্নপথে পরিচালিত করছে। ফলে শ্রমিক অধিকার আদায়ের যে স্বপ্ন তা স্বপ্নই থেকে যাচ্ছে। পুঁজির কাছে শ্রমিকের দাসত্ব আরো প্রলম্বিত হচ্ছে। প্রগতির চাকাকে যারা বারংবার এভাবে টেনে ধরছে তাদের বিরুদ্ধে অনিমেষ আইচের মতো যুদ্ধ ঘোষণা এখন সময়ের দাবি।
লড়তে যখন হবেই তবে ঘুমিয়ে কেন আজো
বাঁচতে যখন হবেই তখন কাফনে কেন সাজো
জাগো এইবার, হও দুর্বার, বজ্রের মতো বাজো।।
সারাটি জীবন কলুর বলদ থাকবো না
মালিকের ধন আর বাড়াবো না বাড়াবো না
আমাদের শ্রম শোষণ করতে দেবো না- না
(আমরা) বিপুল বিশ্বে নিঃস্বের মত বাঁচবো না।। […]
১৮৮৬ সালে আমেরিকাতে যে শ্রমিক আন্দোলন হয়েছিল তার বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের সবটাই কিন্তু সেদিন শ্রমিকরাই করেনি। সেখানে যুক্ত হয়েছিলেন বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীরা। তারা শ্রমিকের ওপর ঘটে যাওয়া জুলুম-নির্যাতনকে অন্যায় মনে করতেন। যে কারণে তারা শ্রমিকদের সংগঠিত করতে, তাদের চিন্তা-চেতনা এবং লড়াইটাকে একটি উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া, শ্রেণি সংগ্রামে রূপদান করে সমাজ বিপ্লবের চেতনাকে জাগ্রত করতে তারা নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন। শ্রমিকদের সাথে থেকে আন্দোলনের ভেতর দিয়ে তাদেরকে সমাজ বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত করে তুলেছিলেন। বর্তমানে শ্রমজীবী মানুষের চেতনার জায়গায় ভয়াবহ অবনতি হয়েছে। পঁচিশ-ত্রিশ বছর আগেও শ্রমিকদের চেতনা যে স্তরে ছিল এখন সে অবস্থানে নেই। কারণ তারা আজ বিভ্রান্ত হয়ে দ্বি-দলীয় রাজনীতির পুতুল হয়ে গেছে। তারা নির্দিষ্ট একটা জায়গায় আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এখান থেকে শ্রমিকদের বের করে এনে তাদের নিজস্ব শক্তিতে দাঁড় করাতে হবে। তার জন্য ১৮৮৬ সালের মতো মানবতাবাদী, সংস্কৃতিসেবক ও বুদ্ধিজীবীদেরকে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। কবি বলছেন 'দেশে আজ কৃষ্ণপক্ষ'। কিন্তু এই কৃষ্ণপক্ষকে শুক্লপক্ষে পরিণত করার সংগ্রামই তো প্রগতিশীল রাজনীতি।
কবি সময়কে আখ্যায়িত করেছেন 'কৃষ্ণপক্ষ' দিয়ে। কিন্তু এই সময়কে পাল্টে শুক্লপক্ষে রূপায়িত করার দায়িত্ব আমাদের। কবিতাকে ইতিবাচক ব্যাখ্যা দেয়ার দায়িত্ব রাজনীতির। হাত গুটিয়ে বসে দেশের কোনো ভবিষ্যৎ নেই, কিছু হবে না বলে বিলাপ না করে এগিয়ে যাবার সংস্কৃতিকে মে দিবসের অঙ্গ করে তুলতে হবে। শ্রমিক আন্দোলনের সাথে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মেলবন্ধন রচনা করতে হবে। শ্রমিকের চেতনার জায়গাটাকে আরো তীক্ষ্ণ-ধারালো করে তুলতে হবে। শ্রমিকের যে অধিকার আছে, তারা যে দাবি করতে পারে, তাদের যে দাবি করার অধিকার রয়েছে সেই বোধ বা চেতনা জাগাতে হবে। তাদের মধ্যে এই বোধ তৈরি এবং তাদের দুর্বলতম ক্ষেত্রসমূহ চিহ্নিত করে শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী ও শ্রমিক শ্রেণির যুথবদ্ধতায় শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে হবে।
শ্রমজীবী মানুষকে সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক চেতনায় জাগিয়ে তুলতে পারলে তারা আজকে যে মানবেতর জীবন-যাপন করছে সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে। দেশের অভ্যন্তরে আয় বৈষম্য যে রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছে, পুঁজিপতি মালিক, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও ধর্মব্যবসায়ীদের যে আঁতাত গড়ে উঠেছে সেটাকে প্রতিহত করে একটি শক্তিশালী শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম হবে। প্রতিহত করা যাবে লুটপাটতন্ত্র, অন্যায়, নির্যাতন, সন্ত্রাসবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, সাম্প্রদায়িকতার মতো সকল অশুভ শক্তিকে। শ্রমজীবী মানুষ আর শোষণমুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে যারা লালন করেন সেইসমস্ত শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী-রাজনীতিকের মিলিত চেষ্টায় মে দিবসের আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন একদিন ঘটবেই। আর সেদিন আমরা শ্বেতকপোত আঁকা শান্তি পতাকা হাতে পা রাখতে পারব মুক্ত মানবের মুক্ত সমাজে। সেদিনের প্রত্যাশায় কাজী নজরুল ইসলামের সাথে সুর মিলিয়ে বলতে চাই–
জাগো অনশন-বন্দী, ওঠ রে যত
জগতের লাঞ্ছিত ভাগ্যহত!
যত অত্যাচারে আজি বজ্র হানি'
হাঁকে নিপীড়িত-জন-মন-মথিত বাণী,
নব জনম লভি' অভিনব ধরণী
ওরে ঐ আগত।।
আদি শৃঙ্খল সনাতন শাস্ত্র-আচার
মূল সর্বনাশের, এরে ভাঙিব এবার!
ভেদি' দৈত-কারা
আয় সর্বহারা!
কেহ রহিবে না আর পর পদ-আনত।।