Published : 16 Apr 2022, 06:07 PM
১৫ এপ্রিল একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে গেল মুন্সীগঞ্জ সার্কিট হাউজে। দিনটি ছিল বাংলা পঞ্জিকার প্রথম মাসের দ্বিতীয় দিন, তাই একদিকে যেমন ছিল আনন্দের আমেজ, আবার সেদিন গাফফার ভাইয়ের মেয়ের মৃত্যু সংবাদে মন ছিল ভারাক্রান্ত। সেই মন নিয়েই ঢাকা থেকে মুন্সীগঞ্জের বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলকে সাথে নিয়ে আমরা ১৫ জন 'উচিত' বক্তা চলে গেলাম মুন্সীগঞ্জের সার্কিট হাউজে। প্রটোকলের নিয়ম পালনের জন্য উপস্থিত ছিলেন জেলার পুলিশ সুপার, জেলা জজ ছুটিতে থাকায়, অতিরিক্ত জেলা জজ, অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার, প্রধান বিচারিক হাকিম। আমাদের দলে ছিলেন শাহরিয়ার কবির, অধ্যাপক মুনতাসির মামুন, নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, মফিদুল হক, অধ্যাপক জিনাত হুদা, অধ্যাপক ওয়াহিদুজ্জামান চান, কাজি মুকুল, ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ, ব্যারিস্টার নাদিয়া চৌধুরী, অধ্যাপক ডা. মামুন মাহতাব স্বপ্নিল, শ্যামলি নাসরিন চৌধুরী, ড. শহিদ কাদের, অধ্যাপক ড. খুরশিদ বিনতে রহমান।
এতো সংখ্যক গুণিজনের একত্রে মুন্সীগঞ্জ যাত্রা সম্ভবত আগে কখনো হয়নি। উদ্দেশ্য একটাই- মুন্সীগঞ্জে অবস্থানরত এবং কর্মরত ধর্মান্ধ, ধর্ম ব্যবসায়ী, সাম্প্রদায়িক চেতনার লোকদের জানিয়ে দেওয়া যে, বাংলাদেশ তাদের জন্য নয়। মতবিনিময় সভায় সব বক্তাই বক্তব্য দিয়েছেন রাখঢাক না রেখে, মন খুলে। পুলিশ, প্রশাসন এবং বিচারিক কর্মকর্তারা প্রটোকল দেওয়ার পর স্থান ত্যাগ করেন, মতবিনিময় সভায় তাদের স্থান দেওয়া হয়নি, কারণ তাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য আলাপ হয়েছে। আমরা ছাড়াও ভাষণ দিয়েছেন মুন্সীগঞ্জের সংসদ সদস্য মৃণাল কান্তি, পৌর মেয়র হাজি বিপ্লব, উপজেলা চেয়ারম্যান আনিসুজ্জামান, জেলার সরকারি উকিল, উদীচীর প্রতিনিধিসহ অনেকে। যে কথাটি মোটামুটি সকল বক্তা উচ্চারণ করেছেন তা হলো- হৃদয় মণ্ডলের বিরুদ্ধে যে আইনে মামলা দেওয়া হয়েছে, সে আইনে তার বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে না এবং তাজরিয়ান শিকদার নামক ধর্মান্ধ, জামাতপন্থি বিজ্ঞান শিক্ষক, যে কুলাঙ্গার ব্যক্তি পুরো ঘটনার জন্য দায়ী, এবং যে ছাত্র হৃদয় বাবুর কথা রেকর্ড করে তা ছড়িয়ে মারাত্মক অপরাধ করেছে তাদের গ্রেপ্তার না করে হৃদয় মণ্ডলের মতো নিরাপরাধ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ, প্রশাসন এবং স্থানীয় বিচারকরা প্রমাণ করেছেন তাদের মধ্যে ধর্মান্ধতা ঘাপটি মেরে আছে এবং আইনের শাসনের প্রতি তাদের কোন দায়বদ্ধতা নেই। দাবি জানানো হয়েছে, সেই জামাতি তাজরিয়ান শিকদার, প্রধান শিক্ষক আলাউদ্দিন, যে বিদ্যুত মিস্ত্রি না জেনে এজাহার দায়ের করেছে তাদের সবাইকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিলে সব প্রকাশ পাবে। অভিযোগের পাহাড় পুলিশ সুপারের বিরুদ্ধে। তিনি কেন তাজরিয়ান শিকদার, সংশ্লিষ্ট ছাত্র এবং মিছিলকারিদের গ্রেপ্তার এবং ছত্রভঙ্গ না করে, নিরাপরাধ শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলা করালেন!
তিনি ধর্মান্ধদের রাজনৈতিক মতাদর্শের লোক কিনা, সে প্রশ্নও উঠেছিল। তবে সংসদ সদস্য মৃণাল বাবু আমাদের জানালেন এই পুলিশ সুপার ছাত্র থাকা অবস্থায় ছাত্রলীগের সাথে জড়িত ছিলেন। আর এটাই সবাইকে অবাক করেছে, এ কারণে যে যে ব্যক্তি ছাত্রাবস্থায় অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি করতেন, তিনি কিভাবে এমন একটি সাম্প্রদায়িক ঘটনার মূল হোতা হতে পারলেন? অভিযোগ থেকে মুক্তি পাননি জেলার ম্যাজিস্ট্রেটরাও। প্রশ্ন উঠেছে, ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে তাদের যোগ্যতা নিয়েও, কেননা তারা তথাকথিত এজাহার আমলে না নিলে হৃদয় বাবুকে গ্রেপ্তার করা যেতো না। অভিযোগ আমলে নেয়ার আগে সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেটদের দেখা উচিত ছিল হৃদয় বাবু যা বলেছেন, আইনের ধারা মতে তা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের পর্যায়ে পড়ে কিনা, আর তা বিবেচনায় না নিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটরা তাদের যোগ্যতার পরিচয়ে ফেল করেছেন, বিধায় ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে তাদের চাকরিতে রাখা আইনের শাসন রক্ষায় ঠিক হবে কিনা, সে প্রশ্ন সকলের। সবাই আশা করছেন মহামান্য হাইকোর্ট তাদের তলব করে ব্যাখ্যা চাইবেন এবং ব্যাখ্যা সন্তোষজনক না হলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন। ১৯ দিন পর যে অতিরিক্ত জেলা (দায়রা) জজ জামিন দিয়ে ছিলেন তিনিও প্রটোকলের তাগিদে সার্কিট হাউজে উপস্থিত হয়েছিলেন, কিন্তু মতবিনিময় সভায় তাকে রাখা হয়নি। সকল বক্তা এক কণ্ঠে বলেছেন, জামিন যথেষ্ট নয়, হৃদয় বাবুর বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিতে হবে, তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তাজরিয়ান শিকদার, সংশ্লিষ্ট ছাত্রদের, প্রধান শিক্ষক আলাউদ্দিনকে এবং সেই এজাহারকারি মিস্ত্রিকে, মিছিলকারিদের, যারা হৃদয় বাবুকে আক্রমণ করেছিল, তাদেরকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিতে হবে এবং তদন্ত হতে হবে বিচার বিভাগীয়, এখন যে সাধারণ তদন্ত হচ্ছে, তাতে কারো আস্থা নেই। মতবিনিময়কালে অভিযোগ উঠেছে পাঠ্য পুস্তকের মাধ্যমেই সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানো হচ্ছে। এ ব্যাপারে উল্লেখ করা হয়, বাচ্চা বয়সী মেয়েদের মাথায় হিজাব পরা ছবি দিয়ে হিজাবের প্রচলন বাড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে, অথচ হিজাব বাঙালি কৃষ্টি, সংস্কৃতি বা ইতিহাসের অংশ নয়। পাঠ্য পুস্তকে প্রগতিপন্থী লেখা বাদ দিয়ে সাম্প্রদায়িক কথা প্রকাশ পাচ্ছে, যা কচি শিশুদের মনে সাম্প্রদায়িকতা ছড়াতে ভূমিকা রাখছে। অভিযোগ উঠেছে, যে সব ওয়াজ ব্যবসায়ী ওয়াজের মাধ্যমে অন্য ধর্মের লোকদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়িয়ে প্রতিনিয়ত অপরাধ করে যাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে কোন মামলা হচ্ছে না। এটা পরিষ্কার পুলিশ এবং প্রশাসনে ঘাপটি মেরে আছে বহু জামাত-শিবিরের লোক, যারা এ দেশকে হিন্দু শুন্য করে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকারকে উচ্ছেদ করে তালিবানি শাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় লিপ্ত।
এর আগে ঢাকায় এক অধ্যাপিকার কপালে টিপ থাকায় এক ধর্মান্ধ পুলিশ যা করলো, নওগাঁ জেলায় আমোদনি পালের বিরুদ্ধে মিথ্যা ছড়িয়ে যা করা হলো, কয়েক মাস আগে স্বীকৃত মিথ্যাবাদি, ধর্ষণ মামলার আসামি, মুমিনুল হকের বিরুদ্ধে ন্যায্য কথা বলায় ঝুমন দাসকে যেভাবে এক বছর কারাগারে রাখা হলো, যেভাবে ফেইসবুক হ্যাক করে নাসিরনগরের সামান্য পড়াশুনা করা মনোরঞ্জনের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা হলো, তাতে মনে হচ্ছে ধর্মান্ধ, মৌলবাদিরাই দেশ শাসন করছে। এ পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু কন্যার পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখা উচিত। কেননা বঙ্গবন্ধু কন্যাকে উচ্ছেদ করে দেশে তালিবানি শাসন প্রতিষ্ঠাই এদের উদ্দেশ্য। তবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ, যাদের সংখ্যা ধর্মান্ধদের তুলনায় অনেক বেশি, তারা এটি হতে দেবে না। প্রয়োজনে ৭১- এর আদলে একটি বিপ্লব ঘটানো হবে ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানপ্রেমি গোষ্ঠিকে চিরতরে বাংলার মাটি থেকে উচ্ছেদ করার জন্য। হৃদয় মণ্ডল ১৯ দিন জেলে কাটিয়ে বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক মানুষের জন্য যে নজির সৃষ্টি করলেন, তা বিফলে যেতে দেয়া হবে না। এর ফলেই ধর্মান্ধ গোষ্ঠিকে নিঃশেষিত করার প্রতিজ্ঞা নিয়েছে ধর্ম নিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী বাংলার কোটি কোটি মানুষ। তাদের প্রতিজ্ঞা বিফলে যাবে না।